বাংলার বাণী
ঢাকা: ২৭শে জুন, বুধবার, ১২আষাঢ়, ১৩৮০
সোভিয়েট-মার্কিন যুক্ত ইশতেহার
অবশেষে সোভিয়েট মার্কিন যুক্ত ইশতেহার স্বাক্ষরিত হয়েছে । পারস্পরিক সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শান্তি রক্ষার প্রতিনিধি হিসেবে উভয় দেশের জনগণের মধ্যে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা গড়ে তোলার ব্যাপারে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্র বৃহত্তর উদ্যোগ নেবে।
ইশতেহারে উভয়পক্ষ মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যা যথাসম্ভব দ্রুত নিষ্পত্তি উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এতে বলা হয়, মধ্যপ্রাচ্যের সংশ্লিষ্ট সকল রাষ্ট্রের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব এবং প্যালেস্টাইনি জনগণের অধিকারের ভিত্তিতে এই সমস্যার সমাধান করতে হবে।
ইশতেহারে আরও উল্লেখ করা হয়, ইউরোপে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা আনয়নে উভয় রাষ্ট্রের একাগ্রতা প্রকাশ করা হয়।
ইউরোপীয় রাষ্ট্রবর্গ বিশেষ করে পশ্চিম জার্মানির মধ্যে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে স্বাক্ষরিত চুক্তির ফলে পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে যুক্ত ইশতেহারে তাতে সন্তোষ প্রকাশ করা হয়। এতে ১৯৭১ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর স্বাক্ষরিত চতুর্থ শক্তি জোটের প্রতি অভিনন্দন জানানো হয়।
ভিয়েতনাম লাওস এবং কম্বোডিয়া-সহ সমগ্র ইন্দচিনে শান্তি প্রতিষ্ঠার উপর গুরুত্ব আরোপ করে বলা হয় যে, ভিয়েতনাম কম্বোডিয়া এবং লাওসের জনগণ বাইরের হস্তক্ষেপ ছাড়াই তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যত নির্ধারণ করবেন।
ইশতেহারের যুদ্ধ বিশেষ করে পারমাণবিক যুদ্ধ পরিহার ও কৌশলগত মারণাস্ত্র সমিতি করানোর ওপর জোর দেওয়া হয়।
সোভিয়েট মার্কিন যুক্ত ইশতেহারের গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ তো বটেই। তবে এমন একটি সময় সোভিয়েত মার্কিন যুক্ত ইশতেহার প্রকাশিত হয়েছে যখন বিশ্বের অন্যান্য অংশের যুদ্ধের স্ফুলিঙ্গ ধিকি ধিকি জ্বলছে। যেকোন সময়ে তা দাবানলে পরিণত হতে পারে। যুক্ত ইশতেহারের যুদ্ধ বিশেষ করে পারমাণবিক যুদ্ধ পরিহারের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে বটে তবে আন্তর্জাতিক আদালত ফ্রান্সের পারমাণবিক বোমা পরীক্ষার বিরুদ্ধে রায় দেওয়ার সত্বেও ফ্রান্স নিজের খেয়াল-খুশি মাফিকই পারমানবিক বোমা বিস্ফোরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড এ ব্যাপারে সাধ্যমত সেই শান্তি বিরোধী তৎপরতার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইন্দোচীনে এখনো স্থায়ী শান্তি আসেনি, আরব ভূমিতে ইসরাইলি হুমকি, ভারত মহাসাগর এলাকায় যুদ্ধজাহাজের পাঁয়তারা সবকিছু মিলিয়ে যে ছবি বিশ্ববাসীর চোখের সম্মুখে ভেসে ওঠে তাহলে স্থায়ী শান্তির পথে একটা অনিশ্চিত অবস্থা। এ অবস্থা চলতে থাকলে স্থায়ী শান্তি কোন অবস্থাতে আসতে পারবে না। সোভিয়েত রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দ্রুত বৃহৎ শক্তি বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে এসেছেন দেখে শান্তিকামী মানুষ মাত্রই আনন্দিত হবেন। কিন্তু তবুও একটি প্রশ্ন থেকে যায় যে, অতীতেও যে এ ধরনের প্রচেষ্টা চালানো হয়নি এমন নয়। যা বলা হয়েছে তা কার্যকরী করা হয়নি। কথা আর কাজের সমন্বয় সাধন ঘটেনি। আমরা আশা করি সোভিয়েট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যা বলা হয়েছে বাস্তবতেও সত্যিকারের প্রতিফলন ঘটবে। ইশতেহারের বক্তব্যকে বাস্তবায়িত করতে দুই পক্ষই এগিয়ে আসবে।
বাংলাদেশ-জি ডি আর মৈত্রী
পূর্ব জার্মানির সোস্যালিস্ট ইউনিটি পার্টি পাকিস্তানে আটক বাঙালিদেরকে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের প্রস্তাব সম্মিলিত ভারত-বাংলাদেশ যৌথ ঘোষণাকে অভিনন্দিত করেছেন। উপমহাদেশে বিরাজমান সমস্যা সমাধান করে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে এ ঘোষণাকে তারা একটি বাস্তব পদক্ষেপ বলে মনে করেন।
গত সোমবার বার্লিনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও জার্মানির সোস্যালিস্ট ইউনিটি পার্টির এক যুক্ত ইশতেহারে এ কথা বলা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য যে, এই পার্টির আমন্ত্রণক্রমে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব জিল্লুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দলের ১০ দিনব্যাপী জি,ডি,আর-এ ব্যাপক সফর শেষে এই ইশতেহার প্রকাশিত হয়।
ইশতেহারে জিডিআর অবিলম্বে বাংলাদেশকে এবং বাংলাদেশে জিডিআরকে জাতিসংঘের সদস্যপদ দানের পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। উভয় দলের নেতৃত্ববৃন্দ উভয় দেশের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অনুধাবন করে পারস্পরিক আস্থা ও সহানুভূতির ভিত্তিতে মৈত্রী সম্পর্ক সুদৃঢ় করার প্রশ্নে মত প্রকাশ করেছেন। জি,ডি,আর নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও আস্থা কাজ করেন। জনাব জিল্লুর রহমান জি,ডি, আর নেতাদের কাছে উপমহাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশের মনোভাব ব্যাখ্যা করেন।
বস্তুত এই ইশতেহারের শান্তি তত্ত্ব উপমহাদেশে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ও ভারত যুদ্ধ ঘোষণার মাধ্যমে যে পদক্ষেপ নিয়েছেন হিংসার রাজনীতিতে উন্মুক্ত এবং চীন-মার্কিন আঁতাতের অবৈধ ফসল পাকিস্তানের জঙ্গির শাসকরা তার বাস্তবতা মেনে নিতেন না চাইলেও সুদূর পূর্ব ইউরোপীয় দেশ জি,ডি,আরের সাধারণ মানুষ সেটা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। তারা বাংলাদেশের ভূমিকার প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধাশীল সে কথাটাও এতে পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে।
জি ডি আর বাংলাদেশের একটি অন্যতম অকৃত্রিম বন্ধু। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে দেশের সরকার এবং জনগণের যে হৃদয় নিংড়ানো সহানুভূতি আমরা পেয়েছি বাংলাদেশের জনগণ তা সবসময় স্মরণ রাখবে। তাছাড়া উপমহাদেশের বাইরে জি ডি আর ই প্রথম দেশ এবং মোট তৃতীয় দেশ যে বাংলাদেশের বাস্তবতা মেনে নিয়ে এই দেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশ জি ডি আর মৈত্রী আত্মিক সম্পর্কের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং এই সম্পর্কের অবশ্যই অটুট থাকবে।
এ দেশ বস্ত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে
গত পরশু জয়দেবপুরের নিকটস্থ কাসেম কটন মিলস এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভাষণ প্রসঙ্গে শিল্প মন্ত্রী সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, অদূর ভবিষ্যতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করার জন্য সরকার একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। বর্তমান পাঁচশালা পরিকল্পনা শেষে এ লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
এই মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, কোন লক্ষ্যে পৌঁছতে গেলে শুধু বড় বড় কথা আওড়ালে চলবে না। সে লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য একদিকে কাজের মাধ্যমে পরিস্থিতি উন্নয়নের চেষ্টা করতে হবে অপরদিকে অবাঞ্ছিত উদ্ভূত প্রতিবন্ধকতাসমূহ নির্মূল করতে হবে।
বাংলাদেশ কোন দিন বস্ত্রশিল্পের স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল না এ কথা সত্য। কিন্তু সেসব ঔপনিবেশিক আমলের কথা। পাকিস্তানি শাসনের ২৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের কটন টেক্সটাইল মিল স্থাপনের কোন প্রচেষ্টা নেওয়া হয়নি। শুধুমাত্র জনসাধারণের চোখে ধুলো দেবার জন্য যে দু-চারটি বস্ত্র শিল্প ও কারখানা স্থাপিত হয়েছিল তার দ্বারা সাড়ে সাত কোটি বঙ্গবাসীর বস্ত্র চাহিদা তখনই মিটেনি। তদুপরি হানাদার বাহিনী এইসকল মিল-কারখানার প্রভূত ক্ষতিসাধন করার ফলে এগুলো উত্পাদন বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছিল। যার ফলে দেশে বর্তমানে বস্ত্র সংকট এত ঘনীভূত হয়েছে। তবু বস্ত্র সংকটের আবর্তন মধ্য থেকে দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার পরিকল্পনা দেশবাসীকে প্রকৃতপক্ষে আশান্বিত করেছে।
আমরা জানি যে, আমাদের বস্ত্র সমস্যার মূল কারণ হ’লো- পাকিস্তানের ২৫বছরের শাসনের এখানে মাত্র ২৩টি সুতাকল একুশটি কাপড়ের কল ছিল। এই মিলগুলোর কাপড়ের উৎপাদন ছিল অপ্রতুল। অথচ আমাদের মাথাপিছু ৯ গজ করে ৬৬ কোটি গজ কাপড়ের প্রয়োজন। ওই ৪৪টি কল ছাড়া আর ৬টি কল নির্মাণাধীন ছিল। তারমধ্যে দুটোতেই ইতিমধ্যেই উৎপাদন শুরু হয়েছে। বাকি তিনটি এ বছরের মধ্যেই উৎপাদনে যাবে। এছাড়াও যুগ যুগ ধরে যে তাঁতশিল্প এককালে সমগ্র বঙ্গবাসীর অধিকাংশ দোকান দিত সেগুলো পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যাসে সঙ্গে করতে হবে। এর দ্বারা মোটা কাপড়ের চাহিদার অনেকটাই মিটবে। সর্বোপরি বাংলাদেশের তাঁত শিল্পের যে একটা ধারাবাহিক ঐতিহ্য ছিল তা পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশের সম্পূর্ণতা অভিযান ত্বরান্বিত হবে। কিন্তু এখানেও কথা আছে। এই ঐতিহ্যমন্ডিত তাঁত শিল্পকে শুধুমাত্র বাঁচিয়ে রাখতে হলে মৌলিকভাবে রং সুতা ইত্যাদির ব্যবসা সংক্রান্ত দুর্নীতিকে অবিলম্বে দমন করতে হবে। দুর্নীতি দমন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু এক নির্দেশ জারি করেছিলেন। কিন্তু তা উপেক্ষা করে বর্তমানে বহু মিথ্যে লাইসেন্স এখনো ইস্যু করা হচ্ছে। ফলে প্রকৃত ফ্যাক্টরির মালিকরা সুতা পায়না। খবরে এমন তথ্য পাওয়া গেছে যে মহকুমা প্রশাসক এর দপ্তরে অথবা তদন্তকারী কর্মকর্তাদের মোটা বকশিশ না দিলে বিভিন্ন আইন দেখিয়ে সত্যিকারের তাঁতীকে লাইসেন্স দেওয়া হয় না। ফলে স্বভাবতই জনসাধারণের মনে প্রশ্ন জাগে যে সকল উন্নয়নমুখী পরিকল্পনাকে যারা এমন করে বানচাল করে দিচ্ছে তাদের উৎপাত আর কতদিন চলবে? এসব দুষ্ট ক্ষত সমাজ দেহের সর্বত্র বিস্তৃত ছড়াচ্ছে এবং দেশের স্বয়ংসম্পূর্ণতার বিপক্ষে এক প্রচণ্ড হুমকিস্বরূপ হয়ে ক্রমশ বিস্তার লাভ করছে। দেশের বৃহত্তর স্বার্থেই নির্মমভাবে এদের বিনাশ করতে হবে। এদের আর কোনমতে প্রশ্রয় দেওয়া চলবে না।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক