স্বীকৃতির প্রশ্নে আর দেরি চলে না
বাঙলাদেশকে স্বীকৃতি দানের ব্যাপারটিকে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রেখে ভারত সরকার আসলে আরাে বেশি জটিলতার জালে আটক পড়াবার বিপদই ডেকে আনছেন।
নয়াদিল্লি থেকে প্রচারিত ভারত সরকারের সর্বশেষ সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধারা যারপর নাই হতাশ হবেন। এবং তারা ও আমাদের দেশে অনেকেই বিচলিত বােধ করবেন।
কারণ এখন জানা গেছে যে, পাকিস্তানি শাসকচক্র ইতিমধ্যে বাঙলাদেশ নিয়ে এক নয়া চক্রান্ত কার্যকর করতে শুরু করেছে। জানা দরকার যে, পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন হয়ে যাবার পর সেখানে আর মিলিটারি শাসন বরদাস্ত করতে কেউ রাজী নন। তাছাড়া বাঙলাদেশে দেড় মাস যাবৎ যুদ্ধ ও নরহত্যা চালানাের পর ইয়াহিয়া খা ও বুঝেছেন ওখানকার প্রশ্ন ও সমস্যার সামরিক সমাধান সম্ভব নয়। চাই রাজনৈতিক সমাধান। আর সেই উদ্দেশ্যেই একটি চক্রান্ত সাজিয়ে তােলা হচ্ছে।
এই চক্রান্ত অনুযায়ী পাকিস্তানি শাসকচক্র বাঙলাদেশে একটি পুতুল সরকার খাড়া করবে। খবরে
অনুগামী আওয়ামী লীগের অন্তর্ভুক্ত। তারাই সংখ্যা গরিষ্ঠ। কিন্তু এই গরিষ্ঠতা বানচাল করে দেবার চেষ্টা চলছে।
পাকিস্তানি শাসকচক্র চাইছে, যে কোনাে প্রকারে জাতীয় পরিষদের ১৫১ জন সদস্যকে সমবেত করতে। তাহলেই জাতীয় পরিষদের প্রস্তাবিত অধিবেশনকে আনুষ্ঠানিকভাবে বৈধ বলে প্রমাণিত করা যাবে। | এই চেষ্টার অঙ্গ হিসাবে বাঙলাদেশ থেকে নির্বাচিত এম এন এ দের ওপর বিশেষ রকম চাপ দেওয়া চলছে। আওয়ামী লীগের এম এন এ (বাঙলাদেশে মােট ১৬৯ জনের মধ্যে ১৬৭ জন) দের মধ্যে বেশ কিছু সংখ্যক গত দেড় মাসে নিহত হয়েছেন। তাছাড়া প্রায় ২৫ জন বয়েছেন জেলে বন্দি। প্রধানত এই বন্দি এম এন এ দের ওপর পাকিস্তানি শাসকরা জবরদস্তি চালাচ্ছেন। মৃত্যুভয়, সাজানাে ষড়যন্ত্র মামলার ভয়, প্রভৃতির দ্বারা এই সব জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যােগ দেন।
এদের মধ্যে ফজলুল হক সাহেবের পুত্র রয়েছেন। তাঁর মতাে ব্যক্তিকে যদি জাতীয় পরিষদে হাজির করা যায় তাহলে স্বনামধন্য ফজলুল হকের নামটিকে ব্যবহার করা সম্ভব হবে।
এ ছাড়া, পাকিস্তান সামরিক চক্র আপ্রাণ চেষ্টা করছে যাতে আওয়ামী লীগের অন্যান্য কিছু এম এন এ কেও দলে বাগানাে যায়।
অতঃপর জাতীয় পরিষদের যে অধিবেশন বসবে তা থেকে অন্তত লােক দেখানাে একটি সংবিধান তাে রচিত হতে পারবে। আর সেই সংবিধান অনুযায়ী একটি নড়বড়ে পাকিস্তান কনফেডারেশন গঠন করা হতে পারে।
তারপর সহজেই অনুমান করা যেতে পারে, এই সংবিধান অনুযায়ী বাঙলাদেশেও অসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা কায়েম হতে পারবে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী তখন হয়ত হবেন পিকিং পন্থী জুলফিকার আলি ভুট্টো।
এরপর বাঙলাদেশে বৈধ ও সংবিধান সম্মত, অথচ আসলে সামরিক চক্রের পুতুল সরকার কায়েম হতে বাধা কোথায়? জনগণের দুর্বল অংশ হয়ত সেই পুতুলদের সঙ্গে সহযােগিতাও করতে পারেন। এই পরিস্থিতিতেও স্বাধীনতাকামী জনগণের প্রতিরােধ হয়ত নিশ্চয়ই চলবে। কিন্তু সে তাে একটি স্বতন্ত্র ব্যাপার।
আসলে সমস্ত পরিস্থিতিই কি আরাে জটিল হয়ে উঠছে না? সেই পরিস্থিতিতে ভারত সরকার কী করবেন। অথচ আজ এখনই যদি ভারত সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন, তবে অনেক জটিলতার হাত থেকে নিস্কৃতি পেতে পারতেন।
ইতিমধ্যে আরাে কতকগুলাে গুরুতর ঘটনা ঘটেছে, এবং ঘটবে। পিকিং তাে এখনই ইসলামাবাদকে তার গণহত্যার অভিযানে সাহায্য করতে লজ্জা বােধ করছে না। একটা সাংবিধানিক বৈধতার আড়ালে আগামী দিনে যখন এই গণহত্যা আরাে নৃশংসভাবে চলবে তখন পিকিং আরাে বেশি করেই তাতে সাহায্য করতে পারবে ; সেক্ষেত্রে লজ্জা পাবারও বিশেষ কিছু কারণ তারা দেখতে পাবে না।
ততদিনে ওয়াশিংটনের সঙ্গেও পিকিং-এর মাখামাখিটা আরাে বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠবে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও আফ্রিকায় এলাকা বণ্টনের ভিত্তিতে চীন ও আমেরিকার মধ্যে যে বােঝাপড়া হয়ে যাচ্ছে তার পরিণামে বাঙলাদেশে চীন-পাকিস্তানের সম্মিলিত যুদ্ধ প্রস্তুতি কি তখন ভারতকে এক মুহূর্তের জন্যও শান্তিতে থাকতে দেবে?
আর ভারতের নয়া নয়া দেশপ্রেমিকদের কি আমরা চিনি না? যারা মুনাফার লােভে আমেরিকাকে সেলাম ঠোকে, হারা চীনকেই বা প্রভু বলবে না কেন।
বাঙলাদেশ আসলে ভারতের নিরাপত্তার পক্ষে অমূল্য। বাঙলাদেশকে সাহায্য করা মানে বাস্তবে ভারতের নিজেকেই সাহায্য করা।
এই মূল কথাটি এখনাে যদি তাহলে সরকার বিবেচনা করে দেখেন তাহলে তারা একটি মারাত্মক ভ্রান্ত নীতি থেকে অব্যাহতি পেতে পারবেন। বিলম্বে সর্বনাশ হতে পারে।
বিভাগুক
সূত্র: সপ্তাহ, ১৪ মে ১৯৭১