You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুজিবের পরে কে? Who is after Mujib? – শেখ মণি | বাংলার বাণী ৫ মে ১৯৭৪

বঙ্গবন্ধুর পরে কে বাংলার প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছে? এই নিয়ে শেখ মণি তার বাংলার বাণী পত্রিকায় সম্পাদকীয় পাতায় ৫ মে ১৯৭৪ তারিখে একটি আর্টিকেল লেখেন। সম্পূর্ণ লেখাটি পড়ুন।

Who is after Mujib? 
মুজিবের পরে কে? 
– শেখ ফজলুল হক মনি
বেশ কিছুদিন ধরিয়া লেখা হয় নাই। ইচ্ছা করিয়াই লিখি নাই। আমার ও আমার সহ-কর্মীদের চরিত্র হননের চেষ্টা চলিয়াছিল। এইরূপ উত্তপ্ত পরিস্থিতি লিখিবার জন্য উপযুক্ত সময় নহে। মনন হইতে আক্রোশ প্রাধান্য পাইয়া বসিতে পারে। তাই উত্তাপ প্রশমিত হইবার জন্য বসিয়া ছিলাম।
আমি বসিয়া থাকিলেই ঘটনা বসিয়া থাকে না, ইতিহাস বসিয়া থাকিবার নহে। কাল তাহার আপন নিয়মে চড়াই উৎরাই অতিক্রম করিয়া মহা-কালের দিকে আগাইয়া চলিবেই। নদীর যাত্রারীতির মতই তাহার গতি। দুই কূলে বসিয়া কে কাঁদিল, কে হাসিল, কোন মুখরা রমণী ঘাটের পানি ঘোলা করিতে করিতে হাঁটুর কাপড় উঠাইয়া প্রতিবেশীর বাড়িতে সদ্যাগতা নব বধুটির  চৌদ্দ পুরুষ শ্রাদ্ধ করিতে নিমগ্না হইল সেইদিকে তাহার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নাই। সকল কলহ-বিবাদ সুখ-দুঃখ কান্না-হাসিকে বাহিরে রাখিয়া কলকল রবে কুল-বাহিয়া মহাসঙ্গমের দিকে সে আগাইয়া যাইবেই। তাই আমাদের চাওয়া-পাওয়ার প্রতি বিন্দু মাত্র ভ্রুক্ষেপ না করিয়াই বাংলাদেশের বুকে অনেক ঘটনা ঘটিয়া গিয়াছে। 
একটি বিদেশী কাগজে ঢাকা হইতে একটি সংবাদ পাঠান হইয়াছে। বঙ্গবন্ধুর পরে বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রী কে হইবেন? জাতির পিতার বয়স এখন মাত্র ৫৫ বৎসর। তিনি এতোটা বৃদ্ধ হইয়া পড়েন নাই যে, তাঁহার পরে বাংলার খালি মসনদে কোন মহারথী আসিয়া আসন জাঁকাইয়া বসিয়া পড়িবেন তাহা লইয়া জল্পনা-কল্পনা চলিতে পারে। মাওসেতুং, মার্শাল টিটো আজ দুই যুগের উপরে তাঁহাদের দেশ শাসন করিতেছেন। প্রতিবেশী দেশের নেহেরু দেড় যুগকাল শাসন চালাইয়া তাহার দেশের প্রাথমিক সমস্যাগুলির সমাধান খুঁজিয়াছিলেন। কত ঘাত-প্রতিঘাত কত দ্বন্দ্ব-সংঘাত তাঁহাদের মাথার উপর দিয়া চলিয়া গিয়াছে। ভয়ানক বেকায়দায় পড়িয়াও বিন্দুমাত্র বিচলিত হইবার মত কারণ সেখানে ঘটে নাই। আর আমাদের জাতির পিতা সামান্য অসুস্থ হইয়া বিদেশে চিকিৎসা করিতে যাওয়ার সাথে সাথেই এইদেশ হইতেই তাহার উত্তরসূরী খুঁজিবার জন্য হিড়িক পড়িয়া যায়!  ইহা কেবল অশোভনই নহে, জাতির জন্য ক্ষতিকর ও বটে। সমগ্র জাতির আত্মবিশ্বাসের মূল লইয়া টানাটানি বাধাইয়া দেওয়ারই সামিল। বাংলাদেশে সেই অশোভন সর্বনাশা আলোচনা হইয়াছে। হইতে চলিয়াছিল। 
উক্ত সংবাদ নিবন্ধে বলা হইয়াছে, আমি আর আমাদের যুবলীগের জন্যই নাকি জনৈক মহারথী বঙ্গবন্ধুর সাকসেসর হইতে পারিতেছেন না। বঙ্গবন্ধুর পরে বাংলাদেশের রাজনীতি কোথায় গড়াইবে, কে কোথায় বসিয়া চিনাবাদাম খাইবেন, আর কে উচ্চাকাঙ্ক্ষার পালে বাদাম লাগাইয়া দিয়া মসনদে গিয়া বসিবেন আমরা তাহা লইয়া মাথা ঘামাই না। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি করি। তাহার পরের রাজনীতি করিনা। করিবার কথা এখন ভাবিতেও পারি না। 
অথচ আমাদেরকেই আজ ব্যক্তিবিশেষের তখতে আরোহনের কাঁটা হিসেবে চিত্রিত করা হইয়াছে।  বাংলাদেশের মানুষকে তাহাদের প্রাণপ্রিয় জাতির পিতার জীবদ্দশায়ই তাঁহার পরবর্তী রাজনীতি শেখানো হইতেছে।  
রাজনীতিতে পথের কাঁটা হইলে তাহার পরিণতি কি হইতে পারে তাহা আমরা জানি।  ইতিহাসে তাহার ভুরি ভুরি নজির রহিয়াছে। আর তারপর যদি সিংহাসন দখলের যাত্রাপথে কাহারও কাঁটা হিসাবে দাঁড়াইয়া যাইবার সম্ভাবনা দেখা দেয় তাহার অবস্থা সহজেই অনুমান করা চলিতে পারে। ঐ কাঁটা তুলিয়া ফেলিবার চেষ্টা হইবে। জ্যামিতির স্বতঃসিদ্ধের মতই এই বিধান নামিয়া আসিবে। মসনদ দখলের জন্যই সম্রাট আওরঙ্গজেব পিতা শাহজাহানকে বন্দীশালায় আটক করিয়াছিলেন, ভ্রাতাদের জীবননাশের কারণ হইয়াছিলেন। আমরা নিজেরা হরহামেশা আমাদেরকে মুঘল জাতির বংশধর বলিয়া দাবী করিয়া আসিয়াছি, পাঠান বাদশাদের সহিত জ্ঞাতিত্ব, আত্মীয়তা দাবী করিয়াছি।  সুতরাং আজ বিংশ শতকের শেষ পাদে দাঁড়াইয়া আবার তাঁহাদেরই রীতিতে রাজনীতি শুরু করিব তাহাতে আর বিচিত্র কি ?  তাই আমাদের চরিত্র হননের চেষ্টা দেখিয়াও বিন্দুমাত্র অধৈর্য হই নাই। প্রাণনাশের চেষ্টা হইলেও বিচলিত হইতাম না। 
জনাব গাফফার চৌধুরী লিখিয়াছেন, সিরাজ শিকদারের ভগ্নী বঙ্গবন্ধুর মূর্তি গড়িতেছেন। ১৯৭১ সালে মুজিবনগরের সরকারের অভিষেক উৎসবে জাতির পিতার মূর্তি স্থাপনের চেষ্টা চলিয়াছিল। আমি সে অনুষ্ঠানে যাইতে পারি নাই। যাইনাই। আমরা জান দিতে শিখিয়াছি। মান দিতে শিখি নাই। আজ বাংলাদেশের কুৎসিত কদর্য রাজনীতিতে সেই মান-সম্মান লইয়া যখন টানা-হেঁচড়া শুরু হইয়াছে তখন আর ভয় পাইবার কোন কারণ নাই। যাহাদের দূষ্কর্মের কাল দাগগুলির উপর চুনকাম করিবার জন্য এতদিন কলম চালাইয়া আসিয়াছিলাম আজ তাহারা নগ্ন চেহারা লইয়া আগাইয়া আসিয়াছেন। সুতরাং আমাদের অতীতের সব প্রচেষ্টাকে পণ্ডশ্রম জানিয়াই আজ সত্য বলিবার জন্য আগাইয়া আসিতে হয়। 
বঙ্গবন্ধুর পরবর্তী রাজনীতির খোঁজ আমরা রাখি না। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতির রাজনীতির স্বাদ আমরা ইতিমধ্যে পাইয়া গিয়াছি। নয়মাসের মুক্তিযুদ্ধের সময় থিয়েটার রোডের রঙ্গমঞ্চে তাহা প্রত্যক্ষ করিয়াছি। বঙ্গবন্ধু না থাকিলে কাহার কি চেহারা হয়, কাহার সহিত কাহার মিতালি জমিয়া ওঠে, কাহার স্বার্থের সহিত কাহার স্বার্থ বাঁধিয়া যায়, বঙ্গবন্ধু তাহা দেখিবার সুযোগ পান নাই। আমরা দেখিয়াছি। 
Who is after Mojib — মুজিবের পরে কে — এই প্রশ্ন আজই আকস্মিকভাবে ওঠে নাই। বন্দী নেতাকে পাকিস্তানের কারাগারে আটক রাখিয়া সেইদিন সর্বপ্রথম এই প্রশ্ন তোলপাড় তুলিয়াছিল। সময় মত বঙ্গবন্ধু ফিরিয়া আসিবার কারণে বাংলাদেশের মানুষ তাহা জানিতে পারে নাই। কেহ জানিয়া থাকিলেও তাহা ভুলিয়া যাইতে চাহিয়াছিল। আজ আবার নেতা সামান্য অসুস্থ হইয়া পড়িলে, বা কোন সংকট জমাট বাঁধিয়া গেলেই আবার ঐ প্রশ্ন মাথাচাড়া দিয়া ওঠে। বাংলার মাটি হইতে শাঠ্য-ষড়যন্ত্রের রাজনীতির কবর দিতে হইলে ঐ প্রশ্নটিকে কবর দিতে হইবে। মুজিবের পরে কে — এই প্রশ্নটিই আজ আমাদের কিছু লোকের ভাবনা-চিন্তায় তছনছ ঘটাইয়া দিতেছে। দেশবাসীর মনে সংশয়, সন্দেহ সৃষ্টি করিয়া চলিয়াছে। অতএব কোন কিছু করিবার বা বলিবার আগে প্রশ্নটিকে মাটি চাপা দিয়া কবর দিতে হইবে। বঙ্গবন্ধুর জীবন লইয়া বাংলার মাটিতে যাহাতে আর কেউ স্পেকুলেশান চালাইতে না পারে তাহার বিধান করিতে হইবে। 
মুজিবনগরে মূর্তি স্থাপনের চেষ্টা দেখিয়া বিস্মিত হইয়াছিলাম, বিমূঢ় হইয়াছিলাম। সিরাজ শিকদারের ভগ্নীর মূর্তি নির্মাণের সংবাদ পাইয়া এবার আর বিস্মিত হই নাই। পার্থক্য কেবল এইখানেই। 

Unicoded by Tashrique Mohammed Sikder

মূল পত্রিকার কাটিং –

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!