You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.15 | সাম্রাজ্যবাদী কালাে ছায়া | কালান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

সাম্রাজ্যবাদী কালাে ছায়া

জাতিসংঘ শান্তির ধ্বজা তুলে তার আড়ালে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা অস্ত্র-আস্ফালন শুরু করে দিয়েছে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার টনকিন উপসাগর থেকে মার্কিন সপ্তম নৌবহরের পারমাণবিক শক্তিচালিত একটি বিমানবাহী জাহাজ এবং তার সঙ্গে আরাে কয়েকটি জাহাজ বঙ্গোপসাগরের দিকে রওনা হয়েছে। ঢাকা থেকে মার্কিন নাগরিকদের উদ্ধার করার জন্যই নাকি এই মার্কিন নৌ-অভিযান। এর চেয়ে হাস্যকর সাফাই আর কী হতে পারে! ঢাকা থেকে অন্যান্য দেশের নাগরিকদের যখন নিরাপদে সরানাে সম্ভব হয়েছে তখন মার্কিন নাগরিকদের সরাতেই বা বাধা কোথায়? মার্কিন কর্তৃপক্ষ তেমন অনুরােধ করলে ভারতের বিমানবাহিনী নিশ্চয়ই সেই নির্দিষ্ট সময়ে ঢাকার বিমানহানা বন্ধ রাখত এবং মার্কিন নাগরিকরা অনায়াসে ঢাকা ত্যাগ করতে পারতেন। কিন্তু তেমন কোনাে অনুরােধ না করে নিক্সন চক্র একেবারে সরাসরি ভারতীয় দরিয়ার দিকে তার নৌবাহিনীকে এগুবার নির্দেশ দিয়েছে। এতে কি আর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের দুরভিসন্ধি বুঝতে কারাে বাকি থাকে? শ্বেতাঙ্গদের নিরাপদে সরাবার অছিলায় কঙ্গোতে ছাত্রীসৈন্য নামিয়ে দেয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের অব্যাহত অগ্রগতিকে রােধ করার জন্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের তেমন কোনাে জঙ্গি মনােভাব থাকা অসম্ভব নয়।
নিক্সন সেদিন ভারতকে চোখ রাঙিয়ে বলেছেন, জাতিসংঘের একটি সদস্য রাষ্ট্র অর্থাৎ পাকিস্তান যখন ডুবতে বসেছে তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হাতগুটিয়ে চুপ করে বসে থাকতে পারে না। চুপ করে যে সে বসে নেই তা আমরাও জানি। নিরাপত্তা পরিষদে দু’দুবার সােভিয়েত ভেটোর গুঁতাে খেয়ে সে এখন ইয়াহিয়া খানের ডুবন্ত নৌকা কী করে রক্ষা করা যায় তার জন্য অন্যপথ খুঁজছে। সিয়াটো এবং সেন্টো চুক্তির তল্পী ঝেড়ে দেখছে তারই কোনাে ছিদ্রপথে পাকিস্তানকে অস্ত্র দেয়া যায় কিনা। দুরাত্মার ছলের অভাব হয় না। সামরিক জোটের অংশীদার পাকিস্তানকে অস্ত্র জোগাবার কোনাে না কোনাে একটা ফিকির সে খুঁজে বার করতে পারবেই। তারই তােড়জোড় চলছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ঘায়েল করতে হলে ভারতের উপর সামরিক চাপ সৃষ্টি করা দরকার; কারণ ভারতীয় জওয়ানরা মিত্র বাহিনী রূপে মুক্তিযােদ্ধাদের পাশে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশকে সম্পূর্ণরূপে পাক-হানাদারমুক্ত করার জন্য লড়ছেন। সুতরাং সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত ব্যর্থ হতে দেখে নিক্সন চক্রের ভারতেরই উপর বেশি রাগ।
মহাচীনের মাওবাদী নেতৃত্ব এখন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নিকটতম দোসর। নিক্সন-মাও-ইয়াহিয়া মিলে যে অক্ষের সৃষ্টি হয়েছে সেটি গণতন্ত্র ও মুক্তিসংগ্রামের ঘাড়ে কোপ মারতে উদ্যত। এই উপমহাদেশে রক্তস্রোত বইয়ে দিতেও তারা পরাঙ্মুখ হবে না। দক্ষিণ এশিয়ায় গণতন্ত্র ও মুক্তিসংগ্রামের আজ এক অগ্নিপরীক্ষা। সাম্রাজ্যবাদী, জঙ্গিবাদী আর সমাজতন্ত্রী বিশ্বাসঘাতকদের জোট জয়ী হবে? না গণতন্ত্র ও মুক্তিসংগ্রাম দুর্বারগতিতে সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে বিজয়লক্ষ্মীর বরমাল্য কণ্ঠে ধারণ করবে? মানবশত্রুদের এই চ্যালেঞ্জের মােকাবিলা করার দিন সমাগত।
ভারত সদর্পে এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছে। গণতন্ত্র ও নিপীড়িত জাতির মুক্তির জন্য সর্বস্ব পণ করে শেষ রক্তবিন্দু ঢালতে সে প্রস্তুত। এই গণতান্ত্রিক আদর্শ ও মানবমুক্তির প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়েই ভারতীয় জওয়ানরা বীরবিক্রমে লড়ছেন। কিসের জন্য তাঁরা লড়ছেন তা তাঁরা জানেন বলেই তাদের মনােবলও উচ্চ মানে। এই জওয়ানদের পেছনে আজ দেশের সমস্ত শক্তিকে সংহত করতে হবে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নগ্নরূপ এখন আর কারাে অবিদিত নেই। সমাজতন্ত্রী বিশ্বাসঘাতক মাওবাদী চীনা নেতাদের গণতন্ত্র ও মুক্তিসংগ্রামবিরােধী চরিত্র আজ সম্পূর্ণরূপে উদঘাটিত পর্দার অন্তরালে আর কিছুই নেই- এদের স্বরূপ একেবারে মঞ্চে উপস্থিত। আজ তাই সাম্রাজ্যবাদবিরােধী ঐক্য ভারতকে একসূত্রে গেঁথে দিয়েছে।
এই সাম্রাজ্যবাদবিরােধী সংগ্রামে ভারতের জনগণের পাশে রয়েছে সােভিয়েত ইউনিয়ন ও অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। সেই মৈত্রীর বন্ধন আরাে সুদৃঢ় করে তুলতে হবে। ভারত ও বাংলাদেশের সাড়ে বাষট্টি কোটি মানুষের গণতান্ত্রিক অভ্যুত্থান ও তার পাশে সমাজতান্ত্রিক দুনিয়াকে দেখে সাম্রাজ্যবাদ আজ আতঙ্কিত। তাই তার জকুটি। কিন্তু সেই ভ্রুকুটিতে ভারত ভীত নয়। যে ইয়াহিয়া খানকে সামনে রেখে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা এবং চীনের সমাজতন্ত্রী বিশ্বাসঘাতকরা অস্ত্রে শান দিচ্ছে সেই অস্ত্র ভােতা করে বাংলাদেশকে ইয়াহিয়া চক্রের কবল থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত করার জন্য ভারতীয় জওয়ানরা মুক্তিবাহিনীর পাশে দাঁড়িয়ে লড়বেনই, আর মার্কিন ও চীনা অস্ত্রে বলীয়ান হয়ে পাকিস্তান যদি ভারতের সার্বভৌমত্বে হাত বাড়ায় তবে পশ্চিম রণাঙ্গনে ভারতীয় বাহিনী পাক মিলিটারি জুন্টার রণসাধ চিরতরে মিটিয়ে দেবে।
জাতির সামনে আজ অগ্নিপরীক্ষা বলেই তার মনােবল অটুট রাখা ও ঐক্য ইস্পাতসদৃশ দৃঢ় করা দরকার। কোনােক্রমেই যেন আমাদের মধ্যে আত্মপ্রসাদ বা শৈথিল্যের ভাব না আসে। রণাঙ্গনে আমাদের জওয়ানরা যেন উপলব্ধি করতে পারেন পঞ্চান্ন কোটি ভারতবাসী রয়েছে তাঁদের পেছনে আর গােট জাতি মাতৃভূমির স্বাধীনতা, অখণ্ডতা, রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করতে প্রস্তুত। এখানে দল ও মতের প্রশ্ন নেই। দেশের দুর্দিনে তাকে বিপন্মুক্ত করাই সকলের সমূহ কর্তব্য।

সূত্র: কালান্তর
১৫.১২.১৯৭১