You dont have javascript enabled! Please enable it! বায়ান্নর স্মৃতি - রোমন্থন করছেন বঙ্গবন্ধু - সাক্ষাৎকার কে জি মুস্তাফা - সংগ্রামের নোটবুক

“বায়ান্নর স্মৃতি”
রোমন্থন করছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

(১৯৪৭ সালের ছাত্রনেতা, আজকের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২১শে ফেব্রুয়ারী বাংলাদেশ টেলিভিশনে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে ভাষা আন্দোলনের অনেক অজানা তথ্য প্রকাশ করেন। খ্যাতনামা সাংবাদিক জনাব কে. জি. মুস্তাফা এই সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। ‘বায়ান্নর স্মৃতি’ শীর্ষক এই অন্তরঙ্গ সাক্ষাৎকারের পূর্ণ বিবরণ এখানে দেয়া হলো।)

কে. জি. মুস্তাফা- ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রাম। ১৯৪৭ সালে এই সংগ্রামের সূত্রপাত, তার বিকাশ ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৯ সাল এবং তার পরিনতি ১৯৭১ সালের সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে। যার ফলশ্রুতি আজকের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। এই সংগ্রাম যেমন ধীরে ধীরে পরিণতি লাভ করেছে তেমনি এই সংগ্রামের প্রথম থেকেই যিনি নেতৃত্ব দান করেছেন তাঁর জনপ্রিয়তা ধীত্রে ধীরে তেমনি বেড়ে উঠেছে। ১৯৪৭ সালে যিনি নেতা, ১৯৭২ সালে তিনিই নেতা। তফাত শুধু এতটুকু ১৯৪৭ সালে যিনি ছাত্রনেতা ১৯৭২ সালে তিনি জাতির পিতা। আজকের বায়ান্নর স্মৃতি অর্পন অনুষ্ঠানে আমরা তাঁর কাছে অতীতের কয়েকটি ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে চাই। আমি আশা করব বঙ্গবন্ধু তাঁর চিন্তাধারার মাধ্যমে সে সব প্রশ্নের উত্তর দেবেন। ১৯৪৭ সালের ৩রা জুন বৃটিশ যখন ভারত বিভাগ করবেন বলে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন তারপর আমার মনে আছে কোলকাতা সিরাজুদ্দৌলা হলে আপনি ছাত্রনেতাদের একটি সম্মেলন ডেকেছিলেন। আপনি তখন পাকিস্তানে বাঙালীর ভবিষ্যৎ কি হবে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন বোধ করেছিলেন?

       বঙ্গবন্ধু- ৩রা জুনের ঘোষণার পরে যখন বাংলাদেশকে ভাগ করা হলো আমরা যারা স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছিলাম আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম এজন্যে যে, যে-স্বাধীনতা আমরা চেয়েছি আমরা তা পাচ্ছিনা। আমার মনে হয়েছিল সে মুহূর্তে একটা ষড়যন্ত্র হচ্ছে বাংলাদেশকে শোষণ করার জন্য। কারণ তখনই রাজধানীসহ সবকিছু পশ্চিম পাকিস্তানে স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আমরা তখন এটা বুঝতে পেরেছিলাম যদিও জনগণ অতটা সজাগ ছিলেন না। আমরা একটা জিনিসের জন্য পাকিস্তানের সংগ্রাম করেছিলাম তখন মানুষকে অন্যকিছু বোঝাতে আমাদের অসুবিধা হতো। আমরা ভাবলাম, এ সম্পর্কে আলোচনা আমাদের মধ্যে প্রয়োজন। যদি এখনই বাধার সৃষ্টি না করি ভবিষ্যতে এটা ভীষণ রূপ ধারন করতে পারে। আমার মনে আছে, তুমি আমার বন্ধু মুস্তাফা তুমিও ছিলে আমার সাথে—আমরা যারা ছাত্র আন্দোলন করতাম কোলকাতার সে সময়ে একটা সভা সিরাজুদ্দৌলা হলে ডাকা হয়। সে সময়ে আমার বক্তৃতার কথা তোমার মনে আছে নিশ্চয়ই—আমি বলেছিলাম যে, এটা একটা বিরাট ষড়যন্ত্র। বাংলাদেশকে কলোনী করা করা হবে, বাংলার মানুষের ওপর আঘাত করা হবে, এ স্বাধীনতা সত্যিকারের স্বাধীনতা নয়। আমাদের আবার নতুন করে স্বাধীনতার সংগ্রাম করতে হবে। অনেকে সেদিন বুঝতে চেষ্টা করেননি, তোমার সহকর্মীদের মধ্যে অনেকে ছিলেন- যারা বুঝতে চেষ্টা করেছিলেন। তারপর আমরা যখন কোলকাতা থেকে বিদায় নিয়ে বাংলার মাটিতে ফিরে আসি। এসেই আমরা দেখলাম যে সমস্ত লোক স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগদান করে নাই, যারা বৃটিশের দালালি করেছে- স্যার, খানবাহাদুর, রায়বাহাদুর সে সব গোমরাই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলো। যেসব সরকারি কর্মচারী আমাদের আন্দোলনের পথে বাধা সৃষ্টি করেছিল তারাই এসে বড় বড় পদে বসে পড়লো। আমার মনে আছে মুস্তাফা, তুমি আমরা এক সঙ্গেই ঢাকায় ফিরে এলাম ১৯৪৭ সালে। এসেই দেখলাম যে, সাম্প্রদায়িকতায় দেশ ভরে গেছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধাবার চেষ্টা হচ্ছে। তখন আমরা কিছুসংখ্যক ছাত্র যুবক মিলে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে রুখে দাড়াবার চেষ্টা করলাম। যার ফলে মরহুম সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে বাংলাদেশ থেকে বহিষ্কার করা হলো। আমাদের বিরুদ্ধে পুলিশ লেলিয়ে দেয়া হলো। আমরা যারা নামকরা ছাত্রনেতা ছিলাম, লেখাপড়া ত্যাগ করে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলাম। আমার মনে আছে বোধহয় ১৯৪৮ সালে হবে …

       কে. জি. মুস্তফা— …১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা করার জন্য আপনাদের আন্দোলন শুরু হলো। ১১ই মার্চ আপনি সকালবেলা ইডেন বিল্ডিং-এর প্রথম গেট অর্থ্যাৎ আব্দুল গনি রোডের দিকটায় গ্রেফতার হয়ে গেলেন।

       শেখ মুজিব- তোমার তো দেখি সব মনে আছে।

       কে. জি. মুস্তফা- ১৫ই মার্চ আন্দোলনের এক বিরাট পর্যায়ে সন্ধাবেলায় আপনি মুক্তিলাভ করলেন এবং ১৬ই মার্চ (ঢাকা) বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সভায় আবার আপনি সভাপতিত্ব করলেন এবং মিছিলে নেতৃত্ব দিলেন। এই যে আন্দোলনের গতির পরিবর্তন করলেন অর্থ্যাৎ ১৯৪৭ সালে আপনি যেটা চিন্তা করেছিলেন বলতে হবে আপনার দূরদৃষ্টি ছিল। সে জন্যই ১৯৪৮ সাল অর্থাৎ একবছর পুরো না হতেই সে লাইনেই আন্দোলন শুরু করতে হলো। আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করতে চাই, ঐদিন ইডেন বিল্ডিং এর প্রথম গেটে গ্রেফতার হয়ে যাওয়ার পর আন্দোলনের পরিণতি এবং লক্ষ্য সম্পর্কে আপনার কি চিন্তাধারা  ছিল এবং ১৫ই তারিখে মুক্তি পাওয়ার আগে পর্যন্ত জেলে বসে আপনি কি চিন্তা করেছিলেন?

