ভারতকে নতিস্বীকার করানাের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে
সপ্তাহের পত্র
ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাধিয়েও পাকিস্তান নিস্তার পেল না। বরং এবার পাকিস্তান একেবারে ভরাডুবির মুখােমুখি এসে দাঁড়িয়েছে।
পাকিস্তান আশা করেছিল, যুদ্ধ লাগিয়ে দেবার পর তার আমেরিকান এবং চীন মুরুব্বিরা আন্তর্জাতিক দরবারে এমন একটা কিছু ব্যবস্থা নিশ্চয়ই করবে যার ফলে উপমহাদেশের সংকট নিছক ভারত-পাকিস্তানের ব্যাপার বলে পরিগণিত হতে পারে। অতঃপর যে মীমাংসা হবে, তাও হবে নিতান্তই পাক-ভারত বিরােধের মীমাংসা। সেখানে বাংলাদেশ নিয়ে আর কে মাথা ঘামাবে।
চীন-মার্কিন-পাকিস্তানের এই দুরভিসন্ধি বানচাল হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক দরবারে সােভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা চীনের এবং আমেরিকার আক্রমণকে ভেঁতা করে দিয়েছে। আর এদিকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে ভারত সারা বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েচ্ছে ভারত পাকিস্তান বিরােধ মীমাংসার ধুয়াে তুলে বাঙলাদেশের অস্তিত্বের বাস্তবতাকে অস্বীকার করার আর কোনাে ভিত্তি নেই।
বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের আর একটি বিরাট রাজনৈতিক তৎপর্য আছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমেরিকা এবং চীন আর একটি ভারত বিরােধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। আজকের দুনিয়ার সবচেয়ে নিকৃষ্ট এবং হিংস্র সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসী শক্তি আমেরিকা এবং বর্তমানে তার সহযােগি চীন প্রচার চালিয়েছিল, ভারতই আগ্রাসনের দোষে দোষী। বাঙলাদেশকে স্বীকৃতি দান করে ভারত সারা পৃথিবীর কাছে প্রমাণ করে দিল যে, ভারত সেনাবাহিনী পররাজ্য গ্রাস করার জন্য আদৌ ব্যস্ত নয়।
ভারত কর্তৃক বাঙলাদেশকে স্বীকৃতিদানের সঙ্গে সম্পর্কিত আরাে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা এ ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
আমাদের দেশে আমেরিকা এবং চীনের ভক্তবৃন্দের কথা বলছি। ওরা এই দীর্ঘ আট মাস যাবৎ দুই বিপরীত অবস্থান থেকে বাংলাদেশ সম্পর্কিত ভারতীয় নীতি ও কৌশলকে ক্রমাগত আক্রমণ চালিয়ে গেছে। তার ফলে অবশ্য এক্ষেত্রেও খানিকটা লাভবান হয়েছে পাকিস্তানের সামরিক চক্র। এক্ষেত্রেও উভয়ের আক্রমণের লক্ষ্য ছিল মূলত শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, যিনি এক বিরাট ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন; স্বাক্ষরিত হয়েছে বিশ বছর মেয়াদী ভারত সােভিয়েত মৈত্রি চুক্তি। এই ঘটনার পর উক্ত আমেরিকা ও চীন পূজারীদের গাত্রদাহের যেন সীমা পরিসীমা ছিল না। এখন ভারতীয় নীতি কৌশলের সাফল্যে এদের গায়ের জালা আরাে বাড়বে বলে সহজেই অনুমান করা যায়। এদেশে আরাে এক শ্রেণির লােক আছে, যারা জাতীয় নীতি কিংবা আন্তর্জাতিক ধার ধারে না। দাবি করে তারা একেবারে স্বয়ম্ভু স্বাধীন, এবং তারাই নাকি সারা পৃথিবীতে একমাত্র অভ্রান্ত শক্তি। এদের পরিচালিত কিছু বিভ্রান্ত লােক এই আমাদের কলকাতার রাজপথেই না আওয়াজ তুলেছিল, “ইন্দিরা ইয়াহিয়্যা এক হ্যায়”! আজো এরাই বলে চলেছে, “ইন্দিরা গান্ধী ফাসিস্ত শাসন কায়েম করেছেন।”
এদের মূল প্রচার ছিল, ভারত সরকার জনগণকে কেবল ভাঁওতা দিয়ে চলেছেন; বাংলাদেশকে তারা কোনােদিন স্বীকৃতি দেবে না। তারা বলেছিল, সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করার ফলে ভারতের নাকি হাত পা বাধা হয়ে গেছে, ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই প্রচারের সূত্র ধরে আরাে কেউ কেউ বলেছিলেন, পৃথিবীতে ভারত আজ বন্ধু শূন্য। সােভিয়েতের সঙ্গে চুক্তি করে ভারত নাকি আরাে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছে। অদ্ভুত যুক্তি বটে। যেন আমেরিকা সাম্রাজ্যবাদী নীতি অনুসরণ করে চলেছে তার দায়-দায়িত্ব ভারতের। কিংবা সােভিয়েতের। চীন যদি সাম্রাজ্যবাদের সহযােগিতা করে চলে তবে তার জন্য কি ভারত সােভিয়েত ইউনিয়ন দায়ী হবে?
অর্থাৎ মূল কথাটি হলাে, ভারতীয় নীতি ও কৌশলের কথা। মনে রাখা দরকার পাকিস্তানকে …করে একদিকে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার এবং অন্যদিকে চীন একযােগে আমাদের দেশকে প্রায় ঘেরাও করে ফেলেছিল। শুধু আমাদের আঞ্চলিকতা অখণ্ডতা নয় আমাদের সমস্ত আদর্শ ও অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। এই মারাত্মক ভবিতব্য থেকে ভারতকে রক্ষা করেছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। এই কাজে আমাদের সব থেকে বড় সহায়ক হয়েছেন সােভিয়েত ইউনিয়ন। …জন্যই আমাদের শত্রুরা এবং সহযােগিরা আজ এত কুদ্ধ ও বিরক্ত। | মনে রাখা দরকার, এখানে দুশ্চিন্তার অনেক কারণ আছে। শত্রুরা ভারতের উপর নানাভাবে চাপ দেবার চেষ্টা করবে। লক্ষ্য ভারতকে নতি স্বীকারে বাধ্য করা। এদেশে অর্থ সাহায্য বন্ধ করার মার্কিন ঘােষণা তারই সূচনা।
আমরা যেন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর কথাটি মনে রাখি। আত্মশক্তিই দেশ ও জাতীর পরাক্রমের এবং জয়ের …আত্মনির্ভরতার দ্বারাই দেশ ও জাতি বড় হতে পারে। আমাদের আপন শক্তি যাতে বাড়তে পারে তারই জন্য সােভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সমাজবাদী দুনিয়া তার সাহায্য ভাণ্ডার মুক্ত করে দিয়েছেন। আর কে না জানে, শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ পরাক্রান্ত ভারত প্রতিবেশী বাঙলাদেশের সবথেকে বড় অবলম্বন।
সূত্র: সপ্তাহ, ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১