পূর্ব বাঙলার কৃষিসমস্যার স্বরূপ
শামসুর রহমান
পূর্ব বাঙলায় শতকরা ৮০ জন লােকই কৃষির উপরে নির্ভরশীল। কাজেই কৃষকদের সমস্যাই যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও জাতীয় সমস্যা তাহা আর বিশেষ করিয়া বলার প্রয়ােজন করে না। কৃষি ও কৃষকদের সমস্যার সুষ্ঠ সমাধানের উপরেই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতি প্রধানত নির্ভরশীল। কিন্তু আমাদের দেশে এই সমস্যাগুলাে সম্বন্ধে সরকারি ও বেসরকারি তথ্য এতই সামান্য ও অনির্ভরযােগ্য যে এ বিষয়ে কোনাে আলােচনাও অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। সরকার তাঁহার রেওয়াজ মাফিক মাঝে মাঝে এবং কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে বৎসর বৎসর কতকগুলাে সংখ্যা হাজির করেন সত্য, তবে এগুলাের প্রায় ক্ষেত্রেই প্রকৃত অবস্থার সঙ্গে কোনাে মিল নাই এবং কোনাে কোনাে সময় একমাত্র প্রচারের জন্যই ইহা করা হয়, যেমন খাদ্য উৎপাদনের ব্যাপারে স্বয়ংসম্পূর্ণতার বিষয় প্রমাণ করিতে গিয়া আউয়ুব-মােনায়েমের আমলে করা হইয়াছিল। এখন পর্যন্তও তাহার কোন ব্যতিক্রম হইয়েছে বলিয়া মনে করিবার কারণ নাই। তবুও যে সামান্য তথ্য আছে তাহার উপরে ভিত্তি করিয়াই সমস্যাটার আলােচনা করা যাইতে পারে।
সামন্তবাদের শােষণ
উৎপাদনের যে-কোনাে ক্ষেত্রে অগ্রগতি কিংবা উন্নতির প্রধান লক্ষণ হইল যে সেখানে কোননারকম উদ্বৃত্ত কিংবা সঞ্চয় হয় কি না। ইহা না হইলে সেই উৎপাদন-ক্ষেত্র, অবনতির দিকে যাইতে বাধ্য। কিন্তু পূর্ব বাঙলায় যে উৎপাদনব্যবস্থার সঙ্গে শতকরা ৮০ ভাগ লােক জড়িত সেখানে কোনাে রকম উদ্বৃত্ত তাে দুরের কথা তাহা চালাইয়া রাখার মতাে নিম্নতম ব্যবস্থাও নাই। ফলে সমস্ত কৃষিব্যবস্থা ধ্বংসের দিকে যাইতেছে এবং কৃষকসমাজের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ দিনে দিনে একেবারে নিঃস্বে পরিণত হইতেছে। অভুক্ত, অর্ধভূক্ত, স্বাস্থ্যহীন, অস্থিকংকালসার কৃষকরাই আজ সমস্ত গ্রাম অঞ্চলের প্রধান বৈশিষ্ট্য। অথচ ইহারাই জাতির অধিকাংশ। ইহাদের সমস্যার কথা বাদ দিয়া দেশের কোনাে সমস্যার কথা চিন্তা করাও মূর্খের স্বর্গে বাস করার মতাে।
সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান সমস্যা হইল সামন্তবাদী ভূমিব্যবস্থা। জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ হইয়াছে বটে, কিন্তু, খােদ চাষির হাতে জমি আসে নাই। ভূমিহীন, গরিব ও মধ্য চাষি যাহার নিজেদের শ্রম দ্বারা ক্ষেতখামারগুলােতে শস্য উৎপাদন করে ইহাদের সংখ্যা কৃষকসমাজের ভিতর শতকরা ৯০ জনের কম নহে। ইহারা পূর্ব বাঙলার মােট আবাদি জমির কত পরিমাণের মালিক তাহার কোনাে সংখাতত্ত্ব এখন পাওয়া কঠিন। কিন্তু পুরানাে হিসাব হইতে বুঝা যায় যে এই বিপুলসংখ্যক কৃষকরা মােট আবাদি জমির শতকরা ৩৭/৩৮ ভাগের বেশি জমির মালিক নহে। বাকি শতকরা ৬২/৬৩ ভাগ জমির মালিক হইল জোতদার, মহাজন, ধনী কৃষক প্রভৃতি কৃষিজীবীদের ভিতর যাহাদের সংখ্যা শতকরা ১০ জনের বেশি নয়।
যাহার জমিতে ফসল উৎপাদনের আসল শক্তি তাদের হাতেই বেশির ভাগ জমি না থাকা, এবং যাহারা জমিতে ও ফসল উৎপাদনের শ্রম করে না, তাহাদের হাতে বেশি জমি—এই সামন্তবাদী ভূমিব্যবস্থা হইল কৃষি উৎপাদনের উন্নতির পথে প্রথম বাধা।
দ্বিতীয় বড় সমস্যা হইতেছে কৃষি জমির স্বল্পতা। পূর্ব বাঙলার আবাদি জমির পরিমাণ আনুমনিক হইল ২ কোটি একর। পাঁচ কোটি কৃষিজীবীকে ইহার উপর নির্ভর করিতে হয়। কাজেই, মাথা-প্রতি জমির পরিমাণ হইল আধা একরের মতাে। অথচ একজন লােকের মানুষের মতাে বাঁচিয়া থাকার জন্য পূর্ব বাঙলার দেড় একরের কম উর্বর জমি হইলে কিছুতেই চলে না। কিন্তু, মাথাপিছু এই দেড় একর করিয়া উর্বর জমি পাওয়ার কোনাে উপায় নাই। কাজেই প্রশ্ন আসিতেছে, প্রথমত কৃষির উৎপাদন প্রভূত পরিমাণে বাড়ানাে। দ্বিতীয়ত, জমির উপর চাপ কমানাে এবং ইহার জন্য শিল্পোন্নয়ন প্রভৃতির মাধ্যমে বিকল্প কাজের ব্যবস্থা করা।
তারপর সমস্যা হইতেছে কৃষকেদের উপরে বিভিন্ন রকমের শােষণ, বিশেষ করিয়া সামন্ততান্ত্রিক শােষণ । এখানে জমিদার প্রথার উচ্ছেদ হইয়াছে বটে, কিন্তু এখনও খাজনা আদায়ের যে পদ্ধতি তাহাতে সমস্ত রকমভাবে কৃষকদের (বিশেষ করিয়া গরিব কৃষকদের) অর্থনৈতিক দিক দিয়া পঙ্গু করিয়া ফেলা হইতেছে।
শতকরা ৮০ জনের উপরে কৃষকের জমির পরিমাণ হইতেছে ৫ একর কিংবা তাহার কম। ইহাদের জমি হইতে ভরণ-পােষণের কোনাে ব্যবস্থাই নাই। অথচ ইহাদের উপরে খাজনা ধার্য আছে। যাহার কিরিজীবী কিংবা ব্যবসায়ী তাহাদের একটা নিম্নতম আয় সমস্ত রকম ট্যাক্স হইতে বাদ যায়। কিন্তু কৃষকদের ভিতরে যাহার এক বিঘার কম জমিও আছে সেও খাজনা হইতে বাদ পড়ে না। জমিদারি প্রথার উচ্ছেদের পরে সরকারই হইতেছে খাজনা ধার্যের মালিক। এক কথায় সে-ই জমিদার। অথচ পুরানাে খাজনা প্রথা বজায় রহিয়াছে। পূর্ব বাঙলার সমস্ত জমির উপরে ধার্য খাজনার পরিমাণ হইতেছে ১৯ কোটি টাকার মতাে। তাহার মধ্যে শতকরা ৮০ জন গরিব কৃষকের উপর খাজনার পরিমাণ আনুমানিক ১২ কোটি টাকা। খাজনা দিতে গিয়া যে ঘুষ-দুর্নীতির সম্মুখীন হইতে হয় তাহাতে এই কৃষকদের ১২ কোটি টাকার সঙ্গে আরও ১২ কোটির বেশি খরচ করিতে হয়। খাজনা-সংগ্রহকারী তহশিলদারদের ঘুষ ও দুর্নীতির কাহিনিও প্রবাদবাক্যোর মতাে। একমাত্র খাজনা দিতে গিয়াই গরিব কৃষকের ২৫ কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হইতে হয়। এই টাকা কৃষির কোন উন্নতির কাজেও আসে না কিংবা কৃষকের অভাব মােচনেও কোনােরকম সাহায্য করে না।
জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের পরেও বর্গা প্রথা রহিয়া গিয়াছে। যদিও প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী বর্গা চাষিদের ফসলের অর্ধাংশ মালিককে দিতে হয় তবুও জমির অতিরিক্ত চাহিদার জন্য অনেক জায়গায় তাহারা ফসলের ৩ ভাগের ২ ভাগ এমন কি ৪ ভাগের ৩ ভাগ দিতেও বাধ্য হয়। আর বর্গা জমির এখন প্রতি বৎসরই হাত বদলের রেওয়াজ প্রায় সাধারণ নিয়মে পরিণত হইয়াছে। ইহার ফলে কিছু পরিমাণ সেলামি দেওয়ার রেওয়াজও ক্রমেই প্রসার লাভ করিতেছে। সেলামির টাকার পরিমাণও দিন দিন বাড়িতেছে।
উত্তরবঙ্গে ও দক্ষিণবঙ্গেই বর্গা প্রথার প্রচলন খুব ব্যাপকভাবে রহিয়াছে। এ সমস্ত জায়গায় অকৃষক বড় বড় জোতদাররাই সাধারণত বর্গা দেয়। ইহাদের জমির পরিমাণ ১০০ বিঘা হইতে আরম্ভ করিয়া ১০,০০০১৫,০০০ বিঘা পর্যন্ত। পূর্ব অঞ্চলের জেলাগুলােতে খুব ছােট ছােট জমির মালিকেরাও ব্যাপকভাবে বর্গা দেয়। কারণ ইহাদের জমি কম থাকিবার ফলে হাল বলদ রাখিয়া চাষ করা ইহাদের পক্ষে ক্ষতির কারণ হইয়া দাড়ায়। কিন্তু সমস্ত ক্ষেত্রেই বর্গা চাষের ফলে খােদ উৎপাদনকারী কৃষকের হাত হইতে বিপুল পরিমাণ ফসল অকৃষকদের হাতে চলিয়া যাইতেছে। এই পরিমাণ যে কতখানি তাহা সাধারণভাবে হিসাব করিলেই বুঝা যাইবে। পূর্ব বাঙলায় বর্গা জমির পরিমাণ সর্বসাকুল্যে শতকরা ২৫ ভাগ। ২ কোটি একর আবাদি জমির মধ্যে ইহার পরিমাণ হইল ৫০ লক্ষ একর। প্রতি একরে যদি ৩ শত টাকার ফসল হয় তবে ৫০ লক্ষ একরে ফসল জন্মে ১৫০ শত কোটি টাকার। ফসলের অর্ধাংশের হিসাব ধরিলেও ইহার মধ্যে ৭৫ কোটি টাকার ফসল কৃষকের হাত হইতে অকৃষকের হাতে চলিয়া যাইতেছে। এই অকৃষকরা জমির উন্নতির জন্য কোনােরকম খরচই করে না। এমনকি, তাহারা এই টাকার বেশির ভাগই গ্রাম অঞ্চলেও খরচ করে না। শহরে বাড়ি তৈয়ার করে, মােটর গাড়ি কিনে, নানাভাবে ব্যক্তিগত ভােগলালসা চরিতার্থ করিবার জন্য অপব্যয় করে কিংবা কেহ কেহ হয়তাে কিছু শিক্ষা কাজে কিংবা কন্ট্রাকটারিতে খরচ করে। আর কৃষকরা ফসলের যে অংশ পায় তাহাতে কৃষির খরচ যােগাইয়া কোনাে মতেই তাহাদের খাওয়া চলে না। জমির উন্নতির কোনাে খরচের তাে কথাই উঠে না। তদুপরি প্রতি বৎসর জমি হাত বগল করিবার ফলে জমির উন্নতির কোনােরকম মনােভাবও তাহাদের পক্ষে থাকা সম্ভব নয়। বর্গাপ্রথা হইতেছে সামন্তবাদী শােষণের একটি অত্যন্ত বর্বর রূপ। এই ব্যবস্থার উচ্ছেদ করিয়া খােদ কৃষকের হাতে জমি দেওয়ার ব্যবস্থা না করিতে পারিলে কৃষির উন্নতি কিংবা বিরাট সংখ্যক কৃষকের মানুষের মতাে জীবনযাপন কোনােরকমেই সম্ভব নয়। যে ৭৫ কোটি টাকার ফসল অকৃষকের হাতে চলিয়া যাইতেছে তাহার অর্ধাংশও জমির উন্নতির জন্য ব্যয় কিরতে পারিলে উৎপাদন যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পাওয়া সম্ভব। আর জমির মালিকানা লাভের ফলে কৃষকের ভিতরে যে উৎসাহের সৃষ্টি হইবে তাহাও উৎপাদন বৃদ্ধির ব্যাপারে যথেষ্ট সাহায্য করিবে।
এই উভয় প্রকারের শােষণ ছাড়াও বৎসর বৎসর একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার বিনিময়ে জমি পত্তনের ব্যবস্থা অনেক জায়গায়ই প্রচলিত আছে। এবং ইহার ফলেও কয়েক কোটি টাকা কৃষকের হাত হইতে অকৃষকের হাতে চলিয়া যায়। এই টাকাও জমির কোনাে উন্নতির কাজে লাগে না।সরকারি হিসাব মতাে ১৯৬১ সালে পূর্ব বাঙলার কৃষকের ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৩ কোটি টাকা। ইহার মধ্যে সরকারি ঋণ সামন্যই। বেশির ভাগই হইতেছে সুদখাের গ্রাম্য মহাজনদের ঋণ। এই হিসাবও পূর্ণঙ্গ নয়, কারণ প্রতি বৎসরই লক্ষ লক্ষ কৃষক অভাবের সময় অত্যন্ত চড়া সুদে অল্প সময়ের জন্য ধনি কিংবা টাকা কর্জ নেয়। এই সমস্ত ধরিলে ঋণের পরিমাণ আরও অনেক বেশি হইবে। সরকারি ঋণের সুদের হার কম হইলেও বে-সরকারি ঋণের সুদের হার শতকরা একশত টাকা অনেকটা প্রচলিত নিয়ম হিসাবেই দাড়াইয়া গিয়াছে। কাজেই টাকায় ঋণ, ধানে ঋণ প্রভৃতি ধরিয়া যদি হিসাব করা হইলেও ৫০ কোটি টাকা কিংবা সেই মূল্যের ফসল খােদ কৃষকের হাত হইতে মহাজন, জোতদার প্রভৃতির হাতে চলিয়া যাইতেছে। ইহাও কৃষি কিংবা কৃষকের উন্নতির জন্য ব্যয় হইতেছে না। উপরের সমস্ত রকম শােষণগুলােই হইল সামন্তবাদী ব্যবস্থার কতকগুলাে অবশেষ প্রচলিত থাকার ফল।
(ক্রমশ)
সূত্র: সপ্তাহ, ১৬ এপ্রিল ১৯৭১