You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা: ১৩ই জুন, মঙ্গলবার, ২৯ শে জৈষ্ঠ, ১৩৮০

স্বাধীনতার শত্রুর মোকাবেলা করুন

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি কর্তৃক আয়োজিত এক গণজমায়েত গত পরশুদিন বায়তুল মোকাররমে অনুষ্ঠিত হয়েছে। কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান কমরেড মনি সিং তার ভাষণে দেশের স্বাধীনতার শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। কমরেড মনি সিং আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ সহ সকল দেশ প্রেমিক সংগঠনকে ও উক্ত প্রতিরোধ আন্দোলনে শরিক হওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। এছাড়া তিনি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ চীনের মাওবাদ চক্র এবং তাদের সহযোগী ভাসানী ন্যাপ, উগ্রপন্থী জাসদ, অবলুপ্ত মুসলিম লীগ, জামাতে ইসলাম, রাজাকার, আলবদর, আল শামস প্রভৃতি গণবিরোধী শক্তি স্বাধীনতার নস্যাতের যে ষড়যন্ত্র করছে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আবশ্যকতাকেও তিনি জোরের সঙ্গে ঘোষণা করেছেন। ওই সকল শক্তি যে আজ বন্ধুরাষ্ট্র ভারত ও সোভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছে সে কথাও তিনি উল্লেখ করেন। কমরেড সিং স্বাধীনতার শত্রু এবং অন্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের সমস্যা মোকাবেলার জন্য ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা চালানোর ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। কমিউনিস্ট পার্টি প্রধান তার বক্তৃতার এক অংশে প্রশাসন ক্ষেত্রে অনেক দোষ ত্রুটি উল্লেখ করে বলেছেন যে আমরা সরকারের ভালো কাজের প্রতি যেমন সমর্থন দেবে তেমনি খারাপ কিছু করলে সমালোচনা করবো। প্রসঙ্গে তিনি পনের হাজার ভুয়া লাইসেন্সধারীদের কঠোর বিচার করার দাবি জানান এবং প্রশাসন বিভাগ থেকে দুর্নীতিবাজদের তাড়িয়ে দেব আর সপক্ষেও মত পোষণ করেন।
বজ্র পক্ষে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির গত পরশু দিনের গণনা থেকে বিভিন্ন নেতৃবৃন্দের বক্তব্যে যে বিষয়টি অত্যন্ত সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে তা হলো একশ্রেণীর স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি আজ দেশে তৎপর। তাদের বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে সকল দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক সংগঠনকে। সঙ্গে সঙ্গে দেশের বর্তমান অভাব-অনটন দুঃখ দারিদ্রের মোকাবেলার জন্য সকল দলমত নির্বিশেষে এদিকে এগিয়ে আসতে হবে। দেশের দুঃখকে নিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটার মোটর সমীচীন হবে না। রেড মনি সিং সেদিনের বক্তৃতায় যে আহ্বান জানিয়েছেন তারা বহু পূর্বেই আমরা জানিয়েছি। অভ্যন্তরীণ শত্রুরা আজ তৎপর। বিভিন্ন উপায়ে তারা আজ মাঠে নেমেছে। স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। এ ব্যাপারে দেশি-বিদেশি মদদও যে নেই এমন কথা বলা যাবে না। বহু রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে তাকে কোনক্রমে শত্রুর ষড়যন্ত্রের শিকার হতে দেওয়া যাবে না। এ মুহূর্তে তাই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন দেশ প্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য। এবং শত্রুর মোকাবেলায় একটি সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলা। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি যে ওদের আহ্বান জানিয়েছেন তার প্রতি দেশপ্রেমিক সংগঠনগুলোর সাড়া দেবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। এবং অবিলম্বে দেশব্যাপী একটি প্রতিরোধ আন্দোলনের সূত্রপাত করার ব্যাপারে বাস্তব কর্মসূচি গ্রহণ করা আবশ্যক। আমরা আশাবাদী যে দেশের প্রতিটি দেশপ্রেমিক সংগঠনের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যেকোনো চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে সম্পূর্ণ সক্ষম।

ভুয়া পারমিটশিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা

অসাধু ব্যবসায়ী আর ভুয়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মালিকরা একখণ্ড কাগজের উপর কয়েকটি অক্ষর সম্বলিত একটি লাইসেন্স সংগ্রহের জন্য যার পর নাই প্রচেষ্টা কেরছেন। অনেক ব্যবসায়ী এবং ভুয়া শিল্প প্রতিষ্ঠান মালিকরা উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীদের সুপারিশও রিপোর্টের ভিত্তিতে লাইসেন্স বাগিয়ে ‘টু-প ইস’ যা কামাবার দিব্যি কমিয়েছেন। অসাধু ব্যবসায়ী আর ভুয়া শিল্পপ্রতিষ্ঠান যেমন করে লাইসেন্স সংগ্রহ করছে তা তদন্ত ও এদের বিরুদ্ধে আইনগত ও শাস্তি মূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্দেশ জারি করেছেন। একটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতি, অপরটি শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্রতি। বঙ্গবন্ধু অবগত হয়েছেন যে অসাধু ব্যবসায়ী এবং ভুয়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে পনের হাজার লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। এইসব অসাধু ব্যবসায়ী ও ভুয়া প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স ইস্যু করার জন্য নাকি প্রভাবশালী সরকারি কর্মকর্তারা তদবির এবং সুপারিশ ইত্যাদি দেদার করেছেন। বঙ্গবন্ধু আরো জানতে পেরেছেন যে তেরো শ ভুয়া শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক শিল্প-কারখানায় ব্যবহারের জন্য কাঁচামাল আমদানির লাইসেন্স সংগ্রহ করেছেন। অথচ ওইসব প্রতিষ্ঠান অস্তিত্ব বলতে কিছুই নেই। বঙ্গবন্ধুর আদেশ কার্যকরী করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর অনুসন্ধান ও তদন্ত ব্যুরো এবং দুর্নীতি দমন বিভাগ শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে সাহায্য করবে।
অসাধু ব্যবসায়ী ও ভুয়া শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকদের দুর্নীতি ও দূরত্ব যখন চরম পর্যায়ে উন্নত হয়েছে ঠিক তখনই প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশ। দুর্নীতি পরায়ন ও অসাধু ব্যবসায়ীদের সর্বনাশের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। তা হোক। দুর্নীতিবাজ ও অসৎ ব্যবসায়ীদের নির্মূল করাই আমাদের ব্রত। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও দুর্নীতিবাজদের উচ্ছেদ ও দুর্নীতিবাজ পারমিট শিকারি ও তাদের সহায়তাকারীদের উপযুক্ত শায়েস্তা করতে বদ্ধপরিকর। একথা দিবালোকের মত সত্য যে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা অসাধু ব্যবসায়ী ও ভুয়া শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকদের লাইসেন্স সংগ্রহের ব্যাপারে সহায়তা করে থাকে। উপযুক্ত তদন্ত করলে এ হেন কর্মের পরিচয় যে ভুরিভুরি পাওয়া যাবে তাতে আমাদের কোন সন্দেহ নেই। আমরা জানি অসাধু ব্যবসায়ী ও ভুয়া শিল্প প্রতিষ্ঠান মত সরকারি কর্মচারীরাও এই জঘন্য প্রতারণামূলক কর্মের সঙ্গে জড়িত। দু’পক্ষেরই বিচার এবং শাস্তি হওয়া দরকার। নইলে পারমিট বাজি ও দুর্নীতি পরায়নতা ভূত আমাদের কাছ থেকে অপসারিত হবে না। তাই বঙ্গবন্ধু নির্দেশ যাতে বাস্তবায়িত হয় আমরা তাই আশা করব। তবে শুধু নির্দেশ দিলেই হবে না নির্দেশগুলো কড়ায়-গণ্ডায় কার্যকরী করার মধ্যেও সত্তিকারের সাফল্য ও সার্থকতা নিহিত রয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি যে যথা যোগ্য তদন্ত হলে অসাধু ব্যবসায়ীরা যেমন উৎখাত হবে তেমনি ভুয়া শিল্পপ্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব আর থাকবে না। যারা এসব দুর্নীতি পরায়ন কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং সহায়তাকারী তাদের শাস্তি দেওয়া হলে ভুয়া পারমিটশিকারীদের সমস্ত তৎপরতার অবসান হবে।

সুস্থ সবল শিশু গড়ে তুলতে হবে

বাংলাদেশ শিশু চিকিৎসক সমিতির প্রথম জাতীয় সম্মেলন সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই সম্মেলনে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এক বাণীতে বলেন যে, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্বাসন কাজে প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হল সারা দেশের রুগ্ন ও দুর্দশাগ্রস্ত শিশুদের সব অসুস্থ নাগরিক রূপে গড়ে তোলা।
এ সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন যে প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় একশত ষাট কোটি টাকার পল্লী স্বাস্থ্য কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। প্রত্যেক থানার সদরদপ্তরে পঁচিশ লক্ষ টাকা ব্যয়ে একটি করে স্বাস্থ্য কেন্দ্র স্থাপন ও পরে ইউনিয়ন পর্যায়ে ধরনের কেন্দ্র স্থাপন করা হবে।
উল্লেখিত পদক্ষেপ গ্রহণের পরিকল্পনায় পল্লী স্বাস্থ্য উন্নয়নের মাধ্যমে শিশুসহ সমগ্র জনস্বাস্থ্য কল্যাণের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে বলে অনুমিত হয়। এ প্রসঙ্গে বলা যায় যে আমাদের দেশের পল্লী জনসাস্থ আজ যে পর্যায়ে রয়েছে সেখান থেকে কোন স্বাস্থবান সুস্থ নাগরিক বা শিশু আশা করা প্রায় বাতুলতা। তাই শিশুদের সুস্থ ও সবল নাগরিক রূপে গড়ে তোলার প্রাথমিক স্তরে পল্লী স্বাস্থ্য উন্নয়নের পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নের জন্য উক্ত পদক্ষেপ গ্রহণের উদ্যোগ অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক।
তাছাড়া সম্মেলনে সংবর্ধনা কমিটির চেয়ারম্যান তার ভাষণে সকল হাসপাতালের শিশু বিভাগের উন্নয়ন ঘটানো আবেদন জানান। অতঃপর তিনি ঢাকা নগরীতে একটি শিশু স্বাস্থ্য কেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাব করেন। কারণ শিশুদের সুস্থ সবল করে গড়ে তোলার ব্যাপারে তাদের সুচিকিৎসার বন্দোবস্ত প্রসঙ্গটিও এসে পড়ে। সে প্রসঙ্গে আবার হাসপাতাল তথা শিশু হাসপাতাল বা হাসপাতালের শিশু বিভাগের কথা ওঠে। শিশু চিকিৎসক সমিতি এদিকে দৃষ্টি রেখেছেন।
একথা তর্কের অতীত যে শিশুর হলো জাতির ভবিষ্যৎ। একটি জাতির ভবিষ্যতের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও আদর্শ শিশুর মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয় এবং বাস্তবায়িত হয়। শিশু একদিকে তাই জাতির মূল ভিত্তি অপরদিকে ভবিষ্যতের প্রতীক।
যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের শিশুদের অধিকাংশ আজ রুগ্ন ও দুর্দশাগ্রস্ত। এদের স্বাস্থ্যের প্রতি তাই আর যত্নবান হতে হবে। এদের সব স্বাস্থবান নাগরিক রূপে গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব দিতে হবে সবচেয়ে বেশি। কারণ আজকের শিশুদের স্বাস্থ্যের প্রতি উপযুক্ত যত্ন নেওয়ার মাধ্যমে আগামীকালের স্বাস্থ্যবান নাগরিক পাওয়া যাবে।
পরিশেষে আমরা বলতে চাই যে সমিতির সকল সদস্য যেন নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে শিশু চিকিৎসক সমিতির ভূমিকার মনোনয়নে সমর্থ হতে পারেন। কারণ প্রতিটি পরিকল্পনা ও কাজের মূল্যায়ন তার ভূমিকার উপরই নির্ভর করে। আমরা আশাবাদী। তাই সম্মেলনকে কেন্দ্র করে শিশুস্বাস্থ্য তথা সুস্থ নাগরিকের সম্ভাবনাকে আমরা আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি। সমগ্র জাতির কল্যাণের জন্যই আজ সুস্থ শিশু প্রয়োজন।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!