বাংলার বাণী
ঢাকা: ১৫ই জুন, শুক্রবার ৩১শে জৈষ্ঠ, ১৩৮০
আইনের ফাঁক বন্ধ করুন
রাষ্ট্রপতির ৫০ নম্বর আদেশে অভিযুক্ত যেসকল দুষ্কৃতিকারী এবং সমাজবিরোধীদের এতদিন গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের সবাইকে এখনও হাজতবাস করছে এমন নয়। জামিনে মুক্ত হয়ে এদের অনেকেই এখন সমাজে অবাধে বিচরণ করছে। অনেকের বিরুদ্ধে আবার নতুন করে গুপ্তহত্যা, ছিনতাই, রাহাজানি, বেআইনি অস্ত্র শস্ত্র রাখা এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাষ্ট্রদোহী কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ আসছে। কদিন আগেও জামিনে মুক্ত রাষ্ট্রপতির ৫০ নম্বর আদেশে অভিযুক্ত কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে রাজশাহীর নাচোল, আত্রেই প্রভৃতি স্থানে সমাজবিরোধী বিভিন্ন কাজ এবং গুপ্ত হত্যার অভিযোগ তোলা হয়েছে। শান্তি প্রিয় দেশবাসী যারা এই সকল দুষ্কৃতিকারীদের ধরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে সরকারকে সহযোগিতা করেছিলেন এবং তাদের বিরুদ্ধে আনীত বিভিন্ন অভিযোগের সাক্ষ্যদানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এসেছিল তারা জামিনে মুক্ত অভিযুক্তদের মারাত্মক শাসনের মুখে এখন অসহায়ের মতো দিন গুজরান করছে।
আইনের কোনো না কোনো ফাঁক গলিয়ে যে অভিযুক্ত এই সকল দুস্কৃতিকারীরা বেরিয়ে আসতে পারছে এটা আজ সুস্পষ্ট। সমাজে এদের অবাধ বিচরন জনমনে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। জনগণের মধ্যে একটা অনাস্থার ভাব জেগে উঠেছে। এটা ভালো লক্ষণ নয়। ক্রমান্বয়ে তা আইনের উপর জনসাধারণের মনোভাবে প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে। সময় থাকতে তাই সাবধান হতে হবে। জনসাধারণের মনে যাতে আইনের উপর কোন অশ্রদ্ধার ভাব করে নাও উঠে সে ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অবশ্যই নতুন করে চিন্তাভাবনা করতে হবে। রাষ্ট্রপতি ৫০ নম্বর আদেশের মধ্যেও যে ফাঁক রয়েছে তা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। কোন অভিযুক্ত দুষ্কৃতিকারী যাতে সে ফাঁক গলিয়ে বাইরে বেরুতে না পারে সে ব্যবস্থা অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে।
কোটি মানুষের প্রতিনিধিরা সবাই এই অধিবেশনে উপস্থিত আছেন। কালক্ষেপণ না করে এই আদেশের প্রয়োজনীয় সংশোধনী সংসদে পেশ করা হবে বলে আমরা আশা করি। ইতিমধ্যে সরকার নিশ্চয়ই এই গুরুত্ব অনুধাবন করেছেন। আমরা একটা পরিকল্পিত সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করতে চলেছি। সমাজতন্ত্র আমাদের মূল লক্ষ্য। এখানে সবকিছুতে ‘ফ্রি ষ্টাইল’ কোন অবস্থাতেই চলতে দেওয়া উচিত হবে না। অধিকতর কঠোরতার সঙ্গে জননিরাপত্তায় হুমকিস্বরূপ এমন সকল অবাঞ্ছিত লোকদের সমাজ দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে হবে।
একশ্রেণীর লোক রয়েছেন যারা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা তাকে ‘অগণতান্ত্রিক’ বলে আখ্যায়িত করতে সদা সক্রিয়। বহু বছরের পুঁজিবাদী এবং সাম্রাজ্যবাদী প্রচারণার ফলে এমনই একটা ধারণা উপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষিত মানুষের মনে দৃঢ়বদ্ধ হয়েছে। সমাজে যে একটা বিপ্লবের ধারা বইছে তা তারা এড়িয়ে চলতে চান। স্বাধীনতাত্তোর কাল থেকে সরকারের বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক পদক্ষেপ গ্রহণে তারা অগণতান্ত্রিকতার চিহ্ন খুঁজে ফিরেছেন। আমরা সরকারের কাছে এসেই ‘শিক্ষিত বিদ্বজ্জনদের’ পরামর্শে কান না দিয়ে অত্যন্ত কঠোর ও তার সঙ্গে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই।
একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ
বাংলাদেশ সরকারের খাদ্য মন্ত্রী শ্রী ফনিভূষণ মজুমদার খাদ্য সমস্যা সমাধানের জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ছাত্রদলের সহযোগিতা কামনা করে একটি চিঠি দিয়েছেন বলে সংবাদ প্রকাশ। খাদ্যমন্ত্রী তার চিঠিতে মুনাফাখোর, কালোবাজারি, দুর্নীতিবাজদের চক্রান্ত ব্যর্থ করে দেশের মানুষের হাতে খাদ্যদ্রব্য পৌঁছে দেবার জন্য সকল সংগঠনের সাহায্য ও সহযোগিতার কথা উল্লেখ করেছেন। এ ব্যাপারে অন্যান্য সংগঠনের দায়িত্বের কথাও তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
খাদ্যমন্ত্রী তার চিঠিতে বলেছেন-সুষম খাদ্য দ্রব্য বর্জনের জন্য নিষ্ঠাবান সরকারি কর্মচারী ঐক্য ও দেশের জনগণের সহযোগিতা প্রয়োজন। তিনি আরো বলেছেন আমাদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে দেশ-বিদেশ থেকে খাদ্যশস্য খরিদ করে আনা হচ্ছে আমাদের জনগনের ক্ষুধার অন্ন জোগাড়ের জন্য স্বার্থন্বেষী মহলের চক্রান্তে চোরা বাজারে চড়া দের বিক্রয় করার জন্য নয়। যতশীঘ্র আমরা এ সমস্ত সমাজ রোগীদের খুঁজে বের করতে পারি ততই দেশের মঙ্গল। খাদ্য মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে তাই একটি ব্যাপক অভিযান শুরু করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। আর সে কারণে খাদ্যমন্ত্রী সকল মহলে সাহায্য ও সহযোগিতা কামনা করে চিঠি দিয়েছেন। বস্তুতপক্ষে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এ ধরনের প্রচেষ্টা শুরু করার জন্য বহুদিন পূর্বে আমরা বলেছি। সরকার মাঝেমধ্যে ভুয়া রেশন কার্ড উদ্ধার, চোরাচালান, কালোবাজারি, মুনাফাখোরদের উচ্ছেদ প্রভৃতি ব্যাপারে একটা প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে তার কোনো সুফল হয়নি। খাদ্যমন্ত্রীর বর্তমানে এই ঘোষণায় আমরা আশান্বিত। সত্যিকার অর্থেই যদি সরকার দুর্নীতিবাজদের কবল থেকে জনগণকে রেহাই দিতে চান তাহলে আর দেরি না করে সঠিক দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। খাদ্যদ্রব্য জনগণের কাছে পৌঁছে দেবার নিশ্চিত ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশের বর্তমান নানা সমস্যার মধ্যে খাদ্য সমস্যায় সবচেয়ে বেশি প্রকট। অন্যান্য সমস্যা মানুষকে যতোটুকু স্পর্শ করে থাকে তার চাইতে বেশী স্পর্শ করে থাকে খাদ্যদ্রব্যের অভাব। খাবারের অধিকার মানুষের মৌলিক অধিকার। বাংলাদেশ আজ বিভিন্ন অভাব-অনটনে জর্জরিত। বহু প্রচেষ্টার মাধ্যমে সে আজ সমস্যা সমাধানে আত্মনিয়োগ করেছে। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের জন্য প্রাণান্ত প্রচেষ্টার করা হচ্ছে। ঠিক এমনই নানাবিধ প্রতিকুলতার মধ্য দিয়ে যখন খাদ্য দ্রব্য আমদানি করা হচ্ছে তখন একশ্রেণীর সমাজবিরোধী ব্যক্তিরা ঐসকল চোরা বাজারে অধিক মুনাফা বিক্রি করে ফায়দা লুটছে। মানুষের দুঃখ কষ্ট বাড়িয়ে তুলছে। বহু সতর্কবাণী উচ্চারণ সত্বেও এরা নিয়ন্ত্রিত হয় নি। এদের অশোক তৎপরতা বন্ধ হয়নি। তাই খাদ্যমন্ত্রীর বর্তমান পদক্ষেপ গ্রহণের পরিকল্পনায় একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এই পদক্ষেপ বাস্তবায়িত করতে পারলে সমস্যা অনেকখানি লাঘব হবে বলে আমরা মনে করি। জনমনে আস্থা ফিরে আসবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
বিসিকের ব্যাপারটা তদন্ত করা হোক
এ শুধু একটা সংস্থার কথা নয়, নানা সংস্থা নানা প্রতিষ্ঠান থেকে একই অভিযোগ উঠছে। কর্তা ব্যক্তিরা কাজ করছেন না, ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন অথবা সরকারি নীতিসমূহ বানচালে অপূর্ব দক্ষতা দেখাচ্ছেন এমনই নানা অভিযোগ বিভিন্ন মহল থেকে উত্থাপিত হচ্ছে কিন্তু কেউই বলতে পারছেন না এর শেষ কোথায়। ক্ষুদ্র শিল্প করপোরেশন নিয়ে এমনই একটা খবর ছাপা হয়েছে গত কালকের ‘বাংলার বাণীতে’। খবর অনুসারে স্বাধীনতা যুদ্ধে যে সকল ক্ষুদ্র কল-কারখানা বিনষ্ট হয় অথবা হানাদার বাহিনী পশ্চাদপসরণ এর সময় যেসকল শিল্পপ্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে দেয় সেগুলো মেরামত করা এবং উৎপাদন করে গড়ে তোলার জন্য সরকারি বিসিক এর মধ্যে দেশে বিদেশি মুদ্রা মিলে প্রায় চার কোটি ত্রিশ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করেন। অথচ সংবাদ নিবন্ধে অভিযোগ করা হয়েছে যে, বিসিক নাকে জনসাধারণ থেকে এ ব্যাপারটা যতদূর সম্ভব চেপে রাখার নীতি অনুসরণ করে আসছে। সবচাইতে যে বিস্ময়কর তাহলে এক হাতে সরকার যে বৈদেশিক মুদ্রা বরাদ্দ করেছিলেন তার অর্ধেকের বেশী খরচ না করে সরকারকে ফিরিয়ে দিয়েছে।
পাকিস্তানি আমলে এই সংস্থাটির আঠারোটি নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব কি করে বানচাল হয়ে গেলো সে কথা না তুলে ও স্বাধীনতা-উত্তরকালে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেই আঠারোটির নোট কে নতুনভাবে গ্রহণ করা এবং সেই সংক্রান্ত সুইডিশ ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সির বরাদ্দকৃত ঋণ কিভাবে অব্যবহৃত রয়ে গেল তা চিন্তা করে আমরা উদ্বেগ বোধ না করে পারি না। গত ফেব্রুয়ারি মাসে উক্ত এজেন্সির প্রদত্ত বৈদেশিক মুদ্রা বরাদ্দের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে।
পাকিস্তান আমলে এরকম অকর্ম কুকর্মের দক্ষতা দেখিয়ে অনেক আমলা বাজিমাত করেছেন। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থবিরোধী কাজের বিনিময়ে এনাম মিলত শাসকশ্রেণীর কাছ থেকেই। আজ স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশ যখন সরকার স্বয়ং উদ্যোগ নিয়ে দেশে ক্ষুদ্র শিল্প গড়ে তোলার তথা ক্ষুদ্র পুঁজি বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টির বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন তখন কর্মকর্তাদের খামখেয়ালি আমাদের বিস্মিত করেছে। এটা ‘স্যাবোটেজ’ হতে পারে অথবা অন্যকিছু। কিন্তু যাই হোক না কেন জনসাধারণকে অবশ্যই তা জানতে হবে। দেশে বৃহৎ শিল্প সমূহ যেখানে রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়েছে সেখানে ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠার ব্যক্তিগত উদ্যোগকে কেন নস্যাৎ করার জন্য বিসিক আমলারা তৎপরতা অনুসন্ধান করে দেখা দরকার। হয়তো এর পেছনে বিরাট কোন চক্রান্ত লুকিয়ে রয়েছে। সার্বিক ব্যাপারটা তদন্ত করে দেখবার জন্য কি সরকার এগিয়ে আসবেন? অথবা আরও অনেক ব্যাপার এর মত এক্ষেত্রে ‘যেমন চলছে তেমনি চলুক’ নীতি অনুসরণের মহাজনী পন্থায় গৃহীত হবে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক