You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
২৬শে মে, শনিবার, ১৯৭৩, ১২ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

একটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী জনাব এ.এইচ.এম. কামরুজ্জামান গত পরশুদিন বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমিতির উদ্যোগে আয়োজিত এক সম্বর্ধনা সভায় ভাষণ দিয়েছেন। অনুষ্ঠানে তিনি প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখতে গিয়ে ঘোষণা করেছেন যে, সরকার অবিলম্বে মধ্যসত্ব বিলোপের কর্মসূচী বাস্তবায়িত করবেন। দেশের প্রকৃত ক্রেতাদের কাছে সরাসরি দ্রব্য বিতরণের নিশ্চয়তাদানের জন্যে মধ্যসত্ব বিলোপের কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। সরকার ইনডেনডিং প্রথা, ফড়িয়া ও সকল প্রকার মধ্যবর্তী ব্যবসায়ীদের উচ্ছেদ করার জন্যে উল্লেখিত এই পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। বাণিজ্যমন্ত্রী জনাব কামরুজ্জামান উক্ত সভায় আরো উল্লেখ করেছেন যে, ভুয়া লাইসেন্স পারমিটধারীদেরকে ফৌজদারী আদালতে সোপর্দ করা হবে এবং তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বাণিজ্যমন্ত্রী দেশী উৎপাদিত ও আমদানীকৃত দ্রব্যাদি সরাসরি জনগণের হাতে পৌঁছে দেবার জন্যে মধ্যসত্ব বিলোপের যে দৃঢ়প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন তা অত্যন্ত মূল্যবান ও সমাজতান্ত্রিক জীবনের প্রেক্ষিতে সুদূরপ্রসারী। বেশ কিছুদিন ধরে আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক গৃহীত কতকগুলো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ সবিশেষ লক্ষ্য করে আসছি। যেমন ইতিপূর্বে এগারোই মে তারিখে বাণিজ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন যে, দেশে পনেরো হাজার লাইসেন্স ভুয়া রয়েছে। ভুয়া লাইসেন্সধারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও তিনি জানিয়েছেন। একইদিনে আরো জানিয়েছেন যে, আগামী পাঁচ বছরে বিদেশ থেকে বিলাস দ্রব্য ও দামী কাপড় আমদানী করা হবে না। এছাড়া পূর্বাহ্নেই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সর্বমোট ১৭৭ জন ভুয়া ও অসৎ ডিলারের ডিলারশীপ বাতিল করে দিয়েছে। এদের কিছু সংখ্যকের বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করা হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে আমদানী ও রফতানী বিভাগ সম্প্রতি এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছিলেন যে, যারা উক্ত বিভাগ থেকে প্রচারিত জরিপ প্রশ্নপত্র পূরণ করে ফেরত দেয়নি, তাদের লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে। অসৎ ব্যবসায়ীদের কবল থেকে জনগণকে মুক্তিদানের জন্যে এ সকল শুভ উদ্যোগ গ্রহণ ছাড়াও দেশের আমদানী-রফতানী বাণিজ্যিকে দ্রুত উন্নয়ন করারও কর্মসূচী গৃহীত হচ্ছে বলে জানা গেছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দেশের রফতানী বাণিজ্যের উন্নত সাধনকল্পে একটি উন্নয়ন তহবিল গঠন করেছেন। এছাড়াও দুখী জনগণের দ্রুত বস্ত্র সমস্যার সমাধানের জন্যে বাণিজ্যমন্ত্রী এক ঘোষণার দ্বারা অবাধ বাণিজ্য লাইসেন্সের অধীনে বেসরকারী খাতে কাপড় আমদানীর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। উক্ত ঘোষণায় লাইসেন্সের টাকার পরিমাণ উল্লেখ করে জনসংখ্যার ভিত্তিতে জেলাসমূহের মধ্যে লাইসেন্স বিতরণের কর্মসূচী নেওয়া হয়েছে। তাতে আরো বলা হয়েছে যে, উক্ত ও.জি.এল-এর মাধ্যমে যে সকল কাপড় আমদানী করা হবে তার পঞ্চাশ ভাগ সূতী শাড়ী ও সূতীর কাপড়। এছাড়া পঁচিশ ভাগ তাঁতের লুঙ্গি, পনেরো ভাগ মার্কিন কাপড় এবং দশ ভাগ লং ক্লথ থাকবে। আমরা ইতিপূর্বে ও.জি.এল-এর মাধ্যমে কাপড় আমদানীর পরিকল্পনাকে শুভ উদ্যোগ বলে অভিমত পোষণ করেছি। সঙ্গে সঙ্গে আমরা কর্তৃপক্ষকে জানিয়েও দিয়েছি যে, দেশের সাধারণ মানুষের জন্যে যে মোটা কাপড় আনা হবে তার উপর যেন কোনক্রমেই বেশী কর নির্ধারণ না করা হয়।
