You dont have javascript enabled! Please enable it!
ভিনদেশিদের মুক্তিযুদ্ধ
দুশানের বাংলাদেশ।
=============
দুশান জু ভাবিতেল ছিলেন চেক নাগরিক, জন্ম ১৯২৫ সালের ৭ মে মােরাভিয়ার ফ্রেঞ্চস্টাট নামের শহরে। তিনি বলতেন, “আমার আর রবীন্দ্রনাথের জন্ম তারিখ এক। মারাও যাবাে আমি রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু তারিখে।” ২০১২ সালের ৭ আগস্ট প্রাগে মারা যান ৮৭ বছর বয়সে।
বাংলাভাষার প্রতি তার ভালােবাসার উৎস রবীন্দ্রনাথ। কার্লোভা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারততত্ত্ব বা ইন্দোলজি নিয়ে পড়েন। এবং বাংলা শেখা শুরু করেন। ১৯৪৮ সালে কার্লোভাতে বাংলাভাষা শেখানাে শুরু হয়। এখানে দুশান বাংলা পড়াতেন। ১৯৫৮ সালে শান্তিনিকেতন যান ।
বাংলা শেখার পর তৎকালীন পূর্ববঙ্গ বা ঢাকা আসার চেষ্টা করেন । চেকোশ্লোভাকিয়া কমিউনিস্ট দেশ বলে ভিসা পাননি। ১৯৬০ সালে ইউনেস্কো বৃত্তি পেলে তিনি ঢাকা আসেন। এখানে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় জয়নুল আবেদিন, জসীম উদ্দীন ও মনসুর উদ্দীনের। ময়মনসিংহ গীতিকা নিয়ে কাজ করেছেন বাংলা একাডেমিতে। জসীম উদ্দীনের সঙ্গে গ্রামে গঞ্জে ঘুরে বেরিয়েছেন। ঢাকার গবেষণার ফল ময়মনসিংহ ব্যালেডস অ্যান্ড দেয়ার প্রব্লেম অব অথিনসিটি। ১৯৬৩ সালে তা প্রকাশিত হয় কলকাতা থেকে। এ সময় রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে বাংলা ভাষায় রচিত অনেকের বই তিনি অনুবাদ করেছেন।
যাট দশকে ঢাকা ভ্রমণ নিয়ে তিনি একটি ভ্রমণ কাহিনিও লিখেছিলেন । সেখানে তিনি মন্তব্য করেছিলেন নাদিরা মজুমদারের অনুবাদ] “সেই ট্রাভেলগ-এ লিখেছিলাম যে, বাংলাভাষা ও সংস্কৃতি সাহিত্যের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের এই যে হীনম্মন্য আচরণ, তাতে করে পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের অংশ হিসেবে টিকে থাকতে পারে না। স্বাধীন তারা একদিন হবেই । বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়াতে যারা সবচেয়ে খুশি হয় তাদের মধ্যে তিনিও একজন। স্বাধীন বাংলাদেশ, তার বাংলাভাষা, বাংলাভাষার আলাদা একটা। সৌন্দর্য আছে, ধ্বনির মাধুর্য আছে।
দুশানই বােধ হয় প্রথম বিদেশি যিনি গত শতকের ষাটের দশকে স্বাধীন বাংলাদেশ সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন।
১৯৬৮ সালে চেকোশ্লোভাকিয়ায় রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে দুশান বিদ্যাপীঠের চাকরি হারান। ১৯৭১ সালে জনমত সৃষ্টির জন্য ইন্দিরা গান্ধী যখন প্রাগ যান তখন প্রেসিডেন্ট হুসাককে অনুরােধ করেছিলেন দুশানের জন্য যেন কিছু করা হয়। হুসাক সে অনুরােধ রেখেছিলেন। ইন্দিরা সফর শেষে দুশান আবার কার্লোভা বিশ্ববিদ্যালয়ে যােগ দেন।
দুশান প্রায় ১২-১৩টি ভাষা জানতেন। তিনি আটবার ভারত গেছেন। বাংলাদেশে একবার স্বাধীনতার পরও চেষ্টা করেছিলেন । কিন্তু ভিসা যােগাড় করতে পারেননি। এই আফসােস তাঁর সবসময় ছিল।
১৯৭১ সালের পর দুশান একটি বই লেখা শুরু করেন চেক ভাষায়। ১৯৭৩ সালে বইটি প্রকাশিত হয়, বাংলা অনুবাদে যার নাম বাংলাদেশ : রাষ্ট্র হিসেবে যার অভূদয় অনিবার্য ছিল। নাদিরা লিখেছেন
“পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি উপনিবেশ সুলভ আচরণের তথ্যাবলি এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অজস্র অসংখ্য দুষ্প্রাপ্য ছবির সমাহারে বইটি অনন্য। বাঙালির অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক জীবনে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রভুসুলভ ঔপনিবেশিক শােষণ শাসনের তথ্যে ঠাসা এত চমৎকার বই খুব কমই নজরে পড়ে।”
মৃত্যুর আগে এক সাক্ষাৎকারে নাদিরাকে বলেছিলেন-বাংলাদেশে যাওয়ার ইচ্ছা “অবশ্যই আছে। বাংলাদেশ একমাত্র দেশ, যার রাষ্ট্রভাষা বাংলা। বাংলা আমার সারাজীবনের ভালােবাসা। পশ্চিমবঙ্গের লােকেরা বলে যে আমি নিশ্চয়ই পূর্বজন্মে বাঙালি ছিলাম। আমারও ধারণা তাই । আরেকবার, অন্তত আরেকবার বাংলাদেশে যাওয়ার খুব ইচ্ছা। সেখানে আরেকবার যেতে চাই।” আসা আর হয়নি তার।
উৎস : নাদিরা মজুমদার, ‘আমার চেনা চেক দেশীয় বাঙালি দুশান জু বাডিতেল’
Reference: ভিনদেশিদের মুক্তিযুদ্ধ – মুনতাসির মামুন
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!