বাংলার বাণী
২৭শে মে, রবিবার, ১৯৭৩, ১৩ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
ঐতিহাসিক ‘ঢাকা ঘোষণা’
গত শুক্রবার এশীয় শান্তি সম্মেলন সমাপ্ত হয়েছে এবং সম্মেলন শেষে প্রকাশ করা হয়েছে ‘ঢাকা ঘোষণা’। চারটি মৌলনীতির ভিত্তিতে এ ঘোষণা রচিত। ঢাকা ঘোষণায় প্রকাশ করা হয়েছে, এশিয়াকে কোন অবস্থাতেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর হাতের ক্রীড়নক হতে দেওয়া হবে না। এশিয়ার দেশগুলোর স্বার্থে এশিয়ার দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে এবং এশিয়ার বুকে সাম্রাজ্যবাদী হামলা ও ঔপনিবেশিক শোষণ চিরতরে বন্ধ করতে হবে। ঢাকা ঘোষণায় আরো হয়েছে, এই মহাদেশে সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর নীতি হচ্ছে এশীয়দের বিরুদ্ধে এশীয়দের লেলিয়ে দেওয়ার রীতি। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদীদেশগুলো এশিয়ায় তাদের লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে এবং এশিয়ায় সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের ভিত ধসে গেছে। এশিয়ার বিপ্লবী শক্তিগুলো সাম্রাজ্যবাদী শক্তির উপর মরণ কামড় হেনেছে এবং নবতর বিজয়ের গৌরব শিখরে উন্নীত হচ্ছে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় এশিয়ায় মার্কিন স্ট্রাটেজির চরম বিপর্যয় বলে ঢাকা ঘোষণায় অভিহিত করা হয়েছে। ঢাকা ঘোষণায় বলা হয়েছে, ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভারত ও বাংলাদেশ এবং ভারত ও ইরাকের মধ্যে শান্তি মৈত্রী আর সহযোগিতার যে চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে তা এশীয় দেশগুলোর মধ্যে শান্তি ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে এক উল্লেখযোগ্য অবদান।
এশীয় শান্তি সম্মেলন শেষে প্রকাশিত ঢাকা ঘোষণা অবশ্যই বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার সহায়ক পদক্ষেপ। এশীয় মহাদেশে শান্তির জন্যে এশীয় দেশগুলোর মধ্যে দৃঢ় ঐক্যের সম্পর্ক অবশ্যই স্থাপন করা দরকার। কিন্তু যারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি তারাই দক্ষিণ এশিয়ায় উত্তেজনা প্রশমনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে বলে ঢাকা ঘোষণায় উল্লেখ করা হয়েছে। ভারত উপমহাদেশ শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানকে সুনিশ্চিত করার জন্য ভারত উপমহাদেশকে একটি শান্তির এলাকা হিসেবে ঢাকা ঘোষণায় অভিহিত করা হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তান যদি উত্তেজনা ও বিরোধ অব্যাহত রাখে, তাহলে তা বিশ্বের সকল শান্তিকামী শক্তির কাছে দারুণ উদ্বেগের কারণ হয়ে থাকবে। ‘ঢাকা ঘোষণা’ তাই শান্তিকামী বিশ্ব শক্তিগুলোর কাছে একটি স্বস্তিকর ঘোষণা। এই ঘোষণা তাই এশিয়া মহাদেশে শান্তির পথ প্রশস্ত করবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। এশীয় শান্তি সম্মেলন যে ‘ঢাকা ঘোষণা’ প্রকাশ করেছে, তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। আমরা আশা করি, এশীয় দেশগুলো ঢাকা ঘোষণার প্রতি শ্রদ্ধাশীল মনোভাব গ্রহণ করে এই ঐতিহাসিক ঘোষণার বাস্তবায়ন সাধন করতে তৎপর হবে এবং এ পথেই এশিয়ায় শান্তির লক্ষ্য অর্জিত হবে—এশীয় নিরাপত্তা হবে ক্রমাগত জোরদার। আমরা ‘ঢাকা ঘোষণা’র সার্বিক সাফল্য কামনা করি।
অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা
অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা আমাদেরকে অর্জন করতেই হবে। নইলে জাতীয়তাবাদ এবং অর্থনৈতিক যে কারণে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি সে স্বাধীনতা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। বহু কষ্টে অর্জিত আমাদের সে স্বাধীনতা বিফল হতে দেওয়া যায় না কোন কিছুতেই; সুতরাং যতদিন আমরা আত্মনির্ভর না হতে পারবো ততদিন আমাদের স্বাধীনতা লাভও পূর্ণাঙ্গ হবে না।
বিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মেরুদন্ড ভেঙে পড়েছে একথা আমরা সবাই জানি। সরকারও একথা স্বীকার করেন এবং অর্থনৈতিক সংকটকে কাটিয়ে উঠার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
স্বাধীনতা লাভের পর বিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন এবং উপস্থিত প্রয়োজন জরুরী ভিত্তিতে মেটানোর জন্যে বন্ধুদেশগুলো বিভিন্ন প্রকার দীর্ঘ ও স্বল্পমেয়াদী ঋণ এবং সাহায্য দ্রব্য দিয়েছেন। সেই সব ঋণ এবং সাহায্যের প্রেক্ষিতে অর্থনৈতিক বিপর্যয়কে কিছুটা কাটিয়ে উঠা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু সেই সঙ্গে একথাও না বলে উপায় নেই বন্ধুদেশগুলো থেকে ইতিপূর্বে যে সব ঋণ ও সাহায্য পাওয়া গিয়েছিলো, সেগুলো যথাযথভাবে ব্যবহৃত হয়নি। দরপত্রের দরকষাকষি এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক কার্যকারণে অযথা বিলম্ব এবং ব্যবসায়ীদেরকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সুতরাং যে জিনিস যে সময়ে আমদানী করা উচিত ছিলো কিংবা যে দ্রব্য যখন রফতানী করা সঙ্গত ছিলো তা যথাসময়ে হয়নি। ফলে অর্থনৈতিক সংকটেরও উন্নতি ঘটতে পারেনি। উপরন্তু নিজেদের দায়িত্বহীনতার কারণে কোন কোন ক্ষেত্রে সাহায্য প্রদানকারী বন্ধুদেশগুলোর প্রতি দোষারোপ করে বিপক্ষ রাজনৈতিক দল জনগণের মধ্যে একটা ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টি করবার প্রয়াস পেয়েছে।
বন্ধুরাষ্ট্র ভারত আগামী বছরগুলোর জন্য ষাট কোটি টাকা প্রদানের কথা ঘোষণা করেছে। এই অর্থের মধ্যে ২৫ কোটি টাকা সহজ বাণিজ্যিক শর্তের ঋণ, ১০ কোটি টাকা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সংগ্রহের জন্য, ৬ কোটি টাকা দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প ঋণ বাবদ এবং ৪ কোটি টাকা সাহায্য হিসেবে প্রদান করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশে তীব্র কাপড় সংকটের কথা বিবেচনা করে শাড়ী, লুঙ্গিও সূতি কাপড় ক্রয়ের জন্য ১৫ কোটি টাকার স্বল্পমেয়াদী ঋণ দিতেও ভারত রাজী হয়েছে। আগেই বলা হয়েছে কেবলমাত্র আমদানী করে উপস্থিত সংকট দূর করা যেতে পারে সত্য; কিন্তু ভবিষ্যতের দূরবস্থাকে সম্পূর্ণ দূর করা যাবে না, যতক্ষণ না অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জন করা যাবে। অবশ্য এই আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতি গড়ে তোলা অকস্মাৎ সম্ভবও নয়। এর জন্য পর্যাপ্ত সময়েরও প্রয়োজন। সুতরাং এই সময়টুকুতে জনগণকে যেমন কৃচ্ছ্র সাধনার মাধ্যমে ধৈর্য ধরতে হবে, তেমনি দেশের স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলার জন্য নিজ নিজ দায়িত্বে সর্বদা সজাগ ও তৎপর থাকতে হবে।
বন্ধুদেশ ভারত থেকে যে সাহায্য এবং ঋণ পাওয়ার আশ্বাস পাওয়া গেছে, সেগুলো যাতে দরপত্র দরকষাকষি বা অনুরূপ কোন কারণে অতীতের ন্যায় অসময়ে ব্যবহৃত না হয়, সেদিকেও সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। নইলে ঋণ ও সাহায্য পেয়েও নিজেদের অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার জন্য আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি না করতে পারলে অন্যান্য বন্ধুরাষ্ট্রগুলো প্রয়োজনীয় ঋণ ও সাহায্য প্রদানে উৎসাহী হবে না। অতএব দেশের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জনের জন্য সকলের কর্মতৎপরতা আমাদের আন্তরিক কাম্য।
