You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
৫ই মে, শনিবার, ১৯৭৩, ২২শে বৈশাখ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

সংঘবদ্ধ তৎপরতা প্রয়োজন

দেশের সকল প্রকার দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে তোলার জন্যে একটি তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বাংলাদেশ আওয়ামী যুব লীগ এ ব্যাপারে সর্বপ্রথম একটি সুষ্ঠু যৌথ পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছিলো। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন ইতিপূর্বে সমাজবিরোধী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের আহ্বান জানিয়ে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করার পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিলো। সম্প্রতি জাতীয় শ্রমিক লীগ অসাধু ব্যবসায়ী, চোরাকারবারী, মওজুতদার, লাইসেন্স-পারমিটের অপব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে একটি সংগ্রামের নেতৃত্ব দান করছে। গতকাল ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট সকল প্রকার সমাজবিরোধী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করার একটি প্রস্তাব পেশ করেছে। আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর এই সভায় দেশের সার্বিক সামাজিক, রাজনৈতিক ও খাদ্য সংকট নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বস্তুতঃপক্ষে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অনুসারী সকল রাজনৈতিক ও ছাত্র-দল দেশের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে তোলায় বদ্ধপরিকর। দেশের আপামর মানুষের দুঃখ কষ্টের জন্যে যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দায়ী সেই সকল সমাজবিরোধী ব্যক্তিদের যে কোন মূল্যে উৎখাত করা দরকার। সরকার এদের বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন পূর্বাহ্নেই। যারা ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অসাধু তৎপরতা চালিয়ে বিভিন্ন উপায়ে সংকট সৃষ্টি করছে তাদেরকে উৎখাত করতেই হবে। সরকারী দেয় লাইসেন্স-পারমিট নিয়ে যারা অসৎ পথে তা ব্যবহার করছে তাদের লাইসেন্স-পারমিট বাতিল করতে হবে। এক্ষেত্রে আওয়ামী যুবলীগের প্রত্যক্ষ দাবী রয়েছে লাইসেন্স-পারমিট বাতিল করে সরকার দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করবেন। দেশের উন্নয়ন ও মানুষের দুঃখ লাঘব করার পথে যারা অন্তরায় তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করার ন্যায়ত মহান দায়িত্ব জনগণ সরকারকে দিয়েছে। সরকার নিজেও সে দায়িত্ব পালনে আন্তরিক। তবে দেশের প্রত্যেকটি সরকারী-বেসরকারী শাখা-প্রশাখায় এতো বেশী দুর্নীতি অনুপ্রবেশ করেছে যে, অত্যন্ত স্বল্প সময়ে তার মূলোচ্ছেদ করা সম্ভব নয়। সরকার তার প্রশাসনিক যন্ত্র দ্বারা অভিযান পরিচালনা করবেন, অন্যদিকে দেশের শান্তি ও প্রগতিকামী রাজনৈতিক ও ছাত্র-সংগঠনগুলো সরকারের সে পদক্ষেপে আন্তরিক সাহায্য করবেন। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, আমরা দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর। যেহেতু একটি ঐতিহাসিক রক্তাক্ত বিপ্লবের পর দেশ স্বাধীন হয়েছে এবং নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে তা অগ্রসর হচ্ছে সেহেতু যে কোন অসঙ্গতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করার পূর্বে সংগ্রামের আহ্বানকারী সংগঠনগুলোকে অবশ্যই গণতান্ত্রিক দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে একবার চিন্তা করতে হবে। নিজেদের হাতে আইন তুলে নেবার অধিকার কোন গণতান্ত্রিক দেশে স্বীকৃত হতে পারেনা। সংগঠনগুলো যৌথভাবে সরকারী পদক্ষেপের সঙ্গে সহযোগিতা প্রদান করলেই শুদ্ধি অভিযানের কর্মসূচী বাস্তবায়িত হতে পারে। এবং আইনের শাসনও দৃঢ় ও মজবুত হতে পারে। এ প্রসঙ্গে সরকারকেও অনুধাবন করতে হবে রাজনৈতিক ও ছাত্র-সংগঠনগুলোর সমাজবিরোধী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযানের গুরুত্ব। সকল প্রকার দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে একটি পরিকল্পিত প্রতিরোধ অবশ্যই গড়ে তুলতে হবে। এবং সে জন্যে সকল সংগঠনকে যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বিচ্ছিন্ন বা এককভাবে কোন সংগঠন যদি এ ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করে তাহলে তা ব্যর্থ হতে বাধ্য এবং নিশ্চিতভাবে তা আইনের অবনতি ঘটাবে। সর্বোপরি একটি নিয়মতান্ত্রিক সরকারের আনুকূল্যে সংগ্রাম পরিচালনা করতে হলে অবশ্যই সকল রাজনৈতিক ও ছাত্র-সংগঠনকে আইন ও শৃঙ্খলার অবমূল্যায়ন যাতে না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। সংঘবদ্ধভাবে সরকার ও সংগঠন যদি সমাজবিরোধীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে তাহলে এ সংগ্রাম সার্থকতা লাভ করবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।

