পশ্চিমী শক্তিবর্গের বিমুখতা
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর তিন সপ্তাহের বিদেশযাত্রা কি কার্যত ব্যর্থ হয়েছে? কারণ, বাঙলাদেশ সমস্যার যে রাজনৈতিক মীমাংসার উদ্দেশ্যে তিনি পশ্চিমী শক্তিবর্গের সাহায্য ও সহযােগিতা পাওয়ার আশায় বিভিন্ন রাষ্ট্রনেতার সহিত সাক্ষাৎ ও আলােচনা করিয়াছেন, বাস্তব ক্ষেত্রে তার সামান্যই ফল পাওয়া গিয়াছে। পশ্চিমের কয়েকটি শক্তি পর্দার বাইরে অপেক্ষা পর্দার আড়ালে ব্যক্তিগত আলােচনায় অবশ্যই রাজনৈতিক মীমাংসার প্রয়ােজনীয়তার কথা স্বীকার করিয়াছেন এবং ব্রিটেন মৌখিক সহানুভূতিও দেখাইয়াছেন। কিন্তু ১০ লক্ষ উদ্বাস্তুকে ভারতের ঘাড় থেকে নামাইবার জন্য যে বাস্তব ও কর্যকর ব্যবস্থা অবিলম্বেই অবলম্বন। প্রয়ােজন, সেই আসল কাজ বিশেষ কিছু আগাইয়াছে বলিয়া মনে হয় না। বিশেষভাবে পশ্চিমী শক্তিবর্গের নেতৃস্থানীয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি মনােভাব বাঙলাদেশের প্রশ্ন ভারতের মনােভাবের প্রতি বিরূপ, একথা বলিলে নিশ্চয়ই অতিরঞ্জন করা হইবে না। কথচ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষভাবে আমেরিকা যাত্রার উদ্দেশ্য ছিল প্রেসিডেন্ট নিকসনকে সমগ্র সমস্যার গুরুত্ব বুঝানাে। গত ৪ এবং ৫ নভেম্বর প্রেসিডেন্টের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর এই সমস্ত সমস্যা নিয়া তিন ঘণ্টারও বেশি আলােচনা হইয়াছিল । অধিকন্তু বিভিন্ন ভােজসভার ও অভ্যর্থনাসভার বক্তৃতা, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মি: উইলিয়াম রজার্স ও বিশিষ্ট সংবাদপত্র সম্পাদকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও আলােচনা ইত্যাদি হইয়ছে। কিন্তু কূটনৈতিক শিষ্টাচারের প্রশ্ন বাদ দিলে সংক্ষেপে বলা যায় যে, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে প্রেসিডেন্ট নিকসনের আলােচনার পরেও মার্কিন নীতির মূলত কোনাে পরিবর্তন ঘটে নাই। তবে, ভারতের সরকারি মহলের একমাত্র সান্ত্বনা বােধ হয় এই যে, প্রেসিডেন্ট নিকসন আশ্বাস দিয়াছেন যে, দক্ষিণ এশিয়াতে শান্তি রক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি সেখানকার সংকট দূর করিবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করিবেন এবং সেই প্রসঙ্গে তিনি নাকি আর একটি আশ্বাস এই দিয়াছেন যে, পাকিস্তানকে আর সামরিক সাহায্য দেওয়া হইবে না। এই শেষােক্ত সিদ্ধান্তটি পরবর্তী কোনাে এক তারিখে ঘােষিত হইবে বলিয়া প্রকাশ। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রেসিডেন্টের সাক্ষাতের নীট ফল মাত্র এইটুকু। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও প্রকশ্যে স্বীকার যা করিয়ছেন, তাতে বুঝা গেল প্রেসিডেন্ট নিকসন ভারতের মনােভাব আগের চেয়ে ভালাে উপলব্ধি করিয়াছেন।
কিন্তু এই ফলের জন্য ভারতের ব্ৰিত জনগণের পক্ষে কোনাে বিশেষ সান্ত্বনার কারণ আছে বলিয়া বিশ্বাস করা কঠিন। কারণ, “দক্ষিণ এশিয়া সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান” কথাটি যথেষ্ট স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট নয়। বরং এটা একটা কূটনৈতিক তত্ত্বকথার আবরণ মাত্র। প্রেসিডিন্ট নিকসন এমন কথা বলেন নাই যে, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধিবার মতাে যে বিপজ্জনক অবস্থার সৃষ্টি হইয়াছে এবং যে সমস্ত কারণে ভারতবর্ষে ৯০ লক্ষ শরণার্থী ইতিমধ্যেই ভিড় করিয়াছেন, সেই কারণগুলাে দূর করিবার জন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের উপর চাপ দেওয়া হইবে কিংবা শরণার্থীদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য যে সম্মানজনক ও গ্রহণযােগ্য রাজনৈতিক মীমাংসা প্রয়ােজন, পাকিস্তানি শাসকচক্রকে সেই সমাধান গ্রহণের জন্যও চাপ দেওয়া হইবে। প্রকৃতপক্ষে প্রেসিডেন্ট নিকসন তার আলােচনায় বাংলাদেশের আসল সমস্যার মূল প্রশ্নই এড়াইয়া গিয়াছেন। এমন কি ভােজসভার বক্তৃতায় তিনি তাঁর উল্লেখও করেন নাই। তিনি যথাসম্ভব পাকিস্তানের মন রক্ষার জন্যই দেখা করিয়াছেন। এর প্রমাণ এই যে, মি: নিকসন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির সঙ্গে আলােচনায় একাধিকবার প্রস্তাব করিয়া ছিলেন ভারতীয় সৈন্যদিগকে পাক-ভারত সীমানা অঞ্চল থেকে প্রত্যাহার করিয়া নিতে এবং তার বদলে পাক-ভারত সীমানা পাহারা দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রসঙ্ঘের সৈন্য মােতায়েন করিতে। বলা বাহুল্য যে, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি এই প্রস্তাব সরাসরি অগ্রাহ্য করিয়াছেন। ভারতের নিরাপত্তার খাতিরেই এমন প্রস্তাব গ্রহণ করা সম্ভব নয়। অবশ্য প্রথম দিনের আলােচনায় তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মন রক্ষার জন্য এমন কথাও নাকি বলিয়াছিলেন যে, তার সরকার জেনারেল ইয়াহিয়া খানের উপর চাপ দিতেছেন শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাণনাশ না করার জন্য এবং প্রেসিডেণ্ড ইয়াহিয়া খান ও বাঙলাদেশের নেতাদের মধ্যে রাজনৈতিক সমাধানের উদ্দেশ্যে কথাবর্তা শুরু করার জন্য। পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ লাগুক, এমন অবস্থা নিশ্চয়ই তিনি চান না। দুর্ভাগ্যক্রমে মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রথমদিনের আলােচনার এই কথাগুলােকে (অবশ্যই সরকারি ভাষ্য নয়, সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপাের্ট মাত্র) নিশ্চিত ভরসার সঙ্গে গ্রহণ করা কঠিন। কারণ, পৃথিবীতে যে দুইটি রাষ্ট্র পাকিস্তানকে সবচেয়ে বেশি মদত দিয়েছে এবং ক্রমাগত পাক-ভারত স্নায়ুযুদ্ধে উস্কানি দিয়া ভারতবর্ষকে ব্ৰিত রাখিয়ছে, সেই দুটি রাষ্ট্র হইতেছে ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পাকিস্তানের অস্বাভাবিক উদ্ভাবের জন্য এবং ভারতবর্ষের পার্টিশানের জন্য যেমন মূলত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ (সেই সঙ্গে কংগ্রেস ও মুশলিম লীগ নেতৃত্ব) দায়ী, তেমনি বারবার পাকিস্তান কর্তৃক ভারতের বিরুদ্ধে আক্রমণের ও সৈন্য সমাবেশের জন্য (যে কথা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরাজী দৃঢ়তার সঙ্গে উল্লেখ করিয়াছেন) ইঙ্গ-মার্কিন কূটনৈতিক চাল ও প্ররােচনা সমানভাবে দায়ী। বিশেষত কোনাে দেশপ্রেমিক ভারতবাসীই একথা ভুলিতে পারেন না যে, ১৯৫৪ সাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে যে পরিমাণ আধুনিক সমরাস্ত্রের দ্বারা সজ্জিত করিয়াছেন এবং সহস্রধিক কোটি টাকার মারণাস্ত্র রাওয়ালপিণ্ডির ফ্যাসিস্ত চক্রকে “দান খয়রাত” করিয়াছেন, সেই মার্কিন বদান্যতার সঙ্গেই পাকিস্তান আজ এত শক্তিশালী এবং দাম্ভিক হইয়া উঠিয়াছে। অন্যথা ভারতবর্ষের তুলনায় পাকিস্তানের সামরিক শক্তি কতটুকু? অর্থাৎ ব্রিটিশ ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নিকট গণতন্ত্র ও জাতীয় স্বাধীনতার শত্রু পাকিস্তানি শাসক চক্রকে ক্ষমতায় রাখা একান্ত অপরিহার্য। কারণ, সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী এবং ইদানীং কালের বাঙালি বিরােধী পাকিস্তান দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মার্কিন প্রভুত্ব অব্যাহত রাখার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার এবং এই হাতিয়ার একেবারে দুর্বল হইয়া পড়িবে যদি বাংলাদেশ স্বাধীন হইয়া যায় কিংবা পাকিস্তান ভাঙ্গিয়া দুই টুকরা হইয়া যায়। কারণ, সেই অবস্থায় সাম্রাজ্যবাদীর কূটনীতি ও রণণীতির সবচেয়ে বড় তরফায় “ব্যালান্স অব্ পাওয়ার” নষ্ট হইয়া যাইবে এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে ভারতবর্ষ সবচেয়ে শক্তিশালী হওয়ার সুযােগ পাইবে। এবং পরিণতি ঘটিতে দিতে ব্রিটিশ এবং মার্কিন সাম্রাস্যবাদ রাজী নয়। অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি কর্তার মুখে অনবরত গণতন্ত্র, শান্তি ও স্বাধীনতার কথা বলিতেছেন। কিন্তু যে মুহূর্তে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির সার্বভৌম স্বাধীনতা, জাতীয়তা ও গণতন্ত্রের প্রশ্ন উঠিতেছে, সেই মুহূর্তেই তাঁরা পাকিস্তানের অখণ্ডতার দোহাই দিতেছেন। এ জন্যই দেখা যাইতেছে যে, গত ২৫ মার্চ রাত্রিবেলা যখন পাকিস্তানি সমরিক বাহিনী আধুনিকতম মার্কিন অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত হইয়া নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর আক্রমণ সুরু করিল এবং ইতােমধ্যে ১০ লক্ষ নিরপরাধ স্ত্রী-পুরুষ ও শিশুকে হত্যা করিয়া আধুনিক ইতিহাসের বর্বরতম অধ্যায়ের সূচনা করিল, তখন সেই পৈশাচিক নরমেধ যজ্ঞের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট নিকসন কিংবা পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদীগণের বিরুদ্ধে বিন্দুমাত্র বিচলিত হইল না। একমাত্র সােভিয়েত রাশিয়া এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানাইয়াছেন এবং এখনও জানাইতেছেন। যদি পাকিস্তানকে সংযত করার কোনাে আন্তরিক ইচ্ছা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থাকিব, তবে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও তার চক্রীদের সাধ্য ছিল না এভাবে মাসের পর মাস বর্বর হত্যাকাণ্ড চালাইয়া যাওয়ার কিংবা লক্ষাধিক মানুষকে দেশ হইতে তাড়াইয়া দেওয়ার। কিন্তু আশ্চর্য এই যে, মার্কিন সরকার এই অমানুষিক কাণ্ডের বিরুদ্ধে আজ পর্যন্ত কোন অঙ্গুলি তােলেন নাই। ১৯৫৪ সালে হইতে পাকিস্তান ও আমেরিকার মধ্যে হাতেকলমে সামরিক চুক্তির শুরু এবং আজ সতের বছর ধরিয়া ভারতের বিরুদ্ধে সেই অশুভ চুক্তির ও সামরিক সাহায্য দানেরই জের চালাইতেছে। অতএব আমরা জানিতাম যে, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিদেশ সফরের দ্বারা আসল সমস্যার কোনাে মীমাংসা হইবে না। বিশেষত পশ্চিমের “বড় বাবুর” দল তাদের সাম্রাজ্যবাদীর অভিসন্ধি পরিত্যাগ করিবেন না। তবু, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর এই সফরকে আমরা স্বাগত জানাইয়াছিলাম এই কারণে যে, শান্তি রক্ষার জন্য ভারতবর্ষের উচিত যথাসাধ্য চেষ্টা করা এবং ৯০ লক্ষ শরণার্থী ও বাঙলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নটিকে উচ্চতম পর্যায়ে তুলিয়া ধরা। এদিক দিয়া প্রধানমন্ত্রী যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াছেন এবং ইউরােপ ও আমেরিকার রাষ্ট্রপ্রধানগণকে অত্যন্ত তীক্ষ বিশ্লেষণে শরণার্থী ও বাঙলাদেশ সমস্যার তাৎপর্য বুঝাইয়া দিয়াছেন। দুর্ভাগ্যক্রমে পশ্চিমের সাড়ে সাত কোটি বাঙালির জীবন-মৃত্যুর প্রশ্নকে কার্যত উপেক্ষা করিয়াছেন। কেবল তা-ই নয়। পশ্চিমী প্রধানগণ ভারতবর্ষ ও পাকিস্তানকে একই ব্রাকেটে দেখিয়া পাকিস্তানি পাপের জন্য যেন ভারতকেই দায়ী করিতে চাহিয়াছেন। অর্থাৎ যারা অপরাধ করিতেছে, তারা এবং যাদের বিরুদ্ধে অপরাধ করা হইল, তারা—এই উভয় পক্ষই যেন সমান দোষী ও সমান দায়ী। স্বয়ং ইন্দিরা গান্ধী পশ্চিমী রাষ্ট্রপ্রধানদের এই প্রকার অভিসন্ধিপূর্ণ মনােভাবের জন্য দস্তুরমতাে বিরক্তি ও ক্ষোভ প্রকাশ করিয়াছেন। এমন কি ওয়াশিংটনে গিয়া হােয়াইট হাউজের ভােজসভায় এক তাৎপর্যপূর্ণ বক্তৃতায় ভারতের শরণার্থী সমস্যার গুরুত্ব বুঝাইতে গিয়া প্রধানমন্ত্রী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের দিকে ইঙ্গিত করিয়া বলিয়াছিলেন যে, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবিচার থেকে পলায়িত লােকদের নিয়াই কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গড়িয়া ওঠে নাই? অর্থাৎ পূর্ব বাংলা থেকে লক্ষ লক্ষ লােকের পলায়নের মূলেও অনুরূপ রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উৎপীড়নের কারণ রহিয়াছে। প্রধানমন্ত্রী আরাে স্মরণ করাইয়া দিয়াছিলেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেমন ‘উন্মুক্ত সমাজ’ ও গণতন্ত্রের দেশ আমাদের ভারতবর্ষ ও তেমনি উন্মুক্ত সমাজের দেশ এবং এজন্যই ৯৫ লক্ষ শরণার্থীর বােঝা আমাদের ঘাড়ে চাপিয়াছে। কিন্তু জল্লাদের শিকার হওয়ার জন্য তাদের ফিরিয়ে দেওয়ার কথা আমাদের জনসাধারণ কল্পনাও করতে পারে না।
এভাবে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি হৃদয় দ্রবীভূত করার জন্য অনেক যুক্তি ও আবেদন পেশ করিয়াছিলেন বলে কিন্তু তৎসত্ত্বেও আসল সমস্যার কোনাে মিমাংসা হয় নাই। পাকিস্তানের প্রতি মার্কিন মমতা ও সামরিক পৃষ্ঠপােষকতা হ্রাস পাওয়ার নয়। অবশ্য কূটনৈতিক ভদ্রতার খাতিরে কিছু স্তোক বাক্য প্রেসিডেন্ট নিকসন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে শুনাইয়াছেন। কিন্তু কাৰ্য্যক্ষেত্রে এইসব মৌখিক সান্ত্বনার কোনাে মূল্য নাই। কারণ আসল সমস্যা ভারতবর্ষ ও পাকিস্তানের সম্পর্কে নয়, আসল সমস্যা হইতেছে বাঙলাদেশের স্বাধীনতা যে কঠিন সত্যের স্বীকৃতি ছাড়া শরণার্থীর প্রশ্নও পাকভারত সমস্যাও মিটিতে পারে না। পাকিস্তানের অবশ্য ভারতের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ের দ্বারা এই সমস্যার মিমাংসার জন্য পাগল হইয়া উঠিয়াছে এবং ওজন্য চীনের সামরিক সাহায্য লাভের উদ্দেশ্যে চীনা প্রেমিক জেড এ ভুট্টোর (প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী) নেতৃত্বে শীর্ষস্থানীয় পাক সামরিক ও সরকারি নেতাদিগকে পিকিংয়ে পাঠানাে হইয়াছে। কিন্তু পাকিস্তান সম্পর্কে চীনের নীতি যাচাই হােক না কেন যুদ্ধের দ্বারা পাকিস্তানের কোনাে সুবিধা হইবে না। কারণ, সে আজ ঘরে বাইরে বিপন্ন। সুতরাং এই অবস্থায় সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হইতেছে বিগত নির্বাচনের ফলাফল মানিয়া লওয়া এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা স্বীকার করা। যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমি শক্তিবর্গ বিমুখ হয়, তবু ইন্দিরা গান্ধিকে তার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করিতেই হইবে। তাঁর শান্তি সফরের পরে ভারতের পক্ষ থেকে দাবি আরও সােচ্চার হইবে।
সূত্র: সপ্তাহ, ১২ নভেম্বর ১৯৭১