শহীদের রক্তস্নাত চট্টগ্রামে
দৈনিক বাংলা, ১৯ শে জানুয়ারি, ১৯৭২
“সে হৃদয় বিদারক হত্যার বর্ণনা যখন শেষ হলো মিসেস কামরুন নাহার আহমদের দুচোখ বেয়ে অঝোরে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিলো। তীব্রশোকে বেদনায় বারবার রুদ্ধ হয়ে আসছিলো তার বাকশক্তি। কান্নাজড়িত কন্ঠে তিনি বললেনঃ তাঁকে বাঁচানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। এতদিনের তিলে তিলে গড়া সংসারের সবকিছু ফেলে শহর ছেড়ে দূরের গাঁয়ে পালিয়েছি। কিন্তু জল্লাদ সেনাদের হাত থেকে শেষ পর্যন্ত তাঁকে বাঁচাতে পারলাম না।
ব্যাঙ্কের চেকটাই তাঁর মৃত্যুর পরওয়ানা হয়ে ফিরে এলো। মিসেস কামরুন নাহার আহমেদ সাবেক পূর্ব পাকিস্তান রেলের চীফ পারসোনেল অফিসার মরহুম নাসির উদ্দিন আহমেদের বিধবা স্ত্রী। তাঁদের বাসা ছিলো চট্টগ্রামের পাহাড়তলী রেলওয়ে কলোনীতে। গত ১১ই মে রাউজানের ডাবুয়ার্গ থেকে খানসেনারা তাকে ধরে নিয়ে এসে হত্যা করে।
বিপ্লবী বাংলার বন্দর নগরী চট্টগ্রাম। বীর চট্টলার মার্চ এলো বিপ্লবীর বান নিয়ে। সর্বত্র অসহযোগ। রাস্তায় রাস্তায় বীর জনতার মিছিলের সমারোহ। জনতার পদভারে বন্দর নগরী প্রকম্পিত। বিপ্লব আর বিদ্রোহের গানে দশদিক মুখরিত। সংগ্রামের উদ্দীপনার মধ্য দিয়েই এগিয়ে চলছিলেন বীর চট্টলার অধিবাসীরা। সংগ্রামমুখর সে নগরীর লাখো পরিবারেরই একটি আহমেদের পরিবার। তারপর এলো ২৫শে মার্চ।
খানসেনারা নেকড়ে বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়লো নিরস্ত্র বাঙ্গালীদের উপর। এক পৈশাচিক নরহত্যা যজ্ঞে মেতে উঠলো তারা। বাঙ্গলীর রক্তে হলি খেললো দস্যু সেনারা। মিসেস কামরুন নাহার আহমদ স্বচক্ষে দেখলেন এই হত্যাযজ্ঞ। সেই বীভৎস দিনগুলোর কথা বর্ণনা দিতে গিয়ে কামরুন নাহার আহমেদ যেন আমাকে নিয়ে গেলেন এক প্রেতপুরিতে। একের পর এক তিনি ঘটনার বর্ণনা দিতে লাগলেন আর আমি যেন মানসচক্ষে দেখতে পেলাম হত্যা আর ধংসযজ্ঞের এক লোমহর্ষ চিত্র।
কামরুন নাহার আহমেদ বললেন, আমরা থাকতাম পাহাড়তলী রেলওয়ে কলোনীতে। রেলের অবাঙ্গালী কর্মচারীরাই সংখ্যায় বেশী ছিলো সেখানে। ২৫শে মার্চের আগে আমরা তাদের রক্ষা করেছি। কিন্তু ২৫শে মার্চের পরে ঘটনাপ্রবাহ ঘুরে গেল। তারা হামলা চালালো আমাদের উপর। লুটতরাজ, নরহত্যা আর নারী নির্যাতন চললো নির্বিচারভাবে। তারপর এলো ২৭শে মার্চ, দস্যু বাহিনী শুরু করলো বোমাবর্ষণ গ্লাস ফ্যাক্টরী, মেডিকেল কলেজ ও কালুরঘাট এলাকায়।
একত্রিশে মার্চ খান সেনাদের পুরোপুরি দখলে চলে গেল চট্টগ্রাম নগরী। আবার শুরু হলো বাঙ্গালী নিধন। ২রা এপ্রিল আমরা বাসা ছেড়ে পাশের এক বাড়ীতে আশ্রয় নিলাম। কারণ খান সেনারা আর অবাঙ্গালীরা আমার স্বামীকে খুঁজছে। তার অপরাধ ছিল বাঙ্গালী কর্মচারীদের সাথে কথা বলতেন। বাংলার স্বাধীনতার স্বপক্ষে গোপনে কাজ করতেন।
