You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.05.10 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল | চিন্তা ও চেতনায় যেন বন্ধ্যাত্ব না আসে | পরিত্যক্ত শিল্প ও কর্মী সমবায় | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
১০ই মে, বৃহস্পতিবার, ১৯৭৩, ২৭শে বৈশাখ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল

দেশের জাতীয় সংবাদপত্রগুলো বেশ কিছু দিন ধরে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে মুক্ত হস্তে দান করার জন্যে একটি বিশেষ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করে আসছে। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে সাহায্য দানের আহ্বান অনেক দিন ধরে সরকার প্রচার করছেন এবং দেশের মানুষও তাতে সাড়া দিয়েছে বলে জানা গেছে। এ পর্যন্ত বেশ কিছু টাকা সংগৃহীতও হয়েছে। তা থেকে শহীদ ও আহতদেরকে সাহায্য করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে এ পর্যন্ত বিপুল পরিমাণ টাকা শহীদান ও আহতদের সাহায্য হিসেবে দেওয়া হয়েছে এবং ভুক্তভোগীরা কিছু দেরীতে হলেও এই তহবিল থেকে সাহায্য পাচ্ছেন। ত্রাণ তহবিলের টাকা প্রধানতঃ দেশী-বিদেশী দানশীল ব্যক্তি বা সংস্থা থেকে সংগৃহীত হয়েছে। একটি সাধারণ হিসেব অনুযায়ী যদি ত্রিশ লক্ষ শহীদ পরিবারকে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে দু’হাজার করে টাকা সাহায্য করা হয়, তাহলে ছয়শত কোটি টাকা লাগে। আর আহত, বন্যা ও ঘুর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে যদি ত্রাণ তহবিল থেকেই সাহায্য করা হয়, তাহলে সাধারণ হিসেবে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা লাগবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ত্রাণ তহবিলে যে পরিমাণ টাকা এ পর্যন্ত সংগৃহীত হয়েছে তা চাহিদার তুলনায় নিতান্তই কম। অথচ মানবতার জন্যে হোক অথবা নৈতিক কর্তব্য হিসেবেই হোক ঐ সকল ভুক্তভোগীদেরকে সাহায্য করতেই হবে। বঙ্গবন্ধু সে কারণেই তাঁর ত্রাণ তহবিলে মুক্ত হস্তে দান করার আবেদন ইতিপূর্বে জানিয়েছিলেন। সম্প্রতিও প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে দান করার আবেদন জানানো হয়েছে। আমরা জানি এই তহবিল থেকে যে পরিমাণ টাকা প্রতিটি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে দেওয়া হয় তা মোটেই স্বল্প নয় এবং তাতে ভুক্তভোগীরা উপকৃতও হয়। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে মুক্ত হস্তে দান করার আহ্বান আমরাও জানাই। দেশপ্রেমিক মানুষের কাছে আমরাও আবেদন করি—মানবতার খাতিরে আপনারা দেশের বিপুল সংখ্যক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে মুক্ত হস্তে সাহায্য করার জন্যে অবশ্যই আপনাদের ক্ষমতার মধ্যে কিছু করণীয় রয়েছে। সরকার যখন নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে তখন যারা সাহায্য করার মতো যোগ্যতা রাখেন তাঁরা দেশপ্রেমের উদাহরণ নিয়ে এগিয়ে আসবেন এবং প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে সাহায্য করবেন বলেই আমরা আশা করি।

