You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
৭ই মে, সোমবার, ১৯৭৩, ২৪শে বৈশাখ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

ভূমিহীনদের ভূমিদান

ভূমি সংস্কার, ভূমি প্রশাসন, বন, মৎস্য ও পশু পালন দপ্তরের মন্ত্রী জনাব আবদুর রব সেরনিয়াবাত ভূমিহীন চাষীদের মধ্যে জমি বন্টন শুরু হয়েছে বলে বাসস’র সঙ্গে সাক্ষাতকারে বলেছেন। তিনি তথ্য পরিবেশন করেছেন সরকার নির্ধারিত সর্বোচ্চ পরিমাণ জমিওয়ালার অতিরিক্ত জমি সমর্পণের মাধ্যমে পাওয়া ৭১ হাজার একর জমিসহ মোট পাঁচ লাখ ৩৩ হাজার একর জমি ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বন্টন করা হবে। এই জমির মধ্যে ৪ লাখ ৬২ হাজার একর খাস জমিও রয়েছে। তিনি আরো বলেছেন, প্রতি পরিবারকে দেড় একর এবং সমবায় গঠনে ইচ্ছুক পরিবার আড়াই একর করে জমি বন্টন করা হবে। বন্টনকৃত জমি ১৫ বছরের মধ্যে কৃষকরা বিক্রি করতে পারবে না এবং যারা আড়াই একর জমি পাবে তাদের আধ একর জমির বাজার দরের অর্ধেক মূল্য হারে সেলামী দিতে হবে এবং এই সেলামীর টাকা ১০ কিস্তিতে পরিশোধ করা যাবে। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর দল ভূমিহীন চাষীদের মধ্যে জমি বন্টনের কথা অনেকদিন আগে থেকে বলে এসেছেন এবং তাই সে নীতি যেমন দলের ম্যানিফেস্টোতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তেমনি নির্বাচনী ওয়াদাতেও উল্লেখ করা হয়েছিলো। সুতরাং ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে জমি বন্টন শুরু হওয়ার খবর বঙ্গবন্ধু তাঁর দল ও সরকারের আরেকটি প্রতিশ্রুতি পালনের প্রকৃষ্ট প্রমাণ। সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা বাস্তবায়নে আমাদের মত কৃষিপ্রধান দেশে কৃষি বিপ্লব বা সবুজ বিপ্লব অপরিহার্য। আর এই সবুজ বিপ্লব সংগঠনের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হচ্ছে সমবায় ও আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের মাধ্যমে ফলন বৃদ্ধি করা। সুতরাং সেদিক থেকে ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিনা মূল্যে জমি বন্টন করে তাঁদেরকে নিজ পায়ে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করা এবং সমবায় পদ্ধতিতে চাষাবাদ করার সুফল সম্পর্কে আমাদের কৃষকদের অবহিত ও উৎসাহিত করা সরকারী পদক্ষেপকে আমরা সাধুবাদ জানাই। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এই কথাটিও বলে রাখতে চাই, সবুজ বিপ্লবের প্রথম স্তরের এই পদক্ষেপ যেন এতটুকু ক্রুটি না থেকে যায়। দেশে একটি নতুন ব্যবস্থা বাস্তবায়নের পথে স্বজন-প্রীতি কিংবা অন্য কোন প্রকার দুর্বলতার জন্যে যেন বৃহত্তর কল্যাণের বিঘ্ন না ঘটে। চুলচেরা বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রকৃত ভূমিহীন চাষীদের মধ্যে জমি বন্টনের ব্যাপারে সরকারকে তাই আমরা অত্যন্ত সজাগ দৃষ্টি রাখার অনুরোধ জানাই।

বস্তি প্রসার রোধে—

ঢাকা নগরী বর্তমানে অননুমোদিত বস্তিতে ঢাকা পড়বার উপক্রম হয়েছে। রাস্তার ধারে, রেল লাইনের দু’ধারে, খোলামাঠের বুকে, সর্বত্র বস্তি গড়ে উঠছে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে জীবিকার সন্ধানে আগত ছিন্নমূল অসহায় মানুষগুলোই শহরের এই ক্রমবর্ধমান বস্তির বাসিন্দা।
সঠিক হিসেব না পাওয়া গেলেও নগরীর বুকে বিভিন্ন এলাকায় যে বস্তিগুলো গড়ে উঠছে তার খুপড়ীর সংখ্যা কমপক্ষে এক লাখ বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে। অনুমান করতে কষ্ট হয় না যে, প্রায় এক লাখ খুপড়ীতে অন্ততঃ কয়েক লাখ মানুষ বাস করে। এরা কারা?
প্রথম কারণস্বরূপ বলা যায়, কৃষিভিত্তিক গ্রাম বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক দৈন্য। গ্রামের মানুষ অধিকাংশই কৃষির উপর নির্ভর করে চলে। এই কৃষিকাজ বিগত সংগ্রামের সময়ে চূড়ান্তভাবে বাঁধাপ্রাপ্ত হয়েছে। তার উপর অনুন্নত কৃষি ব্যবস্থার জন্য ফসলের স্বল্পতা আছে। আরো আছে প্লাবন, অনাবাদ, ঋণের দায়ে জমির হস্তান্তর ইত্যাদি। সর্বোপরি হানাদার বাহিনীর অত্যাচারে স্থাবর অস্থাবর সহায় সম্পত্তি প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এই ধ্বংসের প্রেক্ষিতে ভিটা কামড়ে থাকার আকর্ষণটাও তাদের দিন দিন ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়েছে। অতএব ঐ সব ছিন্নমূল অসহায় লোকগুলো অগত্যা নগরমুখী হয়েছে জীবিকার সন্ধানে। তার ফলে বস্তিগুলো ভরে উঠেছে ও বেড়ে চলেছে।
দ্বিতীয় কারণস্বরূপ বলা যায়—শহরের জীবন ও জীবিকার বৈচিত্র্য গ্রাম্য মানুষদের চিরকাল হাতছানি দিয়েছে। অতএব যারা ছোট খাট কাজ করে গ্রামেই জীবন কাটাতো, তারা বর্তমানের অর্থনৈতিক ধাক্কায় ছিন্নমূল তরুর মত নগরের বস্তি পাদমূলে এসে পড়েছে। এরা অন্নবস্ত্র সংগ্রহের দুরাশায় বস্তি এলাকায় বাস করে নানাবিধ জীবিকার সন্ধানে ঘুরছে। অতএব বস্তি বাড়ছে। এবং শহরের নানা অঞ্চলে তা ছড়িয়ে পড়ছে। বস্তি প্রসার রোধে তাই এর মূল কারণগুলো খুঁজে বের করবার সঙ্গে সঙ্গে তা সমাধানে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যদিও একথা সত্যি যে বস্তিগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নানারকম মারাত্মক সংক্রামক ব্যাধি বিস্তার করে থাকে তবুও বিকল্প কোন সমাধান খুঁজে না বের করে এদের উৎখাত করা যায় না।
অর্থনৈতিক কারণই হ’লো বস্তি প্রসারের মূল কথা। তাই বস্তি প্রসার রোধের কথা চিন্তা করতে গেলে ঐ পথেই করতে হবে। কৃষি প্রধান বাংলাদেশের গ্রামীণ মানুষদের জীবনে অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যের ইশারা এনে দিতে হবে।
আশার কথা এই যে, সরকার ইতিমধ্যেই নানাবিধ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে বস্তি লোকদের জন্য ফ্লাট নির্মাণ, কৃষকদের জন্য সরাসরি ঋণদানের ব্যবস্থা, কুটির শিল্প ও ক্ষুদ্র-শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, ভূমিহীন চাষীদের মধ্যে জমি বন্টন ইত্যাদি।
ইতিমধ্যেই ভূমিহীন চাষীদের মধ্যে জমি বন্টনের কাজ শুরু হয়েছে। অন্যান্য পরিকল্পনাগুলোও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাস্তবায়িত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এর ফলে গ্রামের মানুষ নিজ নিজ ভিটা মাটি কেন্দ্র করে নতুন অর্থনৈতিক সমাজ গড়ে তুলবার প্রয়াস নেবে এবং শহরে বস্তির প্রসার রোধ হবে। শহর ও গ্রামের জীবনে ফিরে আসবে এটা আনুপাতিক ভারসাম্য।

গণ আন্দোলনের ডাক

সমস্যা দিনে দিনে জটিল হয়ে উঠছে। খাদ্য সমস্যা তো রয়েছেই তার উপরে দুর্নীতি, স্বজন-প্রীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এমনকি রাষ্ট্রীয় আদর্শের মূলেই কুঠারাঘাত হানার প্রায় প্রকাশ্য প্রস্তুতি জনমনে হতাশা আর ব্যাপক নৈরাজ্যের সৃষ্টি করে চলেছে। দেশের ভবিষ্যত চিন্তার আশার অংশটা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে চলেছে। প্রতিক্রিয়াশীল চক্রান্তের সংঘবদ্ধ ক্রিয়াকর্মের মুখে প্রগতিশীল শক্তিকে যেন অসহায় মনে হচ্ছে। স্বাধীনতা জনসাধারণের সামনে যে প্রতিশ্রুতি রেখেছিলো ইতিমধ্যেই তা যেন হাওয়ার উপর ভর করে চলতে শুরু করেছে।
দেশব্যাপী এই হতাশা আর সংকটের মুখে প্রগতিশীল ছাত্র সমাজ গণ-আন্দোলনের আহ্বান জানিয়েছে। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এবং বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন দশদফা কর্মসূচীর ভিত্তিতে দেশপ্রেমিক শক্তিসমূহকে সকল প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হবার ডাক দিয়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবং সরকারে কলকারখানা জাতীয়করণ নীতি সফল করার কার্যকরী কিছু পদক্ষেপও তাঁরা গ্রহণ করেছেন। ছাত্র সমাজের এ ভূমিকা অভিনন্দনযোগ্য।
মূলতঃ প্রগতিশীল শক্তিসমূহের নিষ্ক্রিয়তা প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে অবাধে গণবিরোধী কার্যকলাপ চালিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করেছে। সরকারের তরফ থেকে এদের প্রতিরোধের কোন কার্যকরী ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। হুমকি-হুঙ্কার-ধ্বনির মধ্যেই সবকিছু তলিয়ে গেছে। জনগণের দুর্ভোগ লাঘব হয়নি, দেশের সম্পদ পাচার বন্ধ হয়নি। সমাজতন্ত্রকে মূল লক্ষ্য হিসেবে নিয়ে স্বাধীনতা উত্তরকালেই যে নীতি-পরিকল্পনাগুলো ঘোষণা করা হয়েছিলো তাকে নস্যাৎ করবার জন্য অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে প্রচার ও কর্মকান্ড চালানো হয়েছে। উঠতি পুঁজিপতি-আমলা-সামাজিক শত্রুদের সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা প্রতি পদে পদে সরকারকে জনসাধারণের সামনে হেয় প্রতিপন্ন করতে সহায়তা করেছে। এদেশে আন্তর্জাতিক চক্রান্তের প্রতিভূরা ভ্রাতৃপ্রতিম রাষ্ট্রসমূহের বিরুদ্ধে কুৎসা রচনা করে জনগণকে তাদের বিরুদ্ধে বিদ্বিষ্ট করে তুলেছে।
বাংলাদেশের ছাত্র সমাজ অতীতেও সকল গণ-বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম সোচ্চার হয়েছে। স্বাধীনতা উত্তরকালেও যখন রাজনৈতিক সংগঠনসমূহ স্রোতের অনুকূলে গা এলিয়ে চলার নীতি গ্রহণ করেছে তখন ছাত্র সমাজের এই আন্দোলনের ডাক জনসাধারণের মনে নতুন আশার সঞ্চার করবে বলে আমাদের বিশ্বাস। ছাত্রসমাজের কাছে আমাদের আবেদন তারা যেন এই আন্দোলনকে অত্যন্ত সুসংগঠিত এবং সমন্বিতরূপে এগিয়ে নিয়ে যান। কোন রকম হঠকারিতা অথবা বিশৃঙ্খলা তাদের আন্তরিক ইচ্ছার বিপরীতেই কাজ করবে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!