You dont have javascript enabled! Please enable it!

ঢাকার আবহাওয়া
ন.চ.

ঢাকার হাওয়ায় এখন শীতের আমেজ। পাকি সামরিক শাসনের দশ মাসের দুঃস্বপ্নের পর আজকের ঢাকায় বুক ভরে নিঃশ্বাস নেওয়া যাচ্ছে।
পুরনাে শহরের জনাকীর্ণ পথে পথে এখন মুক্তির আবহাওয়া, সর্বত্র কর্মচাঞ্চলতা। শুধু যে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়ে আসছে তাই নয়, বরং বলা যায় মুক্তি ও স্বাধীনতা তার প্রাধান্য বিস্তার করছে, অপসারিত করছে অতীতের উর্পাজাল ও জগদ্দল পাথরকে।
মুক্তির বিভিন্ন দিকের কথা লেখা যায়- অস্ত্রধারণ করেছে বলে গর্বিত যুব সমাজের সীমাহীন উৎসাহ থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী আর কদিন আগেও যারা পাকিস্তানের লােক ছিল সাধারণ মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববন্ধন, শেখ মুজিবুর রহমানের অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে যারা জাতিকে নতুন করে গড়ে তােলার জন্য, তার অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক কাঠামাে গড়ে তােলার জন্য সাহায্য করার চেষ্টা করছেন, সেইসব বুদ্ধিজীবীদের কাজ সম্পর্কে অনেক কথা লেখা যায়। চক্ষুষ্মন উপলব্ধিক্ষম একজন সাংবাদিকের পক্ষে এক সপ্তাহ ঢাকায় থাকাটা প্রায় একটা গােটা জীবনের অভিজ্ঞতা।
ঢাকায় প্রথম দিনেই যা নজরে পড়ে, তা যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি নয়, জেনারেল নেয়াজির আত্মসমর্পণের প্রাক্কালে প্রথম দফা পাক-বর্বরতার ভয়াবহ চিহ্ন। পাক শাসনের শেষ দিনটিতেও ঢাকা এবং বাঙলাদেশের বুদ্ধিক ও রাজনৈতিক জীবনের অন্যান্য কেন্দ্রগুলােকে যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তার বিশেষত্ব বাইরে থেকে বােঝা যায় না। ২৬ মার্চ ১৯৭১ তারিখে পাকি সেনাবাহিনী যেদিন প্রথম সেখানে ঝাপিয়ে পড়েছিল সেই প্রথম দফাতেই কিভাবে ঠাণ্ডা মাথায় রাজনৈতিক কর্মী ও বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছিল, সে সম্পর্কে অনেক খবরই ইতিমধ্যে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সারা বাংলাদেশ থেকেই সাধারণ মানুষের উপর বর্বরতার বীভৎস খবর আসছে- এই ভয়াবহ যন্ত্রণার ক্ষতচিহ্ন- গুলি বাঙলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের হৃদয়ে মনে বহুকাল থেকে যাবে। নতুন প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি আবু সায়ীদ চৌধুরী আমাকে বলেছেন, এগুলাে নিছক যুদ্ধাপরাধ নয়, কারণ এ অপরাধ তাে আসল সামরিক তৎপরতার সময়ে সংঘটিত হয়নি। সৈনিকদের ফুর্তির জন্য বাংকারে যুবতীদের রাখা হয় এবং তারা যাতে পালিয়ে যেতে না পারে সেজন্য তাদের বিবস্ত্র করে রাখা হয়- এমন ঘটনা এ পৃথিবীতে কে কবে দেখেছে? এমনকি হিটলারও তার ফৌজকে এর চেয়ে কড়া শাসনে রাখত-বাংকারে মেয়েদের রাখাটা হলাে আধুনিক ফ্যাসিস্ত ফৌজের ইয়াহিয়া-সংস্করণ।
মানুষের বিরুদ্ধে জঘন্য অপরাধের চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায় সর্বত্র- ঢাকার কর্মব্যস্ত পথেও। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণের মধ্যে অবস্থিত ইনজিনিয়ারিং কলেজের অধ্যাপক নুরুল্লা একদিন বিকেলে আমাকে নিয়ে গেলেন তার ল্যাবরেটরিতে। প্রায় কুড়ি-মিনিটের একটি টেলিভিশন ফিলম আমায় তিনি দেখালেন।
তাঁর মুখের দিকে তাকালে তার চেহারার মধ্যেই দেখতে পাবেন একজন পণ্ডিতকে। কিন্তু সেই মুখের প্রশান্তির আড়ালে লুকিয়ে আছে এক সুমহান নির্ভীক দেশপ্রেমিকের তেজস্বিতা। আর আমাদের তিনি যা দেখালেন, সেটি হলাে ইতিহাসের এক বিরাট দলিল।
২৬ মার্চ সকালবেলা, পাকসৈন্যরা যখন চিৎকার করে জানালা বন্ধ করতে বলছিল, তখন এই তরুণ অধ্যাপক তার পাঁচ তালার জানালার খড়খড়ি দিয়ে দেখেন যে, জগন্নাথ হলের খেলার মাঠে একদল পাকসৈন্য আহত বন্দিদের টেনে আনছে। তারপর তাদের হত্যা করছে গুলি করে। এরা সবাই ছাত্র ও শিক্ষক (পরে এঁদের একজনকে সনাক্ত করা হয়েছে শ্রদ্ধেয় ড. গােবিন্দচন্দ্র দেব বলে)।
অধ্যাপক নুরুল্লা শান্তভাবে তার টেলিভিশন ক্যামেরার লেন্সটি অতি সন্তর্পণে জানালা দিয়ে বার করে দেন। এখন এই ২০ মিনিটের ফিল্মে দেখতে পাওয়া যায় সেই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য। এই ফিল্মটির ঠিক গােড়ার দিকেই রয়েছে ২০ ও ২১ মার্চ তারিখের ছাত্র শােভাযাত্রার দৃশ্য। তারা স্লোগান দিচ্ছে কিভাবে তারা বিরুদ্ধবাদীদের হত্যা করছে তার দৃশ্য। এ এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা।
ঢাকা এবং বাঙলাদেশের অন্যান্য শহরের ছাত্রদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের উন্মত্ত ক্রোধের কারণ পাওয়া যায় এই ঘটনায় যে স্বাধীনতার আহ্বান এসেছিল এই সব তরুণদের কাছ থেকেই, তাদেরই চাপে শেখ মুজিব মার্চ মাসের গােড়ার দিকে স্বাধীনতার স্লোগান দিয়েছিলেন।
কিন্তু যাদের হত্যা করা হয়েছে তারা সকলেই মুক্তিসংগ্রামের জঙ্গী কর্মী ছিলেন না। বহু নিরীহ মানুষকেও খতম করা হয়েছে। ইকবাল হলে বহু নরকঙ্কাল পাওয়া গেছে। তাদের পরিচয় এখনাে অজ্ঞাত। কিন্তু সেই কঙ্কালগুলাের গায়ে নেকলেস আর কানের দুল দেখে বােঝা যায় যে এরা সবাই ছিল তরুণী। ঢাকা শহরেরই বহু জায়গায় ডরমিটরি ও গুদামগুলােকে পরিণত করা হয়েছিল হত্যাশালায়। পাকিস্তান ও বাঙলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক গড়ার চেষ্টায় মুখ খােলার আগে ভুট্টোর উচিত একবার ঢাকায় আসা।
বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের উপর আক্রমণটা ছিল পাক ফৌজের একটা সর্বাত্মক আক্রমণ। এর সবচেয়ে প্রমাণ ও সাক্ষ্য আমি দেখতে পেয়েছি বাঙলা অ্যাকাডেমিতে। সেখানকার মৃদুভাষী ডিরেক্টর আমাকে দেখিয়েছেন ইয়াহিয়া খান একটি কুৎসিত স্মৃতিচিহ্ন – এই বিদ্যাভবন লক্ষ্য করে ছোড়া একটি শেল-এর বহিরাবরণ এবং বইয়ের দগ্ধাবশেষ।
বিশেষ করে বুদ্ধিজীবীদের উপর এই আক্রমণ কেন? কারণ, পাক কর্তৃপক্ষ কোনদিন ভুলতে পারেননি আর একবছর মুক্ত বাঙলাদেশের খােলা হাওয়ায়, ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে ঢাকা শহর শহিদ দিবসের বিংশ বার্ষিকী উদযাপন করবে পরিপূর্ণ বিজয় গরিমায়।
বাঙলা অ্যাকাডেমির সিঁড়ি দিয়া উঠতে উঠতে শুনলাম কী করে এই বাড়িটি যােগাড় করা হয়েছিল অ্যাকাডেমির জন্য। পাকিস্তান যখন সৃষ্টি হয় তখন এটা ছিল মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি। ১৯৫২ সালে যখন ভাষা আন্দোলন হয় তখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন মুসলিম লীগ নেতা নুরুল আমিন, আর এই নুরুল আমিনের সঙ্গে জড়িত সে বছরের ফেব্রুয়ারিতে ছাত্রদের গুলি করে মারার ঘটনা।
পরে নির্বাচনে মুসলিম লীগ যখন শােচনীয়ভাবে পরাস্ত হয়, স্বল্পস্থায়ী যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা তখন বাঙলা অ্যাকাডেমি প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। জনসাধারণের দাবির ফলে সিদ্ধান্ত করা হয় যে ছাত্রদের গুলি করে মারার সময় নুরুল আমিন যে বাড়িতে থাকতেন সেই বাড়িতেই অ্যাকাডেমি প্রতিষ্ঠা করা হবে।
রক্তপিপাসু অত্যাচারী এই সরকারের শেষের দিকে হত্যার আরেকটি প্রকারভেদ দেখা যায়। এই দফায় হত্যার ভার নেয় প্রধানত দুটি সংগঠন। বিশেষ ভাবে তৈরি করা হয় এই উদ্দেশ্যেই-আত্মসমর্পণের সময়ে পাক হুকুমতের সামরিক উপদেষ্টা রাও ফরমান আলির নির্দেশে। শােনা যায় এই কাজে রাও ফরমান আলিকে গােপনে সলা-পরামর্শ দিয়েছে একজন আমেরিকান।
এই উদ্দেশ্যে গঠিত সংগঠন-দুটি হলাে ‘আল বদর ও আল শামস’। রাজাকারদের সংগ্রহ করা হতাে প্রধানত অবাঙালিদের মধ্যে থেকে। এদের বেলায় কিন্তু তা হয়নি। আল “বাঙলাদেশ স্বাধীন হবে!” আর তারপরই হত্যাকারীর কালাে হাত— সেই সব তরুণ-বৃদ্ধ বুদ্ধিজীবীদেরই হত্যার উল্লাসে উন্মত্ত।
একথা বিশ্বাস করা কঠিন যে একটা রাজনৈতিক মােকাবিলার ফলে, জনসমর্থনহীন এক শাসকচক্রের দিক থেকে মতাে নিষ্ঠুরতা ঘটতে পারে। যুদ্ধ নিষ্ঠুরতা কোন নতুন জিনিস নয়, কিন্তু যাকে শান্তির সময় বলা হচ্ছে, সেই সময় এত ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতা এমন একটা জিনিস যাকে বাঙলাদেশের মানুষ পুরুষানুক্রমে মনে রাখবে এবং অভিশাপ দেবে।
অধ্যাপক নুরুল্লার ল্যাবরেটরি থেকে ফিরে আসার পর সে’রাতে বার বার ঘুম ভেঙে জেগে উঠছি, চোখের সামনে ভেসে উঠছে টেলিভিশন ফিল্মের সেই ছােট ছােট চেহারাগুলাে, এক স্বৈরাচারী শাসন যে কুড়ি বছর আগে, ১৯৫২ সালে পূর্ববঙ্গের ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীরাই উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেবার বিরুদ্ধে প্রথম লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, আর সেই লড়াইয়ে পাক কর্তৃপক্ষকে পরাজয় স্বীকার করতে হয়েছিল এবং বাঙলা ভাষাকে দিতে হয়েছিল সরকারি ভাষা হিসেবে উর্দুর সমান মর্যাদা।
সেটাই ছিল সংগ্রামের শুরু। সেই সংগ্রাম শেষ হয়েছে গত ডিসেম্বর মাসে বাঙলাদেশের মুক্তির মধ্যে এবং স্বাধীন একটি জাতি হিসেবে তার আত্মপ্রকাশের মধ্যে। তাই এটা কোনাে বিস্ময়ের ব্যাপার নয় যে পাক সেনাবাহিনীর বর্বরতার অন্যতম প্রথম কাজটি এবারে ছিল বুলডােজার দিয়ে ১৯৫২ সালের সংগ্রামে আত্ম-বিসর্জনকারী ছাত্রদের স্মারক ‘শহীদ মিনারকে’ ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়া।

সূত্র: সপ্তাহ, ০৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!