বাংলাদেশ ১৯৭১
নিবারণ চক্রবর্তী
এই যে দাদা আসুন আসুন। দেখেছেন আজকের কাগজ? কী ঠাট্টা করেন দাদা, খবর কাগজের লোেক আপনি, আর কাগজ দ্যাখেন না, তা কি হয়। রসিকতা ছাড়ন। এই পেঁচো, বাবুকে এক কাপ চা দাও। বউদি কি বাপের বাড়ি? হা হা। বিড়ি চলবে?
কী বলছিলাম? হ্যা এই যে খবরটা। জেলখানার মধ্যে তেরােজন কয়েদীকে স্রেফ লাঠিপেটা করে সাবাড় করে দিলে। হ্যা এই যে দেখুন না ডি এম বলেছে জেলরক্ষীরা গুলি ছোড়েনি। ডিএম-এর বাক্যি মানতে হবে। তা গুলি তৈরির তাে দস্তুর মতাে খরচ আছে, না কি বলেন? দুর্দিনে সরকারের খরচ বাঁচল, এটা কম বড় কথা নয়। লাঠি পিটিয়েই যখন মানুষ নিখরচায় মারা যায় তখন আমােক গুলি খরচের আমি বিরােধী। আমাদের মফস্বল শহরে ছােটোবেলায় দেখেছি মিউনিসিপ্যালিটির ডােমেরা ইয়া কুঁদো লাঠি নিয়ে রাস্তার বেওয়ারিশ কুকুরদের ঠেঙ্গিয়ে মেরে ফেলত। উফ, তাদের সে সময়ের কান্না যদি শুনে থাকেন!
মিউনিসিপ্যালিটির উচিত ছিল সঙ্গে এক দল লােককে ক্যানেস্তারা নিয়ে পাঠিয়ে দেয়া। ক্যানেস্তারার শ৷ কুত্তাদের বেলাল্লা কান্নাকে চাপা দেয়া যেত। তা ওই ছেলেগুলাে কী কেঁদেছিল? জেলখানার পাঁচিল ছুঁড়ে কি ওদের কান্না বাইরে আসতে পথ পেয়েছে? তবু মানুষ কাঁদে, শােনবার লােক না থাকলেও কাঁদতে হয়।
কী বলছেন! ওরা লােহার রড সংগ্রহ করেছিল? মাইরি দাদা আপনারা কাগজের লােক, আপনাদের ক্ষুরেঙ্গুরে দণ্ডবৎ। আপনারা কান দিয়ে দেখেন, চোখ দিয়ে শােনেন, আপনাদের বাহাদুরির সীমা নেই। হলফ করে বলুন দেখি : আপনারা লােহার রড দেখেছিলেন? কী বলছেন? আহা, তার মানে আপনারা সেই মতাে রিপাের্ট পেয়েছেন, এই তাে? তা লােহার রড কেন, ওদের হাতে পিস্তল, রাইফেল, কী লাইট মেশিনগান তুলে দিলে কি খুব অবিশ্বাসযােগ্য হত? দাদা ঠাট্টা করবেন না, এক মাস শ্রীঘরে কাটাবার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল, জেল গেটের খাতায় নাম লেখার সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গে আমাদের প্রায় ল্যাংটো করে ভেতরে পাঠানাে হয়েছিল। শালা, একটা বিড়ি লুকোবারও উপায় ছিল না। কী বলছেন? সে দিনকাল আর নেই। হ্যা দিনকাল বদলেছে স্বীকার করতেই হয়। নাহলে লালমুখাে সাহেবরা টেররিস্টদের কেবল লাঠির ঘায়ে সাবাড় করে দেবার কথা চিন্তাও করত না।
