You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
১৪ই মে, সোমবার, ১৯৭৩, ৩১শে বৈশাখ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

ইতিহাস রচনা প্রসঙ্গে

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তনে বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদের তিন দিনব্যাপী তৃতীয় বার্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধনকালে মাননীয় রাষ্ট্রপতি জাতীয় ঐতিহ্যের আলোকে প্রয়োজনীয় গবেষণা ও সত্যানুসন্ধানের মাধ্যমে সত্য, ন্যায় ও সুন্দরের প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তরিকতার সাথে বাংলাদেশের সঠিক ইতিহাস রচনার উদ্দেশ্যে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান। প্রধানতঃ ইতিহাসবেত্তাগণের প্রতি তিনি অধিক দায়িত্ব আরোপ করে বলেন যে, স্বাধীনতা সংগ্রামের গৌরবোজ্জল অধ্যায়ের তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণমূলক কাজে তাঁদের ব্রতী হতে হবে।
এই সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু তার প্রেরিত এক বাণীতে বলেন যে, ইতিহাস দেশ ও জাতির জীবনের প্রতিচ্ছবি। তিনি আরও বলেছেন যে, যুগে যুগে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক কাঠামো ও ধারার পরিবর্তন ও ক্রমবিকাশকে ইতিহাস তার পাতায় ধরে রাখে, যা কোন জাতিকে তার আত্মেপলব্ধি করতে সাহায্য করে। ভাবী বংশধর ও পৃথিবীর আপামর মানুষের সামনে বাংলাদেশের ইতিহাস যাতে সঠিক ও নির্ভুলভাবে তুলে ধরা সম্ভব হয়, সেজন্য তিনি ঐতিহাসিকদের অধিকতর নিষ্ঠার সঙ্গে এই কাজে অগ্রসর হতে আহ্বান জানান। সভ্যতার আবর্তন-বিবর্তন, উত্থান-পতন, উন্নতি-অবনতি বিধৃত থাকে ইতিহাসেরই পাতায়। ইতিহাস তাই মানবসভ্যতার অন্যতম প্রধান বার্তা বাহক ও ধারক।
আমরা আজ স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীন নাগরিক। এই স্বাধীন জাতির কাছে স্বদেশের মাটি ও মানুষের প্রকৃত পরিচয় তুলে ধরবে ইতিহাসই। যেদিন আমরা থাকবোনা, সেদিন আমাদের উত্তরসুরীদের কানে কানে ইতিহাসই কথা বলবে। আপন পর বিচার না করে ইতিহাস সেদিন কালের চোখে তার পাতা মেলে ধরবেই।
কালের বুকে মানুষের সৃষ্টিরূপে কালির আঁচড়ে ইতিহাস বন্দী থাকে আগামীদিনের গবেষকদের স্পর্শের প্রত্যাশায়। অতএব ইতিহাস রচনার জন্য সংগৃহীত তথ্যগুলোকে যে যথাসম্ভব সত্যনির্ভর ও অভিজ্ঞতালব্ধ হতে হবে একথা বলাইবাহুল্য। আবার শুধু তথ্যানুসন্ধান ও তথ্য সংগ্রহই ইতিহাসের জন্য সবচেয়ে বড় কথা নয়, সেই সঙ্গে ইতিহাসবেত্তাদের যথার্থ ইতিহাস চেতনারও প্রয়োজন আছে এবং দেশকালগত সামাজিক, ধর্মীয়, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক চিন্তা-চেতনা ও লৌকিক রীতি নীতির সংস্কার ও ধারা সম্পর্কেও পরিষ্কার ধারণা থাকা চাই। এরই প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, স্বাধীনতা সংগ্রামকে কেন্দ্র করে বাংলার জনমানুষের জীবনে যে আলোড়ন ও পরিবর্তন এসেছে, সে ক্ষয়-ক্ষতির অংক এখনও লোকচক্ষুর অন্তরালে রয়ে গেছে, যে ঘটনাপঞ্জী কিংবদন্তী হয়ে ছড়িয়ে আছে সেগুলোর তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণে ইতিহাসবিদগণের পরিচালনায় আজ কম বেশী সকলকেই যৌথ ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। এই সম্মেলনের উদ্দেশ্য সফল হোক এবং বাংলাদেশের সংগ্রাম ও সংগ্রামকেন্দ্রিক বিমিশ্র ঘটনাপঞ্জী বিশ্লেষণের মাধ্যমে যথার্থ ইতিহাসের আকারে রূপ পাক এই আমাদের ঐকান্তিক শুভ কামনা।

দুর্গতি লাঘবের জন্য চাই জনগণের সহযোগিতা

বসন্ত, মহামারী, ঘূর্ণিঝড় এবং সবশেষে বন্যা। একটার ধকল সইতে না সইতেই আর একটি আঘাত। এক দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আর একটি দুর্যোগ। এ দুর্যোগের যেন অন্ত নেই বাংলাদেশে, জনগণের দুর্ভোগেরও যেন শেষ নেই। বন্যার ঢল নেমে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে গ্রাম-গঞ্জ জনপদ। সিলেট-কুমিল্লা আর নোয়াখালীর এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল এখন জলমগ্ন। ত্রাণমন্ত্রী যা হিসেব দিয়েছেন তাতে এই অকাল বন্যায় প্রায় চল্লিশ লক্ষাধিক লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফসল ও অন্যান্য সম্পত্তি বিনষ্ট হয়েছে চল্লিশ কোটি টাকার।
প্রাণ এবং সম্পদহানির যে বিবরণ পাওয়া গেছে তাতে করে অবস্থা সম্পর্কে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারা যায় না। বিশেষ করে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা যে সংকটের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে, তাতে করে জনসাধারণের দুর্ভোগ সরকারী সাহায্যে কতটুকু লাঘব হবে তা বলা মুশকিল। ইতিমধ্যে সাহায্য নিয়েছে। বন্যানিয়ন্ত্রণ মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ এবং ত্রাণমন্ত্রী জনাব মিজানুর রহামন চৌধুরী দুর্গত এলাকা সরেজমিনে দেখে এসেছেন। বঙ্গবন্ধু স্বয়ং বন্যা প্লাবিত এলাকার প্রত্যন্ত প্রান্তরে ঘুরে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সম্বন্ধে অবহিত হয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘দুনিয়ার যে স্থান যে প্রান্ত থেকেই হোক আমি আমার দুর্গত জনগণের জন্য সাহায্য নিয়ে আসবো। কিন্তু আমি দেখতে চাই সেই সাহায্য সেই সম্পদ দুর্গতদের কাছে পৌঁছেছে।’
একশ্রেণীর লোক রয়েছে যারা সব সময়ই সাধারণ মানুষের দুর্ভোগকে পুঁজি করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধিতে তৎপর হয়ে উঠে। বঙ্গবন্ধু সেই গণদুশমনদের ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে উদাসিন থাকতে পারেন না। চিরদিন তিনি এই মনুষ্যরূপী পশুদের অমানবিক কার্যকলাপ চোখের উপরে সংঘটিত হতে দেখেছেন। বাংলার মানুষের দুঃখে প্রাণের সকল উষ্ণতা নিয়ে তিনি যখন তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন, দেখেছেন কর্তৃপক্ষের চোখে ধুলি ছড়িয়ে অথবা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় কেমন করে এই পাশব শক্তি ছিনিয়ে নিয়েছে দুঃখী মানুষের খাবার-অর্থ। আজ তাই সরকারের প্রধান হিসেবে তিনি যখন দুর্গতদের সেবায় সম্ভাব্য সকল সম্পদকে নিয়োজিত করার নির্দেশ দেন তখন ভুলে যান না এই নরপশুদের কথা।
বন্যা হয়েছে, প্রাণ এবং সম্পদহানি সরকারী ভাষ্যের চাইতেও যে বেশী হতে পারেনা এমন কথা বলা যায়না। কিন্তু যা গিয়েছে তার জন্য বসে আফসোস করার চাইতে যেটা মুখ্য কর্তব্য বলে আমরা মনে করি, তা হলো বেঁচে যারা রয়েছে তাদের মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করা। সরকারী সাহায্য এবং বঙ্গবন্ধুর কড়া সতর্কবাণীই যথেষ্ট বলে বিবেচিত হতে পারে। বিভিন্ন সংস্থা এবং সংগঠনের মাধ্যমে জনসাধারণকে আজ এগিয়ে আসতে হবে। এটা সৎ নাগরিকেরই শুধু নয় বরং একজন মনুষ্যত্ব বোধসম্পন্ন মানুষেরও কর্তব্য। আশা করি মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ানো অসংখ্য মানুষের সামনে মানবতা কোনভাবে লাঞ্ছিত হবে না।

আন্তর্জাতিক আদালতে পাকিস্তানের ধর্ণা

পাকিস্তান এবার হেগ আন্তর্জাতিক আদালতে ধর্ণা দিয়েছে। ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগনামা আন্তর্জাতিক আদালতে রেজিস্ট্রি করে পাকিস্তান বলেছে, পাকিস্তানী ৯২ হাজার যুদ্ধবন্দীকে ১৯৪৮ সালের জেনেভা সনদের অধীনে বিচার করার ‘নিরঙ্কুশ ক্ষমতা’র অধিকার একমাত্র পাকিস্তানেরই রয়েছে এবং আন্তর্জাতিক বিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের বিচার করতে পারবে না। পাকিস্তান তাই আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হয়ে আবদার জানিয়েছে, পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী কার্যকলাপের অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের জন্যে ভারত যেন যুদ্ধবন্দীদের বাংলাদেশে পাঠানো থেকে বিরত থাকে। বলাবাহুল্য, পাকিস্তানের এহেন মনোভঙ্গি আমাদের বড়ই তাজ্জব করেছে। পাকিস্তান আন্তর্জাতিক আদালত সমীপে আবেদন করেছে, পাকিস্তানী বেসামরিক নাগরিক ও যুদ্ধবন্দীদের স্বদেশে পাঠানোর ব্যাপারে কারো কারো বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ উত্থাপন করে কোনরকরম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা চলবেনা। অথচ বাংলাদেশ ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচার করা হবে বলে সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে এবং বাংলাদেশ এ কথাও জানিয়ে দিয়েছে যে, যুদ্ধবন্দীদের ফেরত পাঠানো হবে যদি পাকিস্তান অবাঙালীদের ফিরিয়ে নেয় এবং পাকিস্তানে আটকেপড়া বাঙালীদের প্রত্যর্পণ করে। কিন্তু পাকিস্তান সে প্রস্তাবের প্রতি পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে যুদ্ধবন্দী ও যুদ্ধাপরাধীদের মধ্যে তালগোল পাকিয়ে রাজনৈতিক দাবার চাল ক্রমাগত চেলে যাচ্ছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পরিকল্পনা বানচাল করার জন্যে পাকিস্তান আদা-জল খেয়ে দুরভিসন্ধির বেড়াজাল বিস্তৃতি করে চলেছে। ইসলামাবাদের বাঙালীদের মধ্যরাতের অন্ধকারে বন্দী শিবিরে আটক করা হয়েছে। লারাকানার মুকুটহীন নবাবজাদা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জনাব ভুট্টো সাহেব তো হম্বিতম্বি করে বলেই ফেলেছেন যে, বাংলাদেশ যদি সামান্য সংখ্যক পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের কাঠগড়ায় দাঁড় করান, তাহলে পাকিস্তান হাজার হাজার আটকে পড়া বাঙালীদের বিচার করতে কসুর করবেন না। অবস্থাদৃষ্টে স্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছে যে, পাকিস্তানের মতিগতি মঙ্গলকর নয়। সিমলা চুক্তির পর পাকিস্তান দিশেহারা হয়ে আটক বাঙালীদের পুঁজি করে নতুন নতুন ফন্দি আঁটতে শুরু করেছে। ফন্দীবাজ ভুট্টো শাহী আজ বাংলাদেশ ও ভারতকে ‘ব্ল্যাকমেইল’ করার জন্য পাঁয়তারা করছে। ভুট্টো সাহেব আন্তর্জাতিক আদালতে যে অভিযোগনামা দাখিল করেছেন, তাতে যুদ্ধবন্দী এবং যুদ্ধাপরাধীদের একই পংক্তিতে রেখে একটা জগাখিচুড়ি ও অযৌক্তিক পথ বেছে নিয়েছেন। কারণ পাকিস্তানী সৈন্যরা বাংলাদেশে নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়ে ত্রিশ লক্ষ বাঙালীর প্রাণ সংহার করেছে। আন্তর্জাতিক বিধি মতেই যুদ্ধবন্দীদের মধ্য থেকে প্রমাণাদি সাপেক্ষে দোষী সাব্যস্ত ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচারের জন্য বাংলাদেশ তার সিদ্ধান্তে অটল থাকে। ইতিহাস বিখ্যাত নুরেমবার্গ বিচারও এই নীতিমালার ভিত্তিতেই সংঘটিত হয়েছিলো। ভুট্টো সাহেব ইতিহাসের সেই অমোঘ ও উজ্জল উদাহরণটির প্রতি কেন চোখ বুঁজে রয়েছেন, সেটাই আমাদের বোধগম্য নয়। জনাব ভুট্টো নিরপরাধ বাঙালীদের বিচার করার হুমকি দেখিয়েছেন আর বাংলাদেশ যথার্থ যুদ্ধাপরাধী হিংস্র গণহত্যাকারীদের বিচার করতে পারবে না, এ কোন্ বিচার, কোন্ যুক্তি ও কোন্ বিবেক বুদ্ধির পরিচায়ক? তাছাড়া যারা অপরাধী তারা কি কখনো আইন বলে বিচারকের আসনে আসীন হতে পারে? তাও আবার ‘নিরঙ্কুশ ক্ষমতা’র বলে। ভুট্টো সাহেবের মস্তিষ্কে যতোসব আজব বুদ্ধি খেলা করছে এবং তিনি উপমহাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে রীতিমতো ভানুমতির খেল দেখাচ্ছেন। ধৈর্য এবং সহ্য-শক্তির একটা সীমা আছে। কাজেই যুদ্ধবন্দী ফেরত পাঠানোর প্রসঙ্গটি নিয়ে কোন রকম শিশুতোষ আবদারকে অন্ততঃ বাংলাদেশ প্রশ্রয় দেবেনা। জনাব ভুট্টো দেন-দরবার যতোই করুন, আন্তর্জাতিক আদালতের দুয়ার থেকেও ব্যর্থ মনোরথ হয়েই তাকে পচা নালায় ডুবে নিশ্চিত মরণকে বরণ করে নিতে হবে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!