মুজিবুর রহমানের মুক্তি চাই
বাঙলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ যত তীব্র হচ্ছে, মুক্তিবাহিনীর দুর্ধর্ষ আঘাতে একের পর এক এলাকা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানি দখলদার ফৌজ যত হটে যেতে বাধ্য হচ্ছে ইয়াহিয়া খার সামরিকচক্র ততই ক্ষিপ্ত এবং দিশেহারা হয়ে পড়ছে। বাঙলাদেশের মুক্তসংগ্রামের অবিসংবাদী নেতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার হুমকি পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর সেই দিশেহারা উন্মত্ততারই লক্ষণ। সম্পূর্ণ উন্মাদ হলে পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠে এই সহজ সত্য কথাটা উপলদ্ধি করতাে যে, বাঙলাদেশের সাত কোটি মানুষকে কামান-বন্দুকের জোরে গােলামে পরিণত করে রাখবার দিন আজ আর নেই। বাঙলাদেশের মানুষ পাকিস্তানি শােষণ আর অত্যাচারের হাত থেকে আত্মরক্ষার তাগিদে স্বাধীনতার যে পথ বেছে নিয়েছেন সে পথ থেকে তাদের কোন জঙ্গী শাসকই ফেরাতে পারবে না।
বাঙলাদেশে যে পরিস্থিতি আজ সৃষ্টি হয়েছে তার জন্য সম্পূর্ণ দায়ী পাকিস্তানের ক্ষমতালিলু, দাম্ভিক, স্বৈরাচারী শাসকবর্গ যারা মুষ্টিমেয় পাঞ্জাবি একচেটিয়া পুঁজিপতি পরিবার আর সামন্ত প্রভুদের স্বার্থে পাকিস্তানের জনসংখ্যার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে পরিণত করেছিল ঔপনিবেশিক ক্রীতদাসে। পাকিস্তানের বিগত সাধারণ নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বিজয়ী আওয়ামী লীগকে তাদের স্বার্থেই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে দেয়নি ইয়াহিয়া-ভুট্টোচক্র। তাদের স্বার্থেই নিরস্ত্র লক্ষ লক্ষ বাঙালির রক্তে বাঙলাদেশের মাটিকে সিক্ত করেছে পাকিস্তানি বর্বর ফৌজেরা। নর্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের আলােচনা চালাবার অজুহাতে কালক্ষেপ করে সেই সামন্ত ভূস্বামী আর একচেটিয়া পুঁজিপতি গােষ্ঠীদের স্বার্থেই বিশ্বাসঘাতক ইয়াহিয়া খার ফৌজ গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছে মুজিবুর রহমানকে।
কিন্তু মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে কিংবা বাঙলাদেশের গণতন্ত্র-প্রিয় লক্ষ লক্ষ মানুষকে খুন করে বাঙলাদেশকে শায়েস্তা করার যে স্বপ্ন পাকিস্তানি শাসকরা দেখেছিল সে স্বপ্ন অনেক আগেই ভেঙে গেছে। বাঙলাদেশের মানুষের মনােবল তার ধ্বংস করতে পারেনি, ধ্বংস করেছে তারা পাকিস্তানের বনিয়াদকে চিরদিনের মতাে। বাঙলাদেশের মানুষ ঘােষণা করেছেন নিজেদের স্বাধীন অস্তিত্বের কথা, ঘােষণা করেছেন সার্বভৌম প্রজাতান্ত্রিক সরকার। আর বাঙলাদেশের মাটি থেকে পশ্চিম পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীকে উৎখাত করার জন্য দলমত নির্বিশেষে সেখানকার সকল শ্রেণীর মানুষ, শ্রমিক-কৃষক-বুদ্ধিজীবী-ছাত্র-যুবক সকলেই সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধকে দিনের পর দিন প্রবল থেকে প্রবলতর করে তুলছেন। চীন আর আমেরিকার অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনী আজ মুক্তিযােদ্ধাদের দিবারাত্র আক্রমণে বিপর্যস্ত। পাকিস্তানের বন্ধু রাষ্ট্রগুলাের সংবাদপত্রও আজ আর পাকিস্তানি বাহিনীর শােচনীয় অবস্থা গােপন করতে পারছে না। পাকিস্ত যনি ফৌজের মধ্যে বিদ্রোহের লক্ষণ ইয়াহিয়া খা আর তার বন্ধুদের চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছে।
এই বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচবার আশায় ইয়াহিয়া খা ভারত-বিরােধী যুদ্ধের হুমকি ছাড়তে শুরু করে ছিলেন। ভারত-বিরােধী যুদ্ধ বাধিয়ে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ক্রমবর্ধমান অশান্তি, বিক্ষোভ আর বিদ্রোহকে ধামাচাপা দেবার সেই পুরনাে বস্তাপচা কৌশল। কিন্তু সে পথ তার বন্ধ হয়ে গেছে। ভারত-সােভিয়েত শান্তি ও মৈত্রী চুক্তি ইয়াহিয়া খাঁর সামরিক চক্রের যুদ্ধের সাধ চিরদিনের মতাে চিটিয়ে দিয়েছে তাতে সন্দেহ নেই।
ক্ষিপ্ত পাকিস্তানি শাসকরা এখন তাই প্রতিশােধস্পৃহা চরিতার্থ করার চেষ্টা করছে শেখ মুজিবুর রহমানের উপর আঘাত হেনে। বন্দি অবস্থায় কারাগারে এই জনপ্রিয় নেতার উপর অকথ্য অত্যাচার করা হয়েছে। এখন আবার ঘােষণা করা হয়েছে ১১ আগস্ট থেকে সামরিক আদালতে গােপনে মুজিবুর রহমানের বিচার শুরু হবে পাকিস্তান-বিরােধী লড়াই চালানাের অপরাধে। এই গােপন বিচার যে বিচারের নামে প্রহসন হবে তা বুঝতে কারাে বাকি নেই। প্রকাশ্য বিচারের সাহস পাকিস্তানি শাসকেদের নেই কারণ তাহলে তাদের নিজেদেরই দাঁড়াতে হতাে অপরাধীর কাঠগড়ায়। তাই গােপনে চোরের মতাে বিচারের নামে এই তামাসা। এই ধরনের তামাসা আর একবার হয়েছিল শেখ মুজিবুরের বিরুদ্ধে কুখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময়। সেই মামলায় প্রমাণ হয়েছিল শেখ মুজিবুরের বিরুদ্ধে সব অভিযােগ সাজানাে, আসলে অপরাধী পাকিস্তানি শাসকরা কারণ তারাই মিথ্যা মামলা খাড়া করেছিল পাকিস্তানে গণতন্ত্রকে হত্যা করার জন্য, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ককে বিষাক্ত করার উদ্দেশ্যে।
মুজিবুর রহমানের এই তথাকথিত বিচারের ফল যাতে ইয়াহিয়া চক্রের পছন্দমতাে হয় তাই ইয়াহিয়া। আগেভাগেই জানিয়ে রেখেছেন মুজিবুরের মৃত্যুদণ্ড হবে না এমন কোন গ্যারান্টি তিনি দিতে নারাজ ! পাকিস্তানি সামরিক চক্র যেখানে অভিযােগকারী এবং সামরিক আদালত যেখানে বিচারক সেখানে এই ঘঘাষণার তাৎপর্য খুবই পরিষ্কার। সুতরাং দুনিয়ার সমস্ত দেশে গণতন্ত্রকামী মানুষ দাবি তুলেছেন, বিচারের নামে এই প্রহসন বন্ধ হােক, শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি চাই।’
মুজিবুর রহমানকে সামরিক আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানাে পাকিস্তানি খুনী শাসকদের চরম ঔদ্ধত্য ছাড়া কিছু নয় ! মুজিবুরের বিচার করবে ইয়াহিয়া খাঁর পােষা সামরিক আদালত কোন অধিকারে? মুজিবুর রহমান শুধু বাঙলাদেশের মানুষের নির্বাচিত একচ্ছত্র নেতা নন, সমগ্র পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদেরও তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। শুধু বাঙলাদেশের নয়, সমগ্র পাকিস্তানের মানুষের হয়ে কথা বলার অধিকারী একমাত্র তিনিই। ইয়াহিয়া খার কোন অধিকার নেই পাকিস্তানের মানুষের তরফে কথা বলার। কারণ, তিনি কারাে নির্বাচিত প্রতিনিধি নন; তিনি অবৈধ ভাবে ক্ষমতা দখল করে বসে আছেন, পাকিস্তানে গণতন্ত্রকে হত্যা করেছেন, পাকিস্তানের কবর খুঁড়েছেন মুষ্টিমেয় কায়েমী স্বার্থসেবী গােষ্ঠদের ইঙ্গিতে। বিচার তাই হওয়া দরকার মুজিবুর রহমানের নয়, ইয়াহিয়া খার। এখনও যদি মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানি শাসকেরা মুক্তি না দেয়, যদি মুজিবুর রহমানের জীবন বিন্দুমাত্র বিপন্ন হয় তবে তার উপযুক্ত জবাব বাঙলাদেশের মানুষ নিশ্চয় দেবে। এবং সেদিনও দূর নয়, যেদিন ইয়াহিয়া খা এবং তার দুর্বিনীত সামরিক নেতাদের নিশ্চিহ্ন হতে হবে পাকিস্তানের জনগণের প্রচণ্ড রােষবহ্নিতে সেটা আর কার্যকর নয়। পাকিস্তানকে অস্ত্র সাহায্য দেবার কর্মসূচিটি পরীক্ষামূলক কাজ হিসেবেও সফল হয়নি। ১৯৭০ সালের মাঝামাঝি এই সাহায্য কর্মসূচি শেষ হয়ে যায়। তারপরে তা আর নতুন করে শুরু করা হয়নি। পাকিস্তান যে তার সংগৃহীত অস্ত্রকে কোনাে সাম্রাজ্যবাদী বিপদের মােকাবেলা করার জন্য ব্যবহার করবে না, প্রয়ােগ করবে স্বদেশে গণতন্ত্র দমনের জন্য, না হয় গণতান্ত্রিক প্রতিবেশীকে বিপন্ন করার জন্য, একথা এখন দিবালােকের মতাে স্পষ্ট।
অতএব, যারা ভেবেছিলেন যে বর্তমান পরিস্থিতিতে গ্রেমিকো আসছেন দ্বিতীয় তাশখন্দ ঘটাতে তারা বাস্তববুদ্ধির পরিচয় দেননি। কারণ, তাশখন্দের মীমাংসার ভিত্তি ছিল ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও শান্তির প্রত্যাশা। দ্বিতীয়ত, বর্তমান সংকটটি ইসলামাবাদের নিজেরই সৃষ্টি। এ সংকট সে সৃষ্টি করেছে বাঙলাদেশের সমগ্র জনগণকে দমন করতে গিয়ে। এর সঙ্গে পাক-ভারত সম্পর্কের কোনাে সম্বন্ধই নেই। তাই, গ্রোমিকোর এবারকার সফরে একথা প্রকাশ পেয়েছে যে সােভিয়েতের দৃষ্টিতে ওয়াশিংটনের অস্ত্র সাহায্য আর পিকিংয়ের আশীর্বাদপুষ্ট ইসলামাবাদের এখনকার এই যুদ্ধং দেহ ভাব দক্ষিণ এশিয়ার শান্তির পক্ষে বিপদস্বরূপ। তাই, এবার তাশখন্দ নয়, ভারত-সােভিয়েত শান্তি, মৈত্রি ও সহযােগিতা চুক্তি। গ্রেমিকোর এবারকার সফর তাই ইয়াহিয়ার যুদ্ধের হুমকিকে বন্ধ করবে, বাঙলাদেশের মানুষকে সাহায্য করবে তাদের মুক্তিসংগ্রামে।
আর, ভারতের দিক থেকে, সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে তার সম্পর্ক আরাে শক্তিশালী হওয়ার অর্থ হলাে এই গােটা অঞ্চলে শান্তি ও স্বাধীনতার এক নতুন গ্যারান্টি, এক নতুন সেতুমুখ খুলে যাওয়া। একদিকে ইয়াহিয়া খাঁর রণহুঙ্কার, আরেকদিকে ইন্দোচীনে মার্কিন আগ্রাসনের আগুন—এই নিয়ে ভরত আজকের পৃথিবীতে রয়েছে সমরনীতিগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থানে। সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার সঙ্গে ভারতের দৃঢ়সংবদ্ধ সম্পর্ক তাই দক্ষিণ এশিয়ায় সামরিক হঠকারিতার রাজনীতির বিরুদ্ধে, শান্তির এক গুরুত্বপুর্ণ হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে। গ্রোমিকোর সফর এবং শান্তি, মৈত্রী ও সহযােগিতা চুক্তি সেই সম্ভাবনাই উন্মুক্ত করেছে।
এই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপায়িত করার জন্য, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক নতুন পরিপ্রেক্ষিত সৃষ্টি করার জন্য ভারতকে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলাের সঙ্গে, বিশেষত ভিয়েতনামের সঙ্গে তার সম্পর্ককে শক্তিশালী করার কাজে হাত দিতে হবে। একথা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, আমাদের পক্ষ থেকে এরকম কোনাে উদ্যোগ যদি গ্রহণ করা হয় তবে ভিয়েতনামের দিক থেকে আশাব্যঞ্জক সাড়া পাওয়া যাবে। একদিকে মস্কো থেকে শুরু করে অন্যদিকে হ্যানয় পর্যন্ত এক নতুন দিগন্ত খুলে গেছে আমাদের পাররাষ্ট্রনীতির সামনে। যে সমস্ত ভবিষ্যদ্বক্তা নিকসনের প্রস্তাবিত পিকিং সফরের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীতে ভারতের অবস্থান ও মর্যাদাহানির পূর্বাভাস করছিলেন, তাঁদের হিসাবে যে গরমিল রয়েছে সেকথা আরেকবার প্রমাণিত হবে।
সূত্র: সপ্তাহ, ১৩ আগস্ট ১৯৭১