You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.31 | ভারতীয় জাওয়ানদের ঢাকায় বিপুল সমাদর | সপ্তাহ - সংগ্রামের নোটবুক

ভারতীয় জাওয়ানদের ঢাকায় বিপুল সমাদর
ঢাকা থেকে সপ্তাহ-র বিশেষ প্রতিনিধি

ফিরে এস পরবাসী, ফিরে এস ঘরে। বাঙলাদেশের ঘরে ঘরে প্রতিটি মানুষের কণ্ঠে আজ এই আওয়াজ। যে পথ দিয়েই বাঙলাদেশে প্রবেশ করা যাবে সেই পথেই দেখা যাবে বড় বড় ফেস্টুনে স্বাগতম, ভারত বাঙলাদেশ মৈত্রী দীর্ঘজীবী হােক, ইন্দিরা গান্ধী জিন্দাবাদ, ইন্দিরা মুজিব জিন্দাবাদ ধ্বনি লেখা। বাঙলাদেশের যে কোনাে প্রান্তের যে কোনাে মানুষ যখনই জানতে পারবে আপনি ভারতের মানুষ, আপনি পশ্চিম বাংলার মানুষ, তখনই আপনি হয়ে উঠবেন একান্ত আপনজন, একান্তভাবে হৃদয়ের মানুষ। ঢাকা শহরের সঙ্গে কলকাতার চিরকাল একটা প্রতিদ্বন্দ্বী মনােভাব ছিল। কিন্তু এখন ঢাকার মানুষের শুধু একটি কামনা কবে একবার কলকাতা আসবাে। কলকাতার মানুষ গেলে তাে কথা নাই। দোকানে সওদা কিনতে গেলে দাঁড়িয়ে আপনাকে সব বলতে হবে কলকাতার খবর। তার পর দোকানী যে কোন জিনিসের দামই কম নেবে, তার জন্য আপনাকে বলতে হবে না। নিজে থেকেই বলবে, আমার কেনা দামটাই নিলাম। হােটেলে সেই একই অবস্থা, যা বিল হবে শতকরা ৫০ ভাগ বাদ।
শুধু ভারতীয় মানুষ নয়, ভারতীয় জাওয়ানরা বাঙলাদেশের সর্বত্র যে সমাদর ও শ্রদ্ধা পাচ্ছেন তার তুলনা নেই। অবশ্য সেই দিকে ভারতীয় জাওয়ানদের আচরণও অত্যদিক শালীন ও সংযম। যুদ্ধজয় শেষ হবার পর সৈনিকরা এখন সকলেই সেবক ও সাহায্যকারীর ভূমিকা নিয়েছেন। কোথাও কোনােরকম বাড়াবাড়ি বা বাহাদুরি ও হামবড়া মনােভাব নেই। বাঙলাদেশের মানুষ গত নয় মাস যে সৈন্যবাহিনীকে দেখেছে তাতে সৈন্যদের সম্পর্কে তাদের যে ধারণা ভারতীয় সেনাদের দেখে তারা আরাে বেশি করে বুঝতে পারছে তফাতটা। পাক সেনারা এতদিন ঢাকা শহরে অত্যাচার নিপীড়ন যা করেছে সে সব ইতিহাস বাদ দিলেও তারা কখনও কোন দোকানে খাবার খেয়ে পয়সা দিত না, সওদা কিনলে তাে নয়ই। কেউ কখনও দুই-চার পয়সা দিত আর বেশির ভাগ বলতাে “বিল বানাকে তেরা মুজিব বাপকে পাস ভেজদে, ও দাম দে দেগা।” রিকশা বা অন্য কোন গাড়িতে চেপে পাকিসেনারা পয়সা দিয়েছে এমন ঘটনা কখনও ঘটেনি। বড় হােটেলে সৈন্যরা ঢুকেছে, মেনু দেখে খাবার চেয়েছে, না দিতে পারলে চেয়ার টেবিল ভেঙে দিয়ে গেছে, সেই সঙ্গে বয় বেয়ারা তাে চড় কিল ঘুসি বাড়তি পেয়েছেই। পাকিসৈন্যদের বাইরে দেখলে সকলে দরজা জানলা বন্ধ করেছে। শাড়ি বা মেয়েদের পােশাক ঘরের বাইরে রৌদ্রে শুকাতে দেওয়া বদ্ধ ছিল, যাতে খানসেনারা মেয়েদের পােশাক দেখে মনে না করতে পারে এই বাড়িতে মহিলা আছে। আর আজ ভারতীয় সেনাদের অনেককেই ঢাকা শহরের অনেক বাড়ি নিমন্ত্রণ খেতে হয় আর তাদের খাবার পরিবেশন করেন। বাড়ির মেয়েরাই। মেজর অশােক তারা বেগম মুজিবকে খান সেনাদের বাড়ি থেকে উদ্ধার করেছেন এবং তাঁকে বেগম মুজিব একটি ঘড়ি উপহার দিয়েছেন।
ঢাকা শহরে কোথাও খুঁজে আপনি পাকিস্তান শব্দটি পাবেন না। যত সাইনবাের্ড বা কাগজপত্র বা অন্যত্র পূর্ব পাকিস্তান লেখা ছিল সেইগুলাে কালাে কালি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। জিন্নার ছবি একমাত্র দশ টাকার নােটে ছাড়া অন্য কোথাও দেখতে পাওয়া যাবে না। কিন্তু সেই নােটগুলাে হাতে নিয়েও মানুষের ঘৃণার অন্ত নেই। তাই ঢাকা শহরে ভারতীয় নােটের কদর বেশি। যে কোনাে দোকানী নিজে যেচে জিজ্ঞাসা করবে আপনার কাছে ভারতীয় নােট আছে কিনা। শােক ব্যথা দুঃখ বেদনায় ঢাকার মানুষের মন ভারাক্রান্ত, অনেকের দেহেই ক্ষতচিহ্ন কিন্তু সকলেই সেই সব ব্যথা ও শােক ভুলে গেছে। সব ব্যথা দুঃখ ও শােকের উপশম হয়েছে ভারতের মানুষকে কাছে পেয়ে। ভারত ও বাঙলাদেশের মধ্যে পাকিস্তান নাম নিয়ে যে কৃত্রিম বিভেদের প্রাচীর ছিল সেই প্রাচীর ভেঙে গেছে, মিথ্যার প্রাচীর ভেঙে গেছে, ঢাকার ঢাকা খুলে গেছে। তাই আনন্দ।

সূত্র: সপ্তাহ, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৭১