You dont have javascript enabled! Please enable it!

বঙ্গবন্ধু প্রথমবারের মতাে আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ ছেড়ে দিলেন

জনাব এএইচএম কামারুজ্জামানের প্রাইভেট সেক্রেটারি জিয়াউদ্দিন চৌধুরী লিখেছেন :

১৯৭৪ সালের শেষদিকে বলতে গেলে এক ঐতিহাসিক ঘটনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমবারের মতাে আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ ছেড়ে দিলেন। এ পদে তিনি ছিলেন ১৯৬৬ সাল থেকে। তাঁর স্থানে এলেন এএইচএম কামারুজ্জামান, যিনি তখন ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী। কামারুজ্জামান সভাপতি নির্বাচিত হলেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, সর্বসম্মতিক্রমে। আওয়ামী লীগের সভাপতি বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর যে কেউ হতে পারেন, তখন সেটা সাধারণকর্মীদের তাে দূরের কথা তার দলের নেতারাও চিন্তা করেছেন কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। এটা সম্ভব হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর কারণে। তিনি নিজে এই পদ ছেড়ে দেশের কাজে মনােযােগ দিতে চেয়েছিলেন। নতুন দলপতি মনােনয়ন এবং নির্বাচন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হয় দলের কাউন্সিল অধিবেশনে।

আমি তখন এএইচএম কামারুজ্জামানের প্রাইভেট সেক্রেটারি । সরকারি কর্মচারী হিসাবে দলীয় রাজনীতির কাছ থেকে দূরে থাকলেও মন্ত্রীর প্রাইভেট সেক্রেটারি হিসেবে আমার সব সময় দলের নেতাদের সঙ্গে দেখা হতাে, যখনই তারা মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি হবেন এ নিয়ে কিছু কানাঘুষা হলেও তা আমি বেশি চিন্তা করিনি, কারণ আমার কাছে এটা সম্ভব মনে হয়নি। পরে যখন দলের সম্মেলন হলাে আর এএইচএম কামারুজ্জামানের নাম সভাপতি হিসেবে প্রস্তাব এবং সর্বসম্মতিক্রমে অনুমােদিত হলাে, তখন আর সবার মতাে আমিও অবাক হয়েছি। দুটি কারণে, প্রথমত, বঙ্গবন্ধু নিজে থেকে সভাপতির আসন ত্যাগ করবেন—এটা অচিন্ত্যনীয়। দ্বিতীয়ত, এএইচএম কামারুজ্জামান কথায় বা কাজে আমাদের কাছে এ ধরনের পরিবর্তনের কোনাে আভাস দেননি, এমনকি একমাস আগেও।

মার্চ মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে এএইচএম কামারুজ্জামান আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নেবেন। কিন্তু এর আগে তাঁর মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করতে হয়। ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে একদিন কামারুজ্জামান আমাকে বললেন যে, তার পদত্যাগপত্র তৈরি করতে হবে। আমি তা আনলে তিনি সেটিতে সই করে বলেন তার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যেতে হবে। তখন সন্ধ্যা পার হয়ে এসেছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় তখন মিন্টু রােডে, আর মন্ত্রীর বাসভবন হেয়ার রােডে। দু’জনে গাড়ি করে গেলাম।

মন্ত্রী সােজাসুজি প্রধানমন্ত্রীর অফিসের দিকে গিয়ে ঢােকার আগে আমাকে বললেন তার সঙ্গে থাকতে। তাই আমিও গেলাম ভেতরে। ঢুকে দেখলাম প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আরাে তিনজন মন্ত্রী বসে। ঢুকতেই প্রধানমন্ত্রী নেমে এলেন চেয়ার ছেড়ে। লম্বা একটা সালাম দিয়ে কামারুজ্জামানকে সম্বােধন করে বললেন, ‘আসুন সভাপতি সাহেব। কামারুজ্জামান হেসে বললেন, ‘এখনাে দায়িত্ব নেইনি, নেবাে মন্ত্রিত্ব ছাড়ার পর।’ বঙ্গবন্ধু কৌতুক করে বললেন, “কেন দুটা একসঙ্গে করা যায় না?’ বলেই তার স্বভাবসুলভ উচ্চ হাসি দিলেন। কামারুজ্জামান সাহেবও হেসে আমার হাতের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এই যে আমার পদত্যাগপত্র।’ ইঙ্গিত পেয়ে আমি প্রধানমন্ত্রীর হাতে পত্রটি তুলে দিলাম। মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করে দলীয় শীর্ষপদে বঙ্গবন্ধু তাঁকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। নিশ্চয় ঐ প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে এটি ছিল বঙ্গবন্ধুর একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এবং কামারুজ্জামানের প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস, আস্থা ও সম্মান। লক্ষণীয়, তার সভাপতি পদের দায়িত্ব গ্রহণে কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি। সর্বসম্মতিক্রমেই তিনি সভাপতি হয়েছেন। দলীয় সিদ্ধান্তে ও সহকর্মীসহ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদেরও তিনি মূল্যায়ন করেছেন।

বলতে দ্বিধা নেই, কামারুজ্জামান সেই সময় সেই বিরল প্রায় অঙুলিমেয় কয়েকজন নেতার মধ্যে একজন নেতা যার ঢাকাশহরে নিজস্ব কোনাে বাড়ি ছিলনা। 

দীর্ঘদিন এমএনএ, এমপি ও মন্ত্রী থাকলেও কোনাে অবৈধ সম্পদের মালিক তিনি হননি। তার ত্যাগ ও মহত্ত্বের প্রতি যথাযথ সম্মান দিয়েই বঙ্গবন্ধু তাকে সভাপতি অর্থাৎ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উত্তর কাণ্ডারি বলে বিবেচনা করেছিলেন। উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না, তিনি কখনই কোনাে নির্বাচনে পরাজিত হননি। আওয়ামী রাজনীতিতে যােগদানের পর কামারুজ্জামান দলীয় হাইকমান্ডের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত কিংবা বঙ্গবন্ধুর নিদের্শনার কোন ব্যত্যয় ঘটাননি। কখনাে কোনাে বিতর্কে নিজেকে জড়াননি। অথচ, প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী কামারুজ্জামান সম্পর্কে যেসব মনগড়া অভিযােগ উত্থাপন করেছেন, যা অযৌক্তিক ও অবান্তর, অসৌজন্যমূলক। শুধু এটুকুই বলা ভালাে যে, কামারুজ্জামান নির্মোহ একজন দেশ-দরদি নেতা ছিলেন। ছিলেন সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী গণতান্ত্রিক মূল্যবােধসম্পন্ন একজন অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী নেতা। তার এই বৈশিষ্ট্যের জন্যই তাকে প্রতিযােগিতা করে আওয়ামী লীগের সভাপতি হতে হয়নি। উচ্চাভিলাষী হয়ে কামারুজ্জামান কোন মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে রাজনীতি করেননি, কখনাে মন্ত্রিত্ব বা প্রধানমন্ত্রিত্ব দাবি করেননি। তিনি যে কত বড় মাপের সংগঠক ছিলেন তার প্রমাণ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি মুক্তিযােদ্ধা—যুব শিবিরের যােদ্ধাদের, সামরিক যােদ্ধাদের উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে নিজেকে প্রমাণ দিয়েছিলেন বলেই তাঁকে নিয়ে দু’একজন গােষ্ঠীবাদী ব্যক্তি ছাড়া কোন বিতর্ক তােলার সুযােগ পাননি। অদ্যাবধিও তাকে নিয়ে কোন বিতর্ক নেই। সঙ্গতকারণেই মনে করা যায়, বঙ্গবন্ধু কামারুজ্জামানের প্রকৃত নেতৃত্বের গুণাবলি বিবেচনা করেই তাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচন করেন। যা হয়তাে উচ্চাভিলাষী কারাে কারাে মনােকষ্টের কারণও হতে পারে। কেননা, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেও মন্ত্রিত্ব ও পদ নিয়ে যখন প্রতিযােগিতা চলছিল কামারুজ্জামান তখন ছিলেন একেবারে নীরব-নির্লিপ্ত। সেই উচ্চাভিলাষীদের কেউ কেউ খুব বেশি শৃঙ্খলাবিরােধী হয়ে উঠলে বঙ্গবন্ধু বাধ্য হয়েছিলেন কোন কোন ব্যক্তিকে ডেকে মন্ত্রিপরিষদ থেকে মন্ত্রিত্বের পদ ছেড়ে দেয়ার জন্যও।১

অপরদিকে, বঙ্গবন্ধুর নিকট সবচেয়ে গ্রহণযােগ্যতা তাঁরই ছিল বলেই আওয়ামী লীগের মত একটি ঐতিহ্যমণ্ডিত দলের সভাপতির পদে মনােনীত ও নির্বাচিত হয়েছিলেন। সে বিষয়ে কেউ আপত্তি করেননি, বিতর্কও করেননি। মনে হয়, বঙ্গবন্ধু অনেকটা নিশ্চিত হয়েছিলেন দলের দায়িত্বভার এএইচএম কামরুজ্জামানের ওপর ন্যস্ত করে। দায়িত্ব দিয়ে বঙ্গবন্ধু বরং সরকার ও রাষ্ট্র পরিচালনায় মনােযােগী হতে পেরেছিলেন। ১৮ জানুয়ারি ১৯৭৪ সালে তিনি বঙ্গবন্ধুর পর স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম আওয়ামী লীগের সভাপতি হয়েছিলেন। মন্ত্রিত্ব দ্বারা তিনি যতটুকু না সম্মানিত হয়েছেন মনে হয় সবচেয়ে বেশি সম্মানিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতি হতে পেরে। বলা যেতেই পারে এটাই তার রাজনৈতিক জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মান ও গৌরব। সেইদিনের বেশ কয়েকটি জাতীয় পত্রিকায় গুরুত্বসহ। সংবাদটি প্রকাশ হয় এবং মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

Reference: এ এইচ এম কামারুজ্জামান – সালিম সাবরিন, pp. 160-163

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!