বাণিজ্যমন্ত্রী জনাব কামরুজ্জামান ও তাঁর মন্ত্রণালয় কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেসমূহ আমাদেরকে উৎসাহিত করেছে। আমাদের বিশ্বাস দেশের সাধারণ মানুষের জন্যেও ঐ সকল পরিকল্পনা বাস্তবানুগ হবে। সম্প্রতি মধ্যসত্ব বিলোপের যে সিদ্ধান্তের কথা বাণিজ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন তা অত্যন্ত মূল্যবান ও সুদূরপ্রসারী একটি কর্মসূচী। সমাজতান্ত্রিক দেশের বাণিজ্য ক্ষেত্রে মধ্যসত্ব সুযোগ নেই। এ ব্যাপারে বহু পূর্বেই বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ একটি বলিষ্ঠ কর্মসূচীর কথা ঘোষণা করেছে। মধ্যসত্ব বিলোপ তাদের একটি প্রধান দাবী। এছাড়া আমদানী-রফতানী বাণিজ্য জাতীয়করণ করে সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন আনার জন্যে তাদের দাবী রয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের সর্বহারা মানুষের জন্যে আনীত দ্রব্যসামগ্রী যদি মধ্যসত্বের কবলে পড়ে আরো বেশী মূল্যে জনগণের কাছে গিয়ে পৌঁছায়, তাহলে তা নিতান্তই দুঃখের বিষয়। সরকার দেরীতে হলেও মধ্যসত্ব বিলোপের যে সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেছেন, তা দেশবাসীকে আশান্বিত করবে বলে আমরা মনে করি।

বেলুচিস্তানে পাকিস্তানী সামরিক অভিযান

পাকিস্তানের বর্বর সৈন্যদের মারণাস্ত্রগুলো আবার ঝলকিত হয়ে উঠেছে। পাকিস্তানের বোমারু বিমান থেকে বেলুচিস্তানের গ্রামে গ্রামে বোমাবর্ষণ করা হচ্ছে। স্থলপথ এবং আকাশ পথে পাকিস্তানী সৈন্যরা বেলুচিস্তানের সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে নগ্ন হামলা পরিচালনা করার ফলে বেলুচিস্তানে আজ মুক্তি ও স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। হাজার হাজার বেলুচ নাগরিক আজ হাতে তুলে নিয়েছে হাতিয়ার। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছে সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রামে।
বেলুচিস্তান পাকিস্তানের একটি প্রদেশ। এই প্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী এবং পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা সর্দার আতাউল্লাহ খান মেঙ্গল বলেছেন যে, পাকিস্তানের বিমান ও স্থল বাহিনীর যুগবৎ হামলার বিরুদ্ধে প্রাণ বাঁচানোর জন্যে বেলুচিস্তানের হাজার হাজার মানুষ প্রতিরোধ লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে বাধ্য হয়েছে।
করাচীর সান্ধ্য দৈনিক ইভনিং স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত এক বিবৃতিতে সর্দার আতাউল্লাহ খান মেঙ্গল অভিযোগ করেছেন যে, পাকিস্তানী সৈন্যরা বেলুচিস্তানের বহু এলাকা অবরোধ করে রেখেছে এবং খাদ্য ও জল সরবরাহ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দিয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের উল্লেখ করে জনাব মেঙ্গল পাকিস্তানকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন যে, বেলুচিস্তানেও বাংলাদেশের রক্তাক্ত মুক্তি সংগ্রামের মতো একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে যাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ভুট্টো স্বয়ং বেলুচিস্তানে পাকিস্তানী সামরিক অভিযানের কথা স্বীকার করেছেন। জনাব ভুট্টো স্বীকার করেছেন যে, বেলুচিস্তানের বিভিন্ন এলাকা থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামী বেলুচ গেরিলাদের নির্মূল করার জন্য তিনি সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন। ওদিকে বিরোধী দলীয় ইস্তেকলাল পার্টি প্রধান সাবেক এয়ার মার্শাল আসগর আলী মন্তব্য করেছেন যে, বেলুচিস্তানে পাকিস্তানকে এক নতুন বাংলাদেশ পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হচ্ছে। বেলুচিস্তানের রাজধানী কোয়েটা থেকে করাচী ফিরে এসে তিনি সাংবাদিকদের কাছে এ মন্তব্য করেছেন। জনাব আসগর আলী খান বেলুচিস্তানের সমস্যা সমাধানের জন্য সামরিক অভিযান না চালিয়ে রাজনৈতিকভাবে এ সমস্যা সমাধানের জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা গাউস বখস বেজেঞ্জো সরকারের প্রতি সতর্ক বাণী উচ্চারণ করে বলেছেন যে, সর্দার আতাউল্লাহ খান মেঙ্গলকে গভর্ণর পদ থেকে খারিজ করে আকবর বুগতিকে গভর্ণর নিযুক্ত করার জন্যেই পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে গেছে এবং বালুচদের সাথে সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছে। বেলুচিস্তানে ভুট্টো সরকার সামরিক বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে যে সংগ্রামের অগ্নিশিখা প্রজ্জ্বলিত করে দিয়েছেন, তাতে আমরা বিস্মিত হইনি। কারণ আমরা জানি, ভুট্টো সরকারের এছাড়া অন্য কোন পথ নেই। আভ্যন্তরীণ কোন্দল যে একদিন পাকিস্তানকে খন্ড খন্ড করে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে, সে আশংকা আমরাও বহুবার প্রকাশ করেছি। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। প্রেসিডেন্ট ভুট্টো তার চন্ডনীতি বিসর্জন দিতে পারেননি। বাংলাদেশ থেকে ইয়াহিয়া খান যে শিক্ষা পেয়েছেন বেলুচিস্তান থেকেও ডানা ভাঙা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভুট্টোকেও সেই একই শিক্ষা পেতে হবে। কারণ অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে বেলুচিস্তানের মুক্তিকামী মানুষ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আক্রমণকে যে কোন মূল্যেই প্রতিহত করতে প্রয়াসী হবে। বেলুচিস্তানে পাকিস্তান বিমান হামলার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের চোখের সামনে একাত্তরের পঁচিশে মার্চের কালরাত্রির ছবি ভেসে ওঠে। আমরা যেমন প্রাণ দিয়ে বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছি, ঠিক তেমনিভাবে বালুচ জনসাধারণও প্রাণ দিয়ে তাদের মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্য শত্রুহননে অবতীর্ণ হবে।
বেলুচিস্তানে যে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠেছে, সেই আগুন ভুট্টোর দমননীতিকে পিষিয়ে মারবে। অবশেষে পাকিস্তান পরিণত হবে এক বিপাক-ই-স্তানে। কথায় কথায় সৈন্যবাহিনী দিয়ে যদি ভুট্টো সাহেব ন্যায়ের সংগ্রামকে নস্যাৎ করতে চান, তাহলে তাকে তার খেসারত দিতে হবে কড়ায় গন্ডায়। বেলুচিস্তানে সেনাবাহিনীর অভিযানের নেপথ্যে নিশ্চয়ই অস্ত্রের ঝংকার এবং বৃহৎ শক্তির মদদ রয়েছে। পাকিস্তান সম্প্রতি যে সামরিক সাহায্য পেয়েছে সেই সামরিক অস্ত্র দিয়েই আজ ভ্রাতৃঘাতী নারকীয় হত্যালীলায় উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। এতে মুক্তির বদলে ভুট্টো সাহেবের একগুঁয়েমি মনোভঙ্গিরই বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। বাংলাদেশে কেমন করে ইয়াহিয়া শাহীর ভরাডুবি ঘটেছে, তা চোখের সামনে দেখার পরও ভুট্টো সাহেব কেমন করে আবার সামরিক আক্রমণ পরিচালনার ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছেন, তা আমরা বুঝে উঠতে পারছি না। আমাদের বিশ্বাস অস্ত্রের ধমক দিয়ে মুক্তিকামী বালুচদের মুক্তি সংগ্রাম স্তব্ধ করা যাবে না।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!