You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
৮ই মে, মঙ্গলবার, ১৯৭৩, ২৫শে বৈশাখ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

পঁচিশে বৈশাখ

আজ পঁচিশে বৈশাখ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের ১১২তম জন্ম বার্ষিকী। বাংলাদেশে যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে কবির জন্মদিনটি পালনের জন্য বিভিন্ন সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত শিলাইদহের অনু্ষ্ঠানটিতেই কবিগুরুর সাহিত্য ও জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করা হবে। কবির জন্ম-তিথি পালনের এতো আয়োজন, এতো যে সমারোহ, এরই মধ্যে আমাদের মনে এ কথাটি উদয় হওয়া কিছু মাত্র বিচিত্র নয় যে, আমরা রবীন্দ্রনাথের জন্ম দিনে যতো ঘটা করেই অনুষ্ঠানটি করি না কেন, তাতে শুধু লোক দেখানোপনাটাই প্রকাশ পাচ্ছে। মনে হচ্ছে কবির কর্ম ও জীবন আমাদেরকে ততোটা আলোড়িত করেনি। অর্থাৎ আমরা রবীন্দ্রনাথের বাণীকে যতোটা না আত্মস্থ করেছি তার চেয়ে বেশী রবীন্দ্রনাথের বাইরের পরিচয়টাকে জেনেই সন্তুষ্ট হচ্ছি। বাংলাদেশের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নাড়ীর যোগাযোগ ছিলো এবং বাঙালী জাতীয়তাবাদী চেতনা উদ্বোধনের ব্যাপারেও কবিগুরুর কিছুমাত্র কম অবদান নেই। কিন্তু আমরা জাতি হিসেবে এতোই বিস্মৃতপ্রবণ যে, বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি প্রতিটি বাঙালীর হৃদয়ে ছিলো আশার একমাত্র অবলম্বন। কবিগুরুর ‘আমার সোনার বাংলা’ কলিটি গুনগুনিয়েই বাংলার দামাল ছেলেরা মুক্তির সংগ্রামে নিজেদের প্রাণমন সঁপে দিয়েছিলো। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবি হলেও তিনি প্রতিটি বাঙালীর একান্ত আপনজন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের জন্মতিথি ঔপনিবেশিক পাকিস্তানী আমলে নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও আমরা অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করেছি। গত বছর রবীন্দ্র-জন্ম-তিথিটি আমরা তেমন ঘটা করে পালন করতে পারিনি। কারণ সদ্য আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। বিধ্বস্ত দেশে তাই অনাড়ম্বর পরিবেশে আমরা কবির জন্ম-তিথিটি উদযাপন করেছি। কিন্তু এবার? এবারতো আমরা রবীন্দ্র জন্ম-তিথি পালনের জন্য ব্যাপক আয়োজন করতে পারতাম। এবার কেন রবীন্দ্রনাথের জন্ম দিনটি আমরা ততোটা উদ্যোগ নিয়ে পালন না করে দায়সারা গোছের আনুষ্ঠানিকতার বেড়াজালে আবদ্ধ হলাম? এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে যে, রবীন্দ্র-জীবনের অর্ধ শতাব্দী অতিক্রান্ত হবার আগে পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে রবীন্দ্রনাথের কোন জন্মোৎসব পালিত হয়নি। জন্ম-তিথি পালন প্রথাটি ঠাকুর পরিবারে সেই সময় প্রচলিত ছিলো না। পরে অবশ্য ঠাকুর পরিবারে নতুন করে জন্ম-তিথি পালনের রীতি চালু হয়। রবীন্দ্রনাথের খ্যাতি যখন মধ্যগগনে তখনই তাঁর জন্ম-তিথি পালনের প্রতি সাহিত্যানুরাগীদের মধ্যে সাড়া পড়ে যায়। প্রথমে ঘরোয়া অনুষ্ঠান থেকেই যাত্রা শুরু হয়। পরে অবশ্য রবীন্দ্র জন্মোৎসব পালন বাঙালীর জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়। রবীন্দ্রনাথ বাঙালীর জাতীয় কবি। তাঁর জন্মদিনে যদি আমরা যথাযথ সম্মান প্রদর্শন না করি, তাহলে বাঙালী হিসেবে এবং মানুষ হিসেবে যে আমরা সৎ সেই পরিচয়টুকু অন্ততঃ দিতে ব্যর্থ হবো। কবিগুরুর আগামী জন্ম-তিথিতে যেন আমরা এই একই ভুলের পুনরাবৃত্তি না করি। পঁচিশে বৈশাখ যেন আমাদের মুখবাদান না করে। প্রতিটি বাঙালী যেন পঁচিশে বৈশাখে কবিগুরুর ভাষাতেই কবিগুরুকে প্রণতি জানাতে পারি :
আমি বারংবার
তোমারে করিব নমস্কার।

বাঙালীদের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলা বন্ধ করো

সংবাদে প্রকাশ, ইসলামাবাদ সরকার নাকি কয়েক হাজার বাঙালীকে গ্রেফতার করেছে। পাকিস্তানী পুলিশ ভোর রাতে অতর্কিত হানা দিয়ে কয়েক হাজার বাঙালীকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে বলে সংবাদে বলা হয়েছে। এদিকে একজন সরকারী মুখপাত্র রয়টারকে বলেছেন যে, বাংলাদেশে পাঠানোর জন্যে প্রস্তুতি হিসেবে এ সব বাঙালীকে দুইটি অথবা তিনটি স্থানে নেওয়া হচ্ছে। অথচ জানা গেছে যে, কিছু সংখ্যক পুলিশ গত পরশুদিন মধ্য রাতের পর অর্থাৎ ভোর রাতের দিকে বাঙালীদের বাড়ীতে হানা দিয়ে তাদেরকে ধরে নিয়ে যায়। বাঙালীদেরকে ধরে নেবার সময় তাদের নিজস্ব সামান্যতম জিনিসপত্রও সঙ্গে নিতে দেওয়া হয়নি। যে এলাকায় পুলিশ হানা দিয়েছিলো সেটা হলো নিম্ন বেতনভুক সরকারী কর্মচারীদের আবাসিক এলাকা। সম্প্রতি পাকিস্তান সরকারই এক নির্দেশের দ্বারা বাঙালী কর্মচারীদেরকে ঐ সকল কোয়ার্টারে থাকতে বলেছিলো। করাচী থেকে প্রকাশিত জং পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে যে, ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের পর থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের যে সব বেসামরিক বাঙালী কর্মচারী ধ্বংসাত্মক ও রাষ্ট্রদ্রোহিতায় জড়িত ছিলো তাদের সকলকে পশ্চিম পাঞ্জাব ও সীমান্ত প্রদেশের বন্দী শিবিরে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। সংবাদটিতে কখন কতো বাঙালীকে কোথায় কিভাবে গ্রেফতার করা হয়েছে তা বলা হয়নি। মোদ্দাকথা, প্রকাশিত সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বুঝতে সক্ষম হয়েছি যে, অতর্কিতভাবে পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ তাদের পুলিশের দ্বারা বাঙালীদের কোয়ার্টারে আক্রমণ চালিয়ে বহু সংখ্যক বাঙালীকে এই মুহূর্তে বিশেষভাবে গ্রেফতার করা হলো—আমাদের বিশ্ববিবেকের কাছে জিজ্ঞাসা। বাংলাদেশ যখন পাকিস্তানের সাথে একটি নিষ্পত্তি-রফা করে ফেলতে আগ্রহী এবং সরাসরি একটি প্রস্তাবও দিয়েছে তখন কোন্ অভিসন্ধিতে পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ বাঙালীদেরকে বন্দী শিবিরে নতুন করে নিলেন তা বুঝতে আমরা সক্ষম হইনি। তবে একটা কথা আমরা এবং আমাদের দেশবাসী জানে যে, পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ আর যাই হোক, এ উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী নয়। এবং বাংলাদেশের সঙ্গে তার সম্পর্কোন্নয়নের কোন সদিচ্ছাই নেই। আটক বাঙালীদের আটক রেখে সে যুদ্ধবন্দী ও যুদ্ধাপরাধীদের ফেরত পেতে চায় বিনাশর্তে। কিন্তু আমরা পুনরায় বলতে পারি পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ ভুল বুঝেছেন। বাংলাদেশে যেহেতু ন্যায় ও শান্তিতে বিশ্বাসী সেহেতু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবেই। আমরা বিশ্ববিবেকের কাছে আবার আহ্বান জানাবো, জাতিসংঘকে পুনরায় অনুরোধ করবো—আটক বাঙালীদের নিয়ে পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ যে ছিনিমিনি খেলছে তা বন্ধ করার নিশ্চিত ব্যবস্থা করুন। তাদের ফেরত দেবার জন্যে এবং বাংলাদেশের প্রস্তাবের স্বপক্ষে রায় দিয়ে এই উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি নিশ্চিত করুন।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!