বাংলার বাণী
ঢাকা: ২৯শে জুন, শুক্রবার, ১৪ই আষাঢ়, ১৩৮০
পাঁচসালার প্রথম সাল
স্বাধীনতার পর জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে আর সে মূল্যবৃদ্ধির যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এই কারণসমূহ উল্লেখ করতে গিয়ে পরিকল্পনা কমিশন যা বলেছেন তা হল স্বাধীনতাত্তোর কালে যেমন অর্থ সরবরাহের পরিমাণ শতকরা তিরাশিভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনিভাবে পণ্য সরবরাহ আবার মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন কমেছে আর বাংলাদেশের প্রয়োজনীয় প্রধান প্রধান দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়েছে। যোগাযোগের অসুবিধা সমন্বয় ও সুযোগ পরিচালনার অভাব তো ছিলই তার উপরে সুষ্ঠু বাজার ও বন্টন ব্যবস্থার অভাবে সুযোগ নিয়ে মুষ্টিমেয় ফরিয়া তথা মধ্যস্থত্ব দেদার মুনাফা লুটছে।
পরিকল্পনা কমিশন স্বাধীনতাত্তোর কালীন বাংলাদেশের পণ্য মূল্যবৃদ্ধির নানা কারণ দেখিয়েছেন। সে কারণসমূহের সঙ্গে কেউ দ্বিমত পোষণ করবে না। গবেষক বিশেষজ্ঞরা হয়তো এর সঙ্গে আর দুচারটা কারণ যোগ করতে পারেন। বিজ্ঞানীরা মাথা নেড়ে বলতে পারেন, না কারণ ঠিক যুক্তিযুক্ত মনে হচ্ছে না। যাই বলুক না কেন আমরা যারা সাধারন মানুষ তারা এই টুকুই বুঝি যে, বাজারে জিনিসের দাম বেড়েছে এবং এই বাড়তি দামটা আমাদের পকেট থেকেই দিতে হচ্ছে।
দাম বেড়েছে, বাড়ার কারণটাও জানা গেছে। কারণ যখন জানা গেছে তখন প্রতিকারের পথটাও অন্ধকারাবৃত নয়। পরিকল্পনা কমিশন এই প্রতিকারের উপায় সমূহের উপর আলোকপাত করলে আমরা উপকৃত হতাম। ক’দিনের মধ্যেই আমাদের পাঁচসালা পরিকল্পনার কাজ শুরু হবে। পরিকল্পনা কমিশন পুরোটা চেহারা চরিত্রও হাজির করতে না পারলেও প্রথম বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনার একটা রূপরেখা দিয়েছেন। ১৯৭৩-১৯৭৪ সালের এই বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনাকে বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ইয়ার বা ভিত্তিবছর হিসেবে ধরা হয়েছে। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় উন্নয়নের মাত্রা বছরের পাঁচ দশমিক পাঁচ ভাগ হবে এবং এদিকে দৃষ্টি রেখে বছরের বিনিয়োগের হার বাড়ানো হয়েছে শতকরা বিশ ভাগ।
উৎপাদন বাড়বে বিনিয়োগ বাড়বে উৎপাদিত পণ্য এবং অর্থ সুষম বন্টন এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছে দেওয়া হবে এসব শুনে কে না খুশি হবে। আজকে অর্ধাহারে আছে সেও ভবিষ্যতের দু’পেট খাবার আশ্বাস পেলে স্বস্তি পায় আজ যে বেকার সেও আগামী বছরের সাড়ে সাত হাজার চাকুরী সংস্থানের খবরে খুশি হয়। টানাটানির সংসারে আমাদের এমনিতেই নানা দুর্গতি। তার উপরে রয়েছে নানা মধ্যস্বত্বভোগী টাউট এবং গণবিরোধী নানা শক্তি। অর্থনৈতিক দুর্বলতা সুযোগ নিয়েই এরা গোঁফ তাওয়ায়, সিনা চাপরায়। আমাদের অস্তিত্ব এবং স্বাধীনতার বিরুদ্ধে হুমকির আশঙ্কা ততদিনই থাকবে যতদিন আমাদের অর্থনৈতিক দৈন্য ঘুচবে না। অর্থনৈতিক পরিকল্পিত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সেই লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে পরিকল্পনা কমিশনের উপর দেশের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে।
পোড়া এদেশে অর্থ বল না থাক, জনশক্তি রয়েছে। সম্পদ রয়েছে মাটির নিচে, সমুদ্রে, বনে চারদিকে ছড়িয়ে। যা আমাদের রয়েছে তার সঠিক ব্যবহার স্বাধীন এবং স্বনির্ভর পরিকল্পনার মুখ্য বিষয়। জানিনা সে বিষয়টাকে কতটুকু গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে আমাদের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায়। আমাদের মত সাধারণ মানুষের কোন সুপারিশ গ্রহণ যদি তাদের মত বিশেষজ্ঞের প্রেস্টিজ কন্সার্ন হয়ে না দাঁড়ায় তবে বলি অনুন্নত একটা দেশের পরিকল্পিত অর্থনীতির কোনদিনই সাফল্য অর্জন করতে পারবে না। যদি না সেখানে জনগণের অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করা হয়। বিষয়টির দিকে দৃষ্টি দেবেন শুধু পরিকল্পনা কমিশনের নয় দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বও। এটা আমাদের আশা আর আগামী দিনের সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনের একটা অন্যতম মূল কথা।
পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে নয়া বিল
বাংলাদেশ-ভারত যৌথ শান্তি প্রস্তাব ঘোষিত হবার পর উপমহাদেশের নদীতে অনেক জল গড়িয়েছে। সারাবিশ্বে তা নিয়ে আলোচনার ঢেউ উঠছে। তাবৎ দুনিয়ার শান্তিকামী মানুষ সে প্রস্তাব এর সমর্থনে এগিয়ে এসেছে। কিন্তু পাকিস্তান যে সেই বাড়ির মধ্যে মুখ গুঁজে একটানা উটপাখির নীতি অনুসরণ করে চলছে। তারে বিবেক এবং শান্তি বিরোধী কার্যক্রম মদদ যুগিয়ে চলেছে সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী এবং চীনের হটকারী নেতৃত্ব।
সম্প্রতি চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইরান হয়ে পাকিস্তানি গিয়েছিলেন। চীনা মন্ত্রী সেখানে পাকিস্তানের সরকারি নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কি আলোচনা করেছেন তা জানা যায়নি। তবে সংবাদ প্রকাশে পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল পিপলস পার্টি সেখানকার জাতীয় পরিষদে বাংলাদেশকে শর্তযুক্ত স্বীকৃতিদানের একটা বিল পেশ করতে যাচ্ছেন। সে বিল নিয়ে পরিষদে আলোচনা হবে এবং সর্বশেষে তার উপর বক্তব্য রাখবেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট স্বয়ং। যে শর্তগুলোর কথা জানা গেছে তা হলো, পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীদের মুক্তিদান, বাংলাদেশ কর্তৃক পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সিদ্ধান্ত তুলে নেওয়া এবং পাকিস্তান যে বৈদেশিক ঋণ এতদিন গ্রহণ করেছে তার একটা অংশ বাংলাদেশ কর্তৃক পরিশোধ করা। পাকিস্তানে আটক বাঙ্গালীদের বিএফ পারে অথবা বাংলাদেশের অবস্থানকারী যেসকল পাকিস্তানের সাপেক্ষে অপসন দিয়েছেন তাদের ব্যাপারে কোনো বক্তব্য রাখা হয়নি।
পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের এই বিল বাংলাদেশ-ভারত যৌথ শান্তি প্রস্তাবেরই একটা উত্তর বিশেষ। আমরা উপমহাদেশের শান্তি এবং মানবিক বিষয় গুলোকে সামনে রেখে যে প্রস্তাব রেখেছিলাম তাকে নাকচ করে পাকিস্তানের শাসক সম্প্রদায় সাম্প্রতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে চলেছেন। আংশিকভাবে নয় বরং সামগ্রিকভাবে উপমহাদেশের সমস্যা তুলে ধরেছিলাম। যেমন ছিল যুদ্ধবন্দী এবং যুদ্ধাপরাধীদের প্রশ্ন তেমনই ছিল পাকিস্থানে আটক বাঙালি এবং বাংলাদেশের অবস্থানকারী অবাঙালিদের প্রশ্ন। সেখানে যুক্তি ছিল ছিল মানবিক সমস্যার বাস্তব স্বীকৃতি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সিদ্ধান্ত আমাদের মানবতাবোধের স্বার্থেই। যারা মানবতার বিরুদ্ধে এতবার আক্রমণ চালাতে পারে তাদের বিচার হবে এটার ন্যায়ের কথা, ঔচিত্যের কথা। যুদ্ধবন্দীদের পাকিস্তানে ফিরে যেতে দেওয়া হবে। এ ব্যাপারে আমরা আমাদের বক্তব্য সুস্পষ্টভাবেই রেখেছি। বলেছি একইসঙ্গে পাকিস্তানের যারা বাংলাদেশে আসতে চায় অথবা বাংলাদেশের যারা পাকিস্তান নিয়ে যেতে চায় তাদের নিজ নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের অনুমতি দেওয়া হোক।
আমরা কোন বিদ্বেষ রাখিনি। দেশে দেশে শত্রুতা সম্পর্ক সৃষ্টির কূটকৌশলের বিশ্বাস স্থাপন করিনি। খোলা দিলে সাতটা মনে শান্তি প্রতিষ্ঠার বাস্তব পথকে আমরা বেছে নিয়েছি। এই চলার পথে সমর্থন এবং সহযোগিতার হস্ত সম্প্রসারিত করেছে বিশ্ববিবেক তথা তাবৎ দুনিয়ার শান্তিকামি মানুষ। এ থেকে বিচ্যুতির যেমন কোন প্রশ্ন ওঠেনা তেমনি ওঠেনা প্রস্তাবের পরিবর্তন পরিবর্ধন। শতাধিক দেশের শান্তিকামী এ বাংলাদেশকে শর্তহীনভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আগামীতেও যদি কেউ স্বীকৃতি দিতে চায় তবে তাকে ওটা দিতে হবে শর্তহীনভাবে।
পাকিস্তানের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের যে প্রশ্ন উঠেছে সে সম্পর্কেও আমরা বহুবার আমাদের বক্তব্য রেখেছি। বঙ্গবন্ধু শুধু আজ নন সেই গোড়া থেকেই সেগুলো আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ তথা বিশ্বের বিভিন্ন ঋণ প্রদানকারী দেশকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন পাকিস্তান তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের নামে যে ঋণ গ্রহণ করছে অথচ তা সঠিকভাবে ব্যয় করছে না। এ ঋণের বোঝা আমরা বহন করব না। আজ আবার নতুন করে সে প্রশ্ন উঠবার কোনো অর্থই হয় না। পাকিস্তান তার আন্তর্জাতিক মুরুব্বীদের ইশারায় নাচছে। আন্তর্জাতিক শক্তিসমূহের চক্রান্তেই পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অবস্থার ধ্বংসম্মুক। সে ধ্বংসের স্রোতকে কি এমন ভাবে ঠেকানো যাবে? বাংলাদেশের কাঁধে দোষ চাপিয়ে কি ভুট্টা যুদ্ধবন্দীদের আয়োজিত আত্মীপরিজনের চাপ হালকা করতে পারবেন?
পাকিস্তানের শাসক সম্প্রদায় স্বদেশের ইতিহাস খতিয়ে দেখেন না। সাধারণ মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কথা তো নয়ই এমনকি সদস্যের আন্তর্জাতিক নীতিসমূহ অতীতের ব্যর্থতা তাদের কোন প্রকার শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। সেখানকার শাসকগোষ্ঠীর দিনের-পর-দিন বেশি করে বিদেশী শক্তি নির্ভর হয়ে উঠেছেন। আর উপমহাদেশের অবস্থাকে নিয়ে যাচ্ছে অশান্তির পথে। অশান্তি কারো জন্যই মঙ্গল জনক নয়। সময় এখনো বইয়ের যায়নি। পাকিস্তান কি বাস্তবতায় ফিরে আসবে?
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক