প্রধানমন্ত্রীর নির্ভীক উক্তি
মার্কিন প্রেসিডেন্ট মি, নিক্সনের সঙ্গে আলােচনার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী খােদ আমেরিকায় বসে যা বলেছেন তা বিশ্ববাসী বিশেষত মার্কিন শাসকবর্গ অবশ্যই লক্ষ করেছেন। সহজসরলভাবে কিন্তু অত্যন্ত দৃঢ়চিত্তে প্রধানমন্ত্রী ভারতের জনগণের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। ইয়াহিয়া খান সম্পর্কে মার্কিন প্রেসিডেন্টের মনােভাব দেখে প্রধানমন্ত্রী আদৌ বিচলিত হননি।
তিনি দ্বিধাহীনভাবে বলেছেন যে, মিলিটারি ডিকটেটরকে মদদ দিয়ে পাকিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। যদি কেউ তা মনে করে তাহলে ভুল করা হবে। উপমহাদেশের বিরাট অংশ জুড়ে যদি অস্থির অবস্থা চলতে থাকে তাহলে সেখানকার শাসককে সামরিক সাহায্য দিয়ে কোনাে দিনই শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রীর এই স্পষ্টোক্তি ইয়াহিয়া খানকে মার্কিন সামরিক সাহায্যদানকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত সঠিকভাবেই বিশ্ববাসীর বিশেষভাবে মার্কিন জনসাধারণের কাছে মার্কিন শাসকবর্গের নীতির প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন। এর তাৎপর্যপূর্ণ অর্থ হলাে পাকিস্তানের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার সামরিক সাহায্য। পাকিস্তানকে সামরিক সাহায্য দান লক্ষ করে প্রধানমন্ত্রী দৃঢ়ভাবে উল্লেখ করেছেন যে, ভারত আক্রান্ত হলে সােভিয়েত রাশিয়াসহ বহু দেশই ভারতকে অস্ত্র সাহায্য করবে। যুদ্ধের বিপদ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী পশ্চিমী শক্তিবর্গকে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে সকলকে সতর্ক করে দিয়েছেন যে ভারত একা নয়। যতই বৃহৎ এবং সামরিক শক্তিকে বলীয়ান দেশ হােক না কেন তাদের শাসকবর্গের চাপে ভারত মাথানত করবে না। সাম্রাজ্যবাদ বিশেষত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী যে কত বড় রক্ষাকবচ এবং স্বীয় স্বাধীনতা ও মর্যাদা নিরাপদ ও প্রতিপন্ন করার হাতিয়ার তা প্রধানমন্ত্রীর নির্ভীক উক্তি থেকেই প্রমাণিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ সমস্যাকে কেন্দ্র করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে ভারতের শাসকশ্রেণী ও জনসাধারণের বিরােধ যে তীব্র হয়ে উঠেছে তা আর গােপন নয়। এমনকি কূটনৈতিক বক্তৃতাতেও এই বিরােধ আর আত্মগােপন করতে পারছে না।
পাকিস্তান ও ভারতকে যারা সমপর্যায়ভুক্ত করতে চান তারা প্রকৃতপক্ষে ইয়াহিয়ার জঘন্য ও আগ্রাসী কার্যকলাপকে গােপন করতে চান। কিন্তু এই ধুর্তবুদ্ধির দ্বারা ইয়াহিয়ার কার্যকলাপকে গােপন করার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এই প্রয়াসের অর্থ হলাে ভারতকেও আগ্রাসী বলে প্রতিপন্ন করা এবং পাকিস্তানের ঘরােয়া ব্যাপারে ভারতের হস্তক্ষেপ প্রমাণ করা। এই শয়তানি যুক্তির অর্থ হলাে, বিরােধের জন্য পাক-ভারত উভয়ই দায়ী। অতএব উভয়পক্ষের আলােচনার দ্বারা এই বিরােধের সমাধান করতে হবে। সাম্রাজ্যবাদীদের এই চত্বর আক্রমণাত্মক কৌশলের লক্ষ্য যেমন একদিকে ভারত, তেমনই অন্যদিকে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম।
ভারত-পাকিস্তানের সঙ্গে এই ব্যাপারে আলােচনা করতে রাজি নয়। কারণ এই বিরােধ পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে নয়। বিরােধ হচ্ছে পশ্চিম পাক-শাসকদের সঙ্গে বাংলাদেশের জনসাধারণের। পশ্চিমীরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই বিরােধকে স্বীকার করতে চায় না। প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারেও ভারতের জনসাধারণের মতামত সঠিকভাবে প্রকাশ করেছেন।
পাকিস্তান সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করেছে- এ কথা রাষ্ট্রসঙ্ঘকে জানানাে সত্ত্বেও রাষ্ট্রসঙ্ কর্ণপাত করেনি। বরং সীমান্তে রাষ্ট্রসঙ্রে প্রতিনিধি নিয়ােগের প্রস্তাব করা হয়েছে। পাক-ভারতকে সমপর্যায়ভুক্ত করার প্রয়াস থেকে এই প্রস্তাব উদ্ভূত। এই প্রস্তাবের লক্ষ্য বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করা নয়। এই প্রস্তাবের দ্বারা পূর্ববাংলা থেকে ভারতে শরণার্থী আগমন বন্ধ হবে না। এর একমাত্র অর্থ হলাে পাকিস্তানের চরম সঙ্কটকে ভারত-পাক সমস্যায় রূপান্তরিত করা এবং ইয়াহিয়ার প্রতি সর্বপ্রকার মার্কিন সমর্থনকে গােপন করা। এই প্রস্তাব মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থেই করা হয়েছে। ভারত এই প্রস্তাব নাকচ করে আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছে এবং মার্কিন অপকৌশল ব্যর্থ করেছে।
প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্যভাবেই ঘােষণা করেছেন যে, ভারত যুদ্ধ চায় না। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইয়াহিয়া খান সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করে চলেছেন। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা ইয়াহিয়াকে সৈন্য অপসারণের কথা না বলে ভারত সরকারকেই সৈন্য অপসারণের উপদেশ দিয়েছে। তারা চায় যে, পাকিস্তানের সম্ভাব্য আক্রমণের বিরুদ্ধে ভারতকে অপ্রস্তুত রাখতে যাতে ভারতের সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হতে পারে। ভারত নিরাপত্তার জন্য সৈন্য সমাবেশ করছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট যদি জাতীয় নিরাপত্তার ভুয়া যুক্তিতে পারমাণবিক বােমার বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে, তাহলে ভারত-সীমান্তে পাকিস্তানি সৈন্য সমাবেশ ও আক্রমণের প্রকৃত বিপদের বিরুদ্ধে ভারত কোন যুক্তিতে আত্মরক্ষামূলক প্রস্তুতি থেকে বিরত হবে।
অতএব প্রধানমন্ত্রী ফ্রান্সে যাওয়ার প্রাক্কালে ভারতের জনসাধারণের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্ত ও চাপের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর নির্ভীক উক্তি বিশ্বসাসীও সমর্থন করবে বলে আমরা আশা করি।
সূত্র: কালান্তর
৯.১১.১৯৭১