You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে সুইডেনের বন্ধুরা - সংগ্রামের নোটবুক

সুইডেনের সেই সব যােদ্ধা।

মুক্তিযুদ্ধে সুইডেনের বন্ধুরা

বাংলাদেশ থেকে সুইডেনের দূরত্ব অনেক। ১৯৭১ সালে সুইডেনের কয়জনইবা বাংলাদেশের সংবাদ রাখতেন। তারপরও সুইডেনের কয়েকজন সাংবাদিক ও সমাজ/মানবাধিকার কর্মী শুধু সুইডেনে নয়, স্ক্যান্ডিনেভিয়ার অনেকগুলাে দেশ যেমন, ডেনমার্ক, নরওয়ে, ফিনল্যান্ডে বাংলাদেশের জন্য জনমত সংগঠন করেছিলেন।
এঁদের একজন রাজনীতিবিদ ও মানবাধিকার কর্মী লারস লিজনবর্গ। মুক্তিযুদ্ধের সময় শরণার্থীদের দুর্দশা দেখে তিনি সহায়তা করার সিদ্ধান্ত নেন। সােজা চলে যান কলকাতায়। সফর করেন মুক্তাঞ্চল এবং শরণার্থী শিবির। তারপর ফিরে যান সুইডেন এবং বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সংগঠনে নেমে পড়েন। একই সঙ্গে তিনি শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য আবেদন জানান এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারণা চালান। পাকিস্তানকে সুইডেনের সব রকমের সাহায্য প্রদান বন্ধ ও পাকিস্তান থেকে সুইডেন রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহারের দাবি জানান। শুধু তাই নয়, একই উদ্দেশ্যে তিনি ডেনমার্ক, নরওয়ে এবং ফিনল্যান্ড সফর করেন। শরণার্থীদের জন্য তিনি যে তহবিল করেছিলেন তা পাঠিয়ে দেন বাংলাদেশ সরকারের কাছে।
৪৬
ভান স্ট্রমবার্গ একজন সাংবাদিক। সুইডিশ টেলিভিশনে জনপ্রিয় সংবাদ, পরিক্রমা আকতুয়েলৎ’-এর সমন্বয়ক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত তাঁর প্রতিবেদন সমূহ জনমত সংগঠনে সহায়তা করে। তারপর তিনি যশাের ও খুলনার মুক্তাঞ্চল পরিদর্শন করেন। মুক্তিবাহিনীর সাফল্য নিয়ে নিয়মিত প্রতিবেদন পাঠাতেন। যখন সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১৬ ডিসেম্বর যৌথবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে তখন তিনি উপস্থিত ছিলেন। এরপর তিনি রায়ের বাজার বধ্যভূমি পরিদর্শন করে বিমূঢ় হয়ে যান। তাঁর সচিত্র প্রতিবেদন পাশ্চাত্যের পাঠকদের অভিভূত করে। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন তিনি ঢাকায় ছিলেন। শুধু তাই নয় ঐদিন যে কয়জন সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকার নিতে পেরেছিলেন তিনি তাঁদের একজন। মুক্তিযুদ্ধের এক অনাথ শিশুকে তিনি দত্তক নিয়ে দেশে ফিরে যান। শিশুটির নাম রাখেন নিকোলাস মােজেজ জয়।

গুনার মিরডালের নাম কে না জানে? তাঁর পুরাে নাম কার্ল গুনার মিরডাল [সুইডিশ উচ্চারণ মাই ডাল] জন্ম ১৮৯৪ সালে সুইডেনে। মূলত অর্থনীতিবিদ, সুইডিশ সংসদে ১৯৩৩ সাল থেকে দীর্ঘদিন সােশ্যাল ডেমােক্র্যাট হিসেবে
৪৭
সংসদ সদস্য ছিলেন। মন্ত্রী ছিলেন ১৯৪৫ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত। মিরডাল সবসময় নিপীড়িতের পক্ষে থাকার চেষ্টা করেছেন। অর্থনীতির অনেক বই লিখেছেন তিনি, নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন। তবে, আমাদের কাছে তাঁর সবচেয়ে পরিচিত বই ‘এশিয়ান ড্রামা’।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে বাঙালি নিপীড়ন ও শরণার্থীদের দুর্দশার কাহিনি মিরডালের চোখে পড়ে। এর আগে সুইডিশ কিছু সাংবাদিকও বাঙালিদের চিত্র তুলে ধরেছিলেন। মিরডাল তখনই সুইডেনে গঠন করেন বাংলাদেশ সলিডিরাটি কমিটি। তিনি হন এর সভাপতি। পরবর্তী মাসগুলােতে এই কমিটি জনমত সংগঠন ও শরণার্থীদের সহায়তা প্রদানে অনলস কাজ করে গেছে। মিরডাল পরলােকগমন করেন ১৯৮৭ সালে।
১৯৭১ সালে সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন সভেন ওলফ জোয়াকিম পামে (১৯২৭-১৯৮৬)। ইউরােপিয়া দেশে এমন নাম দুর্লভ নয় জার্মান জাতীয় দলের ফুটবল কোচ জোয়াকিম লাে। মিরডালের মতাে তিনিও ছিলেন সােশ্যাল ডেমােক্র্যাট। সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন দু’বার। কিউবায় গিয়ে
৪৮
ক্যাস্ট্রোর প্রশংসা করে বক্তৃতা দিতে বিচলিত হননি। তেমনি ভিয়েতনামে মার্কিন নীতি, সােভিয়েত আগ্রাসী নীতির বিপক্ষে ছিলেন। স্বাভাবিকভাবে ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন বাঙালিদের পক্ষে। এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাকিস্তানিদের সব রকমের সহায়তা প্রদানে ছিলেন বিরােধী। এ বিষয়ে তিনি সরাসরি অবস্থান নিয়েছিলেন। ১৯৮৬ সালে আততায়ীর গুলিতে নিহত হন।
সুইডেনের আরেকজনের নাম করতে হয়। তিনি সৈয়দ আসিফ শাহকার। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন পাকিস্তানের পাঞ্জাব ছাত্র ইউনিয়নের যুগ্ম সম্পাদক। কবিতাও লিখতেন তিনি। বাংলাদেশে গণহত্যার বিরুদ্ধে তিনি লিফলেট রচনা করে গােপনে তা বিতরণ করেন। গণহত্যার বিরুদ্ধে কবিতাও রচনা করেন। পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠায়। শুধু তাই নয়, পাকিস্তান সরকার তাঁকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে অভিহিত করে। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি সুইডেন চলে যান এবং সুইডেনের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। সেখানে একটি আদালতে বিচারক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
ভেন লামজিল চাকরি করতেন সুইডেশ বিমান বাহিনীতে। চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর যােগ দেন রেডক্রসে। রেডক্রসের কর্মকর্তা হিসেবে ঢাকায় কর্মরত ছিলেন। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে তাঁর যােগাযােগ ছিল, সহায়তাও করতেন তাদের। পাকিস্তান কর্তৃক নিযুক্ত গবর্ণর ডা. এ.এম মালেক তাঁর পদত্যাগপত্র লামজিলের কাছেই জমা দেন। যুদ্ধের পর তিনি এক যুদ্ধ শিশুকে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করেন।
ওলাফ পাম ছাড়া সুইডেনের এই কয়জনকে বাংলাদেশ সরকার ২০১২-১৩ সালের মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা এবং পাম-কে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা প্রদান করে।

রেফারেন্স – ভিনদেশিদের মুক্তিযুদ্ধ – মুনতাসির মামুন, পৃষ্ঠা – ৪৬-৪৯