You dont have javascript enabled! Please enable it!

শরণার্থী সেবায় আরও দু’শ কোটি টাকা

আশি লক্ষে পৌছেছে শরণার্থীর সংখ্যা। এখনও গড়ে প্রতিদিন আসছেন পঞ্চাশ-ষাট হাজার। এক কোটি ছাড়তে আর দেরী নেই। সেখানেই শেষ হবে কিনা সন্দেহ। আসন্ন দুর্ভিক্ষ এবং পাক-সেনার জুলুমবাজীতে বাংলাদেশে থাকতে পারবেন না কোন জাতীয়তাবাদী নাগরিক। ভারতের অর্থ-ভান্ডারে পড়েছে বিরাট টান। প্রতিদিন এক একজন শরণার্থীর জন্য খরচ হচ্ছে তিন টাকা। অঙ্কটি আনুমানিক। বেশী হওয়াটাও আশ্চর্য নয়। প্রয়ােজনের তুলনায় বাইরে সাহায্য সামান্য। প্রতিশ্রুতি মত টাকা আসেনি কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। এদিকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে পাকিয়ে উঠছে কঠিন জট। মার্কিন নেতৃেত্বে জোট বাধছে পাক-দরদীরা। ওরা বাঁচাবার চেষ্টা করবে ইয়াহিয়া খানকে। ভারী করে তুলতে চাইবে ভারতের উপর আর্থিক চাপ। অনেকে হাত গুটালেও আশ্চর্য হবার কিছুই নেই। চুপ করে নিষ্ক্রিয় বসে থাকতে পারেন না নয়াদিল্লী। শরণার্থীদের ভরণ-পোষণের নৈতিক দায়িত্ব তারা নিয়েছেন নিজেদের কাঁধে। শরণার্থীরা ভারতের নাগরিক নন। তারা গােটা দুনিয়ার অতিথি। পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র বলেই আশ্রয় নিয়েছেন এখানে। এই দুর্গতদের প্রতি ভারত সহানুভূতিশীল। তাই সে পাক-নেকড়ের মুখে ওদের ঠেলে দেয়নি। দিলে তা হত মানবতা বিরােধী অপরাধ। কক্ৰবাজার অঞ্চলের শরণার্থীরা গিয়েছিলেন ব্রহ্মদেশে। সেখানে দুঃখ-দুর্দশার অন্ত ছিল না তাদের। বর্মী সরকারের অকৃপণ সাহায্য পাননি বাংলাদেশের শরণার্থীরা। প্রকাশিত সংবাদের মর্মকথা ছিল এ ধরনের।
গােটা দুনিয়া মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকলেও ভারত এড়াতে পারবে না দায়িত্ব। প্রায় দু’হাজার মাইল বিস্তৃত তার পূর্বাঞ্চলের সীমান্ত। ওপারে বাংলাদেশ। পাক-দখলদার সৈন্যরা চালাচ্ছে সেখানে গণহত্যা, লুণ্ঠন এবং নারী ধর্ষণ। প্রাণের দায়ে নিপীড়িত মানুষগুলাে পাড়ি দিচ্ছেন সীমান্তে। নিতান্ত অমানুষ না হলে তাঁদের প্রবেশ পথ বন্ধ করা অসম্ভব। কেন্দ্রীয় সরকার ইতিপূর্বে শরণার্থী সেবার ব্যয় বরাদ্দ করেছিলেন পঞ্চাশ কোটি টাকা। বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে ধারণা ছিল না তাদের। ভেবেছিলেন—শরণার্থীর সংখ্যা হবে মাত্র কয়েক লাখ। ছ’মাস পরেই ফিরে যেতে পারবেন তারা স্বদেশে। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি গান্ধী নিজেই বলেছিলেন এই নির্দিষ্ট মেয়াদের কথা। তার আশা ছিল, আন্তর্জাতিক চাপে ইয়াহিয়া বাধ্য হবেন একটি রাজনৈতিক মীমাংসায় আসতে। ব্যর্থ হয়েছে তার সব হিসাব-নিকাশ। সব মীমাংসার পথ বন্ধ করেছেন ইয়াহিয়া খান। দলে দলে তিনি শরণার্থী পাঠাচ্ছেন ভারতে। গােটা পাকিস্তানের জনসংখ্যার তুলনায় বাংলাদেশকে সংখ্যালঘুতে পরিণত করাই তার উদ্দেশ্য। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী চলছে কাজ। ইসলামাবাদের কৃতকর্মের বােঝা এসে পড়ছে ভারতের মাথায়। অর্থের জন্য নয়াদিল্লী হাত পাতছেন সর্বত্র। জনসাধারণ ভালভাবেই জানেন, শরনার্থী সমস্যা যত দীর্ঘস্থায়ী হবে, ভারতের অর্থব্যয়ও সে অনুপাতে বাড়বে। তার লক্ষণ সুস্পষ্ট।
রাজস্ব এবং ব্যয় মঞ্জুরী দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী শ্রী গণেশ দাবি জানিয়েছেন অতিরিক্ত দু’শ কোটি টাকার। শরণার্থী সেবার জন্য দরকার এই ব্যয় বরাদ্দের। চমকে উঠেন নি লােকসভার সদস্যরা। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামীদের প্রতি যখনই জানিয়েছেন অকুণ্ঠ সমর্থন তখনই নিয়েছেন তাঁরা শরণার্থী সেবার ঝুঁকি। যে টাকা সরকার চাচ্ছেন তাতে নাকি চলবে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত। কিন্তু তারপর? এ সময়ের মধ্যে শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের নেই কোন সম্ভবনা। বরং বাড়বে তাদের সংখ্যা। দরকার পড়বে আরও টাকার। সে টাকাও জোগাতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারকে। টাকাটা পড়বে না গাছ থেকে। জনগণের পকেট থেকেই যাবে টাকা। শেষ পর্যন্ত উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলাের কাট-ছাটও বিচিত্র নয়। কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন—ওতে হাত পড়বে না। কিন্তু কিসের ভিত্তিতে বলছেন তারা এসব কথা? এখন পর্যন্ত কর্তাদের হিসাব-নিকাশের ত্রুটিহীনতার পাওয়া যায়নি কোন প্রমাণ। গত পাক-ভারত যুদ্ধে যত টাকা খরচ হয়েছিল তা ছাপিয়ে উঠছে শরনার্থী সেবার ব্যয়ভার।
ভারতের সাধারণ মানুষ গরীব। ভবিষ্যতের দিকে চেয়ে চরম কৃচ্ছসাধনেও তারা প্রস্তুত। একথা সত্য, বন্ধু। হিসাবে স্বাধীন বাংলাদেশকে পেলে পরিণামে কমবে তাদের প্রতিরক্ষার ব্যয়। বাড়াবে ভারতের নিরাপত্তা। কমবে শরণার্থীদের জন্য অতিরিক্ত ব্যয়ের বােঝা। কেন্দ্রীয় সরকার দিয়েছেন কি সুসিদ্ধান্তের কোন ইঙ্গিত? তাদের প্রতিটি পরিকল্পনা গোঁজামিলে ভর্তি। এগুলাে রুপায়ণে নেই কোন আন্তরিকতা। পূর্বাঞ্চল থেকে নির্দিষ্ট সংখ্যক শরণার্থী সরাবার ঘােষণা হয়েছিল অনেকদিন আগে। জরুরী অবস্থা বর্তমানে থাকা সত্ত্বেও কাজ চলছে ডিমে তেতালায়। মাথাব্যথা যেন পশ্চিম বাংলা এবং অন্যান্য পূর্বাঞ্চল রাজ্যের। অন্য রাজ্যগুলাের নেই কোন দায়িত্ব। নয়াদিল্লী স্বীকার করছেন, মুক্তিবাহিনীর বিজয় এবং স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা ছাড়া স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসতে পারে না পূর্ববাংলায়। তা না এলে ফিরবেন না শরণার্থীরা। মুক্তিবাহিনীর বিজয়ের প্রথম পর্যায় বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক স্বীকৃতি লাভ।
এই স্বীকৃতি দানে নয়াদিল্লী করছেন ইতস্ততঃ। অনন্তকাল শরণার্থীদের ব্যয়ভার বহনের ক্ষমতা নেই জনসাধারণের। সময়টা করতে হবে সংক্ষিপ্ত। বাংলাদেশ সরকারকে আশু স্বীকৃতি দান তার আবশ্যিক অঙ্গ। তা হলেই জোরদার হবে মুক্তিসংগ্রাম। ইয়াহিয়ার সঙ্গে চরম ফয়সালার দিন আসবে ঘনিয়ে। বাংলাদেশ সরকার পাবেন দ্বিগুণ প্রেরণা। পাক-চমূর উপর তাদের প্রত্যাঘাত হবে সাংঘাতিক। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক কাঠামাে ভেঙ্গে পড়ছে এবং বাংলাদেশ থেকে তার পাততাড়ি গুটানাে অনিবার্য—এ আনন্দে বগল বাজানাে অর্থহীন। মনে রাখা উচিত ভারতের আর্থিক কাঠামােও সিদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে নেই। সেখানেও ইয়াহিয়া খান দিয়েছেন প্রচণ্ড ধাক্কা।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৭ আগস্ট ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!