       শেখ মুজিব- আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে, ষড়যন্ত্রকারীরা প্রথমেই আমার ভাষার ওপর আঘাত করার চেষ্টা করলো এবং তারা জানতো কোন জাতিকে কাবু করতে হলে তার ভাষা ও সংষ্কৃতিকে ধ্বংস করতে হয়। এটা শোষকশ্রেণীর নীতি। আমার মনে আছে ১৯৪৮ সালে যখন আমাদের রাজনৈতিক বিরোধী দল হয় নাই তখন ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা করি। তুমিও তার সদস্য ছিলে। আমরা ১১ই মার্চ তারিখে অন্যান্য দল ও মতের লোক সবাইকে নিয়ে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করি। সে পরিষদে শিক্ষক ছিলেন, ছাত্র ছিলেন, যুবক ছিলেন। নেতৃত্ব দিয়েছিল ছাত্রলীগ। ১৯৪৮ সালে আন্দোলন শুরু করি। যদি মনে করা হয় এটা শুধু ভাষার আন্দোলন ছিল তাহলে ভুল করা হবে। যদিও তাকে ভাষা আন্দোলন বলেই গ্রহণ করেছিলাম তবুও তাকে স্বাধীনতার আন্দোলন বলেই চিন্তা করেছিলাম। আমাদের চিন্তাধারার লোকের সংখ্যা তখন কম ছিল, কিন্তু ছিল কিছু। আমাদের সংখ্যা কম হলেও আমরা ষড়যন্ত্রটা বুঝতে পেরেছিলাম। সেজন্যেই এ আন্দোলনকে আমরা এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করি। আমার মনে আছে তারা মিঃ জিন্নাকে সামনে রেখে তার জনপ্রিয়তাকে ব্যবহার করে আমার ভাষাকে শেষ করতে চেয়েছিল। তিনি (মিঃ জিন্না) ২১শে অথবা ২২শে মার্চ তারিখে ঢাকায় আসবেন। যখন উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার জন্য গণপরিষদে প্রস্তাব নেয়া হলো তখন বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (মারা গেছেন) ছাড়া একটা মুসলীম লীগের সদস্যও এর প্রতিবাদ গণপরিষদে করল না।

       কে. জি. মুস্তফা- গণপরিষদে কার্য পরিচালনার জন্য উর্দু এবং ইংরেজীর পাশে বাংলাকেও গ্রহণ করার জন্য ধীরেন দত্ত সংশোধণী প্রস্তাব দিলেন। সেটা বাতিল হয়ে গেল। তার জবাবে লিয়াকত আলী সাহেব বললেন, এটা পাকিস্তানকে বিভক্ত করার চক্রান্ত।

       মুজিব- তখন আমাদের উপায় আর ছিল না। গণপরিষদে যেসব বাঙালি সদস্য ছিলেন তারা ভোট দিলেন বাংলার বিরুদ্ধে। তখনকার দিনে ধীরেন দত্ত এবং তার কয়েকজন সহকর্মী ছাড়া কিছু সংখক বুদ্ধিজীবী, কিছুসংখ্যক সাংবাদিক শ্রমিক শ্রেণী আজকের মতো অত শক্তিশালী হয় নাই তারাও আমাদের সঙ্গে এগিয়ে এসেছিলেন। জনগণের সাড়া আমরা পেয়েছিলাম। তাও মানুষের মধ্যে একটা দ্বিধা, মতভেদ ছিল। আমরা তখনই আন্দোলন শুরু করি। আমরা বলেছিলাম, জিন্নাহ সাহেব হোক, যেই হোক এ মুহুর্তে যদি বাধার সৃষ্টি না করি আমরা আমাদের দাবি জীবনেও পাব না, আমাদের শেষ করে দেয়া হবে। এজন্যই আমরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। ঝাঁপিয়ে পড়ার ফলে আন্দোলনের রূপ তোমার মনে আছে। আমরা গ্রেফতার হয়ে যাই। তারপরে বেরিয়ে এসে দেখি আবার একটা কিছু করা হচ্ছে। নাজিমুদ্দিন সাহেবরা ধোঁকা দিলেন। সে সব ইতিহাস তোমার জানা আছে। আমি সে সব (নাজিমুদ্দিনের প্রস্তাব) গ্রহণ করতে পারছিলাম না- তা তোমার মনে আছে।

       মুস্তফা- এ প্রসঙ্গে আমি ছোট প্রশ্ন করবো। জিন্না সাহেব ২৪শে মার্চ কনভোকেশনে বক্তৃতা দেওয়ার কথা। উনি এসেছিলেন এবং ছাত্রনেতাদের সাথে বৈঠক করেছিলেন কয়েকবার। আপনি সে বৈঠকে যোগদান করেননি। আপনি কি মনে করেছিলেন যে, জিন্নাহ সাহেব বাঙালী স্বার্থের প্রতি সম্পূর্ন ন্যায়নীতি অনুসরণ করতে পারবেন না?

       শেখ মুজিব- আমি জানতাম। আমি জিন্নাহ সাহেবকে জেনেছিলাম। এ কথাটা আসে জিন্নাহ সাহেব যখন ভারতবর্ষের বিভক্তি মেনে নিয়েছিলেন, আমার মনে আছে সে যুগে একমাত্র বাংলাদেশেই মুসলীম লীগের সরকার ছিল। কিন্তু তিনি কেবিনেট মিশনের সাথে আলোচনার সময় বাংলাদেশ থেকে কোন প্রতিনিধি নেননি। তিনি সাথে নিয়েছিলেন লিয়াকত আলী খান আর সর্দার আব্দুর বর নিশতারকে। বাংলার কোন প্রতিনিধি তার সাথে যেতে পারেন নাই। তখনই আমরা বুঝতে পেরেছিলাম জিন্নাহ সাহেব যত কথাই বলুন না কেন তিনি বাংলার সম্পর্কে উদ্বিগ্ন নন। আরো একটা ব্যাপার ছিল, আমরা সে সম্পর্কেও মনে মনে চিন্তা করতাম। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে বাংলাদেশে যখন ৩০ লক্ষ লোক মারা যায় তখন জিন্নাহ সাহেব একদিনের জন্যও বাংলাদেশের মানুষকে দেখতে আসেন নাই। সে জন্যেই আমরা বুঝতে পেরেছিলাম জিন্নাহ সাহেবের মনের অবস্থা কি। পশ্চিম পাকিস্তানে তিনি যা পেয়েছেন তা নিয়েই তিনি খুশি ছিলেন। বাংলাদেশকে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের একটি কলোনী এবং তার বোম্বের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের বাজার হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। এসব আমার ভালো লাগেনি। আমি যখন জানতাম তাদের সাথে আমি আপস করতে পারব না তখন তার (জিন্নাহর) সাথে দেখা করার দরকার আমি মনে করিনি।

       মুস্তাফা- ১৯৫২ সালের কথায় আসি। কারণ ১৯৪৮ সালের আন্দোলনই পরিণতি লাভ করে ১৯৫২ সালে। একুশে ফেব্রুয়ারী যে আন্দোলনের সূত্রপাত আপনি তখন জেলে। আমার মনে আছে ১৯৪৯ সালে যখন আওয়ামী লীগের জয় হয় জেলখানা থেকেও আপনি বাইরের কর্মীদের সাথে জেলখানার সিপাহীদের মারফত যোগাযোগ রক্ষা করতেন, উপদেশ দিতেন।

       মুজিব- তুমিও তখন আমার সাথে জেলে ছিলে।

       মুস্তাফা- তখন আমিও জেলে এক্সহিলাম। কিন্তু ১৯৫২ সালে আমি বাইরে ছিলাম। সেজন্যই আমি আপনাকে প্রশ্নটা করছি। ১৯৫২ সালেও তেমনিভাবে জেলে থেকে আপনি বাইরের কর্মীদের উপদেশ এবং নির্দেশ দিতেন।

       শেখ মুজিব- সে এক ইতিহাস। একটা গোপন কথা প্রকাশ করতে হয়। তুমি তো বেরিয়ে এলে। আমি জেল থেকে বেরুবার পর আবার জেলে গেলাম। ১৯৫০ সালের ডিসেম্বর মাসে আমি অসুস্থ হয়ে নিরাপত্তা বন্দী হিসেবেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসি। আমি জানুয়ারী পর্যন্ত সেখানে থাকি। এ সময় নাজিমুদ্দিন সাহেব প্রধানমন্ত্রী হয়ে আবার ঘোষণা করলেন যে, রাষ্ট্রভাষা একমাত্র উর্দুই হবে। সে সময়ে আমি হাসপাতালে। তখনও আমার রাজনৈতিক কর্মীদের সাথে যোগাযোগ ছিল। আমি দুই তিনটি গোপন বৈঠক করি মেডিকেল কলেজের কেবিনে। পুলিশরা কিন্তু আমার সঙ্গে সহযোগিতা করেছিল। ডিউটিরত আই বি অফিসাররাও আমার সাথে সহযোগিতা করেছিল। তরা সহযোগিতা না করলে এ বৈঠক আমি করতে পারতাম না। কয়েকজন আই বি অফিসারকে (যারা পাহারায় থাকতো) সাইকেলে নেতাদের বাড়ী পাঠিয়ে হাসপাতালে গোপন বৈঠক করার জন্য তাদের আনাতাম। রাত একটার পর বৈঠক হতো আমার কেবিনের পেছনে।

       দু’এক সময়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের আমার কেবিনের পেছনের বাথরুমেও আমরা বৈঠকে মিলিত হতাম এবং আলাপ-আলোচনা ও জল্পনা কল্পনা করতাম। এ সময়ে আমাদের গোপন বৈঠকে ঠিক হলো যে, নাজিমুদ্দিনের বক্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ধ্বনি তুলতে হবে এবং আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তরা প্রত্যেকেই এ ব্যাপারে একমত হলেন। আমি তাদের বললাম, তোমরা নেতৃত্ব দিয়ে সমস্ত দলমতের লোকদের ঐক্যবদ্ধ করো এবং গণআন্দোলন শুরু করো। যাই ঘটুক না কেন এর প্রতিবাদ করতে হবে। জন সমর্থন তোমাদের রয়েছে। সে অনুযায়ী ১৬ই ফেব্রুয়ারি থেকে আমি অনশন ধর্মঘট শুরু করবো।

       মুস্তাফা- এ সিদ্ধান্ত বৈঠকে জানিয়ে দিয়েছিলেন?

       শেখ মুজিব- হ্যাঁ, তাদের জানিয়ে দেই। ২১শে ফেব্রুয়ারী থেকে আন্দোলন শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো আলাপ-আলোচনার পর। ১৬ই ফেব্রুয়ারী থেকে আমি অনশন ধর্মঘট শুরু করবো এবং ২১শে ফেব্রুয়ারী থেকে বাংলা ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে আন্দোলন শুরু হবে। যে কোন কারণে হোক মেডিকেল কলেজ থেকে এ গোপন খবর সরকারের কানে যায়। সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জেলে পাঠিয়ে দেয়। আমি জেলে অনশন ধর্মঘট করি। আমার সঙ্গে ন্যাপের মহিউদ্দীনও ছিল। তাকে বললাম, তুইও আমার সঙ্গী হয়ে অনশন ধর্মঘট কর। সে রাজী হলো। সে সময় আমাকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেল থেকে ফরিদপুর জেলখানায় বদলী করে দিল যাতে আমি ঢাকা জেলে বসে এই আন্দোলনের সাথে কোন সংযোগ রাখতে না পারি। ১৯৪৯ সালে জেলাখানায় থাকাকালে সিপাহী ও জেল কর্মচারীদের বাইরের সাথে আমি যে রকম যোগাযোগ রাখতাম এবার যেন তা না করতে পারি যেজন্য কর্তৃপক্ষ ঢাকা থেকে ফরিদপুর জেলে চালান করে দেয়। কিন্তু আমি এবার যদ্দুর সম্ভব আন্দোলনের প্রস্তুতি এবং পরিকল্পনা সব ঠিক করে দিয়েছিলাম। তারপর একুশে ফেব্রুয়ারী এই আন্দোলন শুরু হয়। সে ঘটনা সবাই জানে কি করে আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়, আমাদের ভাইদের গ্রেফতার করা হয়। জেল তখন ভরে যায়। অনেক রকম বদনামও আমাদের দেয়া হতো, আন্দোলনের ব্যাপারে আমাদের বাইরের থেকে শক্তি ও সাহায্য পেয়ে থাকি। কিন্তু এটা সত্য নয়। এ আন্দোলন বাংলার মাটির আন্দোলন। এ আন্দোলন শুধু বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন ছিল না, এ আন্দোলন ছিল সামগ্রিকভাবে বাংলার মুক্তির আন্দোলন। বাংলার মুক্তির আন্দোলন সেদিন থেকে শুরু হয়ে যায় এবং তার চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে বাংলাদেশ আজ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র।

       মুস্তাফা- ১৯৫২ সালের ঢাকার রাজপথে যে রক্ত ঝরেছিল আমার মনে হয় সে রক্তই ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য পথ নির্দেশ করেছিল।

       শেখ মুজিব- বায়ান্ন সালের সে রক্ত, চুয়ান্ন সালের সে রক্ত, আইয়ুবের সামরিক আইনের সময়ে সে রক্ত, ’৬৬ সালের ৬-দফা আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সে রক্ত, ১৯৬৯ সালে আমি যখন ষড়যন্ত্র মামলায় বন্দী ছিলাম তখন ১১- দফার আন্দোলনের মাধ্যমে ছাত্রদের সে রক্তদান ১৯৫২ সাল থেকে শুরু হয়নি। রক্তদান শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ সাল থেকে।

       ১৯৪৮ সালে হয়ত লোক মারা যায়নি, কিন্তু এত লোক আহত হয়েছিল সেদিন যে হাসপাতালে জায়গা ছিল না। এছাড়াও বাংলার বিভিন্ন এলাকায় রক্ত দিয়েছিল মানুষ। ১৯৪৮ সালে যশোর, ফরিদপুর, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে ছাত্ররা রক্ত দিয়েছিল। রক্ত দেয়া শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ সাল থেকে, পরিণতি কিছুটা আসে ১৯৫২ সালে। আর শেষ পরিণতি ১৯৭১ সালে। আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন সাম্প্রতিককালে শুরু হয়নি।

       এ আন্দোলন বহুদিন থেকে শুরু হয়েছে। বলা যায়, ১৯৪৭ সালে কোলকাতার সিরাজদ্দৌলা হোস্টেলে ছাত্রদের নিয়ে যে সভা করেছিলাম সেদিন থেকেই বাংলার মুক্তির আন্দোলন শুরু হয়। এ আন্দোলন দীর্ঘ হয়েছে এবং ত্যাগও অনেক বেশি করতে হয়েছে। অনেক রক্ত আমাদের দিতে হয়েছে। কোন দেশ বা জাতি তার স্বাধীনতার জন্য এত রক্ত দেয়নি। আমরা এমন একটি অসভ্য জাতির হাতে বন্দী হয়ে পড়েছিলাম যাদের মধ্যে নেই মনুষ্যত্ব, যাদের মধ্যে নেই মানবিক কোন গুণাবলী, যারা ক্ষমতা আর বন্দুক-গুলী ছাড়া দুনিয়ার কিছু বোঝে না। যে রক্ত স্বাধীনতার জন্য বাংলার মানুষকে দিতে হয়েছে দুনিয়ার ইতিহাসে আর কাউকে তা দিতে হইনি। বাংলাদেশে আজ হাহাকার। বাংলাদেশে এমন কোন ঘর নাই যেখানে আমার ভাই-বোন বা আমার মেয়েদের বেইজ্জতি করা হয়নি। অর্থনীতি চুরমার করে দিয়েছে, আমার শিক্ষিত সমাজ, বৈজ্ঞানিক, ডাকার, সাংবাদিক ও শিক্ষকদের হত্যা করেছে। কিন্তু তাতেও বাংলার মানুষ দমেনি। তারা শুধু রক্ত দেয়নি স্বাধীনতাও অর্জন করেছে। কিন্তু স্বাধীনতার পরিপূর্ণতা যদি (সাক্ষাৎকারের বাকি অংশটুকু পাওয়া যায়নি)

Reference: 

দৈনিক বাংলার বাণী, ২৩ ফেব্রুয়ারি, সম্পাদকীয় পাতা 

Unicoded by তুষার মন্ডল