You dont have javascript enabled! Please enable it!

ঢাকা প্রেসক্লাবের উপর ট্যাংকের বোমাবর্ষণঃ একটি প্রতিবেদন

২৫ শে মার্চের কালোরাত্রিতে কেমন ছিল আজকের বাংলাদেশ নিয়ন্ত্রণকারী সচিবালয় এবং প্রেসক্লাব? ’৭২ সালে বাংলার বাণীতে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের গণহত্যা’-য় সাংবাদিক ফয়েজ আহমেদের জবানীতে চলুন দেখে আসিঃ

“প্রেসক্লাবের সম্মুখ দিয়ে যে রাজপথ গেছে, সেটা ছিল সেকেন্ড অপারেশনাল রুট-রাজধানী ঢাকার উপর গণহত্যা অভিযান জল্লাদ বাহিনীর দ্বিতীয় সড়ক। এখন সেটা স্বাধীন বাংলাদেশের ফরেন অফিস এবং এক সময় কমিশনার্স অফিস বলা হতো। সেই ইমারত আজ অঙ্গন রাতারাতি গড়ে উঠেছিল গেরিলা কৌশলে ট্রেনিংপ্রাপ্ত জেনারেল মিঠায় অধিনস্থ অফিসারদের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি।

ঢাকার সাংবাদিকদের ক্লাবটা তার প্রায় উল্টো দিকে গুলী গোলার পাল্লার মধ্যে।

মুক্তিযুদ্ধের ন’মাসে প্রত্যেকটি নাগরিকের চরম বিপর্যয় কাহিনীগুলো এক দিকে যেমন পৃথক পৃথক সত্তা নিয়ে প্রকাশ পায়, অপরদিকে সব ঘটনার সামগ্রিক একটা আদল আছে। ঘটনার প্রচণ্ডতা, তার বীভৎস রূপ আর পরিণতি প্রকৃত বিচারে একই। দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের উপর বিভীষিকাময় আক্রমণ ও অবিশ্বাস হত্যাকাণ্ডের সার্বিক ইতিহাসের মধ্যে প্রেসক্লাবের ঘটনা অসাধারণ উল্লেখযোগ্য কিছু নয়।

এই ক্লাবটাকে কেন্দ্র করে ইয়াহিয়ার সামরিক শাসনবিরোধী কোন ব্যাপক প্রত্যক্ষ বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল বা সে সময় সেখানে শাসন বিরোধী আন্দোলন অত্যন্ত প্রকট ছিল, তা নয়। তবে সৎ ও বলিষ্ঠ সাংবাদিকগণ সে সময় প্রকাশ্যভাবে বাংলাদেশের স্বাধিকারের প্রতি, মুক্তির প্রতি সমর্থন জুগিয়েছেন। তখন বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের কণ্ঠে যে ধ্বনি উঠতো সেসব সাংবাদিকের মুখমণ্ডলে তা প্রতিবাদ হতো- অনেকের কলমের ডগায় সেটা আরো স্পষ্ট ছিল। দেশের হাজার হাজার বিভিন্ন মতের প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা যেভাবে সমর্থন জুগিয়েছিল শেখ সাহেবকে তাঁর হস্ত শক্তিশালী করার জন্যে, ঢাকায় বা অন্যান্য স্থানের সাংবাদিকরাও তেমনি দিয়েছিলেন। তা’ছাড়া এমন অনেক বন্ধু ছিলেন, যারা তাস পেটানো, আড্ডা জমানো, সস্তায় খাদ্য গ্রহণ ব্যতিত কোন ঝামেলায় যেতেন না।

সাংবাদিকদের ক্লাব কক্ষের এই সাধারণ পরিবেশটা অবশ্যই অস্ত্রধারী বিদ্রোহীদের সমতুল্য নয়। এমনকি অনেকে এই ক্লাবগোয়ারদের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ এনেছেন। বিরূপ মন্তব্য করতে কুণ্ঠা বোধ করেননি। সেক্ষেত্রে তবুও শহরের প্রাণকেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত প্রেসক্লাবের উপর সেল নিক্ষেপের প্রয়োজন দেখা দিল কেন? ক্লাব ইমারত ধ্বংস করে দিলেই যে সচেতন সাংবাদিকের বিলুপ্তি ঘটবে, তা’নয়। সাংবাদিক ইউনিয়ন বা ক্লাব কমিটির সদস্য বিনা দ্বিধায় সামরিক শাসকদের পদানত হয়ে সর্বক্ষেত্রেই যে কলমের ব্যবসা করবেন, সে কথাও গ্রহণযোগ্য হবে না। এবং ব্রাস হ্যাট জেনারেলগণ সে কথা জানতেন।

তবু কেবলমাত্র খেয়ালের বশে নয়, পরিকল্পিত পন্থায় প্রেসক্লাবের উপর ২৫শে মার্চের রাতে ট্যাঙ্ক থেকে শেলবর্ষণের তাগিদ দেখা দেয়।

দেড় বছর আগের প্রেসক্লাবের শেল বর্ষণের পর থেকে বন্ধু- বান্ধব ও অনেকে এই ঘটনার কারন সম্পর্কে বহু আলোচনা করেছেন। সমগ্র দেশটা পুড়িয়ে খাক করে দেয়ার, ত্রিশ লক্ষ শান্তি প্রিয় মানুষকে নির্বিচারে হত্যার যেমন কোন ন্যায়সঙ্গত ব্যাখ্যা বা যুক্তি বাইরে থেকে সভ্য সমাজের পক্ষে উপস্থিত করা সম্ভব হয়নি, প্রেসক্লাবের ব্যাপারে তাই ঘটেছে। কেউ বলেছেনঃ সাংবাদিক সমাজকে ভীত ও সন্ত্রস্ত করে তোলার জন্যে এটা ছিল তাদের আস্তানার উপর প্রতীক হামলা। আর এক লোক বলেন, প্রেসক্লাবে গেরিলারা প্রতি আক্রমণের জন্যে সুরক্ষিত চৌকি প্রতিষ্ঠা করেছিল বলে হয়তো ভুয়া তথ্য তাদের কাছে কেউ পৌঁছে দিয়েছিল। কেউ কেউ বলেন, সে রাতে প্রেসক্লাবের বহু সাংবাদিক আটক পড়েছেন বলে কোন সূত্র থেকে খবর দিয়েছিল। কেউ কেউ বলেন, সে রাতে প্রেসক্লাবে বহু সাংবাদিক আটকা পড়েছেন বলে কোন সুত্র থেকে খবর হয়তো সামরিক অফিসারদের কাছে পৌঁছেছিল। এই সুযোগটা তারা ছাড়তে চায়নি এবং খবরটা দেরীতে তারা পায় বলেই ভোরে রাতে আক্রমন হয়।

রাত তখন সাড়ে দশটা হবে, আমি প্রেসক্লাবের আশ্রয় নিয়ে বাধ্য হলাম। আর এই কারনেই সে রাতে ক্লাবে শেল নিক্ষেপের কারন সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারনা করা আমার পক্ষে অনেকটা সম্ভব হয়েছে।

এক্ষেত্রে ২৫শে রাতে প্রেসক্লাবের দু’টো রহস্যজনক টেলিফোন কলের উল্লেখ স্বাভাবিকভাবেই আসে।

ক্লাবে প্রবেশের দশ মিনিট পরেই পরপর দু’টো কল আসে এক বিশেষ আধা সাংবাদিকের নামে। এই ভদ্রলোক বিভিন্ন রাজনৈতিক মহল, উকিলদের লাইব্রেরী, সাংবাদিকদের আড্ডা ও অফিসারদের ক্লোজপার্টিসহ সর্বত্রই মোটামুটি পরিচিত। উর্দু প্রস্বর মিশ্রিত বাংলা ও ইংরেজিতে অপর প্রান্ত থেকে উক্ত আধা-সাংবাদিকের সন্ধান করা হচ্ছিল। ক্লাবের ম্যানেজার জনাব কুদ্দুস আমার হাতে ফোন তুলে দিয়ে বললেন, স্যার, চড়া গলায় কা’কে যেন খুঁজছেন ভদ্রলোক।

রুক্ষ কণ্ঠস্বর ও বিশেষ ভাষার ব্যবহার থেকে সহজেই অনুমান করা সম্ভব যে, যে সামরিক ঘাঁটি বা সেনানিবাস থেকে কেউ টেলিফোন করছে। উক্ত আধা- সাংবাদিককেই না পেয়ে সেই ভদ্রলোক ক্ষেপে উঠেছিলেন ঠিকই, তবে কণ্ঠে তার নৈরাশ্যও ছিল।
টেলিফোন কলের এই ঘটনা কোন অর্থ হয়তো বহন করে, তবে এ থেকে প্রেসক্লাব আক্রমণের কারন সন্ধান করা কষ্টকর।

এ সময়টা সমগ্র শহরের উপর সুপরিকল্পিতভাবে একযোগে আক্রমন চলছে।

তখনো ক্লাবের পেছনে বা সামনের দিকে গোলাগুলী আসেনি। তোপখানা রোডের কাছে ‘স্বরাজ’ অফিস থেকে বেরিয়ে আমি গভীর অন্ধকারে আচ্ছন্ন রাজপথে পড়ে সেকেন্ড গেটের উল্টো দিকে বোকার মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম। একটা রিকশা ছিলনা। কিন্তু সে সময় এই আঙ্গটায় কিছুসংখ্যক দুরন্ত যুবক অন্ধকারের মধ্যে সামরিক যান চলাচল বন্ধ করার জন্যে ব্যারিকেড তৈরি করছিল, ইট ড্রাম কাঠের গুঁড়ি দিয়ে।

একটা রিক্সা এসে সেখানে আটকা পড়ল। চালক ত্বরিত গতিতে রিক্সা ঘুরিয়ে মেডিক্যাল কলেজের দিকে ছুটল। আমি জোর করে ধরে তাকে অনুরোধ করেছিলাম। আমাকে একটু আজিমপুরায় নামিয়ে দিন। পুরানো হাইকোর্টের প্রবেশ গেটের কাছে প্রথম বাঁধা পেলাম গাছ আর ড্রাম ফেলে ব্যারিকেড করা হয়েছে। সেটা পেরিয়ে কার্জন হলের গেটের সামনে গিয়ে সম্পূর্ণ থেমে যেতে হল। অন্ধকার থেকে কয়েকজন লোক একে বলল, অন্য দিকে যান। আর্মি আসবে। সেখানেও ব্যারিকেড।

রিক্সাওয়ালা বলল, স্যার, আমি আর যাব না ডর করছে।

আমি তাকে ফিরিয়ে আনলাম সেকেন্ড গেটের দিকে- আজিমপুরার বাসায় সে রাতে আর যাওয়া হল না প্রেসক্লাবের সম্মুখে আমাকে নামিয়ে রিক্সাওয়ালা উধাও হয়ে গেল।

আমি বাধ্য হলাম প্রেসক্লাবের আশ্রয় নিতে। ক্লাব ম্যানেজার কুদ্দুস আর দারোয়ান খয়ের ছাড়া কেউ তখন ছিল না। খয়ের বাইরের গেটে তালা দিয়ে রেখেছে। কুদ্দুস বাসায় ফেরার জন্য আয়োজন করছিল।

মর্নিং নিউজের শহিদুল হককে এবং অবজারভারের মুসা ও কে জিকেও কয়েকবার টেলিফোনে চেষ্টা করলাম- লাইন পেলাম না। শেষ পর্যন্ত শহিদুল হককে পেলাম, কিন্তু তখন আর আমাকে প্রেসক্লাব থেকে উদ্ধার করার উপায় ছিল না। সে উৎকণ্ঠার সাথে জবাব দিল, আমাদের সামনে চৌমাথায় আর্মি। গাড়ী বের করা যাবে না। ক্লাবের একটা কক্ষে রাত কাটানো ছাড়া তখন আর উপায় কি !!

এরপরই সে দুটো রহস্যজনক টেলিফোন কল এলো। প্রেসক্লাব আক্রমণের সাথে এই ফোন কলের কোন যোগসুত্র রয়েছে কিনা প্রতিষ্ঠা করা কষ্টকর। তবে প্রেসক্লাব আক্রমণের যত কারণই থাকুক না কেন, একটা কারণ আমার কাছে উল্লেখযোগ্য বলে মনে হয়।

দারোয়ান খয়ের আমারই নির্দেশে আমাকে দোতালায় লাউঞ্জে বাইরে থেকে তালা দিয়ে চলে গিয়েছিল। সিঁড়ি ও বাইরের গেটেও তালা ছিল। এ বাড়ীতে কেউ থাকে না, এমন একটা ধারনা দেয়ার জন্যেই সর্বদা দ্বারে বাইরে থেকে তালা দেয়া হয়। আমি তখন ক্লাবে একা নীরব নিস্তব্দ ক্লাব এলাকা। সমস্ত আলো নেভানো। গরমের মধ্যেও ফ্যান চালাইনি। বের হবার পথ বন্ধ।

চারদিকে ভয়াবহ আক্রমন চলছে। তোপখানা রোডের উপর প্লাটুন দৌড়ে যাচ্ছে। ট্র্যাকের ঘর ঘর শব্দ। আমি রাইফেল স্টেটগান, মেশিনগান আর মর্টার শেলের গগনবিদারী বীভৎস শব্দের রাজ্যে একা একটা সোফায় বসে আছি। রাজারবাগ আর বিশ্ববিদ্যালয়য় এলাকার দিক থেকে গোলার আওয়াজ আসছিল। হঠাৎ বর্তমান ফরেন অফিস ও ইউসিসের তেমাথায় একটা আলো জ্বলে উঠলো- সমগ্র এলাকাটা তখন দিনের মতো স্পষ্ট। জানালার ফাঁক দিয়ে আর্মির চলাফেরা লক্ষ্য করা সম্ভব। বহু সংখ্যক ট্রাক বোঝাই সৈন্য ক্লাবের সম্মুখ দিয়ে পুরানা পল্টনের দিকে যাচ্ছে।

একটু পরেই নবাবপুর রেল গেটের দিকে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। আকাশের দিকে কালো ধোয়া আর আগুনের শিখা উড়তে থাকে। তারপর এক সময় পুরানো শহরের মধ্যভাগ বংশাল রোডের দিকে আগুন দেখা গেল।

তখন একথা সত্যই যে, শুত্রু বাহিনী পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ধ্বংসের অভিযানে নেমেছে- গণহত্যা চলছে। কিন্তু তখনো জানতাম না যে পিলখানায় ইপিআর বাহিনীর সাথে দখলদার সেনাদের যুদ্ধ চলছে। রাজারবাগে বীর পুলিশরা ম্যাগাজিন খুলে প্রতিরোধ লড়াই করছে। পুরনো শহরের গলিগুলোর ব্যারিকেড বিদেশী সেনাদের পথ বন্ধ করে রেখেছে আর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গুলিবর্ষণ হচ্ছে।
এই নিদারুণ পরিস্থিতির মধ্যেও শহরের বিভিন্ন অঞ্চলের যে সব মুক্তিকামী মানুষ হানাদারদের প্রতিরোধ করছিল তাদের একটা সাহসী দল সেকেন্ড গেটের পাশের সম্মুখে সারারাত ব্যারিকেড সৃষ্টি করে গেছে। প্রেসক্লাবের ডান দিকে সেক্রেটারিয়েটের শেষ দেয়ালের গাঁ ঘেঁষে যে কাঁচা গলিটা গেছে, তার মুখে সন্ধ্যার সময়ই একটা বড় ট্রাক রাখা হয়েছিল এবং তারা পাশে কয়েকটা রিক্সা রেখে হানাদারদের প্রবেশ পথ বন্ধ করে দেয়া হয়। আর সেখানেই একদল দুঃসাহসী যুবক, যারা দোকানদার, রিক্সাচালক গভীর অন্ধকারে গাঁ ঢাকা দিয়ে বড় রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরি করে চলছিল।

প্রতিবার ইয়াহিয়ার বাহিনী তোপখানা রোড দিয়ে যাবার সময় এইখানা বাঁধা পেয়েছে, কনভয় থামিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করেছে। ক্লাব দোতালার দরজায় ফাঁক দিয়ে সারারাত দেখেছি সাঁজোয়া বাহিনী বা আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত প্লাটুন এই পথ ধরে পুরানো শহরের দিকে অগ্রসর হতে গিয়ে এই ব্যারিকেডের সম্মুখীন হয়েছে।

প্রত্যেকবারই সৈন্যরা গাড়ি থেকে নেমে ব্যারিকেড সরিয়ে ফেলত। কিন্তু শেষের দিকে ব্যারিকেডের উপর স্প্রে করে আগুন ধরিয়ে দিত। বাঁধা পেয়েই তারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠত এবং সঙ্গে সঙ্গে স্টেন আর রাইফেল শতকণ্ঠে গর্জে উঠত। বিদ্রোহিদের মনে ত্রাস সৃষ্টি করার জন্যই যে কেবল এভাবে অজস্র গুলী ছোড়া হ’ত তা নয়, কল্পিত গেরিলাদের ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হানাদার সৈন্যরা নিজেদের মনোবল বৃদ্ধির জন্যেও নিষ্প্রয়োজনে ট্রিগার টিপেছে।

রাত প্রায় তিনটার দিকে বড় রাস্তা থেকে ক্লাব বিল্ডিং লক্ষ্য করে কয়েকজন সৈন্য গুলী নিক্ষেপ করে। তখনো আমি ভাবতে পারিনি যে, এটা প্রেসক্লাবের উপর আক্রমণের ওয়ার্নিং।

ব্যারিকেড উঠিয়ে বা পুড়িয়ে দিয়ে যাওয়ার পর সৈন্যরা কেউ থাকত না। দশ মিনিটের মধ্যেই পাশের গলি থেকে কিছু লোক ইট, কাঠের টুকরা, টিন এমন কি ছোট ছোট আস্ত পান বিড়ির দোকান তুলে এনে রাস্তা বন্ধ করে দিত। এটা ছিল তাদের জন্যে অসহ্য এবং কাউকে নাগালের মধ্যে না পেয়ে অন্ধকারে গুলী ছোড়া ছাড়া পথ ছিল না। কিন্তু প্রেসক্লাবের পাশের গলিতে ঢোকার সাহস তাদের ছিল না, আমি ভেবেছিলাম ক্ষিপ্ত ইয়াহিয়া- সৈন্যের এই জাতীয় গোলাগুলীর অংশ ক্লাবে এসে পড়েছিল।

ভোর রাতের দিকে ঢাকা শহরের কয়েকটা অঞ্চলের আকাশ অগ্নিশিখায় রঙিন হয়ে উঠেছিল- নাগরিকদের উপর আক্রমণের তোড়াটা তখন ছিল অনেক বেশী এবং সে সময় অসহায় হাজার হাজার নগরবাসীর কণ্ঠে ছিল নাগরিক এই করুণ ও বিভীষিকাময় পরিস্থিতির প্রত্যক্ষ সাক্ষী।
এর একটু পরই প্রেসক্লাবের উপর আক্রমণ চালানো হয়।

অন্ধকার কক্ষের মধ্যে আমি তখন একটা সোফা ছেড়ে আর একটায় গিয়ে বসছিলাম। বেরিয়ে পালিয়ে যাবার কোন উপায় তো তখন ছিল না। একটার পর একটা চিন্তা আমাকে আচ্ছন্ন করে তুলেছিল। ২৪ তারিখ রাতে ৩২নং রোডের বাড়িতে শেখ সাহেব সাংবাদিকদের একটা প্রশ্নের জবাব দিয়ে বলেছিলেনঃ আলোচনা দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে বলে ওরা সময় পাচ্ছে। এই যদি মনে কর-তবে আমি কি সময় পাচ্ছি না?

ভাবছিলাম যে সময় তিনি পেয়েছেন তা’চব্বিশ ঘণ্টা পর অত্যাধুনিক সেনাবাহিনীকে রোখার জন্যে যথেষ্ট কি না। আমার চিন্তার সুত্র ছিন্ন করে একটা ট্যাঙ্কের শব্দ ভেসে আসলো। ছুটে গেলাম একটা জানালার কাছে। সে রাতে এই প্রথম একটা ট্যাঙ্ক দেখলাম। কমিশনার অফিসের অঙ্গন থেকে ছোট একটা ট্যাঙ্ক (এম ২৪) গর্জন করে ইউসিসের সামনে এসে দাঁড়াল।

ট্যাঙ্কের নলটা ক্লাবের দিকে ঘুরিয়ে দেয়া হয়েছে। আর কয়েকজন সৈন্য ট্যাঙ্কের কাছে ছুটাছুটি করছে। তখনও আমি ভাবে উঠতে পারিনি যা, প্রেসক্লাবের উপরও তাদের সরাসরি আক্রমন চলবে। কিন্তু পর মুহূর্তেই ভাবলাম সব অবিশ্বাস্য ঘটনাই তো তাদের দ্বারা আজ রাতে সম্ভব হয়েছে।
কক্ষ থেকে বের হবার প্রশ্ন ওঠে না। বাথরুমের ব্যাকস্টেয়ার দিয়ে বেরিয়ে যাবার কথা ভাবলাম। বাথরুমের পেছনের দরজা খুলে দেখলাম, দেয়ালের উপর কতোগুলো ফেস্টুন দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে তাতে ইয়াহিয়ার কার্টুন আর সরকারীবিরোধী শ্লোগান খচিত। পেছনের সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে দেখলাম হাতল নেই অন্ধকারে আমার চেষ্টা করা অসম্ভব। কক্ষের দিকে ফিরে আসার সময় ফেস্টুনগুলো টেনে বাথরুমে নিয়ে গেলাম। সমস্ত ঘটনাটাই মিনিটখানেকের মধ্যে।

আমি তখনো সোফার কাছে এসে পৌঁছাইনি একটা ভয়াবহ শব্দ করে প্রথম শেল এসে কক্ষের মধ্যে পড়ল। কোন কিছু চিন্তা করার পূর্বেই একটা ইসপ্লিন্টার প্রচণ্ড বেগে আমাকে উপড়ে ফেলল ফ্লোর থেকে। এই ইসপ্লিন্টারের প্রচণ্ডটা এত বেশী ছিল যে, আমি কখন ফ্লোরে পড়েছি, তা বুঝতে পারিনি। আমার উপর দিয়ে পরপর আরো তিনটে শেল নিক্ষেপ করা হয়, তারপর সব নিস্তব্ধ। দু’টো দেয়ালের কোণে আমি পড়ে ছিলাম। আঘাতে পশ্চিম দিকের দেয়াল উড়ে গেছে- বাইরে থেকে সবই দেখা যায়।

আমার উপর বাথরুমের একটা কপাট, দেয়ালের ইট পড়ে আছে। ঠিক কত মিনিট পর জ্ঞান ফিরে পেয়েছি, জানি না।

শার্ট ও প্যান্টের অনেক অংশ উড়ে গেছে, চোখে চশমা নেই, সমগ্র শরীর ইটের গুঁড়োতে লাল হয়ে আছে। পড়ে থাকা অবস্থাতেই হাত পা নেরে দেখাম কোন হাড় ভেঙ্গেছে কি না। বাঁ পা’টা উঠাতে পারলাম না একটা অংশে অনবরত রক্ত ঝরছিল। শরীরের অনেক স্থানে আঘাতের ব্যথা বেড়ে উঠতে লাগলো। ভাবলাম, জল্লাদের শেল নিক্ষেপ করেই যে ক্ষান্ত হবে, তা’ নয়। ক্লাবে শত্রুপক্ষের অবস্থান সম্পর্কে সন্দেহ করলে পরবর্তী কালে উঠে এসে স্টেন দিয়ে ব্রাস করে যাবে। আমি বাঁ পাটা টেনে টেনে বাথরুমের পেছনের দরজার দিকে গেলাম।

খয়ের ছুটে গেল একটা লুঙ্গি আনতে আমার জন্যে। কিন্তু পনের মিনিটের মধ্যেও সে ফিরে আসল না-ক্লাবের পশ্চিম কোণে তখন সৈন্যরা ঢুকেছে। তার বিলম্ব দেখে আমি এটা আঁচ করতে পেরেছিলাম। আমার পা টেনে টেনে পেছনের দরজা দিয়ে রান্না ঘরের পাশে গেলাম সেখান থেকে পুকুরের পাশে সেক্রেটারিয়েটের দেয়াল ঘেঁষে যে গলিটা গেছে সেখানে উপস্থিত হলাম বিধ্বস্ত অবস্থায়। দশ বারোজন ছোট দোকানদার ও রিক্সাচালকের আশ্রয় পুকুরের ধারের এই ঘরগুলোতে। কয়েকজন আমাকে ধরে নিয়ে একটা চৌকির নীচে লুকিয়ে রাখল। ইতিমধ্যে প্রেসক্লাবের আর তার পাশের সরকারী বাড়ীর মধ্যে সৈন্যরা প্রবেশ করেছে। আমি সেই ঘর থেকে স্পস্ট ওদের দেখতে পারছিলাম

একজন বুড়োকে বললামঃ আপনারা এখান থেকে পালান। একটু পরেই আক্রমন হবে।

বুড়োঃ যাবো কোথায়? সারারাত তো এখানেই ছিলাম- আর রাস্তা বন্ধ করেছি ব্যাটাদের। সব গাড়ি থামাতে হয়েছে ওদের, কাউকে বিনা বাধায় যেতে দেইনি।

কিন্তু এখন তো দিন আসছে, সব দূর থেকে দেখা যাবে, বললাম।

পালানোর চাইতে প্রতি আক্রমণের আগ্রহই তাদের মধ্যে প্রবল। জনৈক যুবক, হয়তো কোন দোকান কর্মচারী, সারারাত কিভাবে হানাদার সৈন্যদের সন্ত্রাসের মধ্যে রেখেছিল তার বর্ণনা দিল। প্রেসক্লাবের পেছনের অংশে প্রতিবারই তারা আশ্রয় নিয়েছে হানাদারদের তাড়া খেয়ে। সাংবাদিকদের এই প্রেসক্লাবের উপর আক্রমণের কারণটা তখন আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠলো। এই সমস্ত বীর প্রতিরোধকারীদের কোন সন্ধান তারা করতে পারেনি- তাদের উপর আঘাত হানাও সম্ভব হয়নি।

এই আক্রোশই ইয়াহিয়ার সৈন্যরা প্রেসক্লাবের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল- তোপের মুখে প্রেসক্লাবটা উড়িয়ে দিয়ে গেরিলাদের স্তব্ধ করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। সারারাত অন্ধকারের মধ্যে যে গেরিলারা তাদের সন্ত্রাসের মধ্যে রেখেছিল তাদের ধ্বংস করার জন্যে নিকটস্ত আশ্রয় কেন্দ্রে প্রেসক্লাবে শেল বর্ষণ অস্বাভাবিক কিছু নয়।

গুলী বর্ষণ সকালের দিকে কোন অঞ্চলে পুনরায় বৃদ্ধি পেতে থাকে। সৈন্যরা তোপখানা রোডের উপর দাঁড়িয়ে রাইফেলের নল উঁচিয়ে আছে।
একজন মধ্য ব্যক্তিকে বললামঃ এখানে গুলী আসবে, আপনারা সরে যান।

প্রশ্ন করলেন তিনিঃ আপনি কি করবেন?

আমাকে সামনের গাছের উপর উঠিয়ে সেক্রেটারিয়েটের মধ্যে ফেলে দিতে পারবেন?

তিন-চারজন যুবক দেয়ালের পাশের গাছটায় উঠে আমাকে টেনে দেয়ালের ওপারে নিয়ে গেল। নীচেই সরকারী মসজিদ। সেক্রেটারিয়েটের ভেতরের পরিবেশটা অন্য প্রত্যেকটি মানুষ আক্রমণের আশঙ্কায় সময় গুনছেন। প্রায় ত্রিশ চল্লিশজন লোককে দেখলাম সাদা পোশাকে নির্বাক ঘুরে বেড়াচ্ছে।

আকস্মিক ভাবে এক তরুণ এসে জিজ্ঞেস করলঃ রাতে কোথায় ছিলেন, কোথায় গুলী লেগেছে, শরীরের সর্বত্রই রক্ত কেন? কাপড় বদলানো দরকার। তার অনেক প্রশ্ন।

শান্তি তার নাম। মোতালেব কনট্রাক্টরের মিস্ত্রী। এখানেই কাজ করে থাকে। তারপর এলো আরো কয়েকজন সেই সাদা পোশাকের লোকগুলো।

একজন আমার পরিচয় জানতে চাইলেন। বললামঃ আমি কুমিল্লায় ব্যবসা করি রাতে লঞ্চ থেকে নেমে বড় ভাই এর বাড়ি যাচ্ছিলাম। এ সমস্ত কিছুই জানতাম না। রাতের বেলা তোপখানা রোডে গুলী খেয়েছি।

নিজেকে সাংবাদিক বলতে চাইনি বলে সবটাই মিথ্যে বললাম তাদের কাছে।

এখানে আক্রমন হলে আপনার পক্ষে বাঁচা সম্ভব হবে না, চলুন ঐ ন’তলায়। একজন প্রস্তাব করলেন। শান্তি ছেলেটা তক্ষুনি একটা লুঙ্গি নিয়ে এলো ওর ঘর থেকে। আমাকে দু’জনে ধরে দু’নম্বর ন’তলায় নিয়ে গেল। পয়লা মার্চ থেকে দেশে অসহযোগ চলেছে- অফিস- আদালত- বন্ধ।
সে কারনে লিফট নেই। পাঁচতলায় গিয়ে পৌছালাম। কোন কক্ষই খোলা নেই। কৃষি বিভাগের একটা বাথরুম পাওয়া গেল খোলা। তখন রক্ত ঝরছিল ক্ষত দিয়ে। এই বাথরুমেই ২৬শে মার্চ ও পরবর্তী রাত কাটাতে হয়। বাইরে মৃত্যুর বিভীষিকা।

যারা আমাকে এই স্থানে আশ্রয় দিয়ে চলে গেলেন, তারা সেক্রেটারিয়েটে প্রহরারত বিদ্রোহী পুলিশ। সকলেই পোশাক খুলে রেখে সাদা পোশাকে সেক্রেটারিয়েটে পাহারা দিচ্ছেন। প্রত্যেকের কাছে মাত্র কুড়ি রাউন্ড বুলেট ছিল। তারা ইতিমধ্যে জানতে পেরেছেন, রাজারবাগ ও পিলখানায় বিদ্রোহ হয়েছে। যুদ্ধ হয়েছে বর্বর বাহিনীর সাথে। বাঙ্গালী পুলিশ ও সেনাদের দাঁড় করিয়ে হত্যা করা হয়েছে। লড়াই না করে কেউ মৃত্যুকে স্বীকার করতে চান না।

সাততলার উপর তাদের ঘাঁটি তৈরি করা হয়েছিল। বিদেশী সৈন্যরা সেক্রেটারিয়েটে প্রবেশ করলে এই ঘাঁটি থেকে আক্রমন করার সমস্ত প্রস্তুতি তাদের ছিল। সেকেন্ড গেটের ভেতর দিকে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে তারা প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুত ছিলেন।

সাতাশ তারিখে দশটার দিকে একজন এসে বললেন, এখন গোলাগুলি বন্ধ। লোকজন রাস্তায় বেরিয়েছে। কারফিউ উঠিয়ে নিয়েছে বলে ঘোষণা করা হচ্ছে।

জিজ্ঞেস করলামঃ আপনারা সকলে এখানে ?

হয়তো সবাই চলে যাব, আপনাকে বড় রাস্তা পর্যন্ত দিয়ে আসি, চলুন।

দু’জনে ধরে আমাকে নিয়ে এলেন সেক্রেটারিয়েটের প্রথম গেট পর্যন্ত। শান্তি সাথে ছিল।

পরনে লুঙ্গি, গাঁয়ে গেঞ্জি অথচ তখনো আমার পায়ে ভালো এক জোড়া জুতা ছিল। শান্তিকে বললামঃ তোমার বাবার স্যান্ডেল জোড়া দাও- আমার জুতাড় সাথে বদল কর। নইলে পোশাকে বড্ড বেশী গরমিল দেখাচ্ছে।

বিব্রত শান্তি তাই করল কিন্তু সেও আমার সাথে বেরিয়ে এলো।

আব্দুল গনি রোডে একটা রিক্সা পাওয়া গেল। বিদায়ের সময় একজন বললেনঃ হাসপাতালে যাবেন না। আহতদের সৈন্যরা তুলে নিয়ে যায়।“

Ref: Bangladesher Swadhinota Zuddho Dolilpotro, Vol 8, pp 359-361

Unicoded by

তানিয়া ইমতিয়াজ লিপি

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!