You dont have javascript enabled! Please enable it!

কে রাষ্ট্রদ্রোহী

মুজিবর রাষ্ট্রদ্রোহী? আওয়ামী লীগ সমেত পূর্ব পাকিস্তান যার নতুন নাম বাংলাদেশ, সেই দেশের তামাম জনতা, ক্ষমতালােভী? পাকিস্তানের শত্রু? তবে দেশপ্রেমিক কে? পাকিস্তান রাষ্ট্রের মিত্রপক্ষই বা কারা? সাড়ে এগার কোটি জনসংখ্যার সাড়ে সাত কোটিই যদি পূর্ণ স্বাধীকারের দাবিতে নিরুপায় হয়ে বিদ্রোহের পতাকা ওড়ায় তবে পাকিস্তান রাষ্ট্রের মিত্র থাকে কারা?
পাকিস্তান রাষ্ট্রের জঙ্গি শাহীর সর্বাধিনায়ক জল্লাদ ইয়াহিয়া বেতারে এই অভিনব অভিযােগ করেছেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পূর্ববাংলার ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম, রাজশাহী থেকে কুমিল্লা, রংপুর থেকে নােয়াখালির পথে পথে এই প্রশ্নের জবাবই জনতার রক্ত দিয়ে লেখা হচ্ছে। বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে স্বাধীন বাংলার পতাকার নিচে সাড়ে সাত কোটি নরনারী বিড়াল-কুকুরের মতাে নয়- বাংলা মায়ের সুযােগ্য সন্তানের মতােই লড়াই করে রাষ্ট্রদ্রোহী ও ক্ষমতালােভী কে তার জবাব দিচ্ছেন। জবাব দেয়ার উন্মাদনা থেকে কেউই আজ পিছিয়ে নেই। অস্ত্রধারী বাঙালি জওয়ানদের পাশে হাজারে হাজারে সারি দিয়েছেন পূর্ববাংলার মা-বােনরা। একদিন সত্য প্রকাশ পাবে। একদিন এই রক্ত ঝরানাের অপূর্ব আলেখ্য পূর্ববাংলার নদী, নালা, খাল, বিল ডিঙিয়ে দুনিয়ার কাছে হাজির হবে। সেদিন দেখা যাবে- পূর্ববাংলার মাটিতে যে জন্ম নিয়েছে, যে বড় হয়েছে, আজও যে তার জল-হাওয়ায় বেঁচে আছে তারা প্রত্যেকে এখন এই মুহূর্তে জল্লাদ ইয়াহিয়ার এই কুৎসার এক ঐতিহাসিক জবাব দিচ্ছেন।
সাড়ে সাত কোটি বাঙালি আজ এক মন, এক প্রাণ। রাজ্যের প্রধান বিচারপতি থেকে দরিদ্রতম পাচকটি পর্যন্ত গণতন্ত্র-স্বাধিকার-আত্মমর্যাদার দাবিতে আজ একমত। পূর্ববাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে এর প্রমাণ তাঁরা বারে বারে দিয়েছেন। সামরিক শাসনের প্রত্যেকটি চালকে তাঁরা চ্যালেঞ্জরূপে গ্রহণ করেছেন এবং উপযুক্ত জবাবও দিয়েছেন। গণতন্ত্রের মূল কথা শান্তিপূর্ণভাবে মত প্রকাশের মাধ্যম যে নির্বাচন সেখানেও তাঁরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় রায় দিয়েছেন। তারও পরে অপেক্ষা করেছেন। ফৌজি কর্তার প্রত্যেকটি কূটচালের জবাব সংযম ও দৃঢ়তার সঙ্গে অথচ নির্ভীকভাবে দিয়েছেন। কিন্তু ক্ষমতা বা কর্তৃত্ব ত্যাগে নারাজ ইয়াহিয়া ও তার সহযাত্রী চক্রীরা বিশ্বাসঘাতকের মতাে পশুর হিংস্রতা নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছে নিরস্ত্র নরনারীর ওপর। পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রাণ পূর্ববাংলা। তার মেরুদণ্ড বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতা, সেই মেরুদণ্ড সােজা করে পাকিস্তানের মর্যাদাই তুলে ধরতে চেয়েছিলেন পূর্ববাংলার জনতা। কিন্তু স্বনির্ভর পাকিস্তান যারা চায় , আত্মমর্যাদায় দৃপ্ত পাকিস্তানি জনতা যাদের কাছে দুঃস্বপ্ন তারাই আজ ঘৃণ্য পাশবিকতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে সেই জাগ্রত জনশক্তির ওপর ইয়াহিয়া-টিক্কা খা-ভুট্টোদের সামনে রেখে।
বাংলাদেশে এক ইতিহাস সৃষ্টি হচ্ছে। একটি রাষ্ট্রের একদল ক্ষুদ্র জঙ্গিগােষ্ঠীর কাছ থেকে স্বাধীকার ও মর্যাদা অর্জনের জন্য এত রক্তপাত পৃথিবীতে আর কোনও অঙ্গ রাজ্যকে করতে হয়নি। সম্ভবত পৃথিবীতে আর কোনও অঙ্গ রাজ্যকে একই রাষ্ট্রের অন্য অংশের দ্বারা এমন নির্মমভাবে শশাষণ ও বঞ্চনার যাতাকলে নিস্পেষিত হতে হয়নি। বাংলাদেশের স্বাধীকারের দাবির অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিমের এই শশাষণের ফাস থেকে মুক্তি লাভ। মুজিবর ও তার বাংলাদেশকে পাকিস্তানের জঙ্গি নায়করা দাপটের জোরে তা থেকে বঞ্চিত করার অপচেষ্টা করছেন। আজ পূর্ববাংলার বিক্ষুব্ধ জনতা যদি নিজেদের স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায় তবে তার দায় পাকিস্তানের সেই স্বৈরাচারী গােষ্ঠীর যারা কেবল পশু শক্তির সাহায্যে সাড়ে সাত কোটি জনতার বিকাশকে স্তব্ধ করে দিতে চায়, যারা গণতন্ত্রের নিহত কঙ্কালের ওপর শােষণের ইমারত গড়ে তুলতে চায়।
পূর্ববাংলার যে ভাই ও বােনরা আজ গণতন্ত্র ও স্বাধীকারের পতাকা নিয়ে রক্ত ঢালছেন তাদের সঙ্গে সৌভ্রাতৃত্ব জানানােটাও পরম গর্বের। তাদের নেতা মুজিবর বিশ্ববাসীর কাছে সংহতি প্রকাশ ও সমর্থনের আবেদন জানিয়েছেন। এই আবেদন জানানাের প্রয়ােজন ছিল না। পূর্ববাংলার সীমানা পেরিয়ে এই সংহতি রচিত হয়ে গেছে অনেক আগেই। ভারত সরকার আন্তর্জাতিক আইনের নিগড়ে বাঁধা কিন্তু ভারতের জনতা নয়। তাদের কাছে ইয়াহিয়া গােষ্ঠীর রাষ্ট্রদ্রোহিতা যেমন স্পষ্ট পূর্ববাংলায় দেশপ্রেমিক জনতার অবিস্মরণীয় সংগ্রামও তেমনি গর্বের। ভারতীয় সংসদ সমেত প্রত্যেকটি শহর ও গ্রাম থেকে তাই দাবি উঠছে রাষ্ট্রদ্রোহী ইয়াহিয়ার গণতন্ত্র হত্যার অভিযান অবিলম্বে বন্ধ করা হােক। এ কথা আজ পরম বিশ্বাসের সঙ্গে ঘােষণা করা যায় রাষ্ট্রদ্রোহী, জনতার শত্রু ইয়াহিয়া চক্রের বিরুদ্ধে দেশপ্রেমিক বাংলাদেশের জনতার গণতন্ত্র ও স্বাধীকার রক্ষার সংগ্রাম জয়যুক্ত হবেই।

সূত্র: কালান্তর
২৮.৩.১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!