প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বিশ্ব শান্তি পরিষদ মহাসচিব রমেশ চন্দ্রের সাক্ষাতকার
============
প্রশ্নঃ ম্যাডাম, ইন্দো-সোভিয়েত চুক্তি ভারতের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দ্বারা প্রশংসিত হয়েছে। এর কারণ কি হতে পারে?
উত্তরঃ ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে বন্ধুত্ব অনেক বছর ধরে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে, আমরা উভয়ে শান্তির জন্য কাজ করেছি এবং বর্ণবাদ এবং উপনিবেশবাদের বিরোধিতা করেছি। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভারী শিল্পের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনের জন্য আমাদের প্রোগ্রাম সাহায্য করেছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অভাবনীয় দ্রুততার সাথে পরিবর্তন, প্রসারণ ও একটি নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। পুরনো ক্ষুদ্রতা কাটিয়ে নতুন নতুন চুক্তিতে আবদ্ধ হচ্ছে নানা দেশ। এটি একটি সাধারণ প্রবণতা। কিন্তু কিছু সুবিধাবাদী দেশ এসব পরিবর্তনের সুবিধা গ্রহণ করে ফায়দা লুটার চেষ্টা করছে।
আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি, বর্তমান চুক্তিতে এই ধরনের হঠকারিরা নিরুৎসাহিত হবে। আমাদের জনগন সোভিয়েত ইউনিয়নকে বন্ধু হিসেবে দেখবে। এজন্যই চুক্তি আমাদের দেশে এই ধরনের ব্যাপক প্রশংসা লাভ করেছে।
প্রশ্নঃ এতে এই এলাকার শান্তির পরিস্থিতি – বিশেষ করে বাংলাদেশের জনগণের মুক্তি সংগ্রামে কোন প্রভাব হবে কি?
উত্তরঃ আপনার প্রশ্নের দ্বিতীয় অংশ দিয়ে শুরু করছি। বাংলাদেশের সংগ্রামের মূল ব্যাপার হচ্ছে এর একপাশে ৭৫ মিলিয়ন মানুষ এবং অন্য দিকে ইসলামাবাদের, প্রতিহিংসাপরায়ণ নিষ্ঠুর ও স্বৈরাচারী সামরিক শাসক – এই দুইয়ের মধ্যে সংঘাত। বাংলাদেশের মানুষ তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য লড়াইয়ে ঐক্যবদ্ধ। কিন্তু আমরা জানি যে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। তাছাড়া বালুচিস্তান, এন.ডাব্লিউ.এফ.পি অথবা সিন্ধু ও পাঞ্জাব কে বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত প্রদেশের মত দেখা হচ্ছে।
আমাদের জনগণ, সংসদ ও সরকার এবং বাঙলা দেশের জনগণের প্রতি পূর্ণ সহানুভূতি ও সমর্থন দেখাচ্ছে। আমরা পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের সঙ্গে কোন ঝগড়া করছিনা। অর্থাৎ সমস্যাটি ইন্দো-পাকিস্তান সম্পর্কিত নয়।
ইসলামাবাদে সামরিক শাসকেরা নিজেদের লোকদের থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন রেখেছে এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। পাকিস্তানের জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে দিতে তারা এই সমস্যাকে একটি ইন্দো-পাকিস্তান সমস্যায় রুপ দিতে চেষ্টা করছে। বিশ্বের বাকি দেশের কাছেও এমনটি করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। যুদ্ধের হুমকি থেকে বেপরোয়া পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। তাই আমরা কি করে এটাকে গুরুত্ব না দিয়ে থাকি? যাইহোক, আমরা মনে করি যে চুক্তি গৃহীত হয়েছে তাতে ইসলামাবাদ কোন হঠকারি সিদ্ধান্ত নিতে গেলে একটু হলেও চিন্তা করবে।
কিন্তু শান্তি মানে নিছক যুদ্ধ অনুপস্থিতি নয়। নিপীড়ন ও অবিচারের মুখে শান্তি বজায় থাকতে পারেনা। তাই জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের উপর ভিত্তি করে শান্তি স্থাপনের ব্যাবস্থা করা উচিত।
প্রশ্নঃ আপনি ন্যায়ত বলেছেন যে চুক্তি করা মানেই জোটনিরপেক্ষ অবস্থান থেকে সরে যাওয়া নয়। কিন্তু এতে করে সমস্ত বিশ্বে জোটনিরপেক্ষ শক্তিগুলো এক হবার সুযোগ সৃষ্টি তরান্বিত হবে কি?
উত্তরঃ পাওয়ার ব্লকের অবস্থায় আমরা বিভিন্ন সরকারের বন্ধুত্ব চেয়েছি। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য যুদ্ধ থেকে বিরত থাকা প্রয়োজন। এর জন্য মৌলিক নীতিমালা হয়েছে। একই সঙ্গে আমরা উপনিবেশবাদ এবং বর্ণবৈষম্যবাদের বিরোধিতা করেছি। এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক জাতি অনুরূপ নীতি অবলম্বন করেছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের নীতিকে সম্মান ও সমর্থন করেছে। চুক্তিটি নিজ প্রয়োজনেই অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।
জোটনিরপেক্ষ শব্দটিকে অপব্যাখ্যা করা হয়েছে। এজন্য এ ধরনের সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। এই চুক্তি আমাদের নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে সরায়নি বলে আমরা মনে করি।
জোটনিরপেক্ষ দেশগুলোর জাতীয় স্বার্থ হচ্ছে সামরিক হঠকারিতার হুমকি থেকে দেশকে সুরক্ষিত করা। সিকিউরিটি এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে করে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি নিশ্চিত করা যায়। ইন্দো-সোভিয়েত চুক্তির ফলে সৃষ্ট বন্ধুত্ব, শান্তি ও সহযোগিতার মূল অর্জন এটি।
প্রশ্নঃ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও পশ্চিম এশিয়ায় শান্তি স্থাপনের জন্য আপনার অনুমান কি?
উত্তরঃ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শান্তি নির্ভর করে ভিয়েতনাম, লাওস ও কম্বোডিয়ার সমস্যার সমাধান উপর। এই তিনটি এখন পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত। তবে, দক্ষিণ ভিয়েতনাম কিছুটা এগিয়েছে। এটি স্বীকৃত যে সামরিক সমাধান কোন সঠিক সমাধান না। সম্প্রতি দক্ষিণ ভিয়েতনামের অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার নির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়েছে। এর মধ্যে আছে বিদেশী সৈন্য প্রত্যাহার, বিশেষভাবে আমেরিকান বাহিনী। আমার কোনো সন্দেহ নেই যে, এই প্রত্যাহার একটি নির্দিষ্ট নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে করা হবে। তারপর দক্ষিণ ভিয়েতনাম বাইরের সামরিক বা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছাড়া তাদের ভবিষ্যতের কর্ম্পন্থা ঠিক করতে পারবে। আজ না হোক কাল, ভিয়েতনাম সমস্যা এই পদ্ধতিতেই সমাধান হবে।
বর্তমানে পশ্চিম এশিয়ায় একটু স্থিরতা আসছে। তবে সম্ভাব্য পরিস্থিতি বিপজ্জনক। সমাধান খুঁজে বের করতে যত বিলম্ব হবে পরিস্থিতি ততই আরো কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। জাতিসঙ্ঘের কাছে এর একটি সমাধান চাওয়া হয়েছে।
১৯৬৭ সালের নিরাপত্তা পরিষদে প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত একটি ধারাবাহিক প্রস্তাব দিয়েছেন। আমরা মনে করি সেগুলো বিবেচনায় আনা উচিৎ।
প্রশ্নঃ চুক্তিটি ছিল উপনিবেশবাদ, বর্ণবাদ এবং নিরস্ত্রীকরণ এর উপরে। তাহলে কিভাবে আপনি মনে করেন এটা অ্যান্টি-উপনিবেশবাদ ও বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের উপর অবদান রাখবে? এবং নিরস্ত্রীকরণ কে অগ্রগতির দিকে নিবে? ‘
উত্তরঃ চুক্তিতে উভয় সরকারের উপনিবেশবাদ এবং সব ধরনের বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে ইচ্ছা পুনর্ব্যক্ত হয়েছে। একইভাবে, আমরা নিরস্ত্রীকরণের জন্য কাজ অব্যাহত রাখব। দু’দেশ শান্তি ও ন্যায়বিচারের জন্য সংকল্পবদ্ধ।
======
Source: ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, 30th August 1971