কী বলছেন! টেররিস্টদের কথা আলাদা? আলাদা তাে বটেই। ওঁদের সহকর্মীরা এখনাে বেঁচে আছেন, যারা মারা গেছেন তাঁদের রক্তপাত যে বিফলে গেছে, সেটা এঁরা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছেন। আজকের দিনে ইস্কুলের ছেলেরা কথাটা মুখস্থ করে পরীক্ষায় পাস করে যে, অহিংসার পথে দেশ স্বাধীন হয়েছে। কী বলছেন, টেররিস্টদের কথা থাক? আচ্ছা থাক। হ্যা এসব কথা বলারও বিপদ আছে। শুধু শুধু বিপদ কে ঘাড়ে নিতে চায় বলুন? না আর বলব না।
কী বলছেন ব্যক্তিগত সন্ত্রাসে কিছু হয় না? এরা ভ্রান্ত! এই পর্যন্ত আপনার বক্তব্য হলে, আমরা আলােচনা করে দেখতে পারি। কথাটা কী জানেন? এ দেশের সাধারণ মানুষ বহুকাল থেকেই ব্যক্তিগত সন্ত্রাসের শিকার। জমিদার চাষির কাছে নিয়ত এক অত্যাচার, জোতদার মহাজন, কারখানার মালিক, যে কোনাে বড় প্রতিষ্ঠান টিকেই আছে এই সন্ত্রাসের ওপর। যাকে আমরা এস্টাব্লিশমেন্ট বলি তারই বিভিন্ন চেহারা এগুলাে। আপনি আমি কেউ কি এই সমাজের কাছে কোনাে নিরাপত্তা বােধ করি? করি না। এই সন্ত্রাসের উপরই সমাজ টিকে আছে। এস্টাব্লিশমেন্ট তেত্রিশ কোটি দেবতার মতােই মূর্তি ধরে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে। এস্টাব্লিশমেন্টের স্বার্থ থেকে আপনার স্বার্থকে ভিন্ন করে দেখতে গেলেই আপনি আর নেই। এটাই নিয়ম। ফলে প্রতিনিয়ত আমরা একটা ভয়ের সাইকোসিসে ভুগছি। এ কথা ঠিক আমরা এতদিন যেভাবে ভেবে এসেছি, ভাবতে ভালােবাসি তার সঙ্গে এদের চিন্তার মিল নেই। স্বীকার করতে হয় ভাবনাটা ওদের কাজটাও ওদের, সেখানে আমাদের কোনাে দায়িত্ব নেই। পিত মহ সূত্রে আমাদের চিন্তাগুলাে যদি ধারাবাহিক ওদের রক্তে চালান করে দিতে পারতাম তাহলে সংসার যেমন চলছে তেমনি চলত। আমাদেরও ঘুমের ব্যাঘাত হতাে না। দুর্ভাগ্য, ওরা বাপ-ঠাকুরদার কথা শুনল না। কী জানি হয়তাে বিশ্বাসই করে না। আমরা তাে জন্ম দেয়া ছাড়া আর কিছু করিনি। একটা ছােট্ট দৃষ্টান্ত দিই। গান্ধীমহারাজ বলেছিলেন, স্বাধীন ভারতে মাদকদ্রব্য বর্জন করা হবে। বলেন কী! তা কী হলাে? মিনিস্টাররা বার-কাম হােটেল উদ্বোধন করছেন। গভর্নরের পার্টিতে মদ পরিবেশন করা হচ্ছে। কেন না, জাতীয় আয় বাড়ছে। থুথু কাপে কোন্ শালার চুল লেপটে রয়েছে। কী বলছেন, পণ্ডিতজি? আহা, তার কথা আর কেন, তিনিই তাে নবীন ভারতের কর্ণধার। ক্ষমতা পেলেই, তিনি ঘােষণা করেছিলেন, ব্ল্যাক মার্কেটিয়ারদের নিকটবর্তী ল্যাম্পপােস্টে ঝুলিয়ে মারবেন! কথা কথাই বুঝলেন না? যদিচ শাস্ত্রে বলেছে শব্ৰহ্ম। এই কথাগুলােই যদি কাজ হতাে তাহলে হিন্দুস্থানের তামাম মানচিত্র পালটে যেত। দেখতেই পাচ্ছেন, যায় নি। যায়নি কারণ কথাগুলাে কাজ নয়। এখন বাংলাদেশ নিয়ে আপনারা যথেষ্ট হইচই করছেন। ভালােই হচ্ছে কাগজের সারকুলেশন ধইধাই করে বাড়ছে। লক্ষ্মীদাদা বলতে পারেন দেশ ভাগটা হলাে কার সুপারিশে? মহাত্মাজী অবশ্য প্রথম দিকে বাধা দিয়েছিলেন, পরিষ্কার করে বলেছিলেন ইন্ডিয়া ভাগ করবার আগে আমাকে ভাগ করাে। তবু দেশভাগ হলাে। জিন্না সাহেবও এতটা আশা করেননি। গান্ধীজী কি শেষ পর্যন্ত চাপে পড়ে মেনে নিয়েছিলেন? থাকগে পুরনাে কাসুন্দি ঘেঁটে লাভ নেই। কী কথা থেকে কোথায় এসে পড়লাম। বুড়াে লােকের এই ধর্ম, কিছু মনে করবেন না।
আমি মােদ্দা কথা যা বলতে চাইছিলাম : আমরা বয়স্করা কথায় এবং কাজে উত্তরাধিকারীদের কাছে এক ফার্দিংও বিশ্বাসযােগ্য হয়ে উঠিনি। তার জন্যে আজকের ছেলেদের দোষ দেবেন না। আসলে আমরা ভয় পাচ্ছি, আমাদের তাে কিছু আছে। ধরুন আপনার চাকরি, কারুর ব্যবসা, কারুর জমি, কারুর কারখানা। আমরা ভয় পাচ্ছি এগুলাে নষ্ট হয়ে যাবে বলে। ভয়টা যথার্থ। কিন্তু ওরা, ওদের সামনে আমরা কি আশ্বাসের ছবি মেলে ধরতে পারছি। কী বলছেন? চাকরির ব্যবস্থা করা হচ্ছে? নাঃ ব্যাপারটা আর এর মধ্যে আটকে নেই। ওরা বুঝতে পেরেছে আমেরিকা-রাশিয়ার আদলে জোড়াতালি মার্কা যে কাঠামে তৈরি করছি সেখানে সুযােগশিকারী তথাকথিত ভাগ্যমন্ত ছাড়া কারুর কোনাে সুবিধে হতে পারে না। এই কৃষিপ্রধান দেশে চাষির অর্থনৈতিক উন্নতি এবং ক্রয়ক্ষমতা না বাড়লে জাতীয় সম্পদ কোনােদিনও বাড়বে না। তাই ওরা মূল ধরে টানছে, কৃষি বিপ্লব চাই। গ্রাম থেকে শহর ঘেরাে। তা আপনি মানুন বা না মানুন। ওরা এইভাবেই ভাবছে। আপনার আমার মতাে ব্যক্তিগত সুবিধের ওরা কাঙাল নয়।
না আমাকে ভুল বুঝবেন না। ওরা যেভাবে ব্যাপারটাকে বােঝবার চেষ্টা করছে সেটাই বলবার চেষ্টা করছি। আপনার আমার বিপ্লবের দরকার কী মশায়, আপনার চাকরি আছে, আমিও বিয়াল্লিশ টাকা তিন আনা পেনশন পাই, ড্যাং ড্যাং করে কাটিয়ে দিলাম, আর ক দিনই বা মেয়াদ। ওদের তাে অনেকদিন বাঁচতে হবে, পৃথিবীটা ওদেরই। আমরা ভাঙা টিনের চেয়ার আটকে আর ক দিন থাকব। বুঝলেন না?
