You dont have javascript enabled! Please enable it!

মোশতাক সরকার কামারুজ্জামানের তিনটি ব্যাংক একাউন্টে পেল মাত্র ১৫,৫০০ টাকা
কড়া সেনাপাহারায় হেলিকপ্টারে রাজশাহী আনা হয় কামারুজ্জামানের লাশ
কফিন খুলে দেখা গেল ডান কান ও চোখের পাশ দিয়ে প্রায় অর্ধ-ইঞ্চি গুলির ছিদ্র
গলার শ্বাসনালীতে বেয়নেট চার্জের চিহ্ন
কামারুজ্জামানের ডায়েরীটা কোথায় গেল?
৭ দিন পাহারায় ছিলো তাঁর কবর
সালিম সাবরিন লিখিত “এ এইচ এম কামারুজ্জামান” বই থেকে হুবহু তুলে ধরা হল।
===========================
শহীদ কামারুজ্জামান যখন দেহ রাখলেন
হজরত শাহ মখদুম (র.)-এর পুণ্যভূমিতে
===========================
আমি তােমাদের মাটি থেকে সৃষ্টি করেছি। আমি তােমাদের মাটিতে ফিরিয়ে আনবাে আমি তােমাদের মাটি থেকেই পুনরুজ্জীবিত করবাে।
(আল কুরআন, সূরা তহা, আয়াত : ৫৫)

৬ নভেম্বর সকাল ১১.৩০ মি. একটি সামরিক হেলিকপ্টার ঢাকার মাটি থেকে উড়ে এসে দাঁড়াল রাজশাহীর মাটিতে। হজরত শাহ্ মখদুম (র.) স্মৃতিধন্য পুণ্যভূমি এই রাজশাহী। এই মাটির সন্তান এএইচএম কামারুজ্জামন তার মৃতদেহ কফিনবন্দি। হেলিকপ্টার থেকে নামানাে হলাে। পৈত্রিক নিবাস কাদিরগঞ্জের ঈদগাহ মাঠসহ সমগ্র এলাকা জুড়ে রাস্তার মােড়ে মােড়ে সশস্ত্র আর্মি পাহারা। ভীতসন্ত্রস্ত আওয়ামী নেতৃবৃন্দ। ভীতসন্ত্রস্ত এলাকাবাসী। প্রিয় নেতা কামারুজ্জামান পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত হবেন। সিদ্ধান্তে অটল তাঁর সহধর্মিণী মিসেস জাহানারা কামারুজ্জামান। অপর তিন জাতীয় নেতৃবৃন্দকে বনানী কবরস্থানে সমাহিত করা হলেও শহীদ কামারুজ্জামানের সহধর্মিণীর ইচ্ছায় প্রিয় নেতার দেহ সমাহিত করার জন্য রাজশাহীতে প্রেরণ করা হয়। খন্দকার মােশতাক সরকার শহীদ নেতৃবৃন্দকে নানা অভিযােগে অভিযুক্ত করার চেষ্টায় তথ্য-তালাশ করে দেখেন শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামানের তিনটি ব্যাংক একাউন্ট মিলে ব্যালান্স মাত্র ১৫,৫০০ টাকা।

ঢাকাশহরে তার একটি একতলা বাড়িও নেই। এমতাবস্থায় ছােট ছােট সন্তানদের নিয়ে কী করে বিপন্ন দিন কাটাবেন মিসেস কামারুজ্জামান—সেসব চিন্তায় তিনি বিপন্ন। …তিনি দেখলেন স্বামী মন্ত্রী থাকাকালে যে ঢাকাকে তার খুব প্রিয় শহর, আপন শহর মনে হয়েছিল ৩ নভেম্বরের পর তিনি উপলব্ধি করলেন তার চারদিকে শূন্যতা আর হাহাকার। তিনি একেবারেই নিঃস্ব এবং নিঃসঙ্গ। স্বভাবতই স্বামীর স্মৃতিকে আঁকড়ে বেঁচে থাকার এক হৃদয়বিদারক পরিস্থিতিতে মিসেস জাহানারা কামারুজ্জামান স্বামীর মৃতদেহ রাজশাহীতে প্রেরণের জন্য কর্তৃপক্ষকে অনুরােধ জানালেন। তার দুই পুত্র সন্তান জনাব এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন এবং জনাব এএইচএম এহসানুজ্জামান স্বপন তখন দেশের বাইরে। স্বামীর মৃতদেহ নিয়ে তিনি দিশেহারা। দেশজুড়ে চরম উল্কণ্ঠা আর নৈরাজ্য। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পরপর সারাদেশ শােকস্তব্ধ। সকলেই প্রাণভয়ে আত্মগােপনে। কোনাে নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যােগাযােগ নেই। এমনই এক বিপন্ন অসহায় পরিস্থিতিতে তার সকাতর অনুরােধ পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় নেতা শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামানকে রাজশাহীতে ফিরিয়ে আনা হয়।

পারিবারিক গােরস্তানে খনন করা হয় তার কবর। তার পূর্বপুরুষ হাজী লাল মােহাম্মদের এস্টেটে বাড়ির সীমানা প্রায় ২২ বিঘা। অথচ, এতদিন এমএনএ ও মন্ত্রী থাকলেও কামারুজ্জামানের সঞ্চয় মাত্র ১৫ হাজার টাকা। এক নিঃস্ব সম্রাট তখন দেহ রাখছেন পিতৃপুরুষের কবরস্থানে। রাজশাহীবাসীর গৌরবের ধন দেশনন্দিত সন্তান ‘হেনা সততার জন্য বাংলার ইতিহাসকে সুবাসিত করে ঝরে পড়লেন। মৃত্যুতেও তিনি মহৎ হলেন আপন কীর্তির মহিমায়।

ঐ মুহূর্তটির বিবরণ অত্যন্ত মর্মস্পর্শী। ৩২ নম্বর থেকে বঙ্গবন্ধুকে যেভাবে টুঙ্গিপাড়ায় সেনাবাহিনীর বিশেষ নিরাপত্তায় দাফন করা হয়েছিল কামারুজ্জামানের ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনটিই ঘটেছিল। তার আত্মীয়পরিজনদের বিবরণ থেকে জানা যায়, সেনাবাহিনীর লােকজন পূর্ব থেকেই কবরস্থানের আশপাশে জনগণের চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে মােড়ে মােড়ে সশস্ত্র পাহারা বসিয়েছিল সকাল ৮টা থেকেই। সাড়ে এগারােটায় হেলিকপ্টারটি পৌছে। সেখান থেকে লাশবাহী কফিন নিয়ে আনা হয় মসজিদের ভেতরে। কোন আত্মীয় পরিজনকে প্রথমে লাশ দেখতে দেয়া হয়নি। শহীদ কামারুজ্জামানের পিতা আব্দুল হামিদ (এমএলএ) সেনাদের অনুরােধ করা সত্ত্বেও লাশের কাছে যেতে পারেননি। তখন কামারুজ্জামানের মা-বাবা দুজনই জীবিত ছিলেন। তারা মৃতসন্তানের মুখটিও দেখতে পাননি। খায়রুজ্জামান লিটন ও এহসানুজ্জামান স্বপন দেখতে পাননি পিতার মুখ। প্রিয় পিতার শেষবিদায় দেখার সুযােগও জোটেনি—এমনই হতভাগ্য সন্তান তারা। কামারুজ্জামানের চাচা প্রথম শ্রেণির বিচারক জনাব আলহাজ্ব আব্দুস সামাদ সাহেবও এসে সেনাদের কাছে পরিচয় দিয়ে অনুরােধ জানান। অবশেষে রাজশাহী সেনানিবাস থেকে কয়েকজন উর্ধ্বতন ব্রিগেডিয়ার পদমর্যাদার সামরিক অফিসার এসে সীমিতসংখ্যক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়কে লাশ দেখার অনুমতি দেন। কামারুজ্জামানের বড় বােন, স্ত্রী ও কয়েকজনমাত্র স্থানীয় বয়স্ক মুরব্বিদের মধ্যে হাজী দীন মােহাম্মদ, কামারুজ্জামানের সহচর নুরুল হুদা সাহেব উপস্থিত ছিলেন। পরবর্তীতে কয়েক মিনিটের ব্যবধানে কামারুজ্জামানের আপন ভাইয়ের মধ্যে আকুল, চুনু, নুকুল এবং চাচাত ভাইয়ের মধ্যে মােহাম্মদ শফিউল আলম লাটু, মােহাম্মদ মাহফুজুল আলম কফিনের কাছে আসার সুযােগ পান।

এমতাবস্থায় সেনা কর্মকর্তাগণ বারবার লাশ দাফনের জন্য তাগাদা দিতে থাকেন। বিচারপতি হাজী আব্দুস সামাদ সাহেব লাশের গােসল করানাের কথা বললেও সেনারা আপত্তি জানান। এছাড়াও কফিন খুলে দেখা যায়, পুরাে কফিনটি চা-এর আস্তরণে ঢাকা। চা-এর আস্তরণ সরালেও লাশ ফুলে যাওয়ার কারণে কফিন থেকে বের করা কষ্টকর হয়ে পড়ে। শেষে কফিনের কপাট খুলে লাশ বের করা হয়। কফিনের কাপড় তখনও রক্তের ছােপ ছােপ দাগে ভরা। মুখমণ্ডল থেকে কফিন সরাতেই দেখা যায়, ডান কান ও চোখের পাশ দিয়ে প্রায় অর্ধ-ইঞ্চির একটি ছিদ্র এফোঁড়-ওফোড় হয়ে গুলি বেরিয়ে গেছে। বুকের ডানপাশটি ক্রসফায়ার করে ঝাঝরা করে দিয়েছে। সেইসব জায়গা তুলাে দিয়ে পূরণ করা হয়েছে। গলার শ্বাসনালীতে বেয়নেট চার্জ করায় পুরাে শ্বাসনালী জুড়ে বড় বড় সেলাই দিয়ে আটকানাে। এমতাবস্থায় কফিন থেকে লাশ বের করে গােসল করানাে সম্ভব নয়, তাই মুখমণ্ডলটি অজুর মতাে ধৌত করা হয়। তারপর রক্তাক্ত সাদা কাফনে মুখটি বেঁধে দেয়া হয়।

প্রিয় নেতার হাস্যোজ্জ্বল যে মুখ দেখতে মানুষ ছুটে আসতাে, যার মুখের মিষ্টি কথা শুনে মানুষ মুগ্ধ হতাে, শত শত মানুষ সেদিন দূরে দাড়িয়ে আহাজারি করলেও সেই প্রিয় নেতার মুখ সেদিন কাউকে দেখতে দিলাে না খুনিচক্র। আব্দুস সামাদ সাহেব নিজেই আপন ভাইয়ের সন্তানের জানাজা নামাজ পড়ালেন। হাজী লাল মােহাম্মদ সরদারের প্রিয় আদরের পৌত্র ‘হেনা’ যেন একটি দিগন্তপ্রসারী উল্কার মতাে ঝরে পড়লেন মাটিতে। তিনি সমাহিত হলেন। কয়েক মিনিট পরেই সামরিক হেলিকপ্টারটি উড়ে গেল ঢাকার আকাশের দিকে। তখনও ঢাকায় চলছে সামরিক বাহিনীর ক্যু ও পাল্টা ক্যু-এর প্রতিযােগিতা। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অফিসাররাই নিজেরা নিজেদের হত্যা-উৎসবে মেতেছেন। অভ্যুত্থান-নাটক ওদিকে চললেও রাজশাহী সেনানিবাসের সেনারা স্থায়ী ক্যাম্প গাড়লেন। কামারুজ্জামানের কবরের পাশে টহল জোরদার করলেন। কোনাে মুসল্লিকেও কবরের কাছে দোয়াদরুদের জন্য যেতে দেয়া হতাে না। পুরাে কয়েক সপ্তাহ কবর স্থানটিও ছিল সেনা অবরােধে অবরুদ্ধ। সেই অবরুদ্ধ প্রহরে, জাহানারা কামারুজ্জামান সেনাদের কাছে, জেল কর্তৃপক্ষের কাছে বারবার অনুরােধ করছিলেন জেলখানায় লেখা কামারুজ্জামানের ডায়েরিটি ফেরৎ পাবার জন্য। কিন্তু সে ডায়েরি চিরতরে হারিয়ে গেল। জানা হলাে না, কী লিখেছিলেন তিনি জীবনের শেষ দিনগুলােতে জেলের প্রকোষ্ঠে বসে? তাঁর সমাধির পাশে দাঁড়িয়ে এখনও রাজশাহীবাসীর বুক কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে। প্রতিটি ৩ নভেম্বরের সকালে ফুলে ফুলে যখন তাঁর সমাধি শ্রদ্ধাঞ্জলিতে ভরে যায় সেই সময় তার সহধর্মিণী প্রতিবছরই আক্ষেপ করে বলেন-আমি আজো বেঁচে আছি আমার স্বামীর ডায়েরিটি পাবার আশায়। ডায়েরিটি কোথায়? জাতীয় নেতা কামারুজ্জামানের বিধবাপত্নী জাহানারা কামারুজ্জামান জেলহত্যার পরবর্তী ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন :

লাশ (শহীদ কামারুজ্জামানের লাশ) রাজশাহী নিয়ে যাবার কথা বললাম। হেলিকপ্টার প্রথমে ওরা দিতে চায়নি। ভাবলাম, না দিলে ট্রাকে বা বাসে লাশ রাজশাহী নিয়ে যাবাে। এভাবে দু’দিন জেলখানায় লাশ পড়ে থাকল। অন্য ৩ জনের ঢাকায় বাড়ি থাকায় উনারা লাশ নিয়ে এসে বনানীতে কবর দিলেন। জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল এখানেই করলাম। ৪ নেতা একসাথে থাকতাে। জাতি স্মরণ করতাে। প্রচণ্ড শােকে তখন ঢাকাকে কষ্টের আর দুঃখের নগরী মনে হয়েছিল। জেলখানা থেকেই কাঠের কফিনে লাশে চাপাতা দেয়া ছিল। হেলিপ্যাডে পুরনাে বিমানবন্দরে প্রথম লাশ দেখলাম। হতবাক বিহ্বল। আমি কি দেখছি! বিশ্বাস হয়নি। একজন সুস্থ মানুষ কেউ বিশ্বাস করবেন কি? নিরাপদ জায়গায় মানুষকে ঘুম থেকে ডেকে গুলি করে ঝাঝরা করা হয়? কোনাে সভ্য দেশে এ ঘটনা ঘটেছে কি?

হেলিকপ্টারে চুমকি (ছােট মেয়ে) ও রিয়াকে (মেজ মেয়ে) নিয়ে রাজশাহী এলাম লাশ নিয়ে, ৬ তারিখ । কাদিরগঞ্জের বাড়িতে। চারদিকে আর্মি পাহারা। যাদের সাহস ছিল জোর করে এসেছে। দেখছে। অনেক লােক আসতে পারেন, দেখতে। ভয়ে জানাজা পড়তে পারেনি। আমার শ্বশুর লাশ দেখেননি। বলেছেন ওর আগের চেহারা আমার মনে থাক।

…কফিনে রাখা মুখটা খুলতেই চমকে উঠলাম। কালাে, কেমন যেন সবুজ হয়ে গেছে চেহারা। মুখটা বেশ ফুলে গেছে। ডান কপালে গুলির ফুটো। মাথার পিছনে কি অবস্থা দেখিনি। পায়ের হাঁটু কোনরকমে ঝুলে আছে। সেখানেও গুলিতে ঝাঝরা। তাই কালাে কম্বল ভাজ করে বুকে জড়ানাে। ভাবলাম, আহা, লােকটাতাে খুব নরম ছিল। ওর জন্য একটা গুলিই তাে যথেষ্ট ছিল।…আর্মি পাহারায় লাশ দাফন হলাে কাদিরগঞ্জ পারিবারিক গােরস্থানে। এখনও সেই স্মৃতি আমাকে দগ্ধ করে। কাউকে বলতে পারি না, নিজেই কষ্ট পাই। …দুঃখ একটাই গায়ে একটু পানিও ঢালা হলাে না। একটু পানি দিলে শান্তি পেতাম। কফিনসহ কবর দেয়া হলাে। ৭ দিন ধরে কবর পাহারা ছিল। যদি কেউ আবার লাশ তােলে? মিছিল করে?ম গাদা গাদা নােট খাতা ও কলম নিয়ে যেতাম। লিখতে লিখতে ডাইরি শেষ হয়ে গিয়েছিল। বলতেন আরাে কাগজ কলম দাও। এত অল্প করে আনাে কেন? উনার মূল্যবান জিনিসটিই আমি আজও পাইনি। কি যে লিখতেন জানতে পারিনি। এটা আমার অধিকারের জিনিস। তা’ও আমাকে দেয়া হয়নি। খােন্দকার আসাদুজ্জামান একসাথে ছিলেন। পরে উনার কাছে শুনতে গেছি জেলের কথা। কীভাবে থাকতেন, উনি বললেন, স্যার সারারাত ঘুমাতেন না, জায়নামাজে থাকতেন। আমাদের ইমামতি করতেন। আর লিখতেন সবসময়। …২০ বছর ধরে বিচারের অপেক্ষা করছি—আগে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার হােক। তারপরে শিষ্যদের।

Reference: এ এইচ এম কামারুজ্জামান – সালিম সাবরিন, pp. 189-193