স্বাধীনতার পরপর মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট জালিয়াতি – মেজর গিয়াসের বয়ান
ঐসময়ের বর্ণনা দিয়ে মেজর গিয়াসউদ্দিন আহমদ লিখেছেন, ‘মাননীয় মন্ত্রী জনাব কামারুজ্জামান কিছুদিন পরে রাজশাহীতে হেলিকপ্টারযােগে আসার পরিকল্পনা করেন। আমরা তার আসার খবর পাই আগমনের এক ঘন্টা পূর্বে। আমাদেরকে রাজশাহী সার্কিট হাউজে থাকতে বলা হয়। সেই মােতাবেক আমরা সার্কিট হাউজে অপেক্ষা করছিলাম।
হেলিকপ্টার নামার হেলিপ্যাডটি ছিল জোহা হলের পাশে, যেখানে পাক আর্মি তাদের হেডকোয়ার্টার স্থাপন করেছিল। তখন জোহা হলে পাশে হেলিকপ্টারের শব্দ শুনে বহু মুক্তিযােদ্ধা রাজশাহী শহরে যাওয়ার বিশ্ববিদালয়ের রাস্তার উপর একত্রিত হয়েছিল। প্রথমত, মন্ত্রীর সাথে দেখা করার জন্য সম্ভবত তাদের কিছু বক্তব্য দেওয়ার জন্য। | হেলিকপ্টার থেকে অবতরণের পর দেখা গেল ১০/১২টি মােটর সাইকেল চড়ে বেশ ২০/২২ জন ছাত্রনেতা মন্ত্রী মহােদয়কে আউট রাইডার হিসাবে এসকর্ট করে নিয়ে যাচ্ছে। সত্যিকারের মুক্তিযােদ্ধারা রাস্তার পাশে মন্ত্রীর গাড়ি থামাতে বললে কিছু বক্তব্য রাখত। সেই মােটর সাইকেলের এসকর্ট বাহিনী তাদেরকে অবজ্ঞা করে জোরপূর্বক সরায়ে সামনে যাওয়ার চেষ্টা করে। মুক্তিযােদ্ধারা এতে বেশ কয়েকজন মােটর সাইকেল আরােহী ছাত্রনেতাদের ওপর চড়াও হয়ে মারধর করে।
তখন আমি এবং লে. কর্নেল কাজী নুরুজ্জামান সার্কিট হাউসে মন্ত্রীর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। খবর পেয়ে সেখান থেকে ত্বরিৎ গতিতে ঘটনাস্থলে পৌছে ঘটনা উদ্ঘাটন করতে গিয়ে জানতে পারলাম যে মুজিব বাহিনী সম্বন্ধে নিবেদিত মুক্তিযােদ্ধাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাদের মধ্যে খুবই অল্প সংখ্যক লােককে দেখা গিয়েছে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে। বিজয় অর্জনের পর সত্যিকারের মুক্তিযােদ্ধাদেরকে অবজ্ঞা করে তারা মন্ত্রীর নিকটস্থ সৈনিক হয়ে দাঁড়াল সেটা তারা। কিছুতেই মেনে নিতে পারল না।
পরবর্তীতে সরলমনা সাহসী মুক্তিযােদ্ধাদের যখন আমি ধমকের সুরে শাসালাম অনেকে কেঁদে ফেলল। বলল, নয় মাস পদ্মার চরে বালুতে জঙ্গলে অভুক্ত শুধু একখানা লুঙ্গি কিংবা ছেড়া হাফ প্যান্ট পড়ে লড়াই শেষ করে মা বাপকে না দেখে বসে রইলাম এ কয়দিন মন্ত্রীর সাথে দেখা করবার জন্য, কিন্তু যাদেরকে আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে দেখিনি তারা কি করে মন্ত্রীর সহচর হয়ে গেল স্বাধীনতার পর!
এদিকে কাহিনী রটান হলাে বামপন্থী কমান্ডারদের প্ররােচনায় এ ধরনের ঘটনা করা হয়েছে। আমি মন্ত্রী কামরুজ্জামান সাহেবকে বললাম, তিনি ১৫ দিনের মধ্যে যেন আমাদের মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে দেখা করতে আসেন এবং কথা বলেন, তবেই বুঝতে পারবেন, আমাদের মুক্তিযােদ্ধারা কতটা সহনশীল এবং নির্দোষ। মন্ত্রী কামারুজ্জামান সাহেব আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। যুদ্ধের মাঝামাঝি যখন সেক্টর পুনর্বিন্যাস হচ্ছিল তখন জেনারেল এম এ জি ওসমানী আমাকে কুমিল্লা এলাকায় পাঠাবার প্রস্তাব করেন কিন্তু কামরুজ্জামান সাহেব বাধা দেন এবং বলেন, রাজশাহী অঞ্চল মুক্তিযুদ্ধের কার্যকলাপ থেকে বঞ্চিত হয়ে যাবে। তাই আমার নিজ এলাকায় আর যাওয়া হলাে না।
পরবর্তীতে তিনি যখন জোহা হলে মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে দেখা করেন এবং খােলাখুলি আলাপ করেন তখন অত্যন্ত উৎফুল্ল ছিলেন। পূর্বে কেন এ ধরনের ঘটনা ঘটল তিনি ভালাে করেই বুঝতে পারেন। কারা এ ধরনের ঘটনার পেছনে ছিল তা তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল।
ড. জোহা হলে আমার অধীন মুক্তিযােদ্ধা, ইপিআর, পুলিশ, আনসার ও সেনাবাহিনীর প্রায় ১০০০ লােক তখনও অবস্থান করছিল। ছাত্র ও গ্রাম্য যুবকরা অস্ত্র, গােলাবারুদ জমা দিয়েছে। অনেকে জমা দিয়ে বাড়ি গিয়ে বাবা, মা ও নিকট আত্মীয়দের সাথে দেখা করতে চলে যায়। ফেরত এসে অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়ে। রাজাকাররা তাদের বাড়িঘর হানাদার বাহিনীর সহায়তায় জ্বালিয়ে দেয় ও অনেক নিকট আত্মীয়কে হত্যা করে বলে জানায়।
এই অসম সাহসী সত্যিকারের মুক্তিযােদ্ধারা অপেক্ষা করছিল জেনারেল এম এ জি ওসমানীর স্বাক্ষরকৃত সাটিফিকেট যেটা আমার দ্বারা প্রতি স্বাক্ষরকৃত দেওয়া সার্টিফিকেট নিতে। আমার কাছে সেক্টরের তখন অধিনায়ক হিসাবে সার্টিফিকেট পৌছাবার আগেই মুজিব বাহিনীর নিকট কয়েক হাজার সার্টিফিকেট পৌছায়ে দেওয়া হয়। এছাড়াও বেশকিছু সার্টিফিকেট হাটবাজারে বিক্রি হতে দেখা গেছে। ৫০-১০০ টাকায় সে সমস্ত সার্টিফিকেট বাজারে পাওয়া যাচ্ছিল। কোনাে মুক্তিযােদ্ধার নাম/রেকর্ড ছাড়াই সেগুলি অতি সামান্য পয়সার বিনিময়ে বিক্রি হচ্ছিল বাজারে এ সমস্ত সার্টিফিকেট প্রথমেই হুড়মুড়ি খেয়ে কিনতে লাগল রাজাকার, শান্তিবাহিনীর সদস্যরা। এর দুই দিন পর সার্টিফিকেটের বস্তা আমার কাছে পৌছাল। তখন সত্যিকারের মুক্তিযােদ্ধারা কিছুতেই সরকারের পাঠান সার্টিফিকেট নিতে রাজি হলাে না। তারা বলল, আমি যেন নতুন সার্টিফিকেট ছাপিয়ে আমার দস্তখত দিয়ে তাদেরকে বিতরণ করি। সেটাই তাদের একমাত্র চাহিদা ছিল যার ফলে আমাকে প্রেস থেকে ছাপান নতুন সার্টিফিকেট নিজ হাতে দস্তখত করে বিতরণ করতে হয়। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য করা যেতে পারে যে, আমার এলাকায় বিশেষ করে ৪নং সাব সেক্টরের প্রত্যেকটি মুক্তিযােদ্ধার নামে লিস্ট ছিল। প্রত্যেক মুক্তিযােদ্ধা রেকর্ডকৃত ছিল। অমুক্তিযােদ্ধা কখনও স্থান পায় নাই।
কিছুদিনের মধ্যে মন্ত্রী জনাব কারুজ্জামান, জনাব ফনীভূষণ মজুমদার ও জনাব তাজউদ্দিন আহমদে সাহেব রাজশাহীতে আগমন করেন, অঞ্চলের পরিস্থিতি অবলােকন করার জন্য। তাদের আগমনের খবর শােনার পর মুক্তিযােদ্ধারা বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্ররা আমাকে অনুরােধ করে যেন আমি সরকারকে বলি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলাে কিছুদিনের জন্য বন্ধ রাখা হয়। তারা প্রত্যেকে তাদের এলাকায় গিয়ে দেশ গড়ার কাজে নিয়ােজিত হতে চায়। এক একটি উদ্দীপ্ত তেজস্বী মুক্তিযােদ্ধা অন্তত পক্ষে ২০০ জন কর্মী যােগাড় করতে সক্ষম বলে আমায় জানায়। _ তাদেরকে জোহা হলে মওজুদ পাক সেনাবাহিনীর রসদ (চাল, ডাল, তৈল, বলণ, মসলা ইত্যাদি) তিন মাসের মওজুদ রসদ সরকার সরবরাহ করলেই তারা রাস্তা, পুল, বিদ্যালয়, বৈদ্যুতিক ও টেলিফোনের খুঁটি, বাড়িঘর ইত্যাদি মেরামত করে দেবে। যেভাবে আমেরিকার আর্মি ভিয়েতনাম ছেড়ে দেওয়ার পর ভিয়েতনামের সরকার স্থানীয় জনগণ/মুক্তিযােদ্ধাদের দ্বারা গড়ে তুলেছে। ইচ্ছা করলে সরকার প্রত্যেক মুক্তিযােদ্ধা এবং সহকর্মীদের দৈনিক এক/দেড় টাকা জোহা হলে রক্ষিত মুজদ রসদ/খাদ্য তার সাথে বরাদ্দ করে সবজি ইত্যাদি কেনার জন্য । তাহলে তারা এটা খেয়েই দেশ গড়াই তাদের শ্রম দান করে দেশকে গড়ে তুলবে।
আমাড় প্রস্তাবটি ফনীভূষণ মজুমদার উড়িয়ে দিলেন এ বলে যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা সরকার নিয়ে ফেলেছে এতে কিছু করার নাই। জনাব তাউদ্দিন সাহেব আমার জোরালাে বক্তব্যের কোনাে উত্তর দেন নি তবে যা কিছু বলেছেন সেটা অনেকটা ফণিভূষণ মজুমদারের এবং সরকারের চিন্তার প্রতিফলন বহন করছিল। কামারুজ্জামান সাহেব অন্য দুইজন মন্ত্রী মহােদয়কে আমার পক্ষ নিয়ে বুঝাতে চাইলেন যে মেজর গিয়াসের বক্তব্যটি ভালােভাবে শােনার এবং সেটা অনেক সুফল ব্যয় বয়ে আনতে পারে দেশ গড়ার জন্যে। শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় সরকার খুলে দিলেন বিলম্ব না করে।
Reference: এ এইচ এম কামারুজ্জামান – সালিম সাবরিন, pp 147-150