You dont have javascript enabled! Please enable it!

পদ্মা মেঘনার ডাকে বৃহৎ শক্তিরা নীরব কেন

বাংলাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রাম চলছে। প্রায় নিরস্ত্র ফৌজের সঙ্গে লড়াইয়ে সর্বাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ইয়াহিয়া খাঁর সেনারা যে অনেক জায়গাতেই খুব বেশি সুবিধা করতে পারছে না, বাংলাদেশের ভিতর থেকে আমাদের সংবাদদাতারা সে খবর দিচ্ছেন। প্রত্যক্ষদর্শী ও পর্যবেক্ষকদের কাছে একটা বিষয় সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে : বিমান থেকে বােমা ফেলে, ট্যাঙ্ক, কামান ও মেশিনগান চালিয়ে বাংলাদেশকে আর দাবিয়ে রাখা
যাবে না। প্রচণ্ড বাধা ঠেলে, দুস্তর পথ অতিক্রম করে বাংলাদেশের মুক্তিফৌজ স্বাধীনতার লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলেছে। স্বাধীনতাকামী সাড়ে সাত কোটি মানুষের দুর্বার অগ্রগতি প্রতিরােধ করার ক্ষমতা পৃথিবীর কোনাে শক্তিরই নেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অবধারিত, অনিবার্য।
মুক্তিকামী সাড়ে সাত কোটি মানুষের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবর রহমান সারা বিশ্বের কাছে সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় মুজিবের এই ডাকে বিশ্বের কোনাে দেশ এখনও সাড়া দেয়নি। পদ্মা, মেঘনা ও আড়িয়াল খাঁর তীরে তীরে কামান গর্জন শােনা যাচ্ছে- পশ্চিম পাকিস্তানি সেনার বর্বর আক্রমণে লক্ষ লক্ষ মানুষ ইতিমধ্যেই প্রাণ দিয়েছেন। কিন্তু মাতৃভূমির মুক্তিসাধনায় লক্ষ মানুষের আত্মদান এখনও বিশ্বের বৃহৎ রাষ্ট্রগুলােকে নাড়া দিতে পারেনি। বাংলাদেশের ঘটনা সম্পর্কে বিশ্বের বৃহৎ রাষ্ট্রসমূহ আমেরিকা, রাশিয়া, ব্রিটেন ও চীন এখনও মৌন, নিশ্রুপ। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বৃহৎ রাষ্ট্রগুলাের মধ্যে কেউ এ পর্যন্ত একটি কথাও বলেনি।
এক সময় কিন্তু পূর্ববাংলার জাতীয়তাবাদের নেতা হিসেবে মুজিবর রহমানের উদ্ভবকে রাশিয়া এবং আমেরিকা স্বাগত জানিয়েছিল। পূর্ববাংলা যে চরম বামপন্থী মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন চলে যায়নি, এতেই বােধহয় সেদিন ঐ দুই বৃহৎ রাষ্ট্রের বর্ণধারীরা খুশি হয়েছিলেন। আজ যখন মুজিব ও তার মুক্তিফৌজ স্বাধীনতার জন্য জীবনমরণ সংগ্রামে লিপ্ত তখন আমেরিকা বা রাশিয়া কারও মুখেই কোনাে কথা নেই। আমেরিকার পত্রিকাগুলােতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্বন্ধে যে সব খবর বেরােচ্ছে তাতে যদি মার্কিন সরকারের মনােভাবের প্রতিফলন হয়ে থাকে তাহলে মুজিব সরকারের আমেরিকার কাছ থেকে সাহায্য পাওয়ার আশা দুরাশা।
নিউজ উইক’ পত্রিকা মুক্তিফৌজের সেনানীদের একগুঁয়ে জাতীয়তাবাদী বলে বর্ণনা করেছেন। পত্রিকাটি বলেছেন, ঐসব জাতীয়তাবাদী লাঠি কাঁধে করে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। নিউইয়র্ক টাইমস তাে ইয়াহিয়া খাঁ এবং মুজিবরের মধ্যে শক্রতা কোথায় তাই খুঁজে পাননি। পত্রিকাটি প্রশ্ন তুলেছেন, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের মধ্যে ইয়াহিয়া খাই কি সর্বপ্রথম পূর্বাঞ্চলের উপর পশ্চিম পাকিস্তানের শােষণের অবসান ঘটাবার জন্য প্রাপ্তবয়স্কদের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে সাধারণ নির্বাচনের ব্যবস্থা করেননি? ইয়াহিয়া যদি এই ঔদার্য না দেখাতেন, তাহলে মুজিব কোথায় থাকতেন?
এ কথা ঠিক ভুট্টো ও তার দলের প্রতি আমেরিকার কোনাে ভালােবাসা নেই।
আমেরিকা বাংলাদেশের ঘটনার প্রতি লক্ষ্য রেখেছে। কিন্তু যতদিন না মুজিবরের মুক্তি ফৌজ বাংলাদেশের সর্বাত্মক সংগ্রামে নিশ্চিতভাবে জয়ের মুখােমুখি হয়ে দাঁড়াবে, ততােদিন আমেরিকা দোস্ত ইয়াহিয়া খাঁর বিরুদ্ধাচরণ করবে বলে মনে হয় না।
সাধারণ নির্বাচনে মুজিবর রহমানের বিপুল সাফল্যের পর রাশিয়ার পত্রিকাগুলাে যেভাবে মুজিবর ও তার দল আওয়ামী লীগকে স্বাগত জানিয়েছিল, তাতে মনে হয়েছিল রাশিয়া মুজিবরের বন্ধু। কিন্তু আজ যখন বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ নিরাপরাধ মানুষ জঙ্গিশাহীর শিকার হচ্ছেন তখন রাশিয়া ধ্যানী বুদ্ধের মতাে চুপচাপ বসে ঘটনা প্রবাহ লক্ষ্য করছে। মুজিব সরকারকে স্বীকৃতি দেয়া দূরে থাকুক, বাংলাদেশে যে নরমেধ যজ্ঞ চলেছে, তার বিরুদ্ধে একটি কথাও উচ্চারণ করছে না।
রাজনীতিতে অবশ্য মানবিকতার কোনাে স্থান নেই স্বার্থসিদ্ধিই রাজনীতির সবচেয়ে বড় কথা। নির্লজ্জ স্বার্থসিদ্ধির জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্র বহু বহুবার মানবিকতার বন্ধুত্ব প্রভৃতি জলাঞ্জলি দিয়েছে, এমন দৃষ্টান্ত ঘটেছে। ১৯৩৭ সালে স্পেনে গৃহযুদ্ধের সময় রাশিয়া যদি স্পেনের সাধারণমন্ত্রীদের যথেষ্ট পরিমাণ সাহায্য দিত তাহলে জেনারেল ফ্রাংকো জয়লাভ করতে পারতেন না— এ সিদ্ধান্ত নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক ও ঐতিহাসিকদের। ইতালি এবং আবিসিনিয়ার মধ্যে যুদ্ধের সময় রাশিয়ার আচরণ সম্পর্কে বহু অভিযােগ উঠেছিল। অবশ্য কেবল রাশিয়াই যে এ ধরনের অপরাধে অপরাধী তা নয়, চীনসহ অন্যান্য বৃহৎ রাষ্ট্রের ইতিহাস ঘাটলে ঐ ধরনের অপরাধের বহু নজির পাওয়া যাবে।
ব্রিটেনের তুলনায় আমেরিকা ও রাশিয়া দূরের দেশ। পাকিস্তান কমনওয়েলথের সদস্য। ব্রিটেনের সঙ্গে তার হাজার এক সম্বন্ধ। বাংলাদেশ সম্পর্কে ব্রিটেন যতােটা ওয়াকিবহাল, অন্য কোনাে রাষ্ট্রের পক্ষে তা হওয়া সম্ভব নয়। বাংলাদেশের ঘটনা সম্পর্কে ব্রিটেন এখনও চুপ করে আছে। ব্রিটিশ পত্রিকাগুলােতে বাংলাদেশের ঘটনা ফলাও করে ছাপা হচ্ছে। দি ইকোনমিস্ট’ পত্রিকা বলেছেন, একটি পৃথক রাষ্ট্র হওয়ার জন্য যেসব জিনিস দরকার পূর্ব পাকিস্তানের আছে। পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা পশ্চিম জার্মানি বা ব্রিটেনের চেয়ে বেশি। দেশটা অনগ্রসর ঠিকই, কিন্তু ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য এবং বিদেশের সাহায্যে ওরা কাজ চালিয়ে যেতে পারবে এবং শেষ পর্যন্ত মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে।
ভাবপ্রবণ বাঙালিরা কি একটা স্থায়ী রাষ্ট্র গঠন করতে পারবে? এই আশঙ্কার সঙ্গে এ কথাও ভেবে দেখা দরকার যে, পশ্চিম এবং পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে ক্রমাগত সংঘর্ষ চলতে থাকলে কি কোনােরূপ স্থায়িত্ব দেখা দেবে? বরং পূর্ব-পশ্চিমে সংঘর্ষ চলতে থাকলে বাইরের শক্তির পক্ষে নাক গলানাে সহজ হবে।
পত্রিকাটি ব্রিটেনকে দুই পাকিস্তানের তত্ত্ব সমর্থন না করার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। স্বাধীন মুসলমান বাংলা এবং হিন্দু বাংলার পাশাপাশি অবস্থানও পত্রিকাটি ভালাে চোখে দেখেনি।
বাংলাদেশকে নিয়ে ব্রিটেন বেশ বিপদে পড়েছে। বায়ায় গৃহযুদ্ধের সময় ব্রিটেন তা দখলের জন্য নাইজেরিয়া সরকারকে অস্ত্র দিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ব্রিটেনকে ভেবেচিন্তে এগােতে হবে। বাংলাদেশের সুনির্দিষ্ট সীমান্ত রয়েছে। মুজিবের পেছনে অভূতপূর্ব জনসমর্থন রয়েছে। পূর্ববাংলার অধিবাসীরা ভাষা সংস্কৃতি, জীবনযাত্রা সবকিছুই পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসীদের থেকে ভিসা। সবচেয়ে বড় কথা : পূর্ববাংলা পাকিস্তানের গরিষ্ঠ অংশ। স্বাধীকার লাভের জন্য যা কিছু প্রয়ােজন পূর্ববাংলার সব কিছুই আছে।
এসব কারণে ব্রিটেন মনস্থির করতে পারছে না। বাংলাদেশের গৃহযুদ্ধে সে যাতে জড়িয়ে না পড়ে, সে জন্য খুব সতর্কভাবে চলেছে।
বৃহৎ রাষ্ট্রগুলাের মধ্যে বাকি থাকে চীন। চীন ইয়াহিয়ার বন্ধু, ভুট্টোরও। চীন ও পাকিস্তানের সাধারণ শত্রু’ ভারতকে দাবিয়ে রাখার জন্য চীন ইয়াহিয়া খাঁ ও ভুট্টোকে হাতছাড়া করতে পারে না। অন্যদিকে মুশকিল বাধিয়েছে মুজিবর রহমান ও তার মুক্তিফৌজের স্বাধীনতা সংগ্রাম। বাংলাদেশে মুক্তিফৌজ গেরিলা যুদ্ধ চালাচ্ছে। হাজার হাজার কৃষক মুক্তিফৌজের শামিল হয়েছে। পাতি বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী মুজিবর যে এ রকম একটা কাণ্ড করে বসবে, পিকিংয়ের কর্তারা তা স্বপ্নেও ভাবেননি। এখন চীনের ‘শ্যাম রাখি কি কুল রাখি’ অবস্থা হয়েছে।
চীন এখন কোন পথ নেবে, তা ভেবে পাচ্ছে না।
শত্রু ভারতকে দাবিয়ে রাখতে হলে ইয়াহিয়া খাঁকে মদদ জুগিয়ে চলতে হয়। কিন্তু তা করতে গিয়ে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ কৃষক গেরিলা যােদ্ধার স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরুদ্ধাচরণ করতে হয়? চীন শেষ পর্যন্ত কী করে তা দেখার জন্য অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করতে হবে।

সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা
৩.৪.১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!