বাংলাদেশের বাস্তবতা

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সনের শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে। তিনি ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পক্ষে অভিমত পোষণ করেছেন। উপমহাদেশে বিরাজিত অস্ত্র প্রতিযোগিতা অবসানেরও তিনি আহ্বান জানিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট নিক্সন বলেছেন, উপমহাদেশের নয়া বাস্তবতা হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানানোর মধ্যেই শান্তি প্রতিষ্ঠার চাবিকাঠি নিহিত রয়েছে। কংগ্রেসের নিকট বৈদেশিক নীতির বার্ষিক রিপোর্ট প্রদানকালে প্রেসিডেন্ট নিক্সন এই অভিমত প্রদান করেছেন। তিনি রিপোর্টে উল্লেখ করেছেন, একাত্তরের যুদ্ধে উপমহাদেশে নানা সমস্যার উদ্রেক হয়েছে। এই সমস্যাবলীর মধ্যে রয়েছে যুদ্ধবন্দীদের মুক্তিদান, আটক ব্যক্তিদের প্রত্যর্পণ, স্বীকৃতি দান ও কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন। বাণিজ্য পুনরারম্ভ ও পাকিস্তান-বাংলাদেশের মধ্যে সম্পত্তি ও দেনা-পাওনার হিসেবও তিনি উল্লেখ করেছেন।
প্রেসিডেন্ট নিক্সন, উপমহাদেশকে একটি স্বাধীন প্রগতিশীল ও শান্তিপূর্ণ উপমহাদেশ হিসেবে দেখতে ইচ্ছুক বলে আশা প্রকাশ করেছেন। এবং তিনি বাংলাদেশের সাফল্য ও স্থিতিশীলতার প্রতিও উৎসাহী বলে জানিয়েছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের মনে বাংলাদেশের বাস্তবতার প্রতি দৃঢ় আস্থার জন্ম নিয়েছে বলেই তিনি উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রশ্নটির উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এবং এ জন্যেই তিনি স্বীকার করেছেন যে, একাত্তর সালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় শান্তি ভঙ্গের দরুণ লক্ষ লক্ষ লোকের দুর্গতিই শুধু বাড়েনি, পারস্য উপসাগর থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত সমগ্র অঞ্চলের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। বাস্তব অবস্থার আলোকেই প্রেসিডেন্ট নিক্সন বাংলাদেশের স্বীকৃতির প্রশ্নটি উত্থাপন করেছেন। বাংলাদেশ উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী। ভারতও এ ব্যাপারে নানা উদ্যেমের পরিচয় দিয়ে চলেছে। উপমহাদেশের এ তিনটি দেশের মধ্যে যদি শান্তি ও সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠিত না হয় তাহলে দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তির আশা সুদূরপরাহত হতে বাধ্য। প্রেসিডেন্ট নিক্সন তাই বাংলাদেশ যে একটি বাস্তব সত্য, সেই সত্যটির প্রতি অঙ্গুলী সংকেত করেছেন। উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বৃহৎ শক্তিগুলোর মুখ্য ভূমিকা রয়েছে, তা আমরা স্বীকার না করে পারি না। এবং দক্ষিণ এশিয়ার বিপদের জন্যই বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে নানা রকম স্নায়ুযুদ্ধ দানা বেঁধে উঠেছিলো। এই অবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শান্তিবাদী ভূমিকা অনুসরণের ঘোষণাকে আমরা উপমহাদেশের শান্তির স্বার্থে একটি শুভ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করি।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন বৈদেশিক নীতি সম্পর্কিত যে রিপোর্ট পেশ করেছেন তাতে মনে হয়, উপমহাদেশের সমস্যাবলী সমাধানের একটি পথ ‍খুঁজে পাওয়া যাবে এবং পাকিস্তান যদি বাংলাদেশের বাস্তবতাকে অবিলম্বে মেনে নিয়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় তাহলে উপমহাদেশে শান্তির পথ তৈরী হতে আর তেমন সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে না। প্রেসিডেন্ট নিক্সনের যেমন শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে আমরা আশা করি পাকিস্তানেরও যদি তেমনি শুভবুদ্ধির উদয় হয়, তাহলে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক না হয়ে পারে না। বাংলাদেশের বাস্তবতাকে পাকিস্তান যত তাড়াতাড়ি মেনে নেয়, ততোই মঙ্গল।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!