You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.24 | বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ | সপ্তাহ - সংগ্রামের নোটবুক

বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ

বাঙলাদেশের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি অধ্যাপক মুজফফর আহমেদের এই লেখাটি কিছুদিন আগেকার। বাঙলাদেশের মানুষের যে মুক্তিসংগ্রাম আজ জয়যুক্ত হয়েছে তার চরিত্র সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে এই প্রবন্ধটি সাহায্য করবে। তাই এখানে সংক্ষিপ্ত আকারে এটি প্রকাশ করা হলাে। সম্পাদক, সপ্তাহ।
পাকিস্তান ছিল একটি কৃত্রিম রাষ্ট্র। জাতীয়তাবাদের সমস্ত মূল নীতিকে অস্বীকার করে ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশকে ইসলাম ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করে সৃষ্টি করা হয়েছিল পাকিস্তানের।
পাকিস্তানের জন্মের পর থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের একটি সামরিক আমলাতান্ত্রিক-শিল্পপতি গােষ্ঠী বাঙলাদেশের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক জীবনের উপর প্রভুত্ব করে আসছিল যার ফলে বাঙলাদেশ কার্যত পরিণত হয়েছিল পাকিস্তানের উপনিবেশে। এই পশ্চিম-পাকিস্তানি গােষ্ঠী সেখানকার বড় বড় শিল্পপতি ও সামন্ত প্রভুদের এবং সাম্রাজ্যবাদীদের বিশেষ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থ রক্ষা করে চলতে।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম থেকেই সেখানকার শাসকশ্রেণী নিজেদের স্বার্থে বাঙালি, সিন্ধী, পাঠান এবং বেলুচ জাতিগুলাের সমস্ত গণতান্ত্রিক এবং জাতীয় অধিকার হরণ করার নীতি অনুসরণ করছিল, গণতন্ত্রের গলা টিপে মারা হয়েছিল, কার্যত চলছিল একনায়কত্ব। জনগণের কোন গণতান্ত্রিক অথিকার ছিল না, কোনাে স্বাধীনতা বলতেও কিছু ছিল না। গণতন্ত্রের গলা টিপে মারার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন জাতিগােষ্ঠির ভাষা এবং সংস্কৃতিরও গলা টিপে মারা হয়েছিল। পাকিস্তানে গণতন্ত্রকে হত্যা করার অন্যতম কারণ ছিল এই যে শাসকগােষ্ঠী আশঙ্কা করত গণতন্ত্র থাকলে বাঙলাদেশের মানুষ (যারা ছিল পাকিস্তানের জনসংখ্যার শতকরা। ৫৬ ভাগ) শাসনকার্যে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব পেয়ে যাবে। পাক আমলাতন্ত্রে বাঙালি ছিল না বললেই চলে।
বাঙলাদেশের অর্থনীতির সবটাই, ব্যাঙ্ক, ইন্সিওরেন্স, বড় বড় কল-কারখানা সবকিছুই ছিল অবাঙালি বৃহৎ শিল্পপতিদের হাতে। বাঙলাদেশের শ্রমিকশ্রেণী এবং জনগণকে অবাধে শােষণ করত বৃহৎ শিল্পপতি গােষ্ঠী (কুড়িটি এবচেটিয়া শিল্পপতি পরিবার এরা কুখ্যাত ছিল) এবং মার্কিন পুঁজিপতিরা। গ্রামঞ্চলে সামন্ততান্ত্রিক শােষণও ছিল সীমাহীন।
দেশশাসন সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের সমস্ত ক্ষেত্রেই কি অর্থনৈতিক, কি সামরিক, কি প্রশাসনিক বাঙলাদেশের প্রতিনিধিত্ব প্রায় ছিল না বললেই চলে। এখানকার অর্থনীতির ধারনটা ছিল ঔপনিবেশিক ধাচের। এখান কার প্রধান উৎপন্ন দ্রব্য পাট এবং চা বাইরে চালান দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা হত। তারপর সেটা কাজে লাগানাে হতাে পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পোন্নতির জন্যে। পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পজাত পণ্য কৃত্রিম চড়া দরে এনে বিক্রি করা হতাে বাঙলাদেশের সংরক্ষিত বাজারে। ফলে বাঙলাদেশের সমস্ত সম্পদ গিয়ে জমা হতে পশ্চিম পাকিস্তানে।
বর্তমান সংগ্রামের পটভূমি পাকিস্তান সৃষ্টির পর ঔপনিবেশিক ধরনের শাসন ও শােষণের বিরুদ্ধে বাঙলাদেশের মানুষের সংগ্রাম শুরু হয় ১৯৪৮ সালে যখন পাকিস্তানি শাসকরা উর্দু ভাষাকে (শতকরা ৬ জনের মাতৃভাষা) বাঙলীদের ওপর চাপিয়ে দেবার ব্যবস্থা করে। ১৯৫২ সালে এই সংগ্রাম ব্যাপক আকার ধারণ করে এবং গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের লড়াইয়ে পরিণত এই লড়াইয়ের ফলে ১৯৫৪ সালে বাঙলাদেশে প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম লীগ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ৩০০টি আসনের মধ্যে তারা পায় মাত্র ৯টি। শাসকশ্রেণী জনগণের এই রায় মানতে রাজী ছিল না। এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভাকে মাত্র ৪৫ দিন মন্ত্রিত্বের পর বাতিল করে দেওয়া হলাে এই বলে যে হক সাহেব ভারতের সঙ্গে চক্রান্ত করে বাঙলাদেশকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র করছিলেন।
১৯৫৬ সালে একটা আধা-গণতান্ত্রিক সংবিধান চালু করা হলাে। এর পর প্রচণ্ড আন্দোলন শুরু হলাে নির্বাচনের দাবিতে। কেন্দ্রীয় পাক সরকার বাধ্য হয়ে নির্বাচনের তারিখ ঘােষণা করলেন ১৯৫৯ সালের মার্চ। কিন্তু নির্বাচনের সম্ভাব্য ফলাফলে ভীত হয়ে শাসকবর্গ ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে জারি করল সামরিক শাসন। আয়ুব খান ক্ষমতা দখল করল, সংবিধান বাতিল করা হলাে। ব্যাপকভাবে শুরু হলাে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলাের উপর নির্যাতন এবং দমননীতি।
কিন্তু এই নির্যাতন ও দমননীতি জনসাধারণ চুপচাপ মেনে নেয়নি। ১৯৬১ সাল থেকে বাঙলাদেশ, পাঠানভূমি এবং বেলুচিস্তানের জনগণ স্বায়ত্তশাসন এবং গণতন্ত্রের জন্যে গৌরবময় লড়াই চালিয়েছিল । উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, ১৯৬১-৬২ সালে বালুচদের মৃত্যুভয়হীন সংগ্রাম, ১৯৬১ সালে পাঠানদের বীরত্বপূর্ণ লড়াই এবং ১৯৬২, ১৯৬৩, ১৯৬৪ সালে বাঙলাদেশের ছাত্র এবং সাধারণ মানুষের সংগ্রামের কথা।
১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগােষ্ঠী প্রচণ্ড ভারতবিরােধী জিগির তুলে সাময়িকভাবে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করতে পেরেছিল। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হবার অব্যবহিত পরেই আওয়ামী লীগের ৬-দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে বাঙলাদেশে প্রচণ্ড আন্দোলন শুরু হর (জুন, ১৯৬৬)। এই ৬-দফা কর্মসূচি মূলত ছিল পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের কর্মসূচি। এই কর্মসূচি বাঙলাদেশের জনসাধারণের ব্যাপক সমর্থন লাভ করেছিল, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির বামপন্থী অংশও (এখন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ওয়ালি-মুজফফর নামে পরিচিত) একে সমর্থন করে। এই কর্মসূচির ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ যে আন্দোলন আরম্ভ করে তা ছিল খুবই শক্তিশালী। কিন্তু আয়ুব সরকার তা দমন করেছিল বলপ্রয়ােগে ।
১৯৬৮-৬৯ সালে গােটা পাকিস্তানে প্রচণ্ড গণবিক্ষোভ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। আয়ুবের পতন ঘটে। ক্ষমতা ছাড়ার আগে আয়ুব ক্ষমতা হস্তান্তর করে সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ইয়াহিয়া খার হাতে। ১৯৬৯ সালে ২৫ মার্চ দ্বিতীয়বার পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি হয়। কিন্তু সামরিক আইন সত্ত্বেও গণঅভ্যুত্থানের চাপে ইয়াহিয়া মেনে নিতে বাধ্য হয় যে (১) প্রাপ্তবয়স্কের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচন হবে, (২) জনসংখ্যা অনুসারে প্রতিনিধিদের ব্যবস্থা থাকবে, (৩) নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ নতুন সংবিধান বানাবে, (৪) আগেকার প্রদেশগুলাে পুনরুজ্জীবিত করা হবে—এক ইউনিট তুলে দেওয়া হবে। তবে এই সঙ্গে ইয়াহিয়া লিগাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার (L.E.O.) বলে একটি নির্দেশ জারি করে, তাতে বলে যে সংবিধান প্রেসিডেন্টের অনুমােদন-সাপেক্ষ এবং ইসলামি হতে হবে।
ন্যাপ (ওয়ালি-মুজফফর) সামরিক চক্রের চক্রান্ত ধরতে পেরেছিল। ন্যাপ দাবি তুলেছিল, জাতীয় পরিষদকে সার্বভৌম ক্ষমতা দিতে হবে এবং L.E.O. সংশােধন করতে হবে। কিন্তু L.F.O. সংশােধন করা হয়নি।
১৯৭০ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচন ও ইয়াহিয়ার বিশ্বাসঘাতকতা
নির্বাচনের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে সাধারণ নির্বাচন হয়। পাকিস্তানের ২৩ বছরের ইতিহাসে এ ধরনের নির্বাচন এই প্রথম।

সূত্র: সপ্তাহ, ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭১