ভুট্টোর পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে
পর্যবেক্ষক
বাঙলাদেশে যুদ্ধ দুই মাস হতে চলল। এই সময়ের মধ্যে ইয়াহিয়া সৈন্যরা ১০ লাখ নরনারী-শিশুকে হত্যা করেছে। লাখ ত্রিশেক লােককে ভারতে আসতে বাধ্য করেছে। কিন্তু ইয়াহিয়া-ভুট্টো-কাইয়ুম চক্র যুদ্ধ জয় করতে পারেনি। বরং এখন তাদের সামনে সমূহ বিপদ।
বাঙলাদেশে পাকিস্তানের ১৬ হাজার সৈন্য নিহত হয়েছে। আহত আরাে অনেক। এখন তাদের চিকিৎসার জন্য রক্তও দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে। পাকিস্তান বেতার থেকে জনগণের কাছে রক্তদানের জন্য প্রায় প্রত্যহ আকুল আবেদন জানানাে হচ্ছে।
বাঙলাদেশে ইয়াহিয়ার প্রশাসন বলতে কিছু নেই। কলকারখানা বন্ধ। অফিস-আদালতে কর্মী নেই। রেল স্টীমার ইত্যাদি কার্যত অচল। ট্যাক্স খাজনা প্রভৃতি আদায় হবার কথাই ওঠে না।
আয় নেই। কিন্তু যুদ্ধের ব্যয় রােজ দেড় কোটি টাকা। পৃথিবীর দেশে দেশে তাই ইয়াহিয়ার দূত ভিক্ষাপাত্র নিয়ে ঘুরছে। এখন ঠিক হয়েছে, আমেরিকা সাহায্য দেবে জানালে পাকিস্তান তার মুদ্রামূল্য শতকরা একশ ভাগ হ্রাস করতে প্রস্তুত। আরশাদ হােসেনকে মস্কোয় এবং আইয়ুব খাকে ওয়াশিংটনে পাঠানাে হয়েছে। মস্কোতে কোনাে পাত্তা না পেয়ে আরশাদ হােসেন বিলেতে ভাগ্য অন্বেষণ করছেন, যদি কিছু সাহায্য কিংবা বাণিজ্য দাক্ষিণ্য লাভ করা যায়।
ইসলামাবাদ বিপন্ন সত্যিই। এবং ক্ষিপ্ত। রাগটা গিয়ে পড়ছে সব থেকে বেশি সােভিয়েত রাশিয়ার ওপর। কাগজে কাগজে সােভিয়েতদের বিরুদ্ধে কড়া সমালােচনা প্রকাশিত হচ্ছে। বলা হচ্ছে, “মস্কো এখন ভারতের ক্রীড়নক। রাশিয়া এখন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদেরই অংশীদার।” অবশ্য ইয়াহিয়ার দূতেরা ঐ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কাছেই “মুক্ত দুনিয়ার প্রতি ইসলামাবাদের অচলা ভক্তি ও অটুট আনুগত্যের শপথবাক্য” নিয়মিত পাঠ করে চলেছে।
বিশ্ব শান্তি সংসদের সাম্প্রতিক অধিবেশন থেকে বাঙলাদেশের ওপর ইয়াহিয়া বাহিনীর অত্যাচারকে যেভাবে নিন্দা করা হয়েছে তা পাকিস্তানের বুকে একেবারে শেল হয়ে এসে আঘাত করেছে। ভুট্টোর পিপলস পার্টির মুখপাত্র “মুসাওয়াত” দাবি করেছে পাকিস্তানে শান্তি সংসদকে বেআইনি করে দেওয়া হােক। লাহােরের অনওয়া-এ-ওয়া-কত” বলেছে, বুদাপেস্তের শান্তি সম্মেলনের প্রস্তাব প্রমাণ করেছে সারা পৃথিবীর সােভিয়েত সমর্থক রাজনৈতিক শক্তিগুলাে এখন “হিন্দু ভারতেরই” দোস্ত। করাচির “জঙ্গ” বলেছে, পাকিস্তানে ঐ সকল মতের সমর্থকদের সবাইকে জেলে পুরে রাখা উচিত।
সব দেখেশুনে মনে হয়, পাকিস্তানে শান্তি সংসদ, সােভিয়েত-পাকিস্তান মৈত্রী সমিতি, আফ্রো-এশিয়া সংহতি সংস্থা, গণতান্ত্রিক নারী সংস্থা প্রভৃতি শীঘ্রই বেআইনি করে দেওয়া হবে। ফৈজ আহমেদ ফৈজ, আবদুল্লা মালিক প্রমুখ লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের গ্রেপ্তার করা হবে বলে শােনা যাচ্ছে।
অপরদিকে পাকিস্তানে চীনের জনপ্রিয়তা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। জামাত-ই-ইসলাম এর পত্রপত্রিকায় “হিন্দু” ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে চীনের দৃঢ় মনােভাবের বিশেষ প্রশংসা প্রচারিত হচ্ছে। তাদের মুখপত্র “জিন্দগি” মাও সে-তুঙকে “সারা পৃথিবীর নির্বাচিত জনগণের একমাত্র প্রকৃত বন্ধু ও নেতা” বলে বর্ণনা করেছে।
শের এবং পশ্চিম পাকিস্তানেরও জনগণের দ্বারা পরিত্যক্ত চীন এখন পাকিস্তানের সব থেকে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির মধ্যে আপন মিত্র ও দোস্ত খুঁজে পেয়েছে।
ইসলামাবাদ এখন চেষ্টা করছে বাংলদেশ সম্পর্কে একটি সমাধান সূত্র বার করতে। নুরুল আমিন সম্মত না হওয়ার ফলে প্রমাণ হলাে যে, ইয়াহিয়ার বিভীষণ হতে কেউ রাজী নয়। ঢাকায় এক “উপদেষ্টা পরিষদ গঠনেরও চেষ্টা চলছে। এই চেষ্টাও এখন পর্যন্ত ফলবতী হয়নি।
ইয়াহিয়া খাঁ পশ্চিম পাকিস্তানে মুসলিম লীগ নেতা আবদুল কোয়ায়ুম খাঁ মারফত একটি প্রস্তাব পেশ করেছেন। এতে বলা হয়েছে আপাতত জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের কোনাে সম্ভাবনা নেই। নতুন করে নির্বাচনের কথা এখন ভাবা যেতে পারে। ইতিমধ্যে রাষ্ট্রপতি স্বয়ং একটি সংবিধান রচনা করুন: যার মূল কথা হবে সংসদীয় গণতন্ত্র, দেশের ঐক্য ও সংহতি, এবং সর্বক্ষেত্রে ইসলামের আধিপত্য। অতঃপর এই সংবিধান সম্পর্কে গণভােট গ্রহণ করা হােক।
জুলফিকার আলি ভুট্টো এই প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন। তার দাবি হলাে অবিলম্বে তার দলকে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসনভার দিয়ে দেওয়া হােক।
কিন্তু ভুট্টো সাহেবেরও এক্তিয়ার হ্রাস পেয়েছে। তার পিপলস পার্টি এখন বিভক্ত। পার্টির একজন বিশিষ্ট সদস্য রাজা খান কাসুরী দল ভেঙে নতুন দল গড়েছেন। তার নাম “র্যাডিক্যাল পপলস পার্টি”। তিনি বলছেন তার দলই গরিষ্ঠ, ভুট্টোর দল নয়। জুন মাসে লাহােরে তিনি দলের নেতাদের কনভেনশন ডাকবেন বলেও জানিয়েছেন।
কাসুরী বলছেন, ভুট্টো আসলে ইয়াহিয়া গােষ্ঠিরই দালাল। এ বিষয়ে নাকি দলিল-প্রমাণও আছে। ভুট্টো আপন স্বার্থের জন্য দেশের গণতন্ত্র নিধনে সাময়িক চক্রকে সর্বদা সাহায্য করেছেন ও করছেন। এই হলাে কাসুরীর অভিযােগ।
এই দলাদলির মধ্যে সিয়া-সুন্নী বিরােধও কাজে লাগানাে হচ্ছে। ভুট্টো নাকি শিয়া সম্প্রদায়ের। অতএব গরিষ্ঠ সুন্নী অংশ এখন আর তার নেতৃত্বে মেনে নিতে রাজী নয়।
অর্থাৎ পাকিস্তানে এখন চার দিকেই গােলমাল। তাই ঢাকা ও অন্যত্র বেতার ও বুলেটিন মারফত প্রচার করা হচ্ছে : ভারতের মতাে এক বিরাট দেশের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ করতে হচ্ছে। তাই এই সংকট” ইত্যাদি।
এই প্রচারেরই জের টেনে ভারতের গুপ্তচর ধরার নানা আজগুবি কাহিনিও রটনা করা চলছে। এই ভারত-বিরােধী প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে নানা কায়দায় বাঙলাদেশ মুক্তিসংগ্রামকে বিভেদের দ্বারা দুর্বল করার চেষ্ট চলছে। আমাদের দেশের কিছু তথাকথিত বামপন্থী পত্রপত্রিকা ও নেতা ইয়াহিয়া চক্রের ঐ অপচেষ্টার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ছেন। সম্প্রতি মাওলানা ভাসানীকে নিয়ে যে অপপ্রচার চলছে তা ঐরকম সর্বনাশেরই একটি দৃষ্টান্ত।
আমাদের দেশে এইসব সর্বনেশে খেলা সম্পর্কে আমাদের অত্যন্ত সতর্ক থাকা আবশ্যক। বােঝা দরকার ইয়াহিয়া ও তার সামরিক চক্র এখন এক অতলস্পর্শী গহ্বরের মুখে। এই ইয়াহিয়া চক্র আত্মরক্ষার অবলম্বন পেতে পারে এমন কোনাে সুযােগ বামপন্থার নামে সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে কেউ যেন ওদের হাতে তুলে না দেয় তা দেখা আমাদের সকলের কর্তব্য।
সূত্র: সপ্তাহ, ২৮ মে ১৯৭১