You dont have javascript enabled! Please enable it! এএইচএম কামারুজ্জামান হেনার পিতামহ হাজী লাল মােহাম্মদ সরদার সম্পর্কে বিস্তারিত - সংগ্রামের নোটবুক

এএইচএম কামারুজ্জামান হেনার পিতামহ হাজী লাল মােহাম্মদ সরদার সম্পর্কে বিস্তারিত

দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান এএইচএম কামারুজ্জামানের ধমনীতে ছিল মানুষের কল্যাণব্রতের রাজনৈতিক আদর্শ। প্রসঙ্গত স্মরণীয়, আবুল হাসনাত মােহাম্মদ কামারুজ্জামানের পিতামহ উপমহাদেশের রাজনীতিতে কেবল রাজশাহী নয়, তৎকালীন সারা উত্তরবাংলার প্রাণপুরুষ ছিলেন। তাঁর পিতামহ হাজী লাল মােহাম্মদ সরদার ছিলেন বিদ্যানুরাগী, সমাজ সংস্কারক ও সৎ-সাহসী রাজনীতিবিদ। অবিভক্ত বঙ্গদেশে বিশেষত পূর্ববঙ্গে তখনও আধুনিক শিক্ষার বিস্তার ঘটেনি। সেই সময় হাজী লাল মােহাম্মদ সরদার রাজশাহীর বিভিন্ন অঞ্চলে শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ গড়ে তােলেন। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত আলােকিত সমাজ গড়ার লক্ষ্যে নানা কর্ম-উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তার সম্পর্কে মূল্যায়ন প্রসঙ্গে অধ্যাপক এস এম আবদুল লতিফ লিখেছেন :

রাজশাহীতে এ সময়ে মুসলিম নেতৃত্বের বেশ অভাব ছিল। হাজী লাল মােহাম্মদ একজন বিত্তবান ব্যক্তিতে পরিণত হওয়ার পর ক্রমান্বয়ে সমাজ কল্যাণে এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে আত্মনিয়ােগ করেন। তিনি দুবার অবিভক্ত বাংলার লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য (এমএলসি) নির্বাচিত হন। হাজী সাহেব ছিলেন চরকানুরাগী ও কংগ্রেস সমর্থক। তার বৃদ্ধা মাতাও ছিলেন চরকানুরাগী। একসময় তিনি ওহাবী আন্দোলনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। পরবর্তীতে শেরে বাংলা ফজলুল হক এর কৃষক প্রজা পার্টিতে যােগদান করেন। শেরে বাংলার নেতৃত্বের প্রতি ছিল তার অগাধ বিশ্বাস। কখনাে কখনাে হাজী লাল মােহাম্মদ শেরে বাংলার পক্ষ অবলম্বন করে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর সঙ্গে রাজনৈতিক বিতর্কে লিপ্ত হতেও দ্বিধাবােধ করেননি। তিনি ছিলেন অত্যন্ত নির্মোহ, নির্ভীক ও স্বাধীনচেতা কল্যাণকামী মানুষ। ফলে ব্যক্তিগত জীবনে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে সততা ও কর্মদক্ষতার গুণে একদিকে হয়েছিলেন বিত্তশালী, অন্যদিকে ছিলেন অহিংসপন্থী। তাই দারিদ্র্যের মধ্যেও সততা, চারিত্রিক দৃঢ়তা ও উদারতার আকর্ষণে তিনি সবার কাছে প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। তাঁর সততা, শ্রম ও নিষ্ঠায় অভিভূত হয়ে ইংরেজ ইঞ্জিনিয়ার নেলসন সাহেবের সহায়তায় প্রথমে ব্যবসায়ী এবং পরে জমিদাররূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। আবার শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টিতে যােগদান করে তিনি তাঁর প্রবর্তিত প্রজাস্বত্ব আইন প্রণয়নেও সমর্থন ব্যক্ত করেছিলেন। শেরে বাংলার একনিষ্ঠ সমর্থক হিসেবে তিনি ১৯২৬ সালে দ্বিতীয়বার এমএলসি নির্বাচিত হয়ে এই বিলের পক্ষে জোরালাে ভূমিকা রাখেন। এ প্রস্তাবে ছিল প্রজাদের নিজ জমিতে গৃহনির্মাণ, পুকুর খনন, বৃক্ষরােপণ বা কর্তন প্রভৃতি ক্ষমতা দান এবং পূর্ববর্তী নিষেধাজ্ঞার বিলােপসাধন। এই কারণেও হাজী সাহেব শেরে বাংলার আরাে প্রিয় রাজনৈতিক সহচর হয়ে ওঠেন। কেবলমাত্র শেরে বাংলা ফজলুল হক নয়, ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলনে হাজী সাহেবের ভূমিকা উপমহাদেশের প্রখ্যাত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। তিনি উত্তরবঙ্গের জমিদারদের মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। হাজী সাহেবের জমিদার বাড়ি হয়ে ওঠে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গের নিকট এক পরম নির্ভরতার স্থান।

মহাত্মা গান্ধী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, সরােজিনী নাইডু, ইসমাইল হােসেন সিরাজী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদি, কবি কাজী নজরুল ইসলাম, সঙ্গীতশিল্পী আব্বাস উদ্দীন, মাওলানা আকরাম খাঁ প্রমুখ প্রখ্যাত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সমাজসেবক, কবি-সাহিত্যিক, সঙ্গীতশিল্পী এবং সাংবাদিকের আবির্ভাব ঘটেছিল তার জমিদার বাড়িতে।
স্বীকার্য যে, ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন ও ১৯৪০ সালের লাহাের প্রস্তাবে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের ভূমিকা উপমহাদেশের ইতিহাসে স্মরণীয় ঘটনা। যদিও লাহাের প্রস্তাব উপস্থাপনের সময় হাজী লাল মােহাম্মদ জীবিত ছিলেন না, তবুও শেরে বাংলার নেতৃত্ব ও স্বায়ত্তশাসনের দিকে এগিয়ে চলার যােগ্য সহচর ছিলেন হাজী সাহেব। কারণ, বাঙালি মুসলমানের মধ্যে যদিও তখন পর্যন্ত স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীন রাষ্ট্রচিন্তার বিষয়টি সঞ্চারিত হয়নি, তবুও শেরে বাংলার নেতৃত্বে পূর্ববঙ্গের মুসলিম কৃষকপ্রজা সাধারণের মুক্তির সােপান যে নির্মিত হতে চলেছিল হাজী লাল মােহাম্মদ তা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলেন। শেরে বাংলা ফজলুল হক প্রণীত ঋণ সালিশী বাের্ডের সদস্য হিসেবেও কাজ করেছিলেন।

তিনি এই সত্যটিও উপলব্ধি করেছিলেন যে, কৃষিজীবী সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববঙ্গের মানুষের মুক্তি ছাড়া বাংলার মুক্তি সম্ভব নয়। পূর্ববঙ্গে অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডই হলাে কৃষি। কৃষক বাঁচালেই দেশ বাঁচবে। তাই হাজী লাল মােহাম্মদ তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতায় অন্যান্য এমএলসি-র চেয়ে যে অগ্রগামী ছিলেন তা শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকও উপলব্ধি করেছিলেন। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলাে, হাজী সাহেব নিজে একজন সামন্ত ভূস্বামী ও শাসকশ্রেণীর প্রতিনিধি হয়েও প্রজাস্বত্ব বিলের পক্ষে প্রস্তাব উত্থাপন করে উদার চিত্তের একজন জনবান্ধব রাজনীতিকের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। কৃষককে বাঁচাতে চেয়েছেন। কৃষকের স্বার্থকে দেশের স্বার্থ বলে বিবেচনা করেছেন। প্রসঙ্গটি সেই সময় অনেকের কাছেই বিস্ময়কর ও সমালােচনার বিষয় ছিল তা অপর একটি সূত্রে জানা যায়। লেখক বলেছেন :

আইন সভায় তাঁর বন্ধু কৌতুকপ্রিয় ব্যক্তি বর্ধমানের জনাব আবুল কাশেম রসিকতা করে বলেছিলেন—হাজি সাহেব শেষে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারলেন। হাজী সাহেব হেসে বলেছিলেন, কি করব বলুন, কারাে পায়ে মারলে আইনের বিচারে শাস্তি হবে, আর নিজের পা একদিন সেরে যাবে কিন্তু এতে যে লক্ষ কোটি মানুষের চলার পা শক্ত হবে। তার যে আত্মতৃপ্তি সেটা তাে আমিই পাবাে। কিন্তু আপনি আফসােস করবেন।

বাংলার ইতিহাসে পরাধীন বাঙালি মুসলমানের পুঞ্জীভূত আফসােস ছিল একথা হাজী সাহেব ভালই বুঝতেন। বুঝতেন বলেই তিনি ভূমিতে প্রজাদের স্বত্বপ্রতিষ্ঠায় ছিলেন অগ্রচারী। কেননা অষ্টাদশ-উনবিংশ শতাব্দী জুড়েই বাংলার কৃষিভিত্তিক ধর্মীয় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ ছিলেন অশিক্ষিত ও ধর্মান্ধ। ধর্মীয় জাতিভেদ প্রথার গোঁড়ামি তাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। তবুও ১৮৫৭ সালের সিপাহীবিদ্রোহ, ১৮৫৮ থেকে ১৮৬০ পর্যন্ত বাংলার চাষীদের নীলবিদ্রোহ, ১৮৭২-৭৩ সালে বাংলার কৃষকবিদ্রোহ ছিল খেটে খাওয়া মানুষের অসাম্প্রদায়িক মুক্তির লড়াই। অর্থনৈতিক মুক্তির লড়াই। প্রজাসাধারণের সংঘশক্তির মুক্তি ছাড়া যে বাঙালির মুক্তি সম্ভব নয় একথা হাজী লাল মােহাম্মদের মতাে অল্পসংখ্যক নেতাই সেই সময় উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতিতে বাংলার মুসলমান সমাজ যে কত পশ্চাৎপদ তা তিনি উপলব্ধি করেছিলেন বলেই রাজশাহী অঞ্চলে শিক্ষা বিস্তারে মনােযােগী হন। তিনি অনেক শিক্ষা ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তােলেন। বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য রাজশাহীর সব চাইতে ঐতিহ্যবাহী সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ‘রাজশাহী এসােসিয়েশন (১৮৭২)-এর সঙ্গে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই যুক্ত ছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা রাজা প্রমােদনাথ রায়বাহাদুর হাজী লাল মােহাম্মদ সরদারকে অত্যন্ত সমীহ করতেন। সেই জন্যই রাজশাহী এসােসিয়েশন প্রতিষ্ঠাকালে এক্সিকিউটিভ পরিষদের একমাত্র মুসলিম সদস্য হিসাবে হাজী লাল মােহাম্মদকে তিনি অন্তর্ভুক্ত করেন। রাজা প্রমােদনাথ রায় বাহাদুর রাজশাহী অঞ্চলে শিক্ষা-সংস্কৃতি ও সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে রাজশাহী এসােসিয়েশন প্রতিষ্ঠাকালীন একমাত্র মুসলিম সদস্য হাজী লাল মােহাম্মদকে সঙ্গে নিয়ে কাজ আরম্ভ করেন। রাজশাহীর সামাজিক-সাংস্কৃতিক শিক্ষা ও উন্নয়নের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুই ছিল রাজশাহী এসােসিয়েশন’। রাজশাহী এসােসিয়েশনের উদ্যোগেই ১৮৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ঐতিহ্যবাহী রাজশাহী কলেজ। কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের অধীনে রাজশাহী কলেজ ব্রিটিশ বাংলার শিক্ষা বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। হাজী লাল মােহাম্মদ এই প্রতিষ্ঠানের গােড়াপত্তনকালে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন। সারা উত্তরবঙ্গের মেধাবী শিক্ষার্থীরা এই প্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষার সুযােগ পান। অর্থাৎ এই অঞ্চলের শিক্ষা বিস্তারে প্রেসিডেন্সি কলেজের পরই রাজশাহী কলেজ ছিল অন্যতম প্রতিষ্ঠান। হাজী
(pp. 19-22)
লাল মােহাম্মদ হিন্দু জমিদারদের সঙ্গে অসাম্প্রদায়িক উদার মনােভাব নিয়ে কাজ করতেন। জনকল্যাণমূলক নানামুখী কর্মকাণ্ডে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। রাজশাহীতে ১৯০৬ সালে ‘মােহামেডান এসােসিয়েশন’ নামে অপর একটি সমৃদ্ধ সংগঠন গড়ে ওঠে। খান বাহাদুর এরশাদ আলী খান চৌধুরী ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং হাজী লাল মােহাম্মদ প্রতিষ্ঠানটির সাংগঠনিক সদস্যপদ লাভ করেন। মােহামেডান এসােসিয়েশন মুসলিম জনগণের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সাংস্কৃতিক জাগরণে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা রাখে। এই ক্ষেত্রে হাজী লাল মােহাম্মদ সরদার ছিলেন বেশ আন্তরিক ও নিবেদিতপ্রাণ। বিষয়টি লক্ষণীয়, রাজশাহী এসােসিয়েশন ও রাজশাহী মােহামেডান এসােসিয়েশন প্রতিষ্ঠান দুটো হিন্দু ও মুসলিম জমিদারগণ পৃথক পৃথক উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করলেও দুটো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেই হাজী লাল মােহাম্মদ যুক্ত ছিলেন। স্বভাবত মধ্যযুগের পুথিসাহিত্যের উদার অসাম্প্রদায়িক কবি আবদুল হাকিমের (১৬০০-১৬৭০) সেই বাণী মনে পড়ে যায় – 
যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী
সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।

মধ্যযুগ থেকেই হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে ভাষা-সংস্কৃতি-সাহিত্য, শিল্প-বাণিজ্য প্রশাসন-রাজনীতি, অর্থনীতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তােলার ক্ষেত্রে উভয় সম্প্রদায়ের কিছু অঘচারী চিন্তার মানুষের কার্যকর ভূমিকা ছিল। সেই উদার বুদ্ধিবৃত্তিকচর্চা ও ইতিবাচক মনােভাব যে হাজী লাল মােহাম্মদ ধারণ করতেন, লালন করতেন তা বেশ বােঝা যায় তার কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। পাশ্চাত্য শিক্ষা সংস্কৃতি-সমাজ-অর্থনীতির ভাবনা যে পূর্ববঙ্গের সমাজে নতুন তরঙ্গ সৃষ্টি করেছিল, ধীরে ধীরে প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় নিশ্চলতাগুলাে সমাজদেহ থেকে খসে পড়ছিল। তা সম্ভব হয়েছিল হাজী লাল মােহাম্মদ সরদারদের মতাে মুক্তচিন্তার মানুষের উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই। সমাজে শিক্ষা ও বুদ্ধিবৃত্তিকচর্চার সুবাতাস বইয়ে দিতে হবে, এই ব্যাপারে হাজী লাল মােহাম্মদের ছিল প্রেরণাসঞ্চারী ভূমিকা। তৎকালীন মুসলিম জাগরণ ও জনসেবার লক্ষ্যে ১৮৯১ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘আঞ্জুমানে হেমায়েতে ইসলাম সমিতি নামে আরাে একটি সংগঠন। তিনি ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। আধুনিক শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া মুসলিম যুবসমাজের উদার মানবিক ও সমৃদ্ধজীবন গঠনই ছিল এই সমিতির লক্ষ্য। মানবসমাজের উন্নতিই ছিল আঞ্জুমানে হেমায়েতে ইসলাম সমিতির মূল উদ্দেশ্য। এই প্রতিষ্ঠানের মুদ্রিত গঠনতন্ত্রে বলা হয়—১. কি উপায়ে ধর্মের উন্নতি হইবে ২. কি উপায়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের লুপ্ত গৌরব ফিরিয়া আসিবে, ৩. কিসে নায্য জীবিকার (হালাল রুজির) পথ প্রশস্ত হইবে, ৪. কি উপায়ে মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্যার আলােক প্রবেশ করিবে ও মুসলমান বালকদিগকে বিদ্যা শিক্ষায় সাহায্য করা যাইবে, এই সকল বিষয় পরামর্শ করিয়া গভর্ণমেন্টের আইন সঙ্গত উপায় অবধারণ ও তাহা কার্যে প্রচলন; ইহাই এই সভার উদ্দেশ্য। অর্থাৎ ধর্ম, সমাজ ও শিক্ষার উন্নতি সাধনের উদ্দেশ্যে আঞ্জুমানে হেমায়েত ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়। হাজী লাল মােহাম্মদ সরদার রাজশাহী আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম (১৮০৭) নামে আরাে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। এই ক্ষেত্রে তৎকালীন ইসলামি চিন্তাবিদ মৌলভী কফিল উদ্দীন আহমদ ছিলেন তাঁর অন্যতম সহযােগী। জনসেবামূলক এই সমিতিটি মানুষের কল্যাণ ও জাগরণের ক্ষেত্রে নানমুখী কর্মসূচি গ্রহণ করে বিপুল জনসম্পৃক্ততা গড়ে তুলেছিল। ফলে হাজী লাল মােহাম্মদ বিভিন্ন সভাসমিতিতে নিয়মিত জনসংযােগ করে মানুষের নিকটসান্নিধ্যে যান এবং বারবার নির্বাচনে বিজয়ী হন। আইন সভার সদস্য হয়ে তিনি রাজশাহীর মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে সারা জীবনই নিজেকে নিয়ােজিত রাখেন। শিক্ষা, সমাজসেবার পাশাপাশি হাজী লাল মােহাম্মদ সরদার বরেন্দ্র অঞ্চলের ঐতিহ্য-অনুরাগীও ছিলেন। বাংলার প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য ১৯১০ সালে রাজশাহীতে প্রতিষ্ঠিত হয় বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম। মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠায় হাজী লাল মােহাম্মদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত কার্যকর ও ইতিবাচক। তিনি খুব সৌখিন মানুষ ছিলেন। তকালীন বরেন্দ্র অঞ্চলের যােগযােগ ব্যবস্থা তেমন উন্নত ছিল না। তবুও ব্যক্তিগতভাবে তিনি ‘সােভরলেট মােটরগাড়ি ব্যবহার করতেন। তাঁর জমিদারী এস্টেট পরিচালনা ছাড়াও নানা সামাজিক ও জনকল্যাণমূলক কাজে তিনি এই মােটরগাড়ি নিয়ে যাতায়াত করতেন। বরেন্দ্রের বিভিন্ন প্রত্যন্ত জনপদে গিয়ে প্রাচীন ঐতিহ্যের উপকরণ মুদ্রা, দলিল, নানা প্রকার মূর্তি সংগ্রহ করে বরেন্দ্র জাদুঘরকে সমৃদ্ধ করে তােলেন। সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা হচ্ছে হাজী সাহেবের এই মােটরগাড়িটি কবি কাজী নজরুল ইসলামও ব্যবহার করেছিলেন। ১৯৩০ সালে রাজশাহীতে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘দি মুসলিম ক্লাব’। এই ক্লাবটি উদ্বোধনের জন্য কবি কাজী নজরুল ইসলামকে আমন্ত্রণ জানানাে হয়। কবি নজরুল রাজশাহীর মুসলিম যুবসম্প্রদায়ের আমন্ত্রণে রাজশাহী আসেন। সেই সময় কলকাতা থেকে নাটোর স্টেশনে আসতে হতাে। নাটোর রেলস্টেশন থেকে হাজী সাহেবের মােটরগাড়িতে করে কবিকে রাজশাহীতে নিয়ে আসা হয় এবং তাঁকে হাজী সাহেব অত্যন্ত সমাদর ও সম্মাননা জ্ঞাপন করেন।

উনবিংশ শতাব্দীর শেষ ও বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকগুলােতে পূর্ববঙ্গের হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের বাঙালির মধ্যে ছিল আত্মজাগরণের পর্ব। এই পর্বে হিন্দু রাজাদের পাশাপাশি মুসলিম জমিদার হাজী লাল মােহাম্মদও নানামাত্রিক কর্মকাণ্ডের জন্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের পুরােধা ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন। রাজা কুমার শরৎকুমারের একটি অনন্যসাধারণ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি। এই সমিতির নানামুখী কার্যক্রমে হাজী লাল মােহাম্মদ উদারচিত্তে সহযােগিতা অব্যাহত রেখেছিলেন। পাল-সেন শাসন আমলে এবং মােঘল শাসন আমলে বরেন্দ্র সভ্যতার সমস্ত নিদর্শন সংগ্রহ ও সংরক্ষণে তিনি বিশেষ অবদান রেখেছেন। এই সমিতিকে তিনি নানাভাবেই সাহায্য করেন। এসব কর্মকৃতি তাকে সর্বজনশ্রদ্ধেয় করে তােলে। নানামুখী সংস্কার ও উন্নয়নমূলক কাজে তিনি নিজেকে নিয়ােজিত রাখায় তাঁর কাদিরগঞ্জের বাইশ বিঘা জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত মিয়াবাড়িতে নিত্য অতিথির আগমন ঘটতােই। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, রাজশাহীর বুনিয়াদি মুসলিম পরিবার হিসেবে হাজী লাল মােহাম্মদ সারা বাংলায় ছিলেন পরিচিত এবং সর্বজনশ্রদ্ধেয়। তিনি দুইবার হজ্বব্রত পালন করেন। ১৯৩৬ সালে এই কীর্তিমান মানুষটি ইহজাগতিক মায়া ত্যাগ করে পরলােক গমন করেন।

Reference:

এ এইচ এম কামারুজ্জামান – সালিম সাবরিন