You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
৬ই মে, রবিবার, ১৯৭৩, ২৩শে বৈশাখ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

বিশ্ব সংবাদপত্রের সমর্থন

বিশ্বের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রভাবশালী সংবাদপত্রের পাতায় পাতায় বাংলাদেশ-ভারত যুক্ত ঘোষণা অভিনন্দিত হচ্ছে এবং অপরদিকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোর সমালোচনা তীব্র হয়ে উঠেছে। কিন্তু এতেও জনাব ভুট্টোর চৈতন্যোদয় হবে কিনা কে জানে! উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বাংলাদেশ আর ভারতের যৌথ প্রয়াসই যথেষ্ট নয়—শান্তি প্রতিষ্ঠাকল্পে পাকিস্তানকেও অবশ্যই এগিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশ-ভারত যুক্ত ঘোষণায় সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশ ও ভারত উপমহাদেশের মানবিক সমস্যাবলীর আশু সমাধান কামনা করে এবং পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধী ছাড়া সকল যুদ্ধবন্দীর মুক্তি ও লোক বিনিময়ের জন্য বাংলাদেশ ও ভারত পাকিস্তানের প্রতি যৌথ প্রস্তাব দিয়েছে। এই প্রস্তাব যেখানে লুফে নেয়া প্রয়োজন সেখানে ভুট্টো সাহেব গোঁ ধরে বসে আসেন। এই যৌথ ঘোষণার স্বপক্ষে বিশ্ব জনমত সংগ্রহের জন্য বাংলাদেশের দূত দেশে দেশে দূতিয়ালী করতে বেরিয়েছেন। ঐদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনও উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য পাকিস্তানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। উপমহাদেশের শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রতি আজ সমগ্র বিশ্বের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে। এবং তারই প্রতিফলন আন্তর্জাতিক প্রভাবশালী সংবাদপত্রগুলোর পাতায় সোচ্চার হয়ে উঠেছে। লন্ডন টাইমস, স্ট্রেট টাইম, সানডে মেল, বেরিটা হ্যারিয়ান, গোতেবোর্স, পোস্তেন ও অটোয়া জার্ণাল প্রভৃতি পত্রিকাগুলো বাংলাদেশ-ভারত যুক্ত ঘোষণার প্রতি অকুন্ঠ সমর্থন জানিয়েছেন। সেই সঙ্গে পত্রিকাগুলোতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভুট্টোর নিষ্ক্রিয়তারও সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছে। পত্রিকাগুলোতে অভিমত প্রকাশ করা হয়েছে যে, উপমহাদেশের মানবিক সমস্যাগুলোর সমাধান এবং উপমহাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা ও স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য এর চেয়ে ভালো কিছু প্রস্তাব আর থাকতে পারে না। লন্ডন টাইমসের সম্পাদকীয় নিবন্ধে মন্তব্য করা হয়েছে, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভুট্টো পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে যে শুধু হুমকিই দিচ্ছেন তা নয়, বরং তিনি সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে নিরপরাধ আটক বাঙালীদের বিচার প্রহসনেরও হুমকি দিচ্ছেন। সানডে মেল-এ বলা হয়েছে, ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রস্তাব পাকিস্তানের গ্রহণ করা উচিত। পাকিস্তান এ প্রস্তাব মেনে নিলে মাত্র দু’শর মতো যুদ্ধাপরাধী ছাড়া তার সকল যুদ্ধবন্দী মুক্তি পাবে। সুইডিশ দৈনিক গোতেবোর্স পোস্তেন মন্তব্য করেছে যে, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভুট্টো এখন চরম সংকটে পড়েছেন। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে তিনি আকন্ঠ নিমজ্জিত। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতেও দিনের পর দিন অসন্তোষ ধূমায়িত হয়ে উঠেছে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী কখনও রাজনৈতিক নেতৃবর্গকে বিশ্বাস করেনি। গত ২৫ বছর ধরে পাকিস্তানের জেনারেলরা দেশ শাসন করেছে।
গোতেবোর্স পোস্তেন প্রেসিডেন্ট ভুট্টোর সংকটের চিত্র তুলে ধরেছে সম্ভবতঃ এই জন্যই যে, পাকিস্তান যদি শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে এগিয়ে না আসে, তাহলে খোদ পাকিস্তানেরই টলটলায়মান অবস্থা ঘণীভূত হবে।
ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে শান্তির পরিবেশ রচিত হোক, এটা আজ সমগ্র বিশ্বেরই সমর্থন লাভ করেছে। কিন্তু পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভুট্টো বিশ্বজনমতের প্রতি তেমন কর্ণপাত করছেন না। তিনি যুদ্ধাপরাধী ও যুদ্ধবন্দীদের এক দৃষ্টিতে দেখছেন। এই এক চক্ষুর নীতি যে দু’চোখকেই অন্ধকার করে দিতে পারে, সে কথাটি ভুট্টো সাহেবকে কতো আর বোঝাবো।
জনাব ভুট্টো, হাতে আর সময় নেই। দরকষাকষিরও অবকাশ তিরোহিত। উপমহাদেশের শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বার্থে বাংলাদেশ-ভারত যুক্ত ঘোষণার প্রতি আপনাকে সমর্থন দান করতেই হবে। ভুল একবার দু’বার সহনীয় কিন্তু বারংবার একই ভুলের পুনরাবৃত্তি মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। ভারত ও বাংলাদেশ যথেষ্ট ঔদার্যের পরিচয় দিয়েছে। এবার ভুট্টো সাহেবকে যৌক্তিক ও ন্যায়সঙ্গত পদক্ষেপ নিতে হবে। বাংলাদেশ-ভারত যুক্ত ঘোষণার প্রতি দৃষ্টি ফিরিয়ে উপমহাদেশের শান্তি ও সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ শর্তের বরখেলাপ ভুট্টো সাহেবের জন্য এক অগ্নিপরীক্ষার অবতারণা করবে। আমরা আশা করি, ভুট্টো সাহেবের চৈতন্যোদয় হবে। বিশ্বজনমতকে তিনি উপেক্ষা করবেন না।