কী বলছেন সমাজবিরােধী? এই তাে দাদা আপনি রাগ করছেন। রাগ করলে আর কথা হয় না। কী বলছেন, সমাজ বিরােধী? তা সমাজে বিরােধটা সত্য কিনা? ধনী আরাে ধনী হবে গরিব আরাে গরিব- এ ব্যবস্থা কি আপনি অনুমােদন করেন? আহ হাতি আর পিঁপড়ের কথা ভুলবেন না। মনুষ্য সমাজে ও ধরনের উপমা চলে না। চললেও উদ্দেশ্যমূলক। কথাটা হচ্ছে সমাজে বিরােধ আছে, আপনি চান বা না চান আছেই। আমি মনে করি সমাজটা অন্যায় আর বৈষম্যের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। আর তখন আমার কর্তব্য কী হবে? সমাজটাকে রাখা না বদলানাে? সমস্যাটা হচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গির। আপনার আমার কাছে সমাজপরিবর্তনের কোনাে মূল্য নেই, আমরা জানি বিপ্লবে আমাদের উপকার নাও হতে পারে, কাজেই আমরা প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় অসুখী নই।
কাজেই ভেবে দেখতে গেলে ওরা সমাজবিরােধী তাে একশােবারই। অবশ্য আপনি যদি গালাগালি দেবার জন্যেই শব্দটা ব্যবহার করে থাকেন তাহলে ওদের সমর্থনে আমাকে কিছু বলতেই হয়। নাঃ ওরা ওয়াগন-ব্রেক করেনি, ছিনতাই করেনি, মেয়েদের শ্লীলতাহানিও নয়। ওদের সঙ্গে ওয়াগন-ব্রেকারদের এক ব্র্যাকেটে বেঁধে দিলে হয়তাে ফন্দিবাজ লােকের কোনাে উদ্দেশ্য হাসিল হয়। অবশ্য এ মতলব থােপে টেকে না। আপনার কাগজেই দেখি এসব ছেলেদের সমাজের ক্রিম বলা হচ্ছে। বিদ্যাবুদ্ধি পড়াশােনা আদর্শে ওরা নাকি ব্রিলিয়ান্ট ছেলে সব! খোজ নিয়ে দেখুন আপনার ভাই কি আমার ছেলে, অমুকের বােন। কী বলেন, আমরা তাে আর সমাজবিরােধী মস্তানদের জন্ম দিইনি। এটা আপনার রাগের কথা। রামকেষ্ট বলেছেন, ক্রোধ চণ্ডাল মানে অস্পৃশ্য। কী বলছেন? ওদের মধ্যে সমাজবিরােধী নেই কিনা এমন হলফ করে বলতে পারি না। থাকতেও পারে নাও থাকতে পারে। তবে এটা বুঝি একজন ওয়াগনব্রেকারের সঙ্গে ওদের চেহারার আমূল আমল। একজন ওয়াগনব্রেকার কতদূর এগােতে পারে আমরা জানি, কিন্তু একজন বিপ্লবী যুবককে জানি না। এমনও হতে পারে ব্যক্তিগত ফিকির গােছাবার জন্যে কিছু ওয়াগানব্রেকার ওদের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। তারপর অনিবার্য বিরােধিতা শুরু হয়েছে। ওয়াগনব্রেকাররা এক সময় টাকা খেয়ে বিপ্লবীদের ধরিয়ে দিয়েছে অথবা অসতর্ক মুহুর্তে খুন করেছে ছেলেদের। বর্ষার তােড়ে অনেক পানা ভেসে আসতে পারে স্রোতের সঙ্গে কিন্তু সমুদ্রে মিশবার মুহূর্তে তাদের আর কোনাে অস্তিত্ব থাকে না।
নাঃ ওয়াগানব্রেকাররা সমাজের পরিবর্তন আনবে না, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। যেহেতু তারা এই সমাজ ব্যবস্থাই চায়। ওয়াগনব্রেকিং তাে উপার্জনের একটা ধান্দা হিসেবে কেউ তুলে দিচ্ছে না। ধরা না পড়লেই হলাে। তাই না? আপনিই ভেবে দেখুন সমাজে ওয়াগনব্রেকিং নেই, তার ছেড়া নেই, তাহলে রেলরক্ষীর প্রয়ােজন কী। ওয়াগন-ব্রেকারও থাকবে রেল রক্ষীও থাকবে, উভয়ের স্বার্থই থাকবে, নয় কি?
আসুন, আরেক কাপ চা হােক। বউদি তাে বাপের বাড়ি। কী বলছেন? আমি বড় ওদের দিকে টেনে কথা বলছি? দাদা লজ্জা দেবেন না আর। দেখুন এ সমাজ থেকে আমার আর কিছু পাবার নেই, আমি সার বুঝে ফেলেছি আমাদের আর কিছু করারও নেই। ওইসব তাজা জোয়ানদের না মেরে যদি আমার মতাে বুড়াে হাবড়াকে মারলে চলে তাে আমার আপত্তি নেই। কে লিখেছে কবিতাটা? যুবক বয়সে মুখস্থ করেছিলাম : Does living means, simply mother, to die very young! কী বলছিলেন পক্ষপাতের কথা? হ্যা আপনি কী চান সমাজের এই সেরা ছেলেরা শেষ হয়ে যাবে? না ঃ আমি তা চাই না।
যা বলছিলাম সকালের কাগজে খবরটা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেছি। জেলখানায় পর পর এ ধরনের মৃত্যু দেখলাম কি না। সমাজের বুদ্ধিজীবী যাদের বলে তারা দিব্য ঘুমিয়ে আছেন, বাংলাদেশের জঙ্গিশাহীর অত্যাচার নিয়ে সভাসমিতি করছেন, রাত্রে স্ত্রীর সঙ্গে সহবাসও করছেন। তা করুন। সবচেয়ে তাজ্জব করেছেন আমার প্রিয় রাজনৈতিক নেতাটি। তিনি সরকারের কাছে তদন্ত চেয়েছেন এই সকল নিহতদের মধ্যে তার দলের ছেলেরা আছে কি না! অর্থাৎ সমাজ বিরােধীরা মরুক আপত্তি নেই, তার দলের ছেলেরা না মরলেই হলাে। এই নেতা সম্প্রতি যে কখন কী বলছেন, তার হিসেব নিলে রামায়ণ হয়ে যায়। একবার বলছেন, ওরা পুলিশের লােক। তা পুলিশের লােক হলে পুলিশ ওদের ঠ্যাঙ্গাবে কেন? আবার যখন সত্যিই পুলিশ ওদের সাবাড় করছে তখন ঠাট্টা করা হচ্ছে গুলিতে কি নিরােধ লাগানাে আছে! এ-এক চাষাড়ে পরিহাস। আপনি কী বলেন? নাঃ চুপ করে থাকবেন না। কথা বলুন। কেউ কি সংসারে নেই যারা এই রাজনৈতিক দাদাদের বােঝাতে পারেন অত্যাচারী রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতের রাইফেল কোনাে বাছবিচার করে না। অবশ্য আপনি যদি সত্যিই রাষ্ট্রযন্ত্রের উচ্ছেদ চান। শান্তিপূর্ণ পথে আপনি যদি বিধানসভা লােকসভা দখল। করতে চান সে কথা আলাদা। দেখুন মশায় বড় রকমের একটা কিছু করতে চাইলে তার ব্লু প্রিন্টটা আগেই ছকে নেয়া দরকার। বিপ্লবের বেলাতেও তাই, বিপ্লবী মতবাদ ছাড়া বিপ্লব হয় না। পেটি বুর্জোয়া মতবাদ সম্বল করে বিপ্লবের কঠিন কাজ সমাধা করা যায় না। আপনি কী বলেন? অবশ্য এ সব কথার কথা। আপনি আমি কেউই বিপ্লব করতে যাচ্ছি না, যাব না। সুখের চেয়ে স্বস্তি ভালাে।
কানাইয়ের মা, মানে আমার ইস্তিরীর কথা বলছি, ঘুম থেকে উঠতে না উঠতেই কাক-তাড়ানাে চিৎকার। বলে, আমরা মিনসে না মাগী, শুনছেন একজন ভদ্রমহিলার শ্রীমুখের উচ্চারণ, ওই ‘আপনজন ‘এখনই’ সিনেমা দেখার ফল আর কী। বিষয় কী? না, পাশের বাড়িতে বলাই আর তপু সবে ভাতের থালা নিয়ে বসেছে, অমনি পুলিশ ঢুকে লাথি মেরে ভাতের থালা সরিয়ে দিয়ে এঁটো মুখে ছেলে দুটোকে ধরে নিয়ে চলে গেল! তাে ওয়াইফ বলছে, আমরা মিনসে না মাগী। বললাম : অ্যাদ্দিন পরে হঠাৎ লিঙ্গ সম্পর্কে এমত সন্দ?
– ভাতের থালা থেকে ছেলে দুটোকে তুলে নিয়ে গেল, আর তােমরা চুপ করে বসে আছ? বললাম :
রি কোনটাতে আপত্তি? ভাতের থালা থেকে অথবা ধরে নিয়ে যাওয়াতে? স্ত্রীর ধাক্কা খেয়ে পৌরুষ জেগে উঠল। বললাম : এর বিহিত না করে ফিরছি না। বউ বললে : হঁ্যা ফিরাে না। গেলাম পাড়ার পার্টি অফিসে। ওরা বললে : কালকেই বন্ধ, ডেকে দিচ্ছি। বন্ধ, ডেকে কী হবে? দিন এনে দিন খায় গরিব লােকদের কষ্ট হবে। ওরা বললে : গণতন্ত্র আমাদের অধিকার দিয়েছে। প্রতিবাদ করতেই হবে। এ সময় নেতৃস্থানীয় একজন মাস্টার এসে হাজির। বললে : কী হয়েছে? পুনরায় বলাই, তপুর গ্রেফতারের কথা বললাম ওকে। এখানে এসেছেন কেন? বললাম : কোথায় যাব বাবা? মাস্টার ঝাঁঝিয়ে উঠলেন : এইসব সমাজবিরােধীদের প্রশ্রয় দিয়ে আপনারা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বারােটা বাজাচ্ছেন। কে হয়, আপনার ছেলে? বললাম : না কেউ হয় না। তবে? যান। এ জাতীয় আবদার নিয়ে আমাদের কাছে দ্বিতীয়বার আসবেন না। কী বলব দাদা, ল্যাজ গুটিয়ে পালিয়ে এলাম। এখন আমি কোন মুখে বউয়ের কাছে যাব, বলতে পারেন? কে জানে, পাড়ার বউ-মাগিদের ঝেটিয়ে থানায় গিয়ে চড়াও হবে কি না। আমার কানাই টাইফয়েডে মারা যাবার সময় ওরা রাত জেগে পাহারা দিয়েছিল কি না। বড় ভালাে ছেলে সব। চোখে যে কী পড়ল। ধুর, বুড়াে মানুষের চোখ কি না। কথায় বলে না, খাচ্ছিল তাঁতি তঁত বুনে- আমারাে তেমন অবস্থা। দিব্য সংসার চলে যাচ্ছে, কোথাও টসকে যাচ্ছে না। আপনার চাকরি, আমার পেনশন, ওর ব্যবসা। আর এই তাে সভ্যতার রীতি, কী বলেন? যার যার বৃত্তির মধ্যে আটকে থাকো। করে খাও। কেউ মাথা গলাবে না। বৃত্তির বাইরে অন্য কথা ভাবতে গেছ কী ব্যস। আমারাে সেই অবস্থা, ঘরে বউ মানে না, বাইরে কেউ পোঁছে না। তাই অক্ষম ক্রোধে নিজেই রক্তারক্তি হচ্ছি। একটা বিড়ি দেবেন? সিগারেট, আচ্ছা তাই দিন। গত বছরে ঠিক এমনি সময়ে আমার কানাই মারা গেলে। ও বেঁচে থাকলে, আহ! কী বলছি?
এরই মধ্যে উঠলেন নাকি? হ্যা আপনার তাে এখনাে ক্ষৌরী করা হয়নি দেখছি। আজ কি বউদির ওখানে যাবেন? আপনার ছেলের বয়স কত হলাে? নয়? কী নাম? সৌম্য? হ্যা ও বাপের নাম রাখবে। বেঁচে গেছেন দাদা বারাে থেকে পঁচিশ এই বয়েসটাই আজকাল বিপদের। কানাই বেঁচে থাকলে ওরও এই বয়েস হতাে। আমি হলফ করে বলছি ও বেঁচে থাকলে আর যাই হােক, টাইফয়েডে ওকে মরতে দিতাম না। বলাই তপু ওর বন্ধু কি না।
কিছু মনে করবেন না। সকাল থেকে মেজাজটা ভালাে নেই। বাইরে এই সকল কাণ্ড আর বাড়িতে ওয়াইফের গঞ্জনা, বুঝতেই পারছেন কার মাথা ঠিক থাকে? বউকে বােঝাতে পারি না, মায়ের প্রাণ তাে, কান্না, শােক করে ওদের আমরা উপকার করতে পারব না। তার দরকারও নেই। আর, বুড়াে বয়সের ক্রোধ আত্মঘাতী। আপনাকে অনেক বিরক্ত করলাম। বকুনি এই বয়সের ধর্ম আর কী। পেঁচো, চায়ের পয়সাটা নাও।
সূত্র: দর্পণ
৭.০৯.১৯৭১