এপ্রিল মাসের ৫ তারিখ পর্যন্ত আমরা সেখানেই থাকি। ৫ তারিখে আমরা জানালা দিয়ে দেখলাম আমাদের প্রতিবেশী রেলের চীফ ইঞ্জিনিয়ার মোজাম্মেল চৌধুরী, একাউন্টস অফিসার আব্দুল হামিদ, এল. আর খান এবং তাদের পরিবারের চাকরবাকর নিয়ে মোট ১১ জনকে জবাই করে হত্যা করা হলো। সকাল ১১টায় এই হত্যালীলা দেখে আমরা আঁতকে উঠলাম। সেদিনই পালিয়ে গিয়ে উঠলাম ২০ নং চৌধুরী নাজীর আহমেদ রোডে ডাঃ সামসুল আলমের বাড়ীতে। সেখানে থাকাও আমাদের নিরাপদ ছিলন। তাই ডাক্তার সাহেবের পরামর্শে পালালাম তার ডাবুয়ার্গ এর বাড়ীতে। ১১মে পর্যন্ত সেখানে আমরা থাকি। মিসেস কামরুন বলেন, এই ১১মে আমাদের জীবনে ডেকে আনলো দুঃখের অমানিশা। আমাদের হাতের অর্থ ফুরিয়ে যাওয়ায় আমার স্বামী একটি চেক ভাঙ্গানোর জন্য ডাক্তার সাহেবের ছেলেকে পাঠান চট্টগ্রাম।
রেলওয়ে বিল্ডিং এর ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের শাখা অফিসে তার একাউন্ট ছিল। কিন্তু সেখানকার কর্মচারীরা সবাই ছিল অবাঙ্গালী। চেকের দস্তখত দেখে তারা ছেলেটিকে আমার স্বামীর খোঁজ দিতে বলে। কিন্তু চেকের ব্যাকডেট এর অজুহাত দেখিয়ে ছেলেটি কিছু জানাতে অস্বীকার করলে তারা রেলওয়ে ওয়াচ এন্ড ওয়ার্ড এর অবাঙ্গালী অফিসার ওয়ার্সীকে ডেকে আনে। ওয়ার্সী তখন ছেলেটিকে ও তার বাবা ডাঃ সামসুল আলমকে ধরে সেনাবাহিনীর সদর দফতরে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের অকথ্য অত্যাচার নির্যাতন চালিয়ে আমার স্বামীর সন্ধান বের করে।
তারপর দুজন খানসেনাকে সঙ্গে নিয়ে ওয়ার্সী রাউজানের ডাবুয়া গ্রামে ডাক্তার সাহেবের বাড়ীতে গিয়ে হাজির হয়। তারা আমার সামনে থেকে আমার স্বামীকে নিয়ে চট্টগ্রাম অভিমুখে রওনা হয়। তাদের সঙ্গে ডাক্তার সাহেব ও তার ছেলেও ছিল। পথে সাক্তার ব্রিজের কাছে বাস থামিয়ে খান সেনারা আমার স্বামীকে নামিয়ে খানিক দূরে নিয়ে যায়। কিছক্ষণ পরেই গুলির শব্দ পান বাসে উপবিষ্ট ডাক্তার সাহেব। মিনিট দশেকের মধ্যে খান সেনারা ফিরে আসে এবং ডাক্তার সাহেবকে চট্টগ্রামে নিয়ে ছেড়ে দেয়।
আমার স্বামীকে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছে বলে ডাক্তার সাহেব আমাকে জানান। মিসেস কামরুন নাহার তারপর এসে উঠলেন ঢাকাতে। অনেক অনুসন্ধান করে স্বামীর সন্ধান পাননি। দস্যু সেনাদের হাতে নাসিরউদ্দিন শহীদ হয়েছে। সদা কর্মব্যস্ত বাঙ্গালী দরদী একটি জীবনের অবসান হলো। জীবন দিয়ে নাসিরউদ্দীন মূল্য দিলেন তার দেশ ও স্বজাতি প্রেমের। তিনি আর এই সুন্দর পৃথিবীতে ফিরে আসবেন না। কিন্তু রেখে গেলেন কামরুন আর স্নেহের দুটি ছোট্ট মেয়ে রিনু আর নিড্ডুকে।
অভিশপ্ত ১১ই মেতে তাদের জীবনে নেমে এলো অমানিশার নিকষ কালো রাত্রি। মে থেকে একে একে ৮টি মাস কেটে গেল। বীভৎস রজনীর অন্ধকার কেটে দশদিক আলোয় ঝলমল করে স্বাধীনতার সূর্য উঠলো। শহীদ নাসিরউদ্দিনের স্বপ্নসাধ সফল হয়েছে। মুক্তির সোনালী আলোতে রিনু আর নিড্ডুর জীবন সুন্দর হবে, সার্থক হবে। এটাই বিধবা মার একমাত্র সান্ত্বনা। কিন্তু এই সান্ত্বনার মাঝেও মিসেস কামরুন নাহারের একটি মাত্র আক্ষেপঃ জল্লাদেরা একটিবারও তার লাশটি দেখতে দিলনা। পুলের ধারে না মেরে তারা যদি আমার সামনেই তাকে হত্যা করতো আমি তো লাশটা পেতাম।“