মূলোৎপাটন কর সকল হুমকির

বাংলাদেশে এবার ‘ব্ল্যাক ডিসেম্বরের’ ভূতের আবির্ভাব ঘটেছে। কিছু দিন আগে ওদের পক্ষ থেকে আওয়ামী যুবলীগের নবাবগঞ্জ শাখার আহ্বায়ক জনাব আবদুল ওয়াহিদকে একটি চরম পত্রদানের মাধ্যমে হত্যা করার হুমকি দেয়া হয়েছে। এর অনেক দিন আগে ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনারকে এই তথাকথিত ব্ল্যাক ডিসেম্বর নামক সংস্থার পক্ষ থেকে একটি চরমপত্র দেয়া হয়। বোম্বেতেও এদের কেউ কেউ নাকি কিছু গন্ডগোল করে, কলকাতাস্থ বাংলাদেশ মিশনের কর্মকর্তাদের হুমকি দেয়, লন্ডনস্থ ভারতীয় মিশন, আরো একটি মিশন এবং কাবুলস্থ এয়ার ইন্ডিয়ার অফিসে হামলা চালায়। বাংলাদেশে এবং বাংলাদেশের বাইরে এ জাতীয় দুর্ঘটনা বা হুমকি প্রদান আসলে কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। পরন্তু এ জাতীয় হুমকি, দুর্ঘটনা এবং গত বছর দেশের সর্বত্র ব্যাপকভাবে সংগঠিত রাজনৈতিক গুপ্তহত্যা একটি অপরটির সাথে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত মনে করার যথেষ্ট কারণও রয়েছে।
বস্তুতঃ দেশ স্বাধীন হবার পর দেশের অভ্যন্তরে ও বাইরে একদল লোক চীন-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ক্রীড়নক পাকিস্তানী শোষণবাদী ও কায়েমী স্বার্থবাদীদের স্বার্থে স্বাধীনতা নস্যাৎ করার চক্রান্তে লিপ্ত থেকে প্রথমতঃ রাজনৈতিক গুপ্তহত্যা, বিভিন্ন ধরনের অসামাজিক কার্যাবলী, গুজব রটনা, হুমকি ও হয়রানিতে লিপ্ত ছিলো। দেশের সেই সময়কার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিও এর জন্য কম দায়ী ছিলো না।
তিয়াত্তরের শুরু থেকে রক্ষীবাহিনীর সার্বিক ও পুলিশ বাহিনীর কিছু কিছু তৎপরতায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটতে থাকে এবং গত ৭ই মার্চের নির্বাচনের পর রাজনৈতিক গুপ্তহত্যাও প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। চক্রান্তকারী এবং দুষ্কৃতিকারীদের বহু দুর্ধর্ষ লোক ধরা পড়তে থাকে। ওরা অনেকটা এখন হীনবল হয়ে পড়তে শুরু করেছে। কিন্তু তবুও ওদের হুমকি-হয়রানি এবং গুজব রটনা এখনো বন্ধ হয়নি—হচ্ছে না। এতে করে এখন মানুষের মনের ত্রাসের ভাবটা কেটে গেলেও ভয়-ভীতি কাটেনি।
এমতাবস্থায় ব্ল্যাক ডিসেম্বর নামক এই গুপ্ত সংস্থার সামান্যতম কোন অস্তিত্বও এদেশে থাকতে পারবে না। অচিরেই যথাযথ ও সার্বিক তদন্তানুষ্ঠানের মাধ্যমে সর্বশক্তি দিয়ে তার সব মূলোৎপাটন করতে হবে। দেশবাসীও সার্বিক শক্তি দিয়ে সরকারকে সাহায্য দান করতে বদ্ধপরিকর।

