You dont have javascript enabled! Please enable it!

ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর একটি আলোচিত মামলা 

এম মনসুর আলীর অপর এক জুনিয়র সহকর্মী ছিলেন এডভােকেট গােলাম হাসনায়েন। তিনিও তৎকালীন পাবনা জজ কোর্টের এক আলােড়িত মামলার স্মৃতিচারণ প্রসঙ্গে মনসুর আলীর বিচক্ষণতার কথা বলেছেন। সেই সময় এই মামলাটি পুরাে এলাকায় বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। পুত্র কর্তৃক পিতাকে খুনের মামলা ছিল এটি। সকলের ধারণা ছিল আসামীর নির্ঘাত ফাসি হবে। কিন্তু মনসুর আলীর দক্ষতা ও বিচক্ষণতায় আসামীর ফাঁসি তাে হয়নি উপরন্তু মামলায় সম্পূর্ণ নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে মুক্তিলাভ করেছিলেন। মামলার ঘটনা ছিল নিম্নরূপ :
পাবনা সদরের একটি গ্রামের নাম মহেন্দ্রপুর। সেই গ্রামের একজন কৃষক, তার নাম আহমেদ আলী। আহমেদ আলীর দুই পুত্র আফসার ও নিজাম। দুই পুত্রই বিবাহিত এবং এক বাড়িতেই একান্নবর্তী পরিবারে তাদের বসবাস। বেশ সচ্ছল ও সুখী পরিবার বলা যায়। হঠাৎই আহমেদ আলীর স্ত্রীবিয়ােগ ঘটে। স্ত্রীর মৃত্যুর পর আহমেদ আলী বৃদ্ধবয়সে আবার এক তরুণী বধূকে বিয়ে করেন। সংসারে শুরু হয় অশান্তি। সারাক্ষণ ঝগড়া লেগেই থাকে পুত্রবধূ ও সৎ-শাশুড়ির মধ্যে। সৎ-মা ও বউদের মধ্যে বনিবনা না হওয়ায় পিতাপুত্রের মধ্যেও আস্তে আস্তে সম্পর্কের দূরত্ব বাড়তে থাকে। ক্রমশ সম্পর্কের এতই অবনতি হলাে যে পিতাপুত্রের মধ্যে কথা বলাই প্রায় বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম। সংসার পৃথক হয়ে গেল কিছুদিনের মধ্যেই। তবু সংসারে শান্তি নেই। অশান্তির আগুন বাড়ছে। এদিকে তরুণী বধূ তার নামে জমিজমা লিখে দিতে চাপ দেয় বৃদ্ধকে। সে গােপন একটি উইল লিখে নেয় কোন মুহুরিকে দিয়ে, যা তার পিতার পরিবারের লােকদের ইন্ধন ছিল। তারাও পরিবারের শান্তি বিনষ্টের জন্য নানারকম চক্রান্ত করতাে এবং বৃদ্ধকে উত্তেজিত করে ক্ষেপিয়ে তুলতে দুইপুত্রের বিরুদ্ধে। অপরদিকে, গ্রামের কিছু ষড়যন্ত্রকারীও মিথ্যে রটনা দিয়ে। দুইপুত্রকে ক্ষেপিয়ে তােলে যে, বৃদ্ধ আহমেদ আলী তার বাগান-পুকুর সব লিখে দিয়েছেন তার ছােট স্ত্রীর নামে। এই নিয়ে পিতা-পুত্রের মধ্যে দারুণ অবিশ্বাস ও অশান্তি সৃষ্টি হয়। সেদিন অক্টোবর মাসের এক সকাল। বৃদ্ধ কৃষক আহমেদ আলী স্থানীয় হাটে লাউ বিক্রির জন্য বাড়ির পাশের লাউক্ষেত থেকে ধারালাে ছুরি দিয়ে ডগা থেকে লাউ কেটে নিয়ে এসে বাড়ির উঠোনে জমা করেছেন। কচি কচি লাউয়ের প্রায় স্কুপ হয়ে গেছে উঠোনে। সেইখান থেকে একটি লাউ নিয়ে আসে আফসারের স্ত্রী রান্না করার জন্য। সৎ-শাশুড়ির চোখ এড়ায় না সেটা। এই নিয়ে শুরু করে যায় ঝগড়া। সকালে একপ্রহর ঝগড়ার পর পাড়াপ্রতিবেশির মধ্যস্থতায় আপাতত তা থেমে যায়। সেটি ছিল নিছকই বউ-শাশুড়ির ঝগড়া। সেই সময় আহমেদ আলী ও আফসার আলী ঝগড়া থেকে বিরতই ছিলেন। সকালের আহার সেরে আবার পিতাপুত্র নিজ নিজ কাজে চলে যায়। আফসার বাড়ির পাশে পুকুরেরপাড় ঘেঁষে পানবরজে কাজ করছিলেন। ওদিকে আহমেদ আলী তখনও লাউক্ষেত থেকে লাউ কেটে আনছেন।

আবার নতুন করে বউ-শাশুড়ির ঝগড়ার সূত্রপাত হয়ে যায়। বাড়ির উঠোনের দুইপ্রান্তে দুই রান্নাঘর থেকে বউ-শাশুড়ি গলা চড়িয়ে ঝগড়া আরম্ভ করে একেবারে পাড়া মাথায় তােলার যােগাড়। খিস্তি-খেউড়ের একপর্যায়ে বউশাশুড়ি পরস্পরের স্বামীদের চারিত্রিক বিষয়ে নােংরামি শুরু করে। তরুণী শাশুড়ি লাউক্ষেতে গিয়ে তার স্বামীকে চারিত্রিক লাম্পট্য নিয়ে অভিযােগে করে উত্তেজিত করে তােলে। বৃদ্ধ উত্তেজিত হয়ে তাঁর পুত্রের পানের বরজে গিয়ে প্রবেশ করে এবং দুর্ঘটনাটি সেখানে ঘটে যায়। বুকে ছুরি লেগে গেলে সেখান থেকে ছটফট করে পুকুরপাড়ে এসে আছড়ে পড়ে প্রচুর রক্তক্ষরণে পুকুরপাড়েই বৃদ্ধের মৃত্যু ঘটে। সঙ্গে সঙ্গে গ্রামবাসী ছেলে আফসার আলীকে ধরে পুলিশে সােপর্দ করে। কিন্তু আফসার আলী বারবার বলতে থাকে সে তার পিতাকে হত্যা করেনি। অতঃপর তাঁকে জেলে যেতে হয়। এদিকে বৃদ্ধের দাফনের কয়েকদিন পর মেয়েপক্ষের লােকজন বলে বৃদ্ধ তার বিষয় সম্পত্তি সবকিছুই তার স্ত্রীকে উইল করে দিয়ে গেছে। পুত্র কর্তৃক পিতাকে হত্যা? বিষয়টি সারা আদালত চত্বরে আলােড়ন সৃষ্টি করে। এলাকাজুড়ে মানুষের নানা প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। মামলার বিচারক ছিলেন আবু মােহাম্মদ হােসেন। তার ধারণা পুত্ৰই পিতাকে হত্যা করেছে। এমন অপরাধের বিচার না হলে সমাজ টিকবে না।

এই মামলার আসামীপক্ষের আইনজীবী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী। বাদী ও রাষ্ট্রপক্ষের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ছিলেন ঢাকা হাইকোর্টের আইনজীবী খান আব্দুস সবুর খান। তিনি ছিলেন মােনায়েম খানের আত্মীয়। বেশ প্রভাবশালী আইনজীবী। সকলের ধারণা পিপি সবুর খানের বিরুদ্ধে মনসুর সাহেব মামলায় হেরে যাবেন এবং আসামির ফাঁসি অবধারিত। মামলার পক্ষে-বিপক্ষে সাক্ষীর সওয়াল-জবাবের সময় আদালতে সাধারণ মানুষের উপচেপড়া ভিড়। একটি রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীও জনপ্রিয় আইনজীবী। তার সহকর্মী, সাধারণ কর্মীদের মনেও উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ। তাহলে কি মনসুর আলী এই মামলায় হেরে যাবেন! অথচ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর মধ্যে কোন ভাবান্তর নেই দেখে সকলেই বিস্মিত।

অবশেষে নির্ধারিত দিনে সওয়াল-জবাবে মনসুর আলী প্রমাণ করলেন যে, আহমেদ আলীর হত্যাকারী তার পুত্র নয়, হত্যাকারী তার স্ত্রীপক্ষেরই লােক। পুত্র বেকসুর মুক্তি পেলেন এবং সত্যি প্রতিষ্ঠিত হলাে। এই মামলা বিজয়ের পর মনসুর আলীর খ্যাতি আরাে ছড়িয়ে পড়লাে। রাষ্ট্রপক্ষের পিপিও অবাক হয়ে গেলেন মনসুর আলীর দক্ষতায়। আইন-পেশায় ছিল তার বিস্ময়কর কৌশল। অধিকাংশ মামলায় সাফল্যের জন্য তিনি সকলের কাছেই ছিলেন। পরম নির্ভরতার একজন ব্যক্তি ও আশা-জাগানিয়া নেতা।

রেফারেন্স – এম মনসুর আলী – সালিম সাবরিন, pp. 41-43

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!