চিন্তা ও চেতনায় যেন বন্ধ্যাত্ব না আসে

পঁচিশে বৈশাখ বাঙালীর জীবনে, বাংলার ঘরে ঘরে প্রতি বছর এক ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারা হয়ে আসে। বয়ে আনে নতুন তাৎপর্য এবং দিয়ে ভবিষ্যতের সংস্কৃতি পরিকল্পনা।
বাঙালীর বাঙালীত্ব রবীন্দ্র কাব্যের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে একথা সুধীজন স্বীকৃত। কিন্তু এ স্বীকারোক্তি ছাড়াও রবীন্দ্র সাহিত্যের প্রভাব বাংলার জন্যে মানুষের চিন্তায় ও চেতনায় এমন ভাবেই মিশে আছে যে তা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। তার প্রমাণ বাঙালী দিয়েছে একুশে ফেব্রুয়ারীতে ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনে এবং পরিশেষে বাংলার স্বাধীনতার সংগ্রাম।
বিগত পঁচিশ বছর ধরে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে দুর্ভোগও কম পোহাতে হয়নি বাংলার মানুষকে। দুঃশাসনের বছরগুলোতে কখনও আঘাত এসেছে বাংলা ভাষার উপর, কখনও আঘাত এসেছে বিশেষ ভাবে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গানের উপরে। কিন্তু টেকেনি কোনটাই। বাংলার মানুষের বাঙালী সত্ত্বা অর্থাৎ জাতীয়তাবোধ ছিলো প্রখর। তাই সব প্রতিবন্ধকতা দুৎহাতে ছিঁড়ে ফেলে তারা জালিমশাহীর চোখ রাঙানীকে উপেক্ষা করে পেয়েছে রবীন্দ্রসঙ্গীত। প্রতিষ্ঠা করেছে বাংলার আবহমান ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির গৌরব।
রবীন্দ্র জন্ম বার্ষিকী এমনই এক সাংস্কৃতিক দর্পণ বহু আঘাতকে প্রতিহত করেও এই দর্পণে বাঙালী চেতনা বার বার প্রতি বছর উদ্ভাসিত হয়েছে। আপনার হাসি কান্না দেখেছে এবং আগামী দিনের আঘাত প্রতিরোধের বর্ম তৈরীর জন্য আবার প্রস্তুত হয়েছে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭২ এর পঁচিশে বৈশাখে যেটুকু উৎসাহ উদ্দীপনা দেখা দিয়েছিলো তিয়াত্তরে তাও হারিয়ে গেছে।
১৯৭৩ সালের রবীন্দ্র জন্ম বার্ষিকী এলো। কিন্তু সেই প্রত্যাশার নিবৃত্তি হ’লো না। আঘাত নেই—অতএব প্রত্যাঘাতের প্রয়োজনও যেন ফুরিয়ে যাচ্ছে। এবারের কবি জন্ম জয়ন্তী তাই বড্ড ঠান্ডা ও উদ্যমহীনতার মধ্যে শুধুই যেন পালিত হতে হয় তাই হয়েছে। এতে করে দেশবাসীর মধ্যে যে চেতনার অভাব আছে তাও বলা যায় না, একে বরঞ্চ সুষ্ঠু পরিকল্পনার ও কর্মসূচীর অভাবই বলা যেতে পারে। কারণ কোন কাজের সুষ্ঠু বাস্তবায়নের জন্য উদ্যম ও পরিকল্পনা দুই-ই থাকতে হবে। সরকারী উদ্যোগে শিলাইদহে আমাদের তা নেই বলেই বাংলা একাডেমীর রবীন্দ্র জন্ম-তিথি অনুষ্ঠানে সাধারণ মানুষের বদলে মুষ্টিমেয় রবীন্দ্র রস পিপাসুদের সঙ্গে কাকের সমন্বয় ঘটেছে। গতকাল কাকের ছবি সম্বলিত যে সংবাদ বাংলার বাণী’তে প্রকাশিত হয়েছে তাতে প্রশ্ন জাগে, এই কি রবীন্দ্র চেতনার বহিঃপ্রকাশ! এই কি জাতীয় চেতনাবোধের নগদ মূল্য না জাতীয় চেতনার ভূমিতে জনগণের কবর?
যদি সমগ্র জাতির রবীন্দ্র জন্ম বার্ষিকী পালনের বিভিন্ন উদ্যোগকে সুষ্ঠু পরিকল্পনার অধীনে একটি সামগ্রিক পরিকল্পনায় পরিণত করা যেতো, তাহলে তা বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের ভূমিকা নিয়ে দেশের বিদগ্ধ জনসাধারণের সামনে একটা আদর্শ ও চেতনাকে তুলে ধরতে সক্ষম হ’তো। তাহলে দেশবাসীর এই উদ্যম ও পরিকল্পনা একটা বৃহত্তর স্বার্থে বৃহত্তর চিন্তার শৃঙ্খলায় বাঁধা পড়তো এবং অসংখ্য উদ্দেশ্যহীন আয়োজন এমনভাবে নিষ্ফল পাথরে মাথা কুটতো না।
পরিশেষে, আমরা আশা রাখতে চাই—আগামী বছরে যেন এই জাতীয় দুর্বলতা আর না দেখতে হয়। চিন্তা ও চেতনায় এমন বন্ধ্যাত্ব যেন দেখা না দেয়। বাংলার জাতীয় চেতনায় খন্ডিত রবীন্দ্রনাথকে ঠিক চেনা যায় না। এতে উভয়বিধ মান ক্ষুন্ন হয়। এতএব সর্বদলীয় সাংস্কৃতিক সংগঠনের মাধ্যমে মর্যাদামন্ডিতরূপে এবং উদ্দেশ্য সাধনের সহায়ক হিসেবে এই দিনটি উদযাপন করার পরিকল্পনা যেন থাকে।

পরিত্যক্ত শিল্প ও কর্মী সমবায়

সরকারী ব্যবস্থাধীনে নিয়ে নেওয়া পরিত্যক্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান বিক্রির ব্যাপারে সমবায় সমিতিকে অগ্রাধিকার দানের সরকারী ইচ্ছার কথা সরকারের এক প্রেসনোটে ঘোষণা করা হয়েছে। পুঁজি প্রত্যাহার বোর্ড ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে কর্মী সমবায় সমিতি কর্তৃক টেন্ডার গ্রহণের সময়সীমা পূর্বঘোষিত সময়সীমা পরিবর্তন করে একমাস অর্থাৎ আগামী সাতই জুন পর্যন্ত বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সরকার গঠিত পুঁজি প্রত্যাহার বোর্ড প্রথম পর্যায়ে ৫৬টি শিল্প প্রতিষ্ঠান কর্মী সমবায় সমিতি ও বেসরকারী লোকদের কাছে বিক্রির জন্য টেন্ডার আহ্বান করেছিলেন এবং টেন্ডার দাখিল করার শেষ সময় ছিলো সাতই মে। কিন্তু এ ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের সমবায় সমিতি গঠনের পদ্ধতিগত কতকগুলো অসুবিধে থাকায় তাঁদের পক্ষে পূর্বঘোষিত সময়ের মধ্যে শিল্প প্রতিষ্ঠান ক্রয়ের ব্যাপারে টেন্ডার দেওয়া সম্ভব হয়নি। তাঁদের সে অসুবিধের কথা বিবেচনা করে পুঁজি প্রত্যাহার বোর্ডের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত ও ইচ্ছা এখন তাঁদের জন্য একটা বিরাট সুযোগ এনে দিলো এবং বোর্ডও একটা শুভ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে আমরা মনে করি। কেননা, সমাজতান্ত্রিক দেশে শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক মালিকানার যে সুযোগ ও দাবী রয়েছে, এতে করে আমাদের দেশেও সেই সুযোগ ও পদ্ধতি বাস্তবায়নের পথ সুগম হলো। সমাজতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থায় এটা একটা বলিষ্ঠ পদক্ষেপও বটে।
সুতরাং আমরা আশা করি কৃষকরাজ, শ্রমিকরাজ কায়েমের প্রেক্ষিতে এদিকে শ্রমিক সংস্থা ও কর্মী ভাইয়েরা সক্রিয় সাড়া দিয়ে এই সুযোগ গ্রহণ করবেন এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থাকে সুসংহত করার জন্য সরকারের প্রচেষ্টার প্রতি পরিপূর্ণ সমর্থন দেবেন।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন