You dont have javascript enabled! Please enable it!

ভারত-পাকিস্তান সংকটঃ সােভিয়েত ইউনিয়ন কোন পক্ষে
ভি. সিমােনােভ

পূর্ব পাকিস্তানি শরণার্থীদের রাশিয়া তার মধ্য এশিয় প্রজাতন্ত্রগুলােতে স্থান দিতে রাজি বলে ভারতকে জানিয়েছে। অক্টোবর মাসের গােড়ার দিকে এই চাঞ্চল্যকর খবরটি বিশ্ববাসীকে জানিয়েছিল রাওয়ালপিন্ডির দৈনিক সংবাদপত্র ‘তামীর’ । মনে হয় পত্রিকাটি খবর উদ্ভাবন করতে পারে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই খবরটি উদ্ভাবন করার পর ‘তামীর’ পত্রিকাটি তাকে যথাযথ নাটকীয় বিবরণাদী দিয়ে অলংকৃত করেনি। যেমন ধরুন, পত্রিকাটি বলেনি সাড়ে নব্বই লক্ষ শরণার্থীকে এতদূর সরিয়ে নিয়ে যেতে কত বছর, কত দশক লাগবে। এই লােকাপসরণ কিভাবে করা হবে সেটাও পরিষ্কার নয় : বিমানে, জাহাজে, না কি শরণার্থীরা হিমালয় পেরিয়ে হেটেই চলে যাবেন। এইসব পুঙ্খানুপুঙ্খ বিষয় সম্পর্কে সংবাদপত্রটির তার ব্যাখ্যা সহজেই পাওয়া যায়-বিশদ বিবরণ দিতে গেলে উদ্ভট এই উদ্ভাবন সঙ্গে সঙ্গে ফাঁস হয়ে যাবে।
যাই হােক দৈনিক ‘তামীর’ এর এই খবরের পেছনে কোন চিন্তা লুকিয়ে আছে সেটা ভেবে দেখা যাক। লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর আগমনস্রোতকে পৃথিবীর সংবাদপত্রগুলাে “ভারতের দিকে রক্তস্রোত” বলে অভিহিত করেছে। ভারতের পক্ষে এ এক গুরুতর বিপর্যয়, সমগ্র উপমহাদেশের পক্ষে এবং সর্বপ্রথমে পূর্বপাকিস্তানের পক্ষে এক মর্মান্তিক ঘটনা। দৈনিক ‘তামীর’ এর উদ্ভট ভাষ্য অনুযায়ী, সােভিয়েত ইউনিয়ন নাকি শরণার্থীদের নিয়ে যাবার প্রস্তাব দিয়েছে দিল্লিকে, ইসলামাবাদকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে, যদিও এই কাজটি তারই মৌল স্বার্থের সাথে জড়িত। পত্রিকাটি বলতে চায়, সােভিয়েত ইউনিয়ন পক্ষপাতদুষ্ট । সে হিন্দুস্তান উপদ্বীপে সংকটময় পরিস্থিতি বিচার করে ভারতঘেষা দৃষ্টিকোন থেকে। শরণার্থীদের পুনর্বাসন সম্পর্কে সাম্প্রতিকতম উদ্ভাবনের সাহায্য পত্রিকাটি এ কথাই প্রমাণ করার চেষ্টা করছে।
দূর্ভাগ্যবশত, এ ধরণের উদ্ভাবনের ব্যাপারে দৈনিক ‘তামীর’ একা নয়। সােভিয়েত-ভারত শান্তি, মৈত্রি ও সহযােগিতা চুক্তি সম্পাদনের পর অনেকগুলাে পাকিস্তানি সংবাদপত্রই যে বক্তব্য বার বার বলে চলেছে, সেটা ১ অক্টোবর ১৯৭১ তারিখের দৈনিক জাবেদান’ পত্রিকার সম্পাদকীয় শিরােনামায় অতি সংক্ষেপে প্রকাশ করা হয়েছে: “রুশিয়া হলাে ভারতের উকিল।”
এই ‘দৈনিক জাবেদান’ পত্রিকাই হিন্দুস্তানের ভবিতব্যের পক্ষে সােভিয়েত পররাষ্ট্রনীতির ভূমিকা সম্পর্কে লিখতে গিয়ে কিছুকাল আগে বলেছিল যে তাশখন্দ ঘােষণার খসড়া রচনায় সােভিয়েত ইউনিয়নের এক বিশেষ দায়িত্ব আছে।”
বস্তুতই, ভারত পাকিস্তান সীমান্তে সংঘর্ষ এবং সেখানে সৈন্য ও সমরােপকরণ সমাবেশের খবরের ধুম্রজালের মধ্য থেকে তাশখন্দ ঘােষণার মানবিক সারমর্ম আজ স্পষ্টতভাবেই চোখে পড়ে। এই ঐতিহাসিক ঘােষণাটি গৃহীত হবার ব্যাপারে সােভিয়েত ইউনিয়ন উদ্যোগ প্রদর্শন করেছে। কারণ তার দৃঢ় বিশ্বাস, ভারত-পাকিস্তান শত্রুতা যে ধরণের আত্মপ্রকাশ করুক না কেন, এশিয়ার জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের শত্রুদের স্বার্থকেই তা পূরণ করে। সােভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের মধ্যে শান্তি মৈত্রি ও সহযােগিতার নতুন চুক্তিটির মধ্যেও অন্তর্নীহিত রয়েছে সেই একই বিশ্বাস, হিন্দুস্তান উপদ্বীপে স্তিথিশীলতা রক্ষার সেই একই “বিশেষ দায়িত্ব”। যার মনে করেন যে এই চুক্তিটি একটি সামরিক চুক্তির আবরণ, যারা সােভিয়েত ইউনিয়নের “পক্ষপাতিত্বের কথা বলেন, তাঁরা ১০ জানুয়ারি ১৯৬৫ তারিখের তাশখন্দ গােষনা থেকে ৯ আগস্ট, ১৯৭১ তারিখে দিল্লিতে স্বাক্ষরিত চুক্তি পর্যন্ত সােভিয়েত পররাষ্ট্র নীতির যুক্তিসঙ্গত পারম্পর্যটি লক্ষ করতে তাদের অক্ষমতার পরিচয় দেন।
যে দুটি দেশের জনসংখ্যা পৃথিবীর জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ, তাদের মধ্যেকার সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রিত করে এই চুক্তি এই দেশগুলাের তথা সমগ্র মহাদেশের নিরাপত্তার অনুকূলে এক শক্তিশালী স্থিতিশীলতাবিধায়ক উপাদানের তাৎপর্য অর্জন করে। চুক্তির ১২টি ধারা হলাে শান্তি ও সৎ প্রতিবেশী-সুলভ মনােভাব সম্পর্কে ১২টি অনুজ্ঞা। এর মধ্যে এমন একটিও কথা বা ইঙ্গিত খুঁজে পাওয়া যাবে না, যাতে বলা যায় যে দলিলটি তৃতীয় কোন দেশের বিরুদ্ধে পরিচালিত। অন্য কোনাে এশীয় জাতির বিরুদ্ধে, বিশেষত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তা যে গােপনে উদ্যত নয় সে কথা এই চুক্তির সম্পর্কে পৃথিবীর সংবাদপত্রজগতের মূল্যায়ন থেকেই স্পষ্ট বােঝা যায়। চুক্তি সম্পর্কে মন্তব্য প্রসঙ্গে রয়টার লন্ডন থেকে জানিয়েছিল : “এই চুক্তি কোনাে নির্দিষ্ট রাষ্ট্রজোটের বিরুদ্ধে চালিত নয় এবং তার কোনাে আক্রমণাত্মক অভিসন্দিও নেই।”
ভারতের পার্লামেন্টে পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বরণ সিং এই চুক্তির যে ব্যাখ্যা করেছেন তাতেও উপরােক্ত বিশ্লেষণের যথার্থ প্রমাণিত হয়। তিনি বলেছেন: “বস্তুত আমরা আশা করি যে এই চুক্তি ভারত ও নির্দিষ্ট অঞ্চলের অন্যান্য দেশের মধ্যে অনুরূপ চুক্তির আদর্শ হিসেবে কাজ করবে। আমাদের অঞ্চলের দেশগুলাের মধ্যে এরকম চুক্তির ফলে এই সমস্ত দেশের শান্তি, স্বাধীনতা ও স্বার্বভৌমত্ব শক্তিশালী হবে।”
ভারত পাকিস্তানের সংঘর্ষের ব্যাপারে সােভিয়েত ইউনিয়ন কোন পক্ষ অবলম্বন করে তা বােঝবার জন্য শরণার্থীদের ব্যাপকভাবে তাশখন্দে স্থানান্তরীত করার উদ্ভট চিন্তা কল্পনা করে মনের উপর চাপ দেওয়ার কোন দরকার নেই। এই উপমহাদেশে সােভিয়েত ইউনিয়ন কতকগুলাে নির্দিষ্ট শক্তির পক্ষ সমর্থক হিসেবে কাজ করে। সে শক্তিগুলাে হলাে শান্তি ও সপ্রতিবেশী-সুলভ সম্পর্কের শক্তি।

সূত্র: সপ্তাহ, ১২ নভেম্বর ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!