গ্রামীণ জীবনই সংস্কৃতির বিষয়
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়কমন্ত্রী জনাব ইউসুফ আলী সম্প্রতি চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ের বার্ষিক প্রদর্শনী উদ্বোধন উপলক্ষে এক ভাষণ দিয়েছেন। ভাষণে তিনি শিল্পীদেরকে জীবনের বাস্তব ছবি তুলে ধরার আহ্বান জানিয়েছেন। বাংলাদেশের সংস্কৃতি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি উল্লেখ করেন দেশজ সংস্কৃতির কথা। বাংলার আবহমান ঐতিহ্য বিজড়িত সংস্কৃতির কথা। আমাদের দেশের শিল্পীদের তুলির আঁচড়ে যাতে করে অকৃত্রিম দেশজ সংস্কৃতির রূপায়ণ ঘটে শিক্ষামন্ত্রী সেদিকটার উপর সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব আরোপ করেন। শুধু চারু ও কারু শিল্প সম্পর্কেই নয়, দেশের প্রতিটি শিল্প বা আর্ট সম্পর্কেই শিক্ষামন্ত্রীর উল্লেখিত বক্তব্য প্রযোজ্য। স্বাধীনতার পর প্রথমবারের মতো আমরা সর্বান্তঃকরণে সরকারী আহ্বান পেয়েছি প্রাণভরে আপন শিল্প ও সংস্কৃতির সেবার করার। ইতিপূর্বে পাকিস্তান আমলে বাংলা সংস্কৃতিকে কর্তৃপক্ষ যথাযথ মর্যাদা দেয়নি। বাংলার আবহমান রূপ-রস-গন্ধকে প্রাণভরে ভালোবাসতে পারেনি বাঙালীরা। তৎকালীন কর্তৃপক্ষ বাংলার মানকে চিরতরে নিমজ্জিত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলো। কেননা, তারা জানতো এদেশের নিজস্ব সংস্কৃতি সৌন্দর্যকে যদি বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে দেওয়া যায়, তাহলে তাদের সমূহ বিপদ হবে। শত চেষ্টা করেও ইতিহাসের অমোঘ নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটাতে পারেনি তারা। বাংলার মাটি আর মানুষের সংস্কৃতি আজ সকল আগল মুক্ত। দেশের স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গেই শিল্প সংস্কৃতি তার স্বমর্যাদা ফিরে পেয়েছে। মর্যাদা বা সম্মান ফিরে পেলেই যে সব পাওয়া হয়না তার প্রমাণ আমরা জানি। কেননা যখন কোন বিষয় দুর্জেয় থাকে, তখন তার প্রতি মোহ বা আকাঙ্ক্ষা বেড়ে যায়। সংস্কৃতি আজ আগলমুক্ত বলেই বোধ করি সংস্কৃতিসেবীদের সকল আগ্রহ আজ স্তিমিত হয়ে গেছে। সবাই যেন যেমন খুশী তেমনি একটা মার্কা এঁটে সংস্কৃতির সেবা করে চলেছেন। এবং শিল্পের নামে পয়সা কামানোয় মত্ত হয়ে উঠেছেন। দেশের শিল্প ও সংস্কৃতি কেমন হবে তার দিক নির্ণয় সরকার করেননি। ফলে যার যেমন খুশী তেমন একটা মনগড়া সংস্কৃতির ছবি এঁকে নিচ্ছে। আমরা ইতিপূর্বেও শুনেছি—শিল্প-সংস্কৃতি হবে দেশজ ঐতিহ্যের প্রতিচ্ছবি। এদেশের গ্রাম বাংলার আমূর্ত রূপ-রস-সৌন্দর্য নির্ভর। কিন্তু সবাই কি সে কথা বিশ্বাস করে? আমরা মনে করি সবাই করে না। অনেকেই তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক আদর্শের মাপকাঠিতে ঢেলে সংস্কৃতিকে উজ্জীবিত করার প্রয়াস পাচ্ছেন। গ্রাম বাংলার কথা ভুলে সবাই প্রায় শহরের কৃত্রিম জীবনাশ্রয়ী সংস্কৃতিকে সমুজ্জ্বল করার প্রাণান্ত প্রয়াস পাচ্ছেন। সরকারী কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই এ ব্যাপারে একটি দিক নির্দেশ করে দিতে হবে। সমাজতান্ত্রিক দেশে এটা নতুন কিছু নয়। আমরা মনে করি, দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পটভূমিকার সংস্কৃতির মানদন্ড গড়ে উঠবে। গ্রামীণ জীবন নির্ভর শিল্প হবে আমাদের সংস্কৃতির বাহন।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক