বাংলার বাণী
ঢাকা: ১২ই জুন, সোমবার, ২৮শে জৈষ্ঠ, ১৩৮০
খাদ্য সংকট সম্পর্কে আশাবাদ
বৃষ্টিপাত হলে ভূমি উর্বর হয়। মাঠে মাঠে ফসলের সমারোহ দেখা দেয়। খরা ফসল উৎপাদন বিঘ্নিত করে। খরা মানুষের দুশ্চিন্তার কারণ। খরা রাতের ঘুম কেড়ে নেয়। বাংলাদেশ সে পর্যাপ্ত খাদ্য শস্য উৎপাদনের জন্য বৃষ্টিপাত খুবই জরুরী। কিছুদিন আগে বাংলাদেশ বৃষ্টিপাত হয়েছে। জাতিসংঘের ত্রাণ কার্যক্রম এর সমন্বয় কর্মকর্তা স্যার রবার্ট জ্যাকসন সম্প্রীতি বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে মাঝারি ধরনের বৃষ্টিপাত হয়েছে। এবং এমনটাই আমরা চেয়েছিলাম। স্যার জ্যাকসন আরো বলেছেন যে, বাংলাদেশের শহর অঞ্চল গুলোতে গত তিন সপ্তাহে খোলা বাজারে চালের দাম হ্রাস পেয়েছে।
স্যার জ্যাকসন আশা প্রকাশ করেছেন যে, এতে করে যারা চাল মজুদ করে রেখেছিল তারা মজুদকৃত চাল বাজারে ছাড়তে শুরু করেছে।
চাল যে প্রচুর পরিমাণে বাজারে মজুত রয়েছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। এই মজুদকৃত চাল যদি বাজারে ছাড়া হয় তাহলে চালের দাম ক্রয় ক্ষমতার আওতার মধ্যে আসবে বলে আমরা মনে করি। বৃষ্টিপাতের ফলে ও আমাদের আশাবাদ প্রকাশ এর সঙ্গত কারণ রয়েছে।
ইতিপূর্বে জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল বাংলাদেশ খাদ্যশস্য প্রেরণের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতি যে আবেদন জানিয়েছিলেন তাতেও আশানুরূপ সাড়া পাওয়া গেছে। ইউরোপীয় অর্থনৈতিক গোষ্ঠী বর্তমান মাসে প্রায় এক লাখ ২০ হাজার টন খাদ্যশস্য বাংলাদেশ পাঠাবেন বলে স্যার জ্যাকসন জানিয়েছেন।
এছাড়া আরো ৫৫ হাজার টন খাদ্যশস্য আগামী আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর এর গোড়ার দিকে বাংলাদেশে এসে পৌঁছাবে। আমাদের খাদ্য সংকট মোকাবেলার পরিপ্রেক্ষিতে এ পরিস্থিতির নিশ্চয়ই আশাব্যঞ্জক। জাপান ও বাংলাদেশকে চাল সরবরাহ করবে এবং এ ব্যাপারে একটি চুক্তিও স্বাক্ষরিত হবে বলে স্যার জ্যাকসন জানিয়েছেন। অবস্থান অনুযায়ী আমাদের মনে হচ্ছে খাদ্য সমস্যার একটা সুরাহা হয়ে যাবে এবং সে অনুযায়ী নানারকম প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। স্যার জ্যাকসন বাংলাদেশের খাদ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে যে আশাবাদ প্রকাশ করেছেন তা একেবারে অমূলক নয়। বৃষ্টিপাত বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ বলতে হবে। অবশ্য অতিবৃষ্টি অনাবৃষ্টি আমাদের ক্ষতি ছাড়া লাভবান করে না। এই বৃষ্টিপাতের ফলে খাদ্যশস্য উৎপাদনের পথ সুগম হবে। তাছাড়াও বাজারে চালের মূল্য হ্রাস পেয়েছে। এতে যারা অধিক মুনাফা লোটার আশায় দিন গুনছিল তাদের কপালে গুড়ে বালি পড়েছে। মজুদকৃত চাল এখন স্বাভাবিক কারণে খোলা বাজারে বিক্রির জন্য ছাড়া হবে। এ অবস্থা আমাদের খাদ্য পরিস্থিতিকে আশার আলো দেখাবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। বাজারে যদি পর্যাপ্ত চাল পাওয়া যায় এবং সে চালের দাম যদি আকাশচুম্বী না হয় তাহলেই বাংলাদেশের মানুষের বেঁচে থাকার একটি অন্যতম প্রধান সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। আমাদের ধারণা খাদ্য সমস্যা আমরা নিশ্চয়ই কাটিয়ে উঠতে পারব তবে বিদেশি সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে খাদ্যশস্য উৎপাদনে আমাদের মনোযোগী হওয়া একান্ত বাঞ্ছিত। বৃষ্টির পর উর্বরা জমিতে কৃষকরা যদি ধান চাষ না করেন তাহলে আমাদের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করব কেমন করে?
লঞ্চ ডুবি এবং আনুষঙ্গিক বিষয়াদি
গত শুক্রবার সন্ধ্যায় মুন্সীগঞ্জে একটি ভয়াবহ লঞ্চ দুর্ঘটনায় প্রায় দুই শতাধিক নারী ও শিশুর সলিল সমাধি হয়েছে বলে আশঙ্কা করা হয়েছে। ঘটনার বিবরণে জানা গেছে যে’ বরিশালগামী লঞ্চ এম, এল রুপালি ও মুন্সিগঞ্জে এম, এল, পায়েল এর সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষের ফলে এ দুর্ঘটনাটি ঘটে। সংঘর্ষের সঙ্গে সঙ্গে পায়েল এর সামনের অংশ ভেঙ্গে গুড়িয়ে যায় এবং মাত্র এক মিনিটের মধ্যে সমস্ত লঞ্চটির নদীগর্ভে ডুবে যায়।
সংঘর্ষের প্রচণ্ড শব্দ ও মরণ যাত্রীদের গগনভেদী আর্তনাদ শুনে লঞ্চে ডাকাতি হচ্ছে ভেবে পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীর ডুবন্ত লঞ্চ এর উভয় দিক থেকে গুলি বিনিময় করে। এ ঘটনা দুর্ঘটনাকে আরও করুণ করে তোলে। ফলে কেউ উদ্ধার কাজে অগ্রসর হতে সাহস করেনি।
নদীবক্ষে এ ধরনের দুর্ঘটনা হরহামেশাই ঘটে। এভাবে প্রায়ই কিছুসংখ্যক মানুষ অকালে তাদের অমূল্য প্রাণগুলো হারায়। এখন প্রশ্ন হল- এই ধরনের দুর্ঘটনা কেন ঘটে, ঘটলেও ক্ষতির পরিমাণ কত হয় এবং প্রতিকারই বা কী?
আপাতঃদৃষ্টিতে দেখা যায়, দুর্ঘটনা ঘটার প্রধান কারণ অসাবধানতায় অর্বাচীনতা। লঞ্চগুলো অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই থাকে। নদীবহুল এ বাংলাদেশের নৌ পরিবহনের গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষ করে বর্ষাকালে দেশের অধিকাংশ এলাকায় সড়ক পথে যখন যোগাযোগ সূত্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তখন জলপথে দেশের অধিকাংশ লোক চলাচল করে এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে। সে ক্ষেত্রে জল পরিবহন রূপে লঞ্চের সর্বাধিক পরিমাণে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এদিকে আবার যাত্রীর সংখ্যা তুলনায় লঞ্চের সংখ্যা অপ্রতুল। অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে লঞ্চ গুলিকে বোঝায় করা হয়। অতঃপর ওই বোঝায় জলযানটি অত্যন্ত অসাবধানতার সঙ্গে দ্রুতগতিতে চালনা করা হয়। কারণ তা নাইলে সম্মুখ সংঘর্ষ হতে পারে না এবং এমন দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে না।
লঞ্চ ডুবিতে শুধু যে অমূল্য প্রাণের ক্ষতি হয়েছে তাই নয় পরিবহন যানটির বিপুল ক্ষতি সাধিত হয়। একে তো হানাদার বাহিনী দেশের সম্পদ বিনষ্ট করে দিয়ে গেছে। বহু জলযান ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। প্রয়োজনের তুলনায় তাই জলযানের অভাব প্রকট ভাবে দেখা দিয়েছে সে ক্ষেত্রে লঞ্চডুবিতে জলযানের ক্ষতিও উপেক্ষা করা যায় না। তদুপরি হতভাগ্য লোক গুলির সঙ্গে যে সকল অর্থ-সম্পদ ও মাল থাকে তাও নিমজ্জিত হয়। ক্ষতির পরিমাণ তাতে বেরিয়ে যায়।
এর প্রতিকার চিন্তা করতে গেলে প্রথমে সংশ্লিষ্ট মহল কে এদিকে নজর দিতে হবে। জল পরিবহন গুলো ক্ষমতানুযায়ী যাত্রী নিচ্ছে কিনা, জলপথে চলাফেরা নিয়ম-নীতিগুলো মেনে চলছে কিনা সেদিকে বিশেষ ভাবে তদারক করে রাখতে হবে। একথা সর্বজন স্বীকৃত যে যেকোন প্রকার পরিবহনের জন্য সাবধানতা অবলম্বন উনিটি নিয়ম মেনে চলাটা দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান পথ। সে দিক থেকে যাত্রীসাধারণ ও পরিবহণ সংস্থা কে সচেতন করে তোলা প্রয়োজন। অন্যথায় এমন ধরনের জান ও মালের ক্ষয়ক্ষতির যোগফল ক্রমশ বর্জিত হয়ে জনজীবনের অশান্তি, উৎকণ্ঠা ও নিরাপত্তাবোধ কে যেমন বিড়ম্বিত করবে তেমনি জাতীয় লোকসানকে বাড়িয়ে তুলবে।
দুর্বৃত্তদের মূল ঘাটি ভেঙ্গে দিতে হবে
ঢাকার দুটো ঘটনা। দুটোই উদ্বেগজনক। বাবলি নামের ছোট্ট মেয়েটিকে উদ্ধার করা হয়েছে তালাবদ্ধ ছোট্ট একটি কুঠুরি থেকে। আর মাইজদী কোর্ট থেকে আসা চৌধুরী মিয়াকে ১৭ দিন বন্দী থাকার পর মুক্ত করা হয়েছে পোস্তগোলা নিকট একতলা দালান থেকে। প্রথম ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার অপরাধে জনৈকা আলতাফকে গ্রেফতার করা হয়েছে, দ্বিতীয় ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে গ্রেফতার হয়েছে আরো দুজন। দু ক্ষেত্রে পুলিশ বাহিনীর তৎপরতা প্রশংসনীয়।
চৌধুরী মিয়াকে বন্দি করে রেখেছিল একটি পেশাদারী দুর্বৃত্ত দল। যে মামলার তদবির করতে তিনি সুদূর মাইজদী কোর্ট থেকে ঢাকায় এসেছিল সে মামলাতেই তার এক প্রতিপক্ষ চৌধুরী মিয়াকে হত্যার জন্য দুর্বৃত্ত দলটিকে নিযুক্ত করেছিলেন। টাকা লেনদেনে কিছু গন্ডগোল হওয়ার অবশেষে চৌধুরী মিয়াকে হত্যা করা হয়নি কিন্তু লেনদেনের পরিষদ হবার পর তাকে হত্যা করা হবে এ উদ্দেশ্যে তাকে পোস্তগোলার এক দোতলা দালানে আটকে রাখা হয়।
ঘটনা দুটোর সঙ্গে সঙ্গবদ্ধ দুর্বৃত্ত দল জড়িত রয়েছে। আমাদের উদ্বেগের কারণ এখানেই, সাধারনত এই সকল সঙ্ঘবদ্ধ দুর্বৃত্তদের পেছনে সমাজের উচ্চ আসনে বসা অনেকের শক্তি ও প্রেরণা কাজ করে। দ্বিতীয় ঘটনাটি সঙ্গে জড়িত দুর্বৃত্ত দলের সঙ্গে এমনই এক বিত্তশালী লোকের যোগাযোগের কথা পুলিশ কর্তৃপক্ষ নিজেই বলেছেন। সুতরাং সঙ্ঘবদ্ধ এসকল দুর্বৃত্তদের উচ্ছেদ করতে হলে প্রথমেই তাদের পেছনে কার্যরত মূল শক্তিকে উচ্ছেদ করতে হবে। পুলিশ বাহিনী চৌধুরী মিয়াকে উদ্ধারে তৎপরতা দেখিয়েছেন তাতে তারা অভিনন্দন পাবার যোগ্য। কিন্তু দুর্বৃত্তদের মূল ঘাঁটিসমূহ তারা যতদিন ভেঙে দিতেন না পারছেন ততদিন যে অন্য কোনো বাবলি অথবা অন্যকোন চৌধুরী মেয়েদের চক্রান্তের শিকারে পরিণত হবে না তা কে বলতে পারে?
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক