You dont have javascript enabled! Please enable it!

১৯৩৯ সালের আজাদ পত্রিকা

রাজনৈতিক

মোসলেম লীগ ও কংগ্রেস
যুক্তপ্রদেশ মােছলেম লীগ কনফারেন্সের যে অধিবেশন সম্প্রতি গােরক্ষপুরে হইয়া গিয়াছে, তার সভাপতিরূপে নওয়াব মােহাম্মদ এছমাইল খাঁর অভিযােগ হইয়াছিল সারগর্ভ, যুগােপযােগী এবং নানা কাজের কথায় পূর্ণ। নওয়াব মােহাম্মদ এছমাইল খাঁ বর্তমানে মােছলেম লীগের অন্যতম বিশেষ। কাজেই তার অভিভাষণ ভারতীয় মুছলমান সমাজে সবিশেষ গুরুত্ব সহকারে আলােচিত হওয়া উচিত।

প্রথমেই তিনি মােছলেম লীগের আদর্শ, উদ্দেশ্য, নীতির দিক দিয়া পরিবর্তনের স্বরূপ সম্বন্ধে আলােচনা করেন। বিগত লক্ষৌ-অধিবেশনের পূর্বেকার ও তৎপরবর্তী মােছলেম লীগের ভিতরে পার্থক্য সব দিক দিয়া কত বড় এবং কিরূপ বিপুল, নানা উদাহরণ দিয়া তিনি তাহার ব্যাখ্যা করেন। তিনি ইহাকে দস্তুরমত বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন বলিয়াই মনে করেন। বর্তমানে মােছলেম লীগ সম্পূর্ণরূপে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হইয়াছে। বার্ষিক দুইআনা চাঁদা দিয়া যে কোনাে মুছলমান ইহার সদস্য হইতে পারেন। ইহার ফলে ভারতের সমস্ত মুছলমানের সম্মুখেই ইহার দ্বার উন্মুক্ত করা হইয়াছে। ভারতীয় মুছলমানরা ইহাকে দিয়া যেকোনাে আদর্শ, উদ্দেশ্য, নীতি গ্রহণ করাইতে পারেন। ভারতের অধিকাংশ মুছলমান যেহেতু গরীব, কাজেই গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে মােছলেম লীগ গরীবের স্বার্থের প্রতি জোর দিতে বাধ্য। যাহারা বলেন, মােছলেম লীগ ধনী মুছলমানদের প্রতিষ্ঠান, তাঁরা ডাহা মিথ্যা কথা বলেন এবং মােছলেম জনসাধারণের সাথে প্রতারণা করেন।

নওয়াব এছমাঈল খাঁ তার অভিভাষণে উপরােক্ত কথাটা সুস্পষ্ট ভাষায় বুঝাইয়া দিয়া ভালাে করিয়াছেন। কারণ কংগ্রেসী এবং ছন্ন কংগ্রেসী মুছলমানরা ইহা লইয়া ভারী লাফালাফি করিতেছে। তারা প্রচার করিতেছে, মােছলেম লীগ হইতেছে মুছলমান বড়লােকদের শ্ৰেণী-প্রতিষ্ঠান। কাজেই কৃষক-প্রজাদের স্বার্থ মােছলেম লীগ উপেক্ষা করিবে। এদের এই প্রচার কাৰ্য্য যে কত বড় মিথ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত, পরিবর্তিত মােছলেম লীগের গঠনতন্ত্র, আদর্শ, নীতি ইত্যাদি সম্বন্ধে যাঁদের সামান্য মাত্রও ধারণা আছে, তাঁরাই তাহা ধরিতে পারিবেন। দুই আনা মাত্র চাঁদা ধার্য্য করিয়া যার দ্বার সকল মুছলমানের জন্য উন্মুক্ত করা হইয়াছে, তাহাকে নিতান্ত কুচক্রী মিথ্যাবাদী ছাড়া অন্য কেহ বড়লােকদের শ্রেণী-প্রতিষ্ঠান বলিতে পারে না। মুছলমান বড়লােক এদেশে কয়জন আছে? শতকরা ৯৫ জন মুছলমানই তাে গরীব-কৃষক প্রজা? সকলেই যখন দুই আনা চাঁদা দিয়া সদস্য হইতে পারেন, তখন কৃষক-প্রজাদের ইহাতে প্রবেশের বাধা কোথায়? বাধা বিন্দুমাত্র নাই- তারাই ইহাতে ঢুকিয়াছে ও ঢুকিবে এবং তাদেরই মােছলেম লীগে ম্যাজরিটী হইতে বাধ্য। এমতাবস্থায়, কৃষক-প্রজার স্বার্থবিরােধিতা মােছলেম লীগে সম্ভব বলিয়া কি করিয়া কল্পিত হইতে পারে? ভণ্ড, দুষ্টবুদ্ধি, মতলববাজ ছাড়া এরূপ প্রচার কেহই করিতে পারেন না।

তারপর আদর্শ, উদ্দেশ্য, নীতি প্রভৃতির কথা। মােছলেম লীগের আদর্শ-উদ্দেশ্য ভারতের পূর্ণস্বাধীনতা-পূর্ণস্বাধীন ভারতের পূর্ণ স্বাধীন মুছলমানদের অধিকার প্রতিষ্ঠার। ইহাতেও এমন কিছুই নাই, যার দ্বারা মনে হইতে পারে, গরীব মুছলমানরা- মুছলমান কৃষক-প্রজারা কোন দিক দিয়া প্রবঞ্চিত হইবে। যে দেশে শতকরা ১৫ জন মুসলমান গরীব কৃষক-প্রজা, সে দেশের মুছলমানদের অধিকার প্রতিষ্ঠা মানেই ইহাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথাই বেশী করিয়া বুঝায়। নীতির দিক দিয়াও মােছলেম লীগে গরীবদের স্বার্থবিরােধিতার কোনাে কিছু নাই। গরীব মুছলমানরা মােছলেম লীগে বেশী-সংখ্যায় যােগ দিলে তাদের স্বার্থই মােছলেম লীগের স্বার্থ না হইয়া পারে না- হইতে বাধ্য কাজেই উপরােক্ত জুজুর ভয় দেখাইয়া মােছলেম জনসাধারণকে প্রবঞ্চিত করা সম্ভব হইবে না। | যারা কংগ্রেসকে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান বলেন, অথচ মােছলেম লীগকে উহা বলিতে সঙ্কুচিত, তাঁদের দুষ্টবুদ্ধির পরিমাপ করিতে গিয়া নওয়াব এছমাঈল খ বলিয়াছেন ? চার আনার সদস্য যিনি নহেন, সেই গান্ধীজীকে যে-প্রতিষ্ঠান সর্বময় কর্তা বলিয়া চালাইয়া দিয়াছে, সেই প্রতিষ্ঠানকেই যারা গণতান্ত্রিক বলিতে দ্বিধা করেন না, তাদের গণতন্ত্র সম্বন্ধে ধারণা কত উঁচু তাতাে সহজেই অনুমেয়। নওয়াব ছাহেব আরাে বলিয়াছেন:এই গণতন্ত্র যােদ্ধারাই যখন বলেন যে, মােছলেম লীগ বৃটীশ সাম্রাজ্যবাদের সমর্থক, তখন হাসি সংবরণ করা কঠিন হয়। গান্ধীজীই কি সম্প্রতি প্রকাশ্যে বলেন নাই যে, কংগ্রেস বৃটিশ গবর্ণমেন্টের বন্ধু? এবং এই অজুহাতেই কি তিনি দাবী করেন নাই যে, কংগ্রেসই একমাত্র প্রতিষ্ঠান, যার সাথে বৃটিশ সরকার ভারত সম্পর্কে সর্বপ্রকার কথাবার্তা চালাইতে পারেন?

কংগ্রেস গণপরিষদ (Constituent Assembly) লইয়া যে সব বাগাড়ম্বর করিতেছে, নওয়াব এছমাইল খাঁ তারও স্বরূপ বিশ্লেষণ করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন, হিন্দু-মুছলমান সমস্যার সমাধানে যার অথৰ্ব্ব অসামর্থ্য প্রমাণিত হইয়া গিয়াছে, সেই কংগ্রেসের মুখে গণপরিষদের কথা বতই হাস্যকর। সাম্প্রদায়িক সমস্যার অমীমাংসা যে গণপরিষদ আহানের দিক দিয়া একটা দুর্লঙ্ বাধা, এ বাস্তব বােধটুকুও যদি কংগ্রেসের থাকিত, তাহা হইলেও এই শ্রেণীর বাগাড়ম্বর তার কুণ্ঠ হইত। কারণ সাম্প্রদায়িক সমস্যার মীমাংসা ব্যতিরেকে কংগ্রেস আহূত ‘গণপরিষদের প্রতি ভারতের সর্ব শ্রেণীর লােকের আস্থা আসিবে কি করিয়া। কংগ্রেস কর্তৃক গণপরিষদের প্রতিনিধি নির্বাচনই বা সকল দলে মানিয়া লইবে কেন?

দেশীয় রাজ্য আন্দোলন সম্পর্কেও নওয়াব ছাহেব যুক্তিপূর্ণ ও সঙ্গত অভিমত ব্যক্ত করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন ও দেশীয় রাজ্যের প্রজাদের অধিকার বিস্তৃত হােক, ইহা নিশ্চয়ই সকলের কাম্য, কিন্তু সব শ্রেণীর ও জাতির প্রজাদের ন্যায় অধিকার ও দাবী তৎপূৰ্ব্বে স্বীকৃত হওয়া উচিত। নতুবা দল বিশেষের স্বার্থসাধনের উদ্দেশ্যে এই আন্দোলন পরিচালিত হইলে তাহা দ্বারা প্রজাদের সত্যিকার মঙ্গল হইবে না। | সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সম্বন্ধেও নওয়াব ছাহেব সুন্দর কথা বলিয়াছেন। কংগ্রেস বর্তমানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দমনের জন্য কঠোর দমন-নীতি প্রয়ােগ করিতেছেন, এ সম্পর্কে সবিশেষ আলােচনা করিয়া নওয়াব ছাহেব বলিয়েছেন : “Repression cannot solve communal trouble. Suspicion and misapprehension have to be removed and a clear and delineate policy on recognition and fulfilment of religions rights should be evolved after consulting the various leaders of the various communities.” অর্থাৎ “দমননীতি দ্বারা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দূর হইবে না। অবিশ্বাস ও সন্দেহের ভাব দূর করিতে হইবে এবং ধর্মীয় অধিকারের স্বীকৃতি ও পূরণ সম্বন্ধে একটা পরিষ্কার এবং নির্দিষ্টপন্থা অবলম্বন করিতে হইবে। অবশ্য, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সাথে আলােচনা করিয়া।”
উপরােক্ত উক্তির সত্যতা কোনাে ন্যায়দর্শী বুদ্ধিমান ব্যক্তিই অস্বীকার করিতে পারেন না। বস্তুতঃ দাঙ্গার উপর দাঙ্গার সটনে কংগ্রেসী পন্থীরা অতিষ্ঠ হইয়া দমন নীতির যে হাতুড়ে দাওয়াইর ব্যবস্থা করিয়াছেন, তাহা পরিণামে ব্যর্থ হইতে বাধ্য। রােগের আসল কারণের সন্ধান না করিয়া হাতুড়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা কখনাে সুফলপ্রসূ হয় না-হইতে পারে না।

২১ মার্চ ১৯৩৯, ৭ চৈত্র ১৩৪৫, সম্পাদকীয়-১ম, পৃষ্ঠা-৪

নয়া বাংলার গােড়াপত্তন

অসহযোেগপন্থী কংগ্রেস বাংলার আমলাতন্ত্র গবর্ণমেন্টের সহিত সহযােগ করিয়া ১৯২৮ সালে যে প্রজাস্বত্ব আইন পাস করিয়াছিলেন, মানুবর মৌলবী ফজলুল হকের মন্ত্রিমণ্ডল কোয়ালিশন দলের সদস্যবর্গের সাহচর্য্যে, সেই শয়তানী শাসন-শােষণের সমস্ত অভিশাপ বাংলাদেশ হইতে নিঃশেষে দূর করিয়া দিয়াছেন। বাংলার শাইলক সমাজ দুস্থ দুর্গত জনসাধারণের হৃৎপিণ্ড ছিড়িয়া খাইয়া এতদিন নিজেদের জাহান্নামী জঠরজ্বালা নিবৃত্ত করিয়া আসিতেছিল, হকমন্ত্রিমণ্ডল কোয়ালিশন দলের মেম্বরগণের সহায়তায় সেই শাইলক দলের করাল কবল হইতে সর্বহারা কৃষক, প্রজা, শ্রমিক প্রভৃতি দরিদ্র জনগণকে উদ্ধার করার স্থায়ী সুব্যবস্থা করিতেছেন। বাংলার চির-নির্যাতিত ও চরম উৎপীড়িত মানবতা প্রবলের অত্যাচার হইতে আত্মরক্ষা করিতে সমর্থ হইতেছে না প্রধানতঃ যে মুখতার অভিশাপে, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার ব্যাপক প্রবর্তন করিয়া হক মন্ত্রিমণ্ডল তাহার কার্যকরী প্রতিবিধানের ব্যবস্থা করিতেছেন। উচ্চস্তরের ভদ্রনামধারী ব্যক্তিবর্গের সর্বগ্রাসী মানসিকতার ফলে দেশের অধঃপতিত মানব সাধারণ-বাঙ্গালী জাতির শতকরা ৯০ জন সরকারী চাকরী ও দেশের শাসন- অধিকার হইতে এতদিন কার্যতঃ বঞ্চিত হইয়া আসিতেছিল এবং তাহার ফলে জনসাধারণের উচ্চ শিক্ষার পথ ক্রমশই নানা প্রতিক্রিয়ার অবশ্যম্ভাবী উপকরণে বিঘ্নসঙ্কুল হইয়া পড়িতেছিল, সকল সম্প্রদায়ের জন্য সরকারী চাকুরীর সঙ্গত বরাদ্দ নির্ধারিত করিয়া দিয়া হকমীমণ্ডল তাহার প্রতিকারে বদ্ধপরিকর হইয়াছেন। মুছলমান ও তপশিলী হিন্দুদিগের দাবী-দাওয়ার প্রতি নিষ্ঠুর উপেক্ষা ও নির্লজ্জ বিদ্রুপ প্রকাশ করিয়া চলাই ছিল যে কর্পোরেশনের সবচাইতে বড় গৌরবের উপকরণ, কংগ্রেসের সব অভাব ও খেয়াল পূর্ণ করার প্রধান অবলম্বন ছিল যে করপােরেশন এবং প্রধানতঃ সেইজন্যই নানা অসাধুতা ও অনাচারের সমবায়ে সত্য সত্যই এ জীবন আস্তাবলে পরিণত হইয়া আছে যে করপােরেশন-হক মন্ত্রিমণ্ডল স্বার্থান্ধ অনাচারীদিগের অন্যায় আর্তনাদের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করিয়া সেই জঘন্য পুতিগন্ধময় এজীবন আস্তাবলের শুদ্ধি সাধনে দৃঢ়তার সহিত কৃতসঙ্কল্প হইয়াছেন, এবং বাঙ্গালী জাতির নির্বাচিত নিরপেক্ষ ও ন্যায়নিষ্ঠ প্রতিনিধিবর্গ সেই সাধু সঙ্কল্পে বাংলার বর্তমান জনপ্রিয় গভর্ণমেন্টকে সর্বপ্রকারে সাহায্য করিতেছেন। এতদিনের উপেক্ষিত সুযােগ্য মুছলমানগণ হক মন্ত্রিমণ্ডলের নিরপেক্ষতার ফলে উচ্চতর পদসমূহে অধিষ্ঠিত হইতেছেন। অথচ হক মন্ত্রিমণ্ডলকে ধ্বংস করিয়া অন্যান্য প্রদেশের ন্যায়, বাংলায় কংগ্রেসী মন্ত্রীমণ্ডল প্রতিষ্ঠার জন্য তাহাদের দুষ্ট প্রতিষ্ঠা যে দুরভিসন্ধি ও ষড়যন্ত্র গত আড়াই বৎসর ধরিয়া পাকাইয়া আসিয়াছে, এবং এই অসাধু সঙ্কল্পকে জয়যুক্ত করার জন্য তাঁহাদের নানা উপায়ে সঞ্চিত ধনভাণ্ডার যে বিপুল অর্ধের অপব্যয় এযাবৎ করিয়া আসিয়াছে, সে সমস্তই আজ মর্মবিদারক ব্যর্থ বিড়ম্বনায় পরিণত। আমাদের এক বিজ্ঞ সহযােগী কপালে করাঘাত করিয়া বলিয়াছেন-“মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবের সময় যাহাদের (যে কংগ্রেস দলের) ভােটসংখ্যা ছিল ১১১, বর্তমানে সাধারণ ব্যাপারে তাহাদের ভােটসংখ্যা দাঁড়াইতেছে ৬০ হইতে ৬৬ অথবা একান্ত বেশী হইলে ৭০ জন।”

নিজেদের স্বার্থাহত মানসিকতার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায়, সর্বগ্রাসের সনাতন দুর্বুদ্ধির অপরিহার্য কর্মফলে এবং প্রকৃতির প্রবল প্রচণ্ড ও দুর্লষ্য প্রতিশােধে আজ তাঁহারা একেবারে অধৈৰ্য্য হইয়া পড়িয়াছেন- এবং আজ তাঁহাদের অবলম্বন হইয়াছে। গালাগালি। বয়কট ও সত্যাগ্রহের বিকার হইতে আরম্ভ করিয়া মৃত্যু কামনা পৰ্য্যস্ত কিছুই আর তাঁহাদের ও তাঁহাদের উচ্ছিষ্ট যাইতেছে না। দুঃখের বিষয়, মানসিক বিকারের প্রচণ্ডতায় আমাদের এই শ্রেণীর বন্ধুরা ভুলিয়া বসিয়াছেন যে, গালাগালির সাধনায় মানুষ নিজের সুপ্রবৃত্তি ও সৎ প্রকৃতিকে পঙ্গু করিয়া ফেলে মাত্ৰ-প্রতিপক্ষের জয়যাত্রার কোন কিছুই তাহার দ্বারা সাধিত হইতে পারে না।

হক-মন্ত্রিমণ্ডল ও তাহার সমর্থক কোয়ালীশন দলের সদস্যবর্গ ন্যায় ও সত্যকে আদর্শ করিয়া বাঙ্গালী জাতিকে, বাংলার চির নির্যাতিত মানবতাকে শতাব্দীব্যাপী অত্যাচার-অনাচারের কবল হইতে রক্ষা করিতে চাহিতেছেন মাত্র। যতদিন তাহারা এই আদর্শকে সম্মুখে রাখিয়া নিজেদের কর্তব্য পালন করিয়া চলিবেন, প্রতিবাদী আর্তনাদী বন্ধুবর্গের এবং তাঁহাদের ভাড়াটিয়া তর্জাওয়ালাদের খেউড়ে-রুচিহীনতায় তাহা যতই জঘন্য হউক না কেন- এ জয়যাত্রা কোন প্রকারেই বিঘ্ন প্রাপ্ত হইবে না, হইতে পারে না।

ব্যবস্থা-পরিষদের কোয়ালিশনী দলের প্রতিনিধিবর্গকে আমরা এই প্রসঙ্গে বাংলার দুস্থ জনসাধারণের পক্ষ হইতে অশেষ সাধুবাদ জ্ঞাপন করিতেছি। বাংলার দুস্থ মানবতার মুক্তি ও মঙ্গলের ভার আল্লার অনুগ্রহে আজ তাহাদের উপর ন্যস্ত হইয়াছে। দীর্ঘ দুইশত বৎসরের নানা উদ্ৰ-উৎপীড়ন-জর্জরিত তিন কোটি উম্মতে মােহাম্মদীর মঙ্গল-ভবিষ্যৎ রচনা করার সম্পূর্ণ দায়িত্বও আজ বিশেষভাবে তাঁহাদের উপর অর্পিত। এই কর্তব্য তাহাদিগকে পালন করিতে হইবে সম্যকরূপে, সম্পূর্ণরূপে। মুছলমান সমাজ অজ্ঞ নহে, অকৃতজ্ঞও নহে। তাহাদের সেবা ও সাধনা এবং অন্যদের নির্লজ্জ কৃতঘ্নতা সম্বন্ধে সমাজ-মন সম্পূর্ণরূপে সচেতন আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকিবে। বর্তমানে দেশ ও সমাজ তাহাদের নিকট চায়- ঋণ লাঘব আইন, করপােরেশন আইন ও চাকরীর সাম্প্রদায়িক বরাদ্দ নির্ধারণ। স্বদেশের কোটি কোটি মানবকে নানা প্রকারে দাসত্ব-শৃঙ্খলে আবদ্ধ এবং নিষ্ঠুরভাবে দলিত-মথিত করিয়া যাহারা বিদেশীর দরবারে স্বরাজ ও স্বাধীনতা বলিয়া আর্তনাদ তুলিতে থাকে, তাহাদের কাজ ও কথার অসামঞ্জস্য বাংলার গণবিবেক সম্যকভাবে বুঝিতে পারিয়াছে। আজ তাহারা চাহিতেছে আও মুক্তি, সাক্ষাৎ স্বরাজ, সত্যকার স্বাধীনতা। গণমনের এই আকুল ও বিপুল আকাঙক্ষাকে পূর্ণ পরিণত করিয়া “নয়া বাংলার গােড়াপত্তনের ইতিহাসে তাহাদের নাম অক্ষয় হইয়া থাকুক, ইহাই আমাদের অন্তরের প্রার্থনা।

৫ এপ্রিল ১৯৩১, ২২ চৈত্র ১৩৪৫, সম্পাদকীয়-২, পৃষ্ঠা-৪

শােচনীয় মনােবৃত্তি

গয়ার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার যে কারণ প্রকাশ পাইয়াছে, তাহা জানিয়া সহৃদয় ব্যক্তিমাত্রই স্তম্ভিত হইবেন। প্রকাশঃ একবাড়ীর উপর তলায় এক মুছলমান-দম্পতি কলহ করিতে করিতে নাকি একজন অপরের দিকে খাবার-থালা ছুড়িয়া মারে। নীচে একটী হিন্দু বালিকা খেলা করিতেছিল; তার উপরে গিয়া খাবার জিনিষগুলি ছড়াইয়া পড়ে। মুছলমানের আহাৰ্য্য যখন তখন উহা আর গরুর মাংস না হইয়া যায় না। কাজেই পাড়ার হিন্দু বীরদের ধর্মীয় জিকিরে বহু হিন্দু জমায়েত হইল এবং তৎপর শুরু হইল নিতুর ছােরাহুরির খেলা। ফলে এগারােটী মানব-জীবনের অবসান হইয়াছে এবং আহতের সংখ্যা শতাধিকের কম নহে। এই সম্পর্কে নাকি তিনশত লােককে গ্রেফতার করা হইয়াছে।

| যে-দেশে এরূপ তুচ্ছ ব্যাপারেও এমন ব্যাপক নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের অভিনয় অত্যন্ত সহজে সম্ভব হয়, সে-দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আর কী আশা করা যাইতে পারে? সেদেশের সাজ-স্বাধীনতার জন্য হকার উপহাসের মতাে শােনায় নাকি? মনুষ্যত্ব বােধ যেখানে এমন সঙ্কীর্ণ, সেখানে মানুষ পশুর চাইতে কোন্ গুণে শ্রেষ্ঠ? পশুর স্বাধীনতা নিশ্চয়ই মানুষের জন্য কাম্য হইতে পারে না। হিন্দুর সভার প্রচার-ফলে এবং কংগ্রেসী অত্যাচার অব্যাহতভাবে চলিতে থাকায় হিন্দু-সাধারণের মনােভাব কিরূপ বিকৃতি দশাপ্রাপ্ত হইয়াছে, এই দাঙ্গার কারণ বিশ্লেষণ করিলে তাহার সুস্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। সাভারকারের হিন্দু বিপন্নের জিকির এবং কংগ্রেসী রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠার উন্মাদনা একশ্রেণীর হিন্দুদিগকে কিরূপ ভয়াবহরূপে মােছলেম-বিদ্বেন্ধ করিয়া তুলিতেছে, এই দাঙ্গা তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। ইহা হইতেই বুঝিতে পারা যায়, হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুছলমানদের জীবন কিরূপ বিপন্ন হইয়া উঠিয়াছে।

শুধু হিন্দুসভা ও কংগ্রেস-রাজ নহে, জাতীয়তার ‘সােল এজেন্ট বলিয়া বাড়ষরকারী চরম সাম্প্রদায়িক হিন্দু সংবাদপত্রগুলিও বেধে বেগ মােছলেম বিদ্বেষের উত্তেজনা দেশময় ছড়াইয়া অবস্থা অধিকতর ভয়াবহ করিয়া তুলিতেছেন। সহযােগী ষ্টেটসম্যান পৰ্যন্ত এ সম্পর্কে বলিতে বাধ্য হইয়াছেন :

“Will Mr. Saverkar and others pause for reflection? And may we suggest that serious papers should not devote their principal leading articles of the day to the terrible crisis in the country caused by the occasional appointment of a Mussalman to be a deputy acting director of some thing or other in Dustipore. Every Hindu who believe has been ‘passed over’ appear to have the columns of our contemporaries open to him, while at the same time they stoutly assert that they are non-communal”-এর সারমর্ম হইতেছে এই যে, হিন্দু সভা-নেতা মিঃ সাভারকর এবং অন্যান্য হিন্দুনেতাদের এখনাে বিদ্বেষ প্রচারে মত্ত না হইয়া ধীরচিত্তে ভাবিয়া দেখা উচিত। আর সংবাদপত্রগুলিরও একজন মুছলমানকে চাকুরী দেওয়া হইলেই এই তুচ্ছ ব্যাপারে আকাশ পাতাল তােলপাড় করা উচিত নহে। একটা তুচ্ছ চাকুরীও যদি হিন্দুকে বাদ দিয়া মুছলমানকে দেওয়া হয়, অমনি এই সমস্ত কাগজ হিন্দুর স্বপক্ষে চীষ্কার জুড়িয়া দেন এবং প্রাণপণে প্রতিপন্ন করিতে চেষ্টা করেন। যে হিন্দু প্রাথটি ছিল একেবারে অসাম্প্রদায়িক!

বস্তুতঃ ষ্টেটম্যান উপরােক্ত মন্তব্যে একটী কঠোর সত্য প্রকাশ করিয়াছেন। কিন্তু হিন্দু সাংবাদিকদের ইহা মনঃপুত হইবে, এ ধারণা আমরা করিতে পারিতেছি না।

১০ মে ১৯৩৯, ১ বৈশাখ ১৩৪৬, সম্পাদকীয়-১১, পৃষ্ঠা-৪

সাম্রাজ্যবাদের মহিমা

বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের মহিমা অপার। এ মহিমার বহু কাহিনী সাম্রাজ্যবাদী প্রভু ও তাহাদের এজেন্টরা নানাভাবে ও নানাভাবে প্রচার করিয়া আসিয়াছেন। কিন্তু প্রভুরা হয়তঃ ভাবিয়া স্থির করিয়াছেন যে, যে-পুরাতন প্রচার-নীতি এখন অচল। তাই গত “সাম্রাজ্য-দিবসে ভারত-সচীব লর্ড ডেটল্যান্ড নূতন সুরে সাম্রাজ্যবাদের বন্দনা আরম্ভ করিয়াছেন। লর্ড জেটল্যান্ড বুনাে’ রাজনীতিক এবং বাংলার ভূতপূর্ব গবর্ণর হিসাবে ভারতের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মনােবৃত্তি সম্পর্কে তাহার জ্ঞানও যথেষ্ট। তাই তিনি ঝােপ বুঝিয়া কোপ মারিয়া বলিয়াছেন

