বাঙলাদেশ পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ কেন?
নির্মল সেন
কায়েদে আজমের স্বাপ্নের মধ্যেই একটা অভিশাপ বােধ হয় ছিল। মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান দাবি তিনি শেষ পর্যন্ত আদায় করেছিলেন ঠিকই কিন্তু সেই আদায়ী সঙের মধ্যে একটা ফাক থেকে গিয়েছিল। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় গঠনে ভৌগােলিক দিক থেকে যদি অখণ্ডতা থাকত, যদি রাষ্ট্রের পশ্চিম ও পূর্ব প্রদেশের মধ্যে বিমানপথে ১০০০ মাইল এবং জলপথে ৩০০০ মাইলের ব্যবধান না থাকত তাহলে সম্ভবত পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকট অন্য পথ গ্রহণ করত। আজকের এই চেহারায় দেখা দিত না। এ তবু বলব পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় গঠনের মধ্যে যে স্ববিরােধ ও অভিশাপ ছিল তার লক্ষণ পাকিস্তানের জন্মের গােড়াতেই দেখা গিয়েছিল এবং তার আবির্ভাব ঘটেছিল কায়েদে আজমের চোখের সামনেই। সবে তখন মাত্র কয়েক মাস হলাে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছে। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানের গবর্নরজেনারেল কয়েদে-আজম জিন্না এলেন পূর্ব পাকিস্তান সফরে ঢাকায়। গ্রামে, গঞ্জে, শহরে লক্ষ লক্ষ লােক পাকিস্তানের জনক, প্রিয় নেতা কায়েদে আজমকে সংবর্ধনা জানাতে জমায়েত হলাে। ২৪ মার্চ কায়েদে আজম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন উৎসবে ভাষণ দিতে উঠলেন। ভাষণের এক জায়গায় এসে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে কায়েদে আজম যখন বললেন: “আমি তােমাদের জানাতে চাই একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা, কারণ এই ভাষার মধ্যে দিয়েই এতকাল ইসলামের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারা প্রবাহিত হয়ে এসেছে”—ঠিক সেই সময়ে সমাবর্তন হলের একপ্রান্ত থেকে বেশ কয়েকটি কণ্ঠের দুঃসাহসী প্রতিবাদ শােনা গেল—“না, না”।
উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে পূর্ব বাঙলার ঘাড়ে চাপিয়ে দেবার চেষ্টার বিরুদ্ধে সেদিন এই যে দৃপ্ত অথচ ক্ষীণ প্রথম প্রতিবাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলে প্রতিধ্বনিত হয়েছিল সেই প্রতিবাদই জানিয়ে দিয়েছিল কায়েদে আজমের স্বপ্নে ফাক কোথায়।
বাঙলা ভাষার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের আন্দোলনকে আমাদের দেশে অনেকেই একটা বলিষ্ঠ সাংস্কৃতিক আন্দোলন বলে মনে করেছিলেন। সেই কারণেই আমাদের দেশে এ আন্দোলনকে নিয়ে কাব্যি করাই হয়েছে বেশি, তার রাজনৈতিক তাৎপর্য ও পরিণতি অনুসন্ধানের চেষ্টা হয়েছে সামান্য।
ভাষা আন্দোলন প্রকৃত পক্ষে পূর্ব বাঙলার নতুন জাতীয়তাবাদের আন্দোলন। নতুন এই অর্থে যে পাকিস্ত নের জন্মের কালে মুসলিম জনসাধারণকে বােঝানাে হয়েছিল জাতীয়তাবাদের ভিত্তি ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতা। জাতীয়তাবাদের এই অপব্যাখ্যা তারা প্রথম যুগে গ্রহণ করে নিলেও পাকিস্তান সৃষ্টির কয়েক বছরের মধ্যে তার রাষ্ট্রগঠন, তার পশ্চিম ও পুর্বের প্রদেশের মধ্যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক ইত্যাদি চোখে আঙুল দিয়ে পূর্ব বাঙলার সাধারণকে বুঝিয়ে দিয়েছিল সাম্প্রদয়িকতার গণ্ডিকে ভেঙে গণতন্ত্রের পথেই প্রকৃত জাতীয় আকাক্ষার মুক্তি। এবং এই নতুন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পথে বাঙলা ভাষার দাবি ছিল অন্যতম উপলক্ষ মাত্র। পূর্ব বাঙলার জনগণের পদদলিত জাতীয় আকার বেদনা ছিল তার গভীরে।
গান্ধীজীর লবণ সত্যাগ্রহ যে কারণে শুধু অর্থনৈতিক আন্দোলন নয়, পরন্ত বিদেশি ঔপনিবেশিকতাবাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক জাতীয় সংগ্রামও, সেই কারণেই পূর্ব বাঙলার ভাষায় আন্দোলন পূর্ব বাঙলার জাতীয় রাজনৈতিক মুক্তি পশ্চিমের শাসকদের ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে।
ভৌগােলিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্ত দিক থেকেই পূর্ব পাকিস্তান তার গােড়াপত্তনের মূখেই পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ হয়ে জন্মেছিল। একই রাষ্ট্রের দুটো প্রদেশ পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব বাঙলা, কিন্তু তার মাঝে রয়েছে হাজার মাইলেরও বেশি এক বিদেশি রাষ্ট্র অর্থাৎ ভারতভূমির বিস্তার। কানাডা এবং ব্রিটেনের মধ্যে যে দূরত্ব তার চেয়েও বেশি দূরত্ব পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে। এই ভৌগােলিক বিচ্ছিন্নতা কখনও পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানকে জাতীয় ঐক্যের নিবিড় বন্ধনে বাঁধতে পারেনি, পারেও না। পশ্চিম পাকিস্তান অর্থাৎ যেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের অবস্থান সেই সরকার ও শাসকেরা অথবা সে অঞ্চলের সাধারণ মানুষের কাছে পূর্ব বাঙলার মানুষের দাবি অধিকারের ন্যায্যতার কোনােদিনই উপলব্ধি ঘটেনি।
অর্থনৈতিক দিক থেকে পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে গােড়া থেকেই শুরু হয়েছে শােষণের সম্পর্ক এবং সে শােষণ পুরােপুরি ঔপনিবেশিক শােষণ। পূর্ব বাঙলা তার অর্থ, রাজনৈতিক অধিকার, গণতন্ত্র সব কিছুই বিসর্জন দিয়েছে পশ্চিমের শাসকশ্রেণী ও সেখানকার ২০টি শিল্পপতি পরিবারের পায়ে।
শিল্পবিকাশের ক্ষেত্রে পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে গােড়া থেকেই এক প্রচণ্ড অসমতা দেখা যায়। পাকিস্তান রাষ্ট্রের শিল্পবিকাশের প্যাটার্ন দেখলেই বােঝা যাবে যে পশ্চিম পাকিস্তানের ২০টি শিল্পপতি পরিবারের স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রেখেই এই বিকাশের গতি নির্ধারিত হয়েছে এবং এক্ষেত্রে পূর্ব বাঙলার
ভূমিকা হচ্ছে পশ্চিমের শিল্পগুলােকে কাঁচা মাল জুগিয়ে যাওয়া এবং পশ্চিমের শিল্পে উৎপাদিত পণ্যের বাজার হিসাবে সীমাবদ্ধ থাকা। কয়েকটি পরিসংখ্যান থেকে পূর্ব বাঙলার এই ঔপনিবেশিক চেহারার হদিশ পাওয়া যাবে। দেশভাগের আগে পূর্ব বাঙলায় ছিল ১১টি কাপড়ের কল এবং পশ্চিম পাঞ্জাবে ছিল মাত্র ৬টি। এখন পশ্চিম পাকিস্তানের মাত্র একটি অংশেই ৯৮টি মিল এবং পূর্ব বাঙলার সমগ্র অংশে মাত্র ৪৫টি। পাকিস্তানের মূল ধাতুশিল্প এবং বিদ্যুতিক যন্ত্রশিল্পে মােট উৎপাদনের শতকরা মাত্র দু-ভাগ উৎপন্ন হয় পূর্ব বাঙলায়। পরিবহন যন্ত্রপাতি উৎপাদনের তুলনায় পূর্ব বাঙলার স্থান পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে অত্যন্ত নগণ্য। বিদ্যুৎ শিল্পের স্বল্পতা পূর্ব বাঙলায় শিল্পের অগ্রগতির পথে অন্যতম বাধা। এই অভাব দূর করার জন্য প্রচুর কাঠখড় পােড়ানাের পর এবং আন্দোলনের চাপে পাকিস্তান সরকার চট্টগ্রামে একটি জলবিদ্যুৎ তৈরির পরিকল্পনা বাধ্য হয়েই গ্রহণ করে কিন্তু ৪৮ কোটি টাকা এর জন্য ব্যয় করেও তা আজও পুরােপুরি চালু হয়নি। এর পিছনে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের অনিচ্ছা ও দুর্নীতি দুটোই কাজ করেছে। বর্তমানে এই জলবিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে যে সামান্য পরিমাণ বিদ্যুৎ-শক্তি পাওয়া যায় তা শিল্পের কাজের পক্ষে অত্যন্ত অল্প। পূর্ব বাঙলার বিদ্যুৎ শক্তির প্রতি ইউনিটের দাম ৩৭ পয়সা। সে জায়গায় পশ্চিমে প্রতি ইউনিটের দাম ১৮ পয়সার মতাে। পূর্ব বাঙলায় বগুড়া-রাজশাহী অঞ্চলে বিরাট স্থান জুড়ে কয়লার সন্ধান পাওয়া গেছে। কিন্তু সেই কয়লা উত্তোলনের কোনাে পরিকল্পনা সরকারের নেই। |
মূল শিল্পের কথা বাদ দিলেও ভ্যেগ্যপণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রেও পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থে পূর্ব বাঙলাকে অনুন্নত রাখা হয়েছে। পাকিস্তানে মােট জুতার উৎপাদনের মাত্র শতকরা চারভাগ উৎপন্ন হয় পূর্ব বাঙলায় তামাকের জন্য বিখ্যাত পূর্ব বাঙলা সিগারেট উৎপাদনেও অনেক পিছিয়ে। বয়নশিল্পে মােট উৎপাদনের মাত্র চার শতাংশ উৎপন্ন হয় পূর্ব বাঙলায় ।
শিল্পে পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় এই অনগ্রসরতার ফলে পূর্ব বাঙলায় বেকার বাড়ছে, মাথাপিছু আয় কমছে, কৃষিতে লােকের ভিড় বাড়ছে এবং তার ফলে কৃষিতেও অনগ্রসরতা জেঁকে বসে আছে।
পশ্চিম পাকিস্তানে যে শিল্পোন্নয়ন ঘটেছে সেই শিল্পকে সম্পূর্ণ নির্ভর করতে হয় বাইরে থেকে কাঁচা মাল আমদানির উপর। বিদেশ থেকে এই আমদানির জন্য যে অর্থ প্রয়ােজন সেই অর্থ আসে পূর্ব বাঙলার চা ও পাট থেকে। পাকিস্তান রপ্তানি থেকে যা আয় করে সে আয়ের শতকরা ৭০ ভাগ যােগায় পূর্ব বাঙলা ।
ক্লাসিক্যাল অর্থেই পূর্ব বাঙলা পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ। পূর্ব বাঙলা থেকে কাঁচা চামড়া ও তামাক আমদানি করে পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব বাঙলার রপ্তানি করে জুতাে ও সিগারেট। পূর্ব বাঙলার নুন ও আসে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে।
পাকিস্তান সরকার তার লাইসেন্স দেওয়ার নিয়মকানুন এমন পক্ষপাতমূলক ভাবে বেঁধে দিয়েছে যার ফলে শিল্পোন্নয়ন এবং বাণিজ্যের উন্নয়ন পূর্ব বাঙলায় হতে পারেনি। শিল্পের এই নীতির ফলে পূর্ব বাঙলা হয়ে রয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানের কাঁচা মাল যােগানের আড়ত এবং সেখানকার উৎপন্ন পণ্যের বাজার হয়ে। এক কথায় পশ্চিম পাকিস্তানের মাত্র কয়েকটি শিল্পপতি পরিবারের স্বার্থে গােটা পূর্ব বাঙলা হয়েছে উপনিবেশ।
জাহাজী পরিবহণের ব্যবস্থাও পশ্চিম শিল্পপতিদের হাতে। সেই কারণে পূর্ব বাঙলাকে বেশি দরে পশ্চিম থেকে আমদানি করা পণ্য কিনতে হয়। পাকিস্তানের বিদেশি বাণিজ্যের সবটাই হয় পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে দিয়ে। তার ফলে বিদেশি মাল করাচি হয়ে যখন পূর্ব বাঙলায় আসে তখন তার দাম আরও বেড়ে যায় পশ্চিমী ব্যবসায়ীদের পকেটে অতিরিক্ত মুনাফা যােগান দিতে গিয়ে।
শিল্প এই দুর্দশার ফলে পূর্ব বাঙলার কৃষিও অনগ্রসর এবং কৃষিতে নির্ভর লােকের সংখ্যা সেখানে ৯৫ শতাংশ।
প্রতি বছর পূর্ব বাঙলা থেকে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার যে কোটি কোটি টাকা আয় করে থাকে তার অত্যন্ত ক্ষুদ্র এক অংশমাত্র ব্যয় হয় পূর্ব বাঙলার জন্য আয়ের সিংহভাগ খরচ হয় পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য। নিচের হিসাব থেকেই দেখা যাবে পূর্ব বাঙলাকে তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে সুযােগ-সুবিধার ক্ষেত্রে কত পিছিয়ে রাখা হয়েছে :
পশ্চিম
পাকিস্তানে |
পূর্ব
বাঙলায় |
|
মেডিক্যাল কলেজ | ৬ | ১ |
ইনজিনিয়ারিং কলেজ | ৩ | ১ |
প্রাইমারি স্কুল | ৬,২৪৬ | ২,২১৭ |
হাসপাতালের বেড | ১৭,৬১৪ | ৫,৫৮৯ |
মেটারনিটি হাসপাতাল | ১১৮ | ২২ |
এই প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে যে পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে পূর্ব বাঙলার জনসংখ্যা অনেক বেশি। অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকটি মাত্র শিল্পপতি পরিবারের স্বার্থে যে শাসন ও শােষণ ব্যবস্থা চলছে সেই ব্যবস্থায় পূর্ব বাঙল