You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.31 | ভারতকে এখন মুখ্য সচেতক হতে হবে | কালান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

ভারতকে এখন মুখ্য সচেতক হতে হবে

বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ইয়াহিয়া খা বিকটতম যুদ্ধ শুরু করেছে। গৃহযুদ্ধের সীমানা অতিক্রান্ত; কেননা গােটা ভূখণ্ডের সমস্ত মানুষ এই আক্রমণের শিকার। সাধারণ যুদ্ধের সীমানা অতিক্রান্ত; কেননা আক্রমণের শিকার শিশু-নারী-বিশ্ববিদ্যালয়-হাসপাতাল প্রভৃতি বেসামরিক জীবন এবং যাবতীয় প্রতিষ্ঠান।
বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের প্রশ্ন উত্থাপন করার প্রধান দায়িত্ব আজ ভারতের। বাংলাদেশের ভারতের শুধু নিকটতম প্রতিবেশী নয়, একমাত্র প্রতিবেশী। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ইয়াহিয়া খার যুদ্ধ ভারতের বিবেকে ঝড় তুলেছে। শুধু তাই নয়, তাড়া খাওয়া মানুষ ভারতে আশ্রয় নিচ্ছেন। দূরের দেশের মতাে ভারতের বসে থাকার কোনাে উপায় নেই। কোনাে না কোনাে উপায়ে ভারতকে হস্তক্ষেপ করতে হবেই।
পাকিস্তানের জঙ্গি শাসকরা ভারতের প্রত্যেকটি উদ্যোগ ও হস্তক্ষেপকে বিকৃতভাবে প্রচারের মারমুখী চেষ্টা চালাবেই। একদিন ছিল যখন পাকিস্তানের সঙ্গে ব্যবহারে ভারতকে যথেষ্ট সংযমী হতে হতাে। কিন্তু পৈশাচিক যুদ্ধের দ্বারা পাকিস্তানের জঙ্গি শাসকদের চেহারা আজ এমন স্পষ্ট যে, বিনা দ্বিধায় এবং সঙ্গে ভারত সরকারকে ন্যায় ও গণতন্ত্রের কথা সুউচ্চে ঘােষণা করতে হবে। ভারতের পক্ষ থেকে প্রচলিত সহিষ্ণুতা এবং সতর্কতার আর কোনাে প্রয়ােজন নেই।
লােকসভায় একটি সর্বসম্মত প্রস্তাব গ্রহণ করার যে প্রয়াস চলছে, তা খুবই প্রয়ােজন। বাংলাদেশের প্রতি ভারতের সমর্থন জ্ঞাপন এবং দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কোনাে দলাদলির স্থান নেই। ভারতের পার্লামেন্টের প্রস্তাব আফ্রো-এশীয় দেশগুলােকে এবং বিশ্বের সকল দেশকেই মনস্থির করতে সাহায্য করবে। বাংলাদেশের আজ সর্বাধিক প্রয়ােজন বিশ্ববাসীর সাহায্য। সরকারি ও বেসরকারি উভয়বিধ সাহায্যেরই প্রয়ােজন। প্রতিহিংসাপরায়ণ যুদ্ধের পিশাচেরা খাদ্য পােড়াচ্ছে, বােমা ছুঁড়ছে, শহরে আগুন লাগিয়ে ঘরবাড়ি ভস্মীভূত করছে, পৃথিবীর কেউ যেন জানতে না পারে সে জন্য সংবাদ গােপন করছে এবং বিদেশী সাংবাদিকদেরও পাইকারিভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। সমাজ ও সভ্যতাকেই যখন ধ্বংস করা হচ্ছে, তখন বাংলাদেশের মানুষকে বাঁচার দায়িত্ব গােটা পৃথিবীর সমাজ এবং সভ্যতাকেই নিতে হবে। আর মুহূর্তের বিলম্ব চলে না। কেননা প্রত্যেকটি মুহূর্তে ধ্বংসের পরিমাণ বাড়ছে।
বাংলাদেশের কথা বিশ্বের দরবারে ভারত হাজির করুক- এই দাবি মুক্তিযােদ্ধারা বারবার জানাচ্ছেন। জলপাইগুড়ি শহরে বাংলাদেশের জনৈক এম পি নিজে হাজির হয়ে জনসভায় সেই দাবি জানিয়েছেন। কুষ্টিয়া থেকে অজয় মুখার্জির কাছেও ফোনে আকুল আবেদন জানানাে হয়েছে। ইন্দিরা-কংগ্রেস নেতারা এবং অজয় মুখার্জি স্বয়ং জনসমাবেশে ঘােষণা করেছেন যে, বাংলাদেশ আমাদের কলিজা’। বাংলাদেশের বাণিজ্য যারা ভাঙছে তাদের বিরুদ্ধে এখনই না দাঁড়ানাের অর্থ নিজেদের কলিজাকে ভাঙা। কিছু করতে হবে বলে পশ্চিমবাংলা এবং ভারতের মানুষ নেমেই পড়েছে। অর্থ, রক্ত, খাদ্য সংগ্রহের কাজ শুরু হয়েছে। পুরােদমে চালাতে হবে সেই কাজ। আর ভারতের সমগ্র মানুষের এই ইচ্ছা, এমন গভীর আকাক্ষা, এমন পরিব্যাপ্ত সহানুভূতিকে সংহত করার দায়িত্ব ভারত সরকারের। সরকার সেই কাজে অবহেলা করলে কিংবা গাফিলতি করলে ভারতবাসীর শ্রদ্ধাও হারাবে। পঞ্চম লােকসভার প্রতি ভারতের যে গভীর আস্থা রয়েছে, আমরা আশা করব প্রধানমন্ত্রী কিছুতেই সেই মর্যাদাকে অকারণ নষ্ট হতে দেবেন না। ভারতবাসীর একাগ্র দৃঢ়তা প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ়পদক্ষেপে ব্যক্ত হবে বলেই আমরা আশা করে আছি।

সূত্র: কালান্তর
৩১.৩.১৯৭১