“আমি অনেক সময় ভাবি যে, ভারতে যাহারা বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের নিন্দাবাদ করিতেছেন, এ কথা তাহারা ভাবিয়া দেখিতে পারেন যে, যে সকল সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আজ রাজনীতি ক্ষেত্রে পশু শক্তির ধ্বজা তুলিয়াছে, তাহাদের কোন একটির অধীন হইলে তাহাদের দশা কি হইত। বৃটিশ সাম্রাজ্যের নাগরিক হিসাবে তাহারা যে অবস্থায় আছেন, তাহার সহিত উক্ত সাম্রাজ্য শক্তিসমূহের অধীন হইলে তাহাদের যে অবস্থা হইত, তাহা তুলনা করিয়া দেখিলে তাহারা লাভবান হইবেন।”

বৃটেনের আশ্রয় ব্যতীত ভারতবর্ষ স্বাধীন ও স্বতন্ত্র দেশরূপে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করিতে পারিবে না, হিন্দু রাজনীতিকবর্গের অনেকেরই এরূপ ধারণা আছে। ইংলন্ড ও ভারতবর্ষের কোন কোন সংবাদপত্রে হালেও একথা প্রকাশ পাইয়াছে যে, কোন কোন কংগ্রেস-নেতা প্রভূধাম লন্ডনে উপস্থিত হইয়া বলিয়া আসিয়াছেন যে, বৃটেন ভারতবর্ষ ত্যাগ করিলে ভারতবর্ষ জাপান বা অন্য বিদেশী শক্তির কবলগত হইয়া পড়িবে। লর্ড জেটল্যান্ড প্রকৃতপক্ষে তাঁহাদেরই অভিমতের প্রতিধ্বনি করিয়াছেন। কংগ্রেসী নেতারা বৃটীশ সাম্রাজ্যবাদের যথার্থ মহিমা বুঝিয়াছেন, লর্ড জেটল্যান্ডের বক্তব্য ইহাই।

দৃষ্টান্ত দ্বারাই বক্তব্য স্পষ্ট ও পরিস্ফুট হয়। তাই লর্ড জেটল্যান্ড দৃষ্টান্ত দিয়া নিজের বক্তব্যকে পরিষ্কার করিয়া দিয়াছেন ।

“Is it conceivable that under any form of Imperialism other than British Imperialism the political party in India which is most vocally and at time vehemently critical of it, should be in power in eight out of eleven provinces with the encouragement and active Co-operation of those agents of British Imperialism, the Governor General and Governors of Provinces?”

অর্থাৎ- “যে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান (কংগ্রেস) তীব্র কঠোর ভাষায় সাম্রাজ্যবাদের নিন্দা করিত, আজ সে কংগ্রেস ভারতের ১১টি প্রদেশের মধ্যে ৮টির কর্তৃত্ব লাভ করিয়াছে তথা সাম্রাজ্যবাদের বাহনে পরিণত হইয়াছে এবং সাম্রাজ্যবাদের প্রতীক বড়লাট ও প্রাদেশিক গবরগণের সহিত দহরম মহরম করিতেছে। এমনটা কি বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ ব্যতীত অপর কোন সাম্রাজ্যবাদের অধীন কল্পনা করা যাইতে পারে?”

সত্যই ইহা কল্পনাতীত। তবে এই অঘটন ঘটাইবার ব্যাপারে যে বাহাদুরী আছে, তাহার প্রাপ্য কংগ্রেস কিম্বা বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের, তাহাই ভাবিবার বিষয়। লর্ড জেটল্যান্ড ইহাকে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের কৃতিত্ব বলিয়া দাবী করিয়াছেন। কিন্তু অনেকে মনে করেন যে, ইহাতে কংগ্রেস ও বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ উভয়েরই কৃতিত্ব আছে। তীব্রকঠোর ভাষার সাম্রাজ্যবাদের নিন্দা করার পর তাহার বাহনে পরিণত হওয়ার যে অসাধারণ ক্ষমতা কংগ্রেসের তথা কংগ্রেসী নেতাদের আছে, তাহা অপর কাহারও নাই। অপর কাহারও যে নাই, তাহা লর্ড জেটল্যান্ড ও তাঁহার সহকর্মী বৃটিশ রাজনীতিকরা মিছরে এবং তাহাদের পূর্বপুরুষরা আমেরিকায় দেখিয়াছেন।

কিন্তু বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের যে মহিমা কংগ্রেসী নেতারা বুঝিয়াছেন, তাহা ভারতের জনসাধারণ এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দল বুঝিতে পারে নাই- বুঝিবেও না। লর্ড জেটল্যান্ড ভারতবাসীকে আশ্বস্ত করিয়া বলিয়াছেন যে, ১৯১৯ সালের ইন্ডিয়া-এ্যাক্টে এবং ১৯২৯ সালে তদানীন্তন রাজপ্রতিনিধির ঘােষণায় ভারতের রাজনৈতিক লক্ষ্য বলিয়া যাহা বিবৃত করা হইয়াছে, তাহা কাৰ্যতঃ “ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন।” ইহা কি সত্য? “ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসনই” যদি ঐ সকল প্রতিশ্রুতির অর্থ হয়, তবে তাহা ১৯৩৫ সালে ইন্ডিয়া এ্যাক্টের মুখবন্ধে স্বীকার করা হইল না কেন? ভারতবর্ষে এ জন্য বহু আন্দোলন হইয়াছে। কংগ্রেসের পক্ষ হইতেও একবার নেহরু-স্কীমের মধ্যস্থতায় ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবী উপস্থিত করা হইয়াছিল। তথাপি ভারত-শাসনআইনের মুখবন্ধে “Dominion status” বা ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন”-এর উল্লেখ পৰ্য্যন্ত করা হয় নাই।

পরিশেষে ভারত-সচীব হিন্দু মােছলেম সমস্যা সম্পর্কেও আলােচনা করিয়াছেন। এত দিনে তিনি বুঝিতে পারিয়াছেন যে, হিন্দু-মােছলেম সমস্যার সমাধানের উপরই ভারতের ভবিষ্যৎ নির্ভর করিতেছে। তিনি বলিয়াছেন

