সংগ্রামী পূর্ববঙ্গের ডাক
পূর্ববঙ্গের গণতান্ত্রিক সংহতিকে সংহার করার জন্য পাকিস্তানের সামরিক শাসকবর্গ যে জঙ্গি বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতা দেখাচ্ছে তাতে বিমূঢ় ও হতবাক না হয়ে পারা যায় না। নিরস্ত্র জনতাকে খুন করার উন্মাদনায় জঙ্গিবাদীরা রাস্তায় রাস্তায় ট্যাঙ্ক নামাতে এবং বিমান থেকে বােমাবর্ষণ করতেও কুণ্ঠিত হয়নি। খবরে প্রকাশ, ট্যাঙ্ক থেকে গােলাবর্ষণের ফলে রাস্তার দু’পাশে যেসব বাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে সেগুলাের ধ্বংসস্তুপে চাপা পড়েছে বহু আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা। যারা আহত তারা যন্ত্রণায় আর্তনাদ করছে। তাদের উদ্ধার করার লােক নেই। কামান ও মেশিনগানের মুখে পড়লেই জীবন শেষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভবনটির উপরও নাকি ট্যাঙ্ক থেকে তােপ দাগা হয়েছে। একটি বড়াে হাসপাতাল বিমান থেকে বােমা ফেলে বিধ্বস্ত করা হয়েছে বলে প্রকাশ। হাসপাতালের রােগীরা নাকি প্রাণে বেঁচে নেই। ঘােষিত যুদ্ধেও হাসপাতাল এবং রেডক্রসকে আক্রমণ বহির্ভুত রাখা আন্তর্জাতিক বিধি। পাকিস্তানের জঙ্গি বর্বরতা, সেই বিধিও লঙ্ন করে চলেছে। নাদির শাহের হুকুমে নাকি তার সৈন্যরা একরাতে গণহত্যা করে দিল্লীকে রক্তস্রোতে ভাসিয়ে দিয়েছিল। নাদির শাহের উত্তরাধিকারীরা আজ ঢাকা শহরে তেমনি রক্তস্নান করে চলেছে।
কিন্তু এই গণহত্যার বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গে গড়ে উঠেছে জনতার প্রতিরােধ দুর্গ। গণতান্ত্রিক সংহতিই সেই দুর্গের প্রধান শক্তি। বুদ্ধিজীবী, শ্রমিক, কৃষক ও অন্যান্য শ্রেণীর সমস্ত মানুষ গণতন্ত্রের পবিত্রতা রক্ষার জন্য আজ অকাতরে প্রাণ দিতে প্রস্তুত। সীমান্তরক্ষা বাহিনী, পুলিশ ও পূর্ববঙ্গীয় সেনাংশও এই প্রতিরােধ সংগ্রামে যােগ দিয়েছে। খুলনা এবং চট্টগ্রাম বন্দরের বাঙালি নৌ-সেনা এবং লস্কররাও এই প্রতিরােধ সংগ্রামের অংশীদার। এককথায় পাকিস্তানি জঙ্গি শক্তির বিরুদ্ধে এক সংকল্পবদ্ধ গণতান্ত্রিক শক্তির প্রতিরােধ সংগ্রাম। অস্ত্রশক্তির বিচারে সুসংগঠিত ও আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত সৈন্যদলের তুলনায় প্রায় নিরস্ত্র এই গণতান্ত্রিক শক্তি হয়তাে অপেক্ষাকৃত হীনবল, কিন্তু সংকল্পের দৃঢ়তায় ঐক্যবদ্ধ জনতার এই শক্তি নিঃসন্দেহে প্রবলতর। সুতরাং গণতান্ত্রিক শক্তির প্রতিরােধের কাছে শেষ পর্যন্ত সামরিক দপচূর্ণ হবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।
পূর্ববঙ্গের গণতান্ত্রিক মানুষের এই প্রতিরােধ সংগ্রামে এপারে আমরা স্বাভাবিকভাবেই নিশ্চেষ্ট ও উদাসীন থাকতে পারি না। এর প্রতি পূর্ণ নৈতিক সমর্থন জানাবার দায়িত্ব আমাদের সামনে উপস্থিত। সে দায়িত্ব পালন করতে পারি আমরা এখানকার সর্বস্তরের মানুষকে গণতান্ত্রিক শিবিরে সামিল করে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য সুস্পষ্ট দাবি তুলে। তার জন্য চাই আমাদের গণতান্ত্রিক সংহতি। শ্রমিক, কৃষক, মধ্যবিত্ত এবং যাঁরাই গণতন্ত্রে বিশ্বাসী তাঁরাই এগিয়ে এসে সমস্বরে দাবি তুলুন- পূর্ববঙ্গে গণহত্যা বন্ধ হােক, গণতান্ত্রিক শক্তি কায়েম হােক। গণতন্ত্রকে হত্যা করে আর যাই হােক মুক্তি নেই, প্রকৃত স্বাধীনতা নেই। শুধু পশ্চিমবঙ্গেই নয়, সারা ভারতেই আজ সমস্বরে এই ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হােক। এখানে কুণ্ঠা বা দ্বিধার স্থান নেই। গণতন্ত্রকে বাঁচার জন্য পূর্ববঙ্গের এই সংগ্রাম শুধু পূর্ববঙ্গবাসীদেরই নয়, এ সংগ্রাম বিশ্বের যে কোনাে প্রান্তেরই গণতান্ত্রিক মানুষের। বিশ্ববাসীর কাছে এই সংগ্রামের বাণী পৌছে দেবার দায়িত্ব যেন আমরা বিস্মৃত না হই। এ বিষয়ে বুদ্ধিজীবী মহলের করণীয় অনেক কিছু আছে। পূর্ববঙ্গের এই গণতান্ত্রিক সংগ্রামে সেখানকার লেখক, শিল্পী, গায়ক, অভিনেতা, অভিনেত্রী, চিত্রকর, সাংবাদিক, অধ্যাপক, আইনজীবী সবাই এগিয়ে এসেছেন ও মিছিলে মিছিলে সামিল হয়েছেন। আজ প্রতিরোধ সংগ্রামে তারা হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছেন কিনা কে জানে? এপারে আমাদের বুদ্ধিজীবী মহল এই দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হবেন বলেই বিশ্বাস করি? পূর্ববঙ্গের গণতন্ত্র রক্ষক বাহিনীকে সর্বতােভাবে সমর্থন জানাতে তারা এখানকার গণতান্ত্রিক শক্তির পাশে এসে দাঁড়ান।
এই প্রতিরােধ সংগ্রাম যদি দীর্ঘায়িত হয় তবে রক্তমােক্ষণের দরুন পূর্ববঙ্গের সংগ্রামী মানুষের অনেক কিছুই প্রয়ােজন হবে। মানবতা ও গণতান্ত্রিক বােধ থেকে আপতকালে রসদ, চিকিৎসা, আশ্রয়, রক্ত দিয়ে সাহায্য এপারের মানুষ করবেই। তার জন্যও আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। প্রস্তুত থাকলে তা প্রেরণের উপায়ও বার হবে। ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়। সর্বাগ্রে প্রয়ােজন এই গণতন্ত্র খুনের জল্লাদপনাকে ধিক্কার জানাবার জন্য দেশের যাবতীয় বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক শক্তির সংহতি। পূর্ববঙ্গের অভূতপূর্ব গণতান্ত্রিক ঐক্য ও প্রতিরােধকে অভিনন্দন জানাবার তাই হবে যােগ্যতম মঞ্চ।
সূত্র: কালান্তর
২৯.৩.১৯৭১