মৌসুমী ফল যেন স্বপ্নের ফল না হয়

আম জাম নারিকেল সুপারী কাঁঠাল
দাড়িম্ব কমলা কলা কামরাঙ্গা তাল
বেল-লেবু আনারস আতা হরিতকি
তরমুজ ফুল ফটি লিচু-আমলকি,
বাল্য শিক্ষায় প্রকাশিত এ কবিতা বাঙ্গালীর ছেলে-মেয়েরা একদিন সুর করে মাথা দুলিয়ে মুখস্ত করতো। কবিতা পড়ার সময় হয়তো তাদের হাতে থাকতো মৌসুমী ফল। বৈশাখজ্যৈষ্টে আম জাম কাঁঠাল অথবা কাঠালের কোয়া হাতে নিয়ে খেতে খেতে হয়তো কবিতা পড়তো। কিন্তু সেদিন আর নেই। এখন যেন সবকিছুই স্বর্প্নের মত মনে হয়। গায়ের ছেলেমেয়েরা দু’চারটে মৌসুমী ফল চোখে দেখলেও শহরের মধ্যবিত্ত অথবা নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনে মৌসুমী ফল আজ আকাশ কুসুমের মতই। নাম হয়তো সকলে জানে কিন্তু চোখে দেখার কোন উপায় নেই। বৈশাখ মাস প্রায় শেষ হতে চললো তবু আজ ফলের বাজারে আগুন। আগুন অবশ্য সর্বত্রই। এক হালি আমের দাম দেড় টাকা থেকে তিন টাকা। লিচুর শ’ সাড়ে চার টাকা থেকে সাত টাকা। কাঁঠালের দাম দশ টাকা থেকে আঠারো টাকা। এমনি আনুপাতিক হারে সব ফলের অবস্থাই এক।
মৌসুমী ফলে হাত দেবার কোন উপায় নেই। অথচ এদেশে মৌসুমী ফলের চাষ করার যে সুযোগ রয়েছে, তা আর অন্য কোথাও নেই। ফলের চাষের কথা যেন মানুষ ভুলতে বসেছে। আগের দিনে বয়স্ক ব্যক্তিরা নিজের বাড়ীতে বা আশে-পাশের জমিতে ফলের গাছ লাগানোকে একটা নিজস্ব দায়িত্ব ও কর্তব্য বলেই মনে করতেন। কিন্তু এখন করেন না। কেমন যেন একটা নিম্পৃহতা পেয়ে বসেছে।
প্রতি বছর বৃক্ষরোপণ সপ্তাহ উদযাপিত হয় ধুমধাম করে। গাছও দু’একটা লাগান হয়। তারপর থেকে সেই অবস্থা। লাগান গাছগুলো গরু-ছাগলে খায়। নয়তো অকালে শুকিয়ে যায় সার-পানির অভাবে।
এমনি অবস্থা যদি চলতে থাকে তাহলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে মৌসুমী ফল আর পাওয়া যাবে না। মৌসুমী ফল-একদিন স্বপ্নের ফলেই পরিণত হবে। আমরা মনে করি, এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে একটা সুষ্ঠু ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে। এগিয়ে আসতে হবে দেশের জনসাধারণকেও। শুধুমাত্র প্রতি বছর নিয়মমাফিক নামকাওয়াস্তে বৃক্ষরোপণ সপ্তাহ পালন করে এ সমস্যার সমধান করা যাবে না।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!