বাংলার বাণী
২৫শে মে, শুক্রবার, ১৯৭৩, ১১ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
আমাদের আত্মার অস্তিত্বে নজরুল
আজ বাংলার বুলবুল বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের পঁচাত্তরতম জন্ম দিবস। স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে দ্বিতীয় বারের মতো কবির জন্ম দিনে বাংলাদেশে ছিলেন আজো আছেন। বিদ্রোহী বাংলার মাটিতে কবি নজরুলের স্বয়ং উপস্থিতি সেদিন যেমন একটি বিশেষ আবেদর সৃষ্টি করছিল আজো তেমনি একটি বিশেষ তাৎপর্য বহন করছে। কবির প্রিয় বাংলাদেশে ও স্বপ্নের তীর্থ স্থানে একদিন তিনি দীপ্ত পদভারে চঞ্চল হয়ে উঠেছিলেন। একদিন তিনি এদেশের মানুষ আর মাটির সঙ্গে নিবিড় আত্মীয়তা গড়ে তুলেছিলেন। আজ ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে মূক ও বধির কবির গানের বুলবুলিরা যেন এই সোনার মাটিতে আর সেদিনের আবাহন জাগাতে পারছেনা। স্বাধীন বাংলার রক্ত ভেজা মাটিতে সেদিন কবির যে নবপদার্পণ হয়েছিলো, তাতে নতুন জন্মলাভ করেছিলো বাংলার মাটি ও মানুষ। আজ একটি বছর পর কবির উপস্থিতিতে আবার তাঁর জন্মতিথি পালন করতে গিয়ে এদেশের মানুষ নতুন স্পন্দন অনুভব করছে হৃদয়ে। বাংলাদেশের হৃদয়ে কবিগুরুর অস্তিত্ব যেমন সত্য, তেমনি সত্য কাজী নজরুল ইসলামের অস্তিত্ব। কালের প্রবাহে ঘটনার পরিক্রমায় যতই পরিবর্তন সাধিত হোক না কেন, নজরুল আমাদের আত্মার অস্তিত্বে লীন হয়ে থাকবে চিরকাল।
কবি নজরুলকে আমরা বাংলাদেশের নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের বিদ্রোহী কন্ঠস্বর বলে জানি। কবির সারাজীবনের সাধনায় যে মানুষ ও প্রকৃতি ধরা পড়েছে তারা আমাদেরই জীবনের সাথী। বাংলার রূপ-রস-শব্দ-গন্ধের মূর্ত প্রতিনিধি তারা। কবি নজরুলই সেই হৃদয় যে হৃদয়ে রয়েছে এক অপার, সাগর যার ব্যাপ্তি যুগ আর কালকে অতিক্রম করে অনিন্দ্য সৌন্দর্য্যলোকের পানে উৎস্বর্গীকৃত হয়েছে। মানুষের কবি, মানবতার কবি নজরুল। অসহায় নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের একান্ত সঙ্গী কবি। তাঁর কাব্য সাধনার মূলকথা ছিলো মানুষ—পান্ডুব অসহায় মানুষ। দুর্দিনে দুর্গশিরে বিজয় কেতন উড়ানোর মহান ব্রত নিয়ে তিনি সাহিত্য বাসরে আগমন করেছিলেন। তাঁর সাধনার শাশ্বত রূপে মুগ্ধ হয়ে কবিগুরু হৃদয়ের সকল আয়োজন দিয়ে আশীর্বাদ করে লিখেছিলেন :
আয় চলে আয় ধূমকেতু
আঁধারে বাঁধ অগ্নি সেতু
দুর্দিনের ঐ দুর্গশিরে—
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।
বাংলাদেশের বিভিন্ন সংগ্রামে কবি নজরুল ইসলাম বিদ্রোহী সত্তা হিসেবে আমাদের মাঝে প্রকাশিত হয়েছে বার বার। এই মাটির কাছের কবি বাংলার অকৃত্রিম বন্ধু বুলবুল নজরুল বিধ্বস্ত বাংলার মাটির মানুষের মাঝে রয়েছেন। তাঁর জন্মদিনে তাই আমরা বাংলার উৎপীড়িতের ক্রন্দনের মুখ দাঁড়িয়েও আমরা আনন্দে উদ্বেল হই। বাংলার কৃষক, বাংলার কুলি মজুর অনন্ত দুঃখ বেদনার মধ্য থেকেও কবিকে নিজেদের মাঝে পাবার আনন্দে আত্মহারা আজ।
বিগত পাকিস্তান আমলে বিদ্রোহী কবি নজরুলকে নিয়ে অনেক নষ্টামী হয়ে গেছে। স্বাধীনতাত্তোর বাংলার মাটিতে কবিকে নিয়ে কোন অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলের উপায় নেই। তবে কবির জীবন আলেখ্য ও রচনা সম্ভারকে কতটুকু চিরঞ্জীব করার কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে তা বিবেচ্য। প্রতিবারের জন্মদিনে কবিকে আমরা নানা কথা দিয়ে তার বিভিন্ন গান গেয়ে বরণ করে থাকি। কিন্তু প্রতিবারের জন্মদিনে কবির রচনা সম্ভার বা জীবনালেখ্য নিয়ে কোন মূল্যবান তথ্যযুক্ত গ্রন্থ প্রকাশ করিনা। কবিকে চিরকালের মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার জন্যে তেমন উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টার প্রয়াস পাইনা। একটি চিরাচরিত নিয়মের অনুসারী হয়ে আমরা কবির জন্ম দিনকে বরণ করি। এ ব্যাপারে ব্যক্তি উদ্যোগের চাইতেও সরকারী উদ্যোগের প্রয়োজন বেশী। নজরুল সম্পর্কে ব্যাপক গবেষণা ও বিস্তৃত আলোচনার প্রয়োজন আজ সবচেয়ে বেশী। সর্বোপরি বাংলাদেশে কবির যে বিরাট কর্মক্ষেত্র রয়েছে, যা আমাদের জাতীয় ইতিহাসের মূল্যবান সম্পদ তাকে চিরস্থায়ী করার আবশ্যকতা অনস্বীকার্য।
সময়ক্ষেপণ না করে কবির সাহিত্য ও ব্যক্তিজীবনের ইতিহাস চিরস্থায়ী করে ধরে রাখার জন্যে অবশ্যই সরকারকে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে কবি নজরুল এক চিরস্মরণীয় প্রতিভা। ঝড়ের বেগে তিনি রবীন্দ্র মহাবর্তের কালেও নিজের অনুপ্রবেশ শাশ্বতঃরূপে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। বিশ্ব-সাহিত্যের ইতিহাসেও এমন নিঃশঙ্কচিত্তের দাবীদার কবির সংখ্যা স্বল্প। তেত্রিশ কোটি মানুষের মুখের গ্রাস যারা একদিন কেড়ে নিতো, তাদের বিরুদ্ধে সকল অনাচার অবিচারের বিরুদ্ধে দুর্জয় প্রতিবাদ বিশ্ব সাহিত্যেও বিরল। সত্য ভাষণে এমন নির্ভিকতার আর তুলনা হয়না। ‘যা অন্যায় তাকে অন্যায় বলে বুঝেছি, অত্যাচারকে অত্যাচার বলেছি, মিথ্যাকে মিথ্যা বলেছি। কারো তোষামোদ করি নাই। প্রশংসা বা প্রসাদের লোভে কারো পিছনে পোঁ ধরি নাই। আমি শুধু রাজার অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করি নাই, সমাজের, জাতির, দেশের বিরুদ্ধেও আমার তরবারীর তীব্র আক্রমণ সমান বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে।’
কবির এই বিদ্রোহী বাণী শতবর্ষ পরেও নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের স্বপক্ষে তীব্র তরবারী হয়ে শোষকের বিরুদ্ধে সোচ্চারিত হবে। স্থবির নজরুল জড় নজরুলের বেষ্টনি ভেদ করে যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশের কন্ঠে হবে তার সরব আত্মপ্রকাশ সকল অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে। বাংলার আবহমান সংস্কৃতি ও নজরুল তাই অভিন্ন সত্তা।
এই শ্রদ্ধা এবং মর্যাদা যেন অক্ষুন্ন রাখতে পারি
শান্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রসেনা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গত পরশু আনুষ্ঠানিকভাবে জুলিও কুরি পদক প্রদান করা হয়েছে। এশীয় শান্তি সম্মেলনের এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন দেশ বিদেশের সম্মানিত প্রতিনিধিবৃন্দ; বিশ্বশান্তি আন্দোলনে যাদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গবন্ধু শুধু ব্যক্তিগতভাবেই নয়, এই পদক গ্রহণ করেছেন বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে, তাঁর নিজের ভাষায় বলতে গেলে এ পদক শুধু তাঁর নয়, এ পদক বাংলার মানুষের। পদক প্রদান অনুষ্ঠানে বিশ্বশান্তি পরিষদের সেক্রেটারী জেনারেল শ্রী রমেশ চন্দ্র জুলিও কুরি পদক বিশ্বশান্তির জন্য বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সংগ্রামের স্বীকৃতি বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বিশ্বশান্তি পরিষদ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও অবদানের জন্য এই সর্বোচ্চ শান্তি পদক প্রদান করেছে।
বঙ্গবন্ধু তথা বাংলার মানুষের সংগ্রামী চেতনা আজ বিশ্বনন্দিত। বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ এবং সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত লাখো মুক্তিসেনা বাংলাকে ছালাম জানায় আন্তরিক শ্রদ্ধার্ঘ দিয়ে। সংগ্রামের রক্তাক্ষরে আজ বিশ্বের যে দু’টি দেশের নাম পাশাপাশি লেখা হয় তার একটি ভিয়েতনাম এবং অন্যটি বাংলাদেশ। স্বাধীনতা উত্তরকালে পৃথিবীর প্রগতিশীল রাষ্ট্রসমূহের সাহায্য এবং সহযোগিতায় বাংলাদেশ আজ সমাজতন্ত্রের উত্তরণের পথে পা বাড়িয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সে সংগ্রামেও নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সমুজ্জল সুর্যের প্রত্যাশায় বাংলার প্রগতিশীল মানুষ সমাজতন্ত্র বিনির্মাণের কাজে নিজ নিজ শ্রম-মেধা নিয়ে এগিয়ে আসছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, তাঁর সমাজতন্ত্র বিনির্মাণের সংগ্রাম এ দু’টোরই মূল লক্ষ্য শান্তি প্রতিষ্ঠা। শান্তি জনগণের জন্য, শান্তি বিশ্বরাষ্ট্রসমূহের জন্য। স্বাধীনতা উত্তরকালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় এবং পররাষ্ট্রনীতি এই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই নির্ধারিত হয়েছে। আমরা এমন চেয়েছি প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ এবং বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক তেমনি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চেয়েছি পারস্পরিক সহযোগিতা। অস্ত্র প্রতিযোগিতার উন্মত্ত খেলা বন্ধ রেখে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসবার জন্য বৃহৎ শক্তিবর্গের প্রতি বার বার আকুল আবেদন জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু স্বয়ং। দক্ষিণ এশিয়ার এই অঞ্চলে বিরাজমান বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে যুক্তিযুক্ত প্রস্তাব রেখেছেন তিনি। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদীদের সহায়তায় পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসক সম্প্রদায় সে প্রস্তাবকে অগ্রাহ্য করে এতদঞ্চলে স্থায়ী অশান্তি জিইয়ে রাখার জন্য নানা কৌশলে ব্যাপৃত।
উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার সকল প্রয়াস নস্যাৎ করার জন্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহই শুধু নয়, মদদ যোগাচ্ছে চীনের মাওবাদী নেতৃত্ব। এদের দোসরেরা দেশের বাইরে এবং ভিতরে থেকে বাংলাদেশ তথা সমগ্র উপমহাদেশে অশান্তির আগুন জ্বালানোর অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এশীয় শান্তি সম্মেলনে যখন উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন কার্যকরী ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, যখন পাকিস্তানে আটক বাঙালীদের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র থেকে আগত প্রতিনিধিবর্গ সোচ্চার বক্তব্য রাখতে চলেছেন, তখন এই চীন-মার্কিন চক্রান্তকারীদের দোসররা শান্তি সম্মেলন বানচাল করার জন্য এক হীন ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছিলেন। জনগণের তীব্র প্রতিরোধের মুখে তারা অবশ্য বেশীদূর এগুতে পারেনি। কিন্তু সে ষড়যন্ত্রের বীজ রয়ে গেছে।
বঙ্গবন্ধুকে বিশ্বশান্তি পরিষদ শান্তির জন্য তাদের সর্বোচ্চ পদক প্রদান করে সংগ্রামী বাংলার মানুষকে যে শ্রদ্ধা এবং মর্যাদা প্রদর্শন করেছে তাকে অক্ষুন্ন রেখে আমাদের অসমাপ্ত কাজকে আজ এগিয়ে নিয়ে যাবার শপথ গ্রহণ করতে হবে। সকল প্রতিবিপ্লবী এবং প্রতিক্রিয়াশীল তৎপরতা নস্যাৎ করে দেশকে সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য সর্বান্তঃকরণে পরিশ্রম করতে হবে। যেদিন বাংলার মানুষের দ্বারে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সামাজিক সাম্যের ফল পৌঁছিয়ে দেয়া সম্ভব হবে, যেদিন ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের মুখে সকল প্রতিক্রিয়াশীলতার দুর্গ ধসে পড়বে, একমাত্র সেই দিনই বাংলা তথা বিশ্বে শান্তির শ্বেত কপোতেরা নির্ভয়ে ডানা মেলে উড়তে পারবে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক