You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাঙলাদেশকে গড়ে তােলার সম্ভাবনা বিপুল
[বিশেষ প্রতিনিধি]

স্বাধীন বাঙলাদেশের পদস্থ অফিসার কবি সানাউল হকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। একটা সময় আমি প্রায় অভিভূক্ত হয়ে বলে উঠলাম : তার মানে, বাঙলাদেশ তাে অত্যন্ত সমৃদ্ধ একটি দেশ হয়ে উঠতে পারে। হক সাহেব বললেন : জী। আমাদের শান্তি নিশ্চিত হলে সাত থেকে দশ বছরের মধ্যে বাঙলাদেশ বাস্তব অর্থেই সােনার বাঙলা হয়ে উঠবে।
পঁচিশ বছর ধরে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠি দেশটিকে শােষণ ও বঞ্চনার দ্বারা পঙ্গু করে রেখেছে। অথচ বাঙলাদেশের সম্পদ ও সম্ভাবনা প্রচুর। ইতিপূর্বে এই শােষণ ও বঞ্চনার বহু তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। তার পুনরাবৃত্তির প্রয়ােজন নেই। শুধু কয়েকটি উদাহরণ উল্লেখ করাই যথেষ্ট।
বাঙলাদেশ উৎপন্ন করে প্রায় ৭২ লক্ষ গাঁট পাট। ৬৮টি চটকলের উৎপাদনের পরেও বাড়তি থাকে প্রায় ৩২ লক্ষ গাঁট উৎকৃষ্ট পাট। পাট এবং পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে বাঙলাদেশ বছরে আয় করে ১৫০ কোটি টাকা মূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা। যার ভিত্তিতে প্রতি বছর অন্তত ১০০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করা সম্ভব। এতদিন পর্যন্ত এই বিপুল সম্পদ লুট করে নিয়ে গেছে পাকিস্তানিরা। এখন দেশের এই সম্পদ দেশেই থাকবে।
তারপর ধরুন চা। বাঙলাদেশ প্রায় সাড়ে সাত কোটি পাউন্ড, চা উৎপাদন করে। ভেতরের প্রয়ােজন মিটিয়েও বাড়তি থাকে চার কোটি পাউন্ড। এতদিন পাকিস্তানিরা এই বাড়তি চা বিদেশে রপ্তানি করতে দেয়নি; নিজেরাই নিয়ে নিত। এখন বাঙলাদেশের হাতে এই বাড়তি অর্থও আসবে।
বাঙলাদেশের গবাদি পশুর উৎকৃষ্ট চামড়া এতদিন পাকিস্তানিরা নিয়ে নিত। তারপর পশ্চিম পাকিস্তানে তা প্রােসেস করার পর বাইরে রপ্তানি করে মােট টাকা মেরে দিত। এখন এই লুটও বন্ধ হবে।
বাঙলাদেশের মােট প্রায় ৫৯ হাজার বর্গমাইল এলাকার শতকরা ১৫ ভাগ বনভূমি। বনজ সম্পদ উল্লেখযােগ্য। শাল, সেগুন, গর্জন, আবলুস প্রভৃতি মূল্যবান কাঠ এতদিন ধরে বিশেষ কোনাে কাজে লাগেনি। এবার বাঙলাদেশ এইসবও কাজে লাগাতে পারবে।
অল্পসল্প সমীক্ষায় জানা গেছে বগুড়া অঞ্চলে উল্লেখযােগ্য পরিমাণে কয়লা এবঙ লাইমস্টোন ডিপােজিট রয়েছে ; পীট রয়েছে ফরিদপুর ও যশােহর এলাকায়। একমাত্র তিতাস অঞ্চলে যে প্রাকৃতিক গ্যাস মজুত আছে তা দিয়ে বাঙলাদেশের আগামী ৩০ বছরের প্রয়ােজন মেটানাে সম্ভব। শােনা যায়, বাঙলাদেশের নানা অঞ্চলে তৈল রয়েছে। পাকিস্তানিরা এই বিষয়ে কোনােরূপ সমীক্ষারও ব্যবস্থা করেনি। তাদের এসব কথা জানা ছিল। কিন্তু সম্পদ আহরণের কোনাে ইচ্ছা তাদের ছিল না। কারণ বাঙলাদেশের অধিবাসীদের কল্যাণের কোনাে বিবেচনাই তাদের মাথায় আসেনি।
একটি ঘটনা বলি। ঢাকার মতিঝিল এলাকায় একটি বড় হােটেল আছে। তার নাম পূর্বানী। ওখানে একদিন পাকিস্তানি সামরিক অফিসাররা অনেকে এসে দাবি জানালাে : খানা দাও। হােটেলে তখন কর্মচারী বেশি নেই। খাবার তৈরি করাও সম্ভব নয়। ফৌজি অফিসারদের কাছে একজন গিয়ে জানালেন : আদমি নেই। অতএব খানা দেওয়া সম্ভব হয় কী করে। এক পাকিস্তানি অফিসার তখন বললে : দেখাে বাপু। এখানে আমরা আদমি চাই না। চাই দেশটা। আদমি সব আমরাই নিয়ে আসব। কিছু চিন্তা নেই।
এই মনােভাবটাই সর্বত্র প্রকট। পাকিস্তানিরা বাঙলাদেশকে দখলে রাখতে চেয়েছিল, নিজেদের স্বার্থে বাঙলাদেশের মানুষের স্বার্থের বিনিময়ে। বিপুল সম্পদ এবং সম্ভাবনা নিয়েও তাই বাঙলাদেশ দারিদ্র্যে বঞ্চনায় পীড়িত।
বাঙলাদেশের শিল্পসম্পদও কম নয়। সূতিবস্ত্র ইত্যাদির কথা ছেড়ে দেওয়া গেল। অন্যান্য জিনিসের কথাই ধরা যাক। দেশে যে চারটি নিউজপ্রিন্টের কারখানা রয়েছে তার উৎপাদনের সিংহভাগ এতদিন পাকিস্তানিরাই নিয়েছে। বাইরে রপ্তানির সুযােগ থাকা সত্ত্বেও তা কাজে লাগাতে দেওয়া হয়নি। এই নিউজপ্রিন্ট অতি উৎকৃষ্ট ; অন্য বিদেশি পণ্য অপেক্ষা কোনাে অংশে খারাপ নয়। এখন বাঙলাদেশ ভারতে রপ্তানি করেই এই নিউজপ্রিন্ট বাবদ বহু পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় করতে পারবে।
ভারতে আরাে বহু জিনিস রপ্তানি করতে পারবে বাঙলাদেশ। শুধু একটি পণ্যের কথা এখানে উল্লেখ করছি। তা হলাে নানা জাতের মাছ। একটি হিসেবে জানা যায়, ভারতে শুধু মাছ রপ্তানি করে বাঙলাদেশ বছরে ১০ কোটি টাকা অর্জন করতে পারবে।
বাঙলাদেশ নদীনালার দেশ। নানা শ্রেণীর জল্যান তার পক্ষে অপরিহার্য। কিন্তু স্টীমার, জাহাজ প্রভৃতির জন্য তাকে পাকিস্তানের নয়ত অন্য কোনাে বাইরের দেশের মুখাপেক্ষী করে রাখা হয়েছে। অথচ বাঙলাদেশের নারায়ণগঞ্জে যে উপকরণ রয়েছে তা দিয়ে শুধু স্টিমার প্রভৃতি নয়, সমুদ্রগামী জাহাজ নির্মাণ করা যেতে পারে।
এসব ছাড়াও এখানে ওখানে মেশিনটুল প্ল্যান্ট, চিনিকল, কাপড়ল প্রভৃতিও রয়েছে।
মােটের ওপর বাঙলাদেশের যা সম্পদ আছে তা ঠিকমতাে কাজে লাগালে অচিরেই এই নতুন রাষ্ট্রটি সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে পারবে। এখন তার অর্থনীতি বহুলাংশে বিধ্বস্ত যােগাযােগব্যবস্থাও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারেনি। প্রাথমিক স্তরে এই সবকিছুর পুনর্গঠনের জন্য বাইরের সাহায্য প্রয়ােজন হবে। ভারত অবশ্যই সাহায্য নিয়ে অগ্রসর হবে। তাছাড়াও আরাে সাহায্য দরকার।
বাঙলাদেশের ভেতরে প্রয়ােজন একটি উপযুক্ত নেতৃত্ব। সমগ্র দেশের জনগণ নতুন করে দেশ গঠনের কাজে এগিয়ে আসবেন। দরকার এই বিরাট জনসম্পদকে কাজে লাগানাে। তার জন্য সকল রাজনৈতিক দল ও মতের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস চাই। চলে যাবার আগে পাকিস্তানিরা বাঙলাদেশের কারিগরি-বিদ্যাসম্পন্ন। অজস্র লােককে হত্যা করে গেছে। বাংলাদেশ পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে এই অভাবটি এখন পূরণ করতে হবে। ভারতের পক্ষ থেকে ডি.পি. ধর এই বিষয়ে সর্বাঙ্গীণ সাহায্য দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। নতুন কর্মীবাহিনী শিক্ষিত করে তােলার কথাও বলা হয়েছে।
নতুন পরিস্থিতিতে বাঙলাদেশের ভেতরেও একটি ব্যাপক পরিবর্তন সাধনের প্রয়ােজন আছে। পাকিস্ত নি-আমলে বাঙলাদেশের প্রশাসন ব্যবস্থা সামান্য মিউনিসিপ্যালিটি পরিচালন ব্যবস্থার বেশি কিছু ছিল না। এখন প্রশাসন ব্যবস্থাকে একটি নতুন জাতির জাতীয় প্রয়ােজনের উপযােগী করে গড়ে তােলা দরকার । সমগ্র মনােভাবেরই আমূল পরিবর্তন চাই।
মােট কথা এই : একটি ঐক্যবদ্ধ বলিষ্ঠ নেতৃত্বে, একটি সুষ্ঠু প্রশাসন-ব্যবস্থা, আর ভারত ও অন্য বন্ধুরাষ্ট্রের সাহায্যে—এই সম্মিলিত শক্তি বাংলাদেশকে একটি সমৃদ্ধ রাষ্ট্র হিসাবে অচিরেই গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।
কবি সানাউল হক মিথ্যা বলেননি। বাঙলাদেশের সম্ভাবনা বিপুল। তার সােনার বাঙলা হয়ে উঠতে কোনাে অলঙ্ঘ্য বাধা নেই।

সূত্র: সপ্তাহ, ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!