“আজ অন্ততঃপক্ষে এইটুকু পরিষ্কারভাবে বােঝা উচিত যে, যাহাদের নিকট শাসনকায্যের ভার হস্তান্তরিত করা হইয়াছে, তাহাদের পক্ষে প্রথম কয়েক বৎসর পরীক্ষার যুগ। ভারতবাসীরা আজ ভারতের দুই বৃহৎ সম্প্রদায় হিন্দু ও মুছলমানদের বিরােধ মীমাংসার দায়িত্বের সম্মুখীন হইয়াছে। আমি একথা বলিতে দ্বিধাবােধ করি না যে, ভারতীয়গণ উক্ত সমস্যার সমাধান করিতে পারিবে কিনা তাহারই উপরে ভারতের ভবিষ্যৎ নির্ভর করিতেছে।” ইহা খুবই সত্য কথা। তবে ভাবিবার বিষয়, ভারত-সচীব বা রাজপ্রতিনিধি এতদিন এ-সত্য অনুভব করেন নাই কেন? আজ দুই বৎসর ধরিয়া মুছলমানরা কংগ্রেসী শাসনের অধীন নানা প্রকার অবিচার অত্যাচার সহ্য করিয়া আসিতেছে। প্রাদেশিক গবর্ণর ও রাজ-প্রতিনিধি বড়লাটের এ সকল কথা অজানা নয়। তথাপি এ সকল অত্যাচারের প্রতিকার বা হিন্দু-মােছলেম বিরােধ মীমাংসার জন্য আজ পৰ্যন্ত তাহারা কোন চেষ্টা করেন নাই। যে হিন্দু-মোছলেম-সমস্যার উপর ভারতের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে, কংগ্রেসী নেতারা এতদিন পর্যন্ত তাহাকে কোন সমস্যাই নয় বলিয়া উড়াইয়া দিয়া আসিয়াছেন। কংগ্রেসী নেতাদের সহিত এত দহরম মহরম সত্ত্বেও হিন্দু-প্রদেশের গবর্নররা তাহাদিগকে ইহার গুরুত্ব বুঝাইয়া দেন নাই। লর্ড জেটল্যান্ডই বা কেন এতদিন নীরব ছিলেন? কাজেই হঠাৎ তিনি কেন এই হিতােপদেশ প্রচারে ব্রতী হইয়াছেন, তাহার উদ্দেশ্য আজ আমাদিগকে উত্তমরূপে হৃদয়ঙ্গম করিতে হইবে। পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিশ্লেষণ করিয়া দেখিলে ইহা বুঝিতে বিশেষ কষ্ট হইবে না। মনে হয়, গত নির্বাচনের পর কংগ্রেসের শক্তি সম্পর্কে বৃটিশ রাজনীতিকবর্গের ভুল ধারণার সৃষ্টি হইয়াছিল। অথবা ইচ্ছা করিয়াই কংগ্রেসকে নিজের শক্তি সম্বন্ধে ভুল ধারণার সংশােধনের সুযোেগ দিয়া তাঁহারা এতদিন তামাশা দেখিতেছিলেন। কংগ্রেসী রাজনীতিকরা বার বার দাবী করিয়া আসিয়াছেন যে, সমগ্র ভারত তাহাদের ইজারা মহল। কিন্তু মিঃ জিন্না তথা মােছলেম-লীগ তাহাদের সেই ভুল ভাঙ্গিয়া দিয়াছেন।

মুছলমানকে বাদ দিয়া ভারতের রাজনীতি যে অচল, তাহা কংগ্রেস ও সাম্রাজ্যবাদী প্রভু উভয়ই এখন বুঝিতে আরম্ভ করিয়াছেন। তাই লর্ড জেটল্যান্ড এখন হিন্দু-মােছলেম সমস্যা সমাধানের গুরুত্ব উপলব্ধি করিতেছেন। শুধু কি ইহাই? কংগ্রেসী বড় কর্তাদের টনকও নড়িয়াছে। সুভাষ বাবুর মুখে লীগের মহিমা পাঠকগণ পূৰ্বেই শুনিতে পাইয়াছেন। ঐ দিকে পণ্ডিত জওয়াহেরলালও সুর বদলাইয়া গত “রাজনৈতিক-বন্দী দিবসে” অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলিয়াছেন- “মােছলেম লীগ মুছলমান জনসাধারণের মধ্যে জাগরণ আনিয়া দিয়াছে।” আমরা বলি- আর কিছুদিন অপেক্ষা করুন, কংগ্রেসী নেতা ও বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা মােছলেম লীগের আরও শক্তির পরিচয় পাইবেন।

২৭ মে ১৯৩১, ১৩ জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৬

ঢাকার উপনির্বাচন

কৃষক-প্রজা দলের নেতা মিঃ শামছুদ্দিন আহমদ ঘােষণা করিয়াছিলেন- ঢাকার মােছলেম লীগের সহিত তাহাদের যে বিরাট শক্তি-পরীক্ষা আরম্ভ হইল, তাহাতে লীগের শােচনীয় পরাজয় সুনিশ্চিত। নিজের শক্তি সামর্থ্য ও প্রভাব প্রতিপত্তি সম্বন্ধে মিঃ শামছুদ্দিন চিরকালই অত্যন্ত অতিরঞ্জিত ধারণা পােষণ করেন এবং তাহার ফলাফলও তাহাকে চিরকালই হাতে হাতে লাভ করিতে হইয়াছে। প্রকাশ, নিজের এই শক্তি-গর্বে আত্ম-বিস্মৃত হইয়া এই নির্বাচন উপলক্ষে মান্যবর মওলবী এ, কে, ফজলুল হক ছাহেবকে প্রকাশ্যভাবে ‘চ্যালেঞ্জ দিতেই নাকি এবার তিনি কুণ্ঠিত হন নাই? কলিকাতার বিভিন্ন হিন্দু-সংবাদপত্র, বিশেষতঃ হিন্দু মহাসভার প্রধান প্রচারপত্র আনন্দবাজার, এই নির্বাচন উপলক্ষে নিয়মিতভাবে যেরূপ প্রচারণা চালাইয়াছিলেন, আশা করি, পাঠকগণ তাহা ইতিমধ্যে বিস্মৃত হন নাই। ঢাকার মুছলমান আনন্দবাজারের সমর্থিত কৃষক-প্রজাদলের প্রার্থীকে সমর্থন করার জন্য একেবারে ব্যাকুল হইয়া উঠিয়াছে। দশ হাজার মুছলমান “মােছলেম লীগ মােৰ্দাবাদ” ধ্বনি করিতে করিতে হক সাহেবের সভা বর্জন করিয়া শামছুদ্দিন মিয়ার সভায় যােগদান করিয়াছে, সমস্ত মুছলমানই মিঃ রেজাই করিমকে ভােট দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করিয়াছে, সুতরাং লীগ প্রার্থীর পরাজয় ও করিম ছাহেবের বিজয় সুনিশ্চিত এই শ্রেণীর বহু ভিত্তিহীন সংবাদ এবং তাহার স্থাপিত সম্পাদকীয় মন্তব্য, ঐ সব সংবাদপত্রে অবিরত প্রকাশিত হইয়া আসিয়াছে। বিশ্বস্তসূত্রে ঢাকা হইতে আরও যেসব সংবাদ আসিয়াছে, তাহাতে জানা যাইতেছে যে, ফরিদপুরের পীর বাদশামিয়া ছাহেব, দিনাজপুরের মাওলানা আবদুল্লাহেল বাকী ছাহেব, মিঃ শামছুদ্দিনের সঙ্গে যােগ দিয়া ভােটের দিন পৰ্য্যন্ত ঢাকার নির্বাচন কেন্দ্রে কাওমীভাবে চড়াও করিয়াছিলেন। কিন্তু এই সব পীর, মিষ্টার, মাওলানা ও শ্রীযুক্ত সম্পাদকের সমস্ত অপচেষ্টা ও অন্যায় অভিসন্ধি, ঢাকার জাগ্ৰত-ঈমান মুছলমান ভােটারগণ সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত বিপর্যস্ত পদদলিত ও নিষ্পেষিত করিয়া এছলাম ধৰ্ম ও মুছলমান জাতির গৌরবকে অক্ষুন্ন রাখিয়াছে, মােছলেম লীগের বিজয় বৈজয়ন্তীকে অভূতপূর্ব সাফল্যে জয়যুক্ত করিয়া দিয়াছে। নির্বাচনের পূর্বে আমরা বলিয়াছিলাম- ঢাকাই হইতেছে নিখিল ভারত মােছলেম লীগের জন্মস্থান, ঢাকার ভক্তিভাজন নওয়াব ছলিমুল্লা মরহুমের সাধনায় তাহার পুষ্টি ও উন্নতি। সুতরাং আমরা দৃঢ়তার সহিত আশা করিতেছি, ঢাকার মুছলমান সমাজ নিজেদের সেই গৌরবইতিহাসকে কলঙ্কিত করিয়া ফেলিতে কখনই সম্মত হইবে না। আমাদের সে আশা সফল হইয়াছে, ঢাকা নিজের ইতিহাসকে রক্ষা করিয়াছে, উজ্জলতর করিয়া তুলিয়াছে।

মাত্র ক এক সপ্তাহ পূর্বে কেন্দ্রীয় পরিষদের রাজশাহী বিভাগের উপনির্বাচনে, মােছলেম লীগের মনােনীত প্রার্থী ডাঃ হাবিবর রহমান ছাহেব তাহার প্রতিদ্বন্দ্বীকে বিপুল ভােটাধিক্যে পরাজিত করিয়া সগৌরবে নির্বাচিত হইয়াছেন। ১৯৩৭ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর হইতে আজ পর্যন্ত বাংলার মােছলেম কেন্দ্রে তাহাদের ভােটের সংখ্যা এইরূপ ঃ

চৌধুরী লবীবুদ্দিন ছিদ্দিকী ২৪৩০
মিঃ রেজায়ে করিম ২১০৮
মিঃ আবুল মােজাফফর ২২৯
মোট ৪৭৩৭
ছৈয়দ ছাহেবে আলম ১২০৩৮৫

সুতরাং লীগ-প্রার্থী তিনজন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সমবেত ভােট অপেক্ষা ৭৩১৮ ভােট বেশী পাইয়াছেন। শামছীয়া কৃষক-প্রজার মনােনীত প্রার্থী মিঃ রেজায়ে করিম ২১০৮টী ভােট পাইয়া তৃতীয়স্থান অধিকার করিয়াছেন। লীগ-প্রার্থী তাঁহাকে পরাজিত করিয়াছেন- ৯৯৭৭ ভােটে। আর মাত্র দুইটী ভােট কম হইলে তাহারা আমানতী টাকাও বাজেয়াপ্ত হইয়া যাইত। | লীগ-প্রার্থীর এই বিজয় তাহার ব্যক্তিগত বিজয় নহে, মৌঃ ফজলুল হক ছাহেবের বিজয় নহে, বরং বস্তুতঃ মােছলেম লীগের বিজয়ও নহে। মােছলেম বঙ্গের জাতীয় জীবনের স্তরে স্তরে আত্মরক্ষা ও আত্মপ্রতিষ্ঠার যে অটুট সঙ্কল্প আজ অভিনব দৃঢ়তার সহিত জাগ্রত হইয়া উঠিয়াছে, দলত্যাগী সমাজদ্রোহীদিগের কুকীর্তির যে তীব্র গভীর অনুভূতি আজ বাঙ্গালী মুছলমানের অন্তরে অন্তরে বদ্ধমূল হইয়া গিয়াছে, এবং মােছলেম-বৈরী অমুছলমান রাজনীতিকগণের ও তাঁহাদের পােয্য কুপােষ্য বর্গের নানা অনাচারে অত্যাচারে মুছলমানের ঈমানে ও আত্মসম্মান জ্ঞানে যে প্রচণ্ড বিক্ষোভের সৃষ্টি হইয়া গিয়াছে-আজিকার এ সাফল্যকে মােছলেম বঙ্গের সেই ভাব, অনুভূতি, সাধনা ও সঙ্করে অবশ্যম্ভাবী বিজয় ব্যতীত আর কিছুই বলা যাইতে পারে না। মিঃ শামছুদ্দিনও যদি আজ পদত্যাগ করিয়া পুনরায় নির্বাচনপ্রার্থী হইতে প্রস্তুত হন, তাহা হইলে তাহাকে মােছলেম লীগের প্রার্থীর নিকট মিঃ রেজায়ে করিম অপেক্ষা অধিকতর শােচনীয়রূপে পরাজিত হইতে হইবে, এ ঘােষণা দৃঢ়তার সহিত প্রচার করা যাইতে পারে। মিঃ রেজায়ে করিমের এই পরাজয় হইতে নিঃসন্দেহরূপে প্রতিপন্ন হইতেছে যে, দলত্যাগী ছদ্মকংগ্রেসী শামছীয়া কৃষক-প্রজাদলের অবলম্বন নীতি ও কার্যপদ্ধতির সমর্থন বাংলার মুছলমান একবিন্দুও করে না। পক্ষান্তরে, গত দুই বত্সরের সমস্ত উপনির্বাচনে মােছলেম-লীগ সর্বত্রই যে অসাধারণ সাফল্যলাভ করিয়া আসিয়াছে, তাহা হইতে স্পষ্টতঃ জানা যাইতেছে যে, মােছলেম বঙ্গের সাধারণ ও সমবেত জনমত মােছলেম লীগেরই সমর্থক।

এই বিজয়ের জন্য ঢাকার মুছলমান ভােটারগণকে, মােছলেম লীগের স্থানীয় নেতা ও কর্মীবৃন্দকে, মােছলেম বঙ্গের একচ্ছত্র নেতা মৌলবী ফজলুল হক ছাহেবকে এবং বিজয়ী প্রার্থী মিঃ ছৈয়দ ছাহেবে আলমকে বাংলার মুছলমান সমাজের পক্ষ হইতে আন্ত রিক মােবারকবাদ জ্ঞাপন করিতেছি। বাঙ্গালী মুছলমানের এই ভাব ও অনুভূতি, এই সাধনা ও সg চিরস্থায়ী হউক, সৰ্ববিজয়ী হউক, সর্বসদ্ধিদাত্য রহমানের-রহীম আল্লার দরগাহে, অশেষ শােকরীয়া সহকারে, ইহাই আমাদের অন্তরের প্রার্থনা।

১৪ জুন ১৯৩৯, ৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৬, সম্পাদকীয়-১ম, পৃষ্ঠা-৪

গণ-পরিষদ

কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটীর এলাহাবাদ অধিবেশন সমাপ্ত হইয়াছে। পাঁচদিন আলােচনার পর কংগ্রেসী বড় কর্তারা বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে যে সুদীর্ঘ প্রস্তাব গ্রহণ করিয়াছেন, তার মােন্দা কথাটা হইল গণপরিষদ। প্রস্তাবােত গণ-পরিষদ সম্পর্কিত অংশটুকু আমরা নিম্নে উদ্ধৃত করিলাম । কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি এ কথাও জানাইতেছেন যে, বৃটিশ শাসননীতি হইতে সাম্রাজ্যবাদের কলঙ্ক দূর করার জন্য এবং অতঃপর সহযােগিতা করার বিষয় কংগ্রেসকে বিবেচনা করিতে দিবার জন্য, স্বাধীনতা ও গণপরিষদের মারকুঠে নিজেদের শাসনতন্ত্র প্রণয়নে ভারত-বাসীর অধিকার অনুমােদন করা একান্ত প্রয়ােজন। তাহাদের মতে, স্বাধীন জাতির গঠনতন্ত্র প্রণয়নের একমাত্র গণতান্ত্রিক উপায় হইল এই গণ-পরিষদ এবং গণতন্ত্রে ও স্বাধীনতার আস্থাবান কোন ব্যক্তির পক্ষেই উহাতে আপত্তি উত্থাপন করা সম্ভবপর নহে। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির ইহাও দৃঢ়বিশ্বাস যে, সাম্প্রদায়িক ও অন্যান্য সমস্যা সমাধানেরও একমাত্র প্রকৃষ্ট পন্থা হইল এই গণপরিষদ। তাই বলিয়া ইহা দ্বারা ইহা বুঝাইতেছেন যে, সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধানে ওয়ার্কিং কমিটির প্রচেষ্টা শিথিল করা হইবে। প্রস্তাবিত গণপরিষদই সংখ্যালঘিষ্ঠ বলিয়া স্বীকৃত সম্প্রদায়সমূহের (accepted minorities) অধিকারসমূহ তাদের সন্তোষজনকভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করিয়া শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করিতে সমর্থ হইবে এবং সংখ্যালঘিষ্ঠ সম্প্রদায়ের অধিকার সম্পর্কে কোন কোন বিষয়ে যদি কোনরূপ আপােস-মীমাংসা হওয়া সম্ভবপর না হয়, তবে তাহা সালিশ দ্বারা নিষ্পত্তি করার ব্যবস্থা করা চলিবে প্রাপ্ত বয়স্কদের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত প্রতিনিধিমণ্ডলী দ্বারা গণ-পরিষদ গঠিত হইবে। যেসব সংখ্যালঘিষ্ঠ সম্প্রদায় বর্তমানের পৃথক নির্বাচন-প্রথা বজায় রাখিতে ইচ্ছুক হইবে, তাহাদের জন্য ইহা বজায় রাখা হইবে। গণ-পরিষদে এই সকল সদস্যের সংখ্যা দ্বারা ঐসব সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা প্রতিফলিত হইবে।”

প্রস্তাবের প্রথমাংশে গণ-পরিষদের প্রকৃতি ও অধিকার এবং শেষাংশে তার নির্বাচন-পদ্ধতির স্বরূপ বর্ণনা করা হইয়াছে। প্রস্তাবিত গণপরিষদের প্রকৃতি ও অধিকারসমূহের মধ্যে দেখা যায় ঃ গণ-পরিষদই ভাবী ভারতীয় শাসনতন্ত্র রচনা করিবে, আর তার এই রচনাই হইবে একমাত্র গণতন্ত্রসম্মত। সাম্প্রদায়িক ও অন্যান্য সমস্যার সমাধান করিবে এই গণ-পরিষদ এবং পরিষদ যে শাসনতন্ত্র রচনা করিবে, তাহাতে সংখ্যালঘিষ্ঠ বলিয়া স্বীকৃত সম্প্রদায়সমূহের অধিকার তাদের সন্তে যিজনকভাবে সংরক্ষিত করিবে। কি সংখ্যালঘুদের অধিকারের নির্ধারণ যদি আপােষমীমাংসা দ্বারা সম্ভব না হয়, তবে গণপরিষদ তাহা সালিশের দ্বারা নিষ্পত্তি করাইবে।

কংগ্রেস-প্রস্তাবিত গণ-পরিষদের প্রকৃতি ও অধিকারগুলি লইয়াই প্রথমে আলােচনা করা যাউক। বলা হইয়াছে যে, স্বাধীন জাতির শাসনতন্ত্র প্রণয়নের একমাত্র গণতান্ত্রিক উপায় হইল গণপরিষদ এবং ইহাতে গণতন্ত্রে আস্থাবান কোনাে ব্যক্তিই আপত্তি করিতে পারে না। মানিয়া লওয়া গেল যে, এ কথা খুবই ঠিক।

ভারতবাসীর এ-দাবী মানিয়া লইবার মতাে উদারতা বৃটীশ গভর্ণমেন্টের আছে, তবে জিজ্ঞাস্য ঃ শুধু কংগ্রেসের দাবীকে সারা ভারতবর্ষের দাবী বলিয়া গ্রহণ করিতে বৃটিশ গভর্ণমেন্ট কেন অগ্রসর হইবেন? কংগ্রেস ভারতবর্ষের প্রতিনিধি, এ-কথা কংগ্রেস বার বার বলিলেও বৃটিশ গভর্ণমেন্ট তাহা স্বীকার করেন নাই, হিন্দু মহাসভা, মুছলমান ও অন্যান্য সংখ্যালঘু দলগুলিও তাহা দৃঢ়কণ্ঠে অস্বীকার করিয়াছে।

এমত অবস্থায় ভারতবর্ষের পক্ষ হইতে সত্যকার দাবী উপস্থিত করিতে হইলে এবং তাহা বৃটিশ গবর্ণমেন্ট কর্তৃক গ্রহণ করাইতে হইলে, তার জন্য শুধু কংগ্রেসের একক দাবীই যথেষ্ট বিবেচিত হইতে পারে না- মুছলমান ও অন্যান্য সংখ্যালঘু দলগুলির পূর্ণসম্মতিও উহাতে আবশ্যক। কংগ্রেসের গণ-পরিষদ আহানের দাবী এযাবত মুছলমান ও অন্যান্য সংখ্যালঘু দলগুলি মানিয়া লয় নাই। কংগ্রেসী বড়কর্তারা এ-সম্পর্কে এই বলিয়াছেন যে, তাদের বিশ্বাস, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রে বিশ্বাসী কোনাে ব্যক্তিই এই দাবীতে আপত্তি করিতে পারে না। কিন্তু এটা হইল সেরেফ বিশ্বাসের কথা- যুক্তির কথা নয়। কংগ্রেসী বিশ্বাসই যে সারা ভারতবর্ষের বিশ্বাস নয়, সম্মিলিত দাবী রচনায় অসামর্থ্য তাে তারই প্রমাণ। কাজেই বিশ্বাসের কথা উত্থাপন করিয়া কোনাে লাভ নাই- দেখিতে হইবে এ সম্পর্কে বাস্তব পরিস্থিতি কি। তাহা এই যে, কংগ্রেসের এই গণ-পরিষদের দাবীতে মুছলমান ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের সমর্থন নাই। এবং যেহেতু কংগ্রেসকেই সারা ভারতের প্রতিনিধি বলিয়া বৃটীশ সরকার স্বীকার করেন না, তাই এ-দাবী বৃটীশ সরকারকে স্বীকার করিয়া লওয়ার আব্দার বাস্তববােধহীনতারই প্রকৃষ্ট প্রমাণ। এ দাবী স্বীকার করাইয়া লইতে হইলে দরকার ভারতের সর্বসম্প্রদায়ের সম্মিলিত দাবী। কাজেই এই দাবী উপস্থিত করার আগে মুছলমান ও