You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
১৩ই মে, রবিবার, ১৯৭৩, ৩০শে বৈশাখ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

অন্ধকারে তলিয়ে যাবার আগে

অবশেষে বাস্তবতাকে যে উপলব্ধি করা হয়েছে এটা আশার কথা। আনন্দের কথা। অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার চাইতে এক বিন্দু আলোর দিকে ছুটে যাওয়া অনেক মঙ্গলজনক। অন্তত এতে ভবিষ্যৎ সংকট কাটিয়ে উঠার পাথেয় পাওয়া যায়।
অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ গত শুক্রবার বার্তা সংস্থা এনা প্রতিনিধির সঙ্গে সাক্ষাতকারে যে বক্তব্য উপস্থাপিত করেছেন তাতে একথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, দেশের ভেঙে পড়া অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে কৃচ্ছ্রতা সাধন, নিয়ন্ত্রিত বন্টন ব্যবস্থা, সর্বাধিক উৎপাদন এবং সুশৃঙ্খল ও সুসমন্বিত অর্থনৈতিক তৎপরতার প্রয়োজন। তিনি আরো বলেন যে, এই মুহূর্তে আমাদের সবচাইতে বড় প্রয়োজন হচ্ছে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উৎপাদন বৃদ্ধি করা।
অর্থমন্ত্রী যে সত্যকে উদ্ঘাটন করেছেন তা সত্যিই উদ্বেগজনক। জাতীয় অর্থনীতি যে আজ প্রায় ভেঙে পড়েছে একথা আর কাউকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার প্রয়োজন পড়ে না। মুদ্রাস্ফীতি, মুদ্রার মূল্য হ্রাস, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অগ্নিমূল্য এবং বৈদেশিক মুদ্রার অভাব ইত্যাদি লক্ষণগুলো ভেঙে পড়া অর্থনীতিরই পরিচায়ক।
কথায় বলে কাশীর পথ ধুলায় অন্ধকার। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশে হয়েছে সেই অবস্থা। সবারই কন্ঠে একই কথা—আরো চাই। অথচ দেয়া নেয়াটা যে পরস্পরের উপর নির্ভরশীল এ সত্যকে উপলব্ধি করতে আমরা ভুলে গেছি। ফলে একদিকে কৃচ্ছ্রতা সাধনের কথা বলা হলেও প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ে বিদেশ থেকে দামী শাড়ী, শাল আর টেট্রন আসছে। আসছে বিদেশ থেকে বিলাসদ্রব্য। অন্যদিকে জাতীয়করণকৃত কল-কারখানাগুলোতে চলছে চরম নৈরাজ্য। ‘কোম্পানীকা মাল দরিয়া মে ঢাল’-এ নীতি অনুসরণ করে কলকারখানার অধিকাংশ প্রশাসকরা দু’হাতে লুটপাট করছেন। এ লুটপাট চলছে উপর থেকে নীচ পর্যন্ত। সবারই বেতন বেড়েছে। কিন্তু বেতন আসবে কোত্থেকে সেদিকে কারো লক্ষ নেই। লুটপাটের ফলে টাকা উড়ছে বাতাসে। কালো টাকার পাহাড় সঞ্চিত হচ্ছে। বিনিয়োগের কোন বালাই নেই কোথাও। শুধু তাই নয়, অবস্থা সংকটজনক হওয়া সত্ত্বেও এতদিন পর্যন্ত বিভ্রান্তির বেড়াজাল তৈরী করা হয়েছে সর্বত্র। বৈদেশিক মুদ্রার অভাব নেই, পাট ঠিকমতই রফতানী হচ্ছে, উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছে যাচ্ছি এমন কথাও ইতিপূর্বে বলা হয়েছে। আর তা বলা হয়েছে ফ্রি স্টাইল কায়দায়। যার যা বলার নয়, তাই বলেছেন অনেকে।
চালু প্রবাদ ‘আগে তিতা পরে মিঠা’ অর্থাৎ কঠিন সত্যকে তুলে ধরার জন্য যদি প্রথমে সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয় তাতেও কোন আপত্তি নেই, কিন্তু শেষ ভালো হলেই হয়। অথচ তা করা হয়নি। এশিয়ার বৃহত্তম পাটকল আদমজীতে প্রতিদিনের গড়পড়তা আশি টন উৎপাদনের মাত্রা থেকে নেমে এসে তা দৈনিক আট টনে দাঁড়াবার পরও অবস্থার উন্নতির জন্য কোন সুষ্ঠু ও সক্রিয় ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তখনও বলা হয়েছে হচ্ছে, হবে ইত্যাদি কথা কলকারখানা জাতীয়করণ করার পর উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন শিল্পগুলোতে দু’শো কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। কিন্তু ফল দাঁড়িয়েছে শূন্যের কোঠায়। আসল পুঁজিপাট্টাই বর্তমানে গায়েব। এরই জন্যে দেখা গেছে খাদ্য নিয়ে জাহাজ এসেছে, বাংলাদেশে আর যাবার সময় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান অবলম্বন পাট নিয়ে যেতে পারেনি।
খাদ্য ঘাটতি পূরণের জন্য কল-কারখানায় খুচরা যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আমদানীর জন্য প্রয়োজন বৈদেশিক মুদ্রার। অথচ সেই মুদ্রাই যদি না থাকে তাহলে তো ভবিষ্যৎ অন্ধকার। ভিক্ষার ঝুলি হাতে নিয়ে কোন জাতি মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারে না। ইতিহাস তা বলে না।
অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বিলম্বে হলেও যে বাস্তবসত্যকে উপস্থাপিত করেছেন তারই পরিপ্রেক্ষিতে সমগ্র জাতিকে বিশেষভাবে ভেবে দেখতে হবে। ভেবে দেখতে হবে—আমরা বাঁচবো না মরবো। পরিশেষে আমরা একথাই বলবো যে, কল-কারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধি, নিয়ন্ত্রিত বন্টন ব্যবস্থা, সুশৃঙ্খল ও সুসমন্বিত অর্থনৈতিক তৎপরতা এবং কৃচ্ছ্রতা সাধনের জন্য যদি সরকারকে কঠোর নীতি অনুসরণ করতে হয় তাহলে তাই করতে হবে।

শাহ-ভুট্টো আঁতাত

ইরানের শাহ ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভুট্টোর মধ্যে গাঢ় মাখামাখিতে একটা অশুভ আঁতাত সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ভুট্টো সাহেব ইরান সফরে বেরিয়েছেন। শাহ সাহেব অভ্যর্থনা জানিয়েছেন। বেশ ভালো কথা। কিন্তু ভুট্টোর ইরান সফরকে কেন্দ্র করে পর্যবেক্ষক মহলে নানা জল্পনা-কল্পনার উদয় হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে যে, পাকিস্তান ও ইরানের মধ্যে একটি কনফেডারেশন হয়তো গঠন করা হবে। সেন্টোর সদস্য হিসেবে পাকিস্তান ও ইরানের মধ্যে সামরিক ও নৌ-চলাচল সহযোগিতা আরো ঘনিষ্ঠ করা হবে বলেও অনুমিত হচ্ছে। এই কনফেডারেশন যদি সত্যিই গঠিত হয়, তাহলে উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ কিছুতেই নিষ্কন্টক হবে না। ইরানের শাহ সম্প্রতি যে সব কথাবার্তা উচ্চারণ করেছেন, তাতে মনে হচ্ছে তিনি পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষার সমস্ত দায়দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়েছেন। বোঝা যাচ্ছে সেন্টোর বাইরে একটি নতুন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গঠনের জন্যই ইরানের শাহ আর পাকিস্তানের ভুট্টোর মধ্যে আঁতাতের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। এই আঁতাতের নেপথ্য নায়ক হিসেবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনেরও যে গোপন হাত রয়েছে, তাও আজ দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ইরানের শাহ নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিনিধির সঙ্গে এক সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, পাকিস্তান যদি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তাহলে সেখানে আর একটি ভিয়েতনামের মতো পরিস্থিতির উদ্রেক হবে। এবং সেই জন্যেই মৃতপ্রায় সেন্টো জোটের পুনরুজ্জীবনের রাজনৈতিক দাবার ঘাঁটি চালা হচ্ছে। সেন্টোর ব্যাপারে ইরান বরাবর একটি মুখ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে আসছে। কাজেই এবারের তৎপরতায় আমরা অবাক বা বিস্মিত হইনি। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ ঘোষণার প্রতি ভুট্টো সাহেবের বৈরী মনোভাব এ ব্যাপারে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে। ভারত ও বাংলাদেশের সঙ্গে শান্তির সম্পর্ক স্থাপনে পাকিস্তান আগ্রহী নয়, ইরানের শাহের সঙ্গে ভুট্টো সাহেবের আঁতাত উপমহাদেশের নতুন সংঘর্ষেরই ইঙ্গিত দিচ্ছে। পাকিস্তানকে রক্ষার নাম করে ইরানের শাহ উপমহাদেশের অমঙ্গলের চিহ্নকেই চাঙ্গা করে তুলেছেন। শুধু ইরান নয়, ইরানের পেছনে একটি মহাশক্তিও উপমহাদেশের বায়ু বিষিয়ে তোলার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। এই মহাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
এ প্রসঙ্গে আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনগুলোর দিকে যদি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিই, তাহলে সুস্পষ্টভাবে চোখের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠবে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানকে সমরাস্ত্র সাহায্য দিয়েছিলো এবং ইরান হয়েই সেই সমর সম্ভার পাকিস্তানে এসেছিলো। ইরানের ভূমিকা আমরা রাতারাতি ভুলে যাইনি। সেই ইরানই আবার স্বাধীনতার পর পাকিস্তান রক্ষার জন্য কুম্ভিরাশ্রু বর্ষণ করতে শুরু করেছে। পাকিস্তান-ইরান কনফেডারেশন তাই উপমহাদেশের শান্তির পক্ষে একটি মারাত্মক হুমকি। এ হুমকি উপমহাদেশের শান্তির আবহাওয়া বিঘ্নিত করবে। এছাড়া, সেন্টো জোটের পুনরুজ্জীবন কিছুতেই উপমহাদেশের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সহায়ক নয় বলেই আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস। শাহ-ভুট্টো আঁতাত তাই উপমহাদেশের জন্যে এক অশুভ পদক্ষেপ তা আমরা সন্দেহাতীতভাবেই উচ্চারণ করতে পারি।

ভূমি জরিপ

সঠিক কৃষিনীতি প্রণয়নের জন্য বাংলাদেশের জমির ব্যবহার সম্পর্কে জরিপের প্রয়োজনীয়তার উপর বিশেষজ্ঞেরা গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
জমির মোট পরিমাণ, উৎকর্ষতা, ফসল উৎপাদনের ক্ষমতা, বসতি স্থাপন, রাস্তাঘাট, গো-চারণ ভূমি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান স্থাপন, পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা প্রভৃতির জন্য সঠিক তথ্য সংগ্রহের পরিপ্রেক্ষিতে এই জরিপ কাজ অপরিহার্য বলে বিশেষ মহল অভিমত পোষণ করেছেন।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, ১৯৪৪-৪৫ সালের পর এদেশে এ ধরনের জরিপ আর অনুষ্ঠিত হযনি। নদ-নদী বিধৌত বাংলাদেশে এই দীর্ঘ ত্রিশ বছরের ব্যবধানে জমির অবস্থা সেই আগের মতো নেই। প্রকৃতির খেয়াল ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির দরুণ ত্রিশ বছর আগে যেখানে নদী ছিলো আজ হয়তো সেখানে চর পড়ে গড়ে উঠছে নতুন নতুন বাসভূমি। আবার সেদিন যেখানে ঘরবাড়ী শহর বন্দর ছিলো আজ সেখানে নদী-খাল প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে ভূমির উৎকর্ষতা, ফসল ফলনের ক্ষমতা ইত্যাদিরও পরিবর্তন ঘটেছে নিঃসন্দেহে। তাছাড়া সেদিনের কৃষি ব্যবস্থা আর বর্তমানের সমাজতান্ত্রিক কৃষি ব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে অনেক।
বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে আমরা নতুন করে গড়ে তোলার শপথ নিয়েছি। শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এই দেশকে সুখী-সমৃদ্ধিশালীরূপে গড়ে তোলাই হচ্ছে আমাদের স্বপ্ন ও সাধনা। তাই সেই সমাজতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থা কায়েমের জন্যে সমবায় ও খামার পদ্ধতিতে কৃষিব্যবস্থা প্রবর্তনের সুসংহত ব্যবস্থা করতে হবে। আর সে ব্যবস্থা বাস্তবায়নের প্রেক্ষিতে আমাদের প্রত্যেকটি কাজ হ’তে হবে সুপরিকল্পিত। বাসস্থান নির্মাণ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গঠন, কলকারখানা স্থাপন ইত্যাদি সব কিছুই সঠিক প্রকল্পের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে পারলে তবেই আমাদের আজকের বিক্ষিপ্ত, অপরিকল্পিত গ্রামগুলো আদর্শ পল্লীতে পরিণত হবে, কৃষি ব্যবস্থায় আসবে আমূল পরিবর্তন। ফলে আমাদের সবুজ বিপ্লবসাধনও সম্ভব। সুতরাং জমির ব্যবহার সংক্রান্ত জরিপের প্রয়োজনীয়তার প্রতি বিশেষজ্ঞ মহলের অভিমতের সঙ্গে আমরাও একমত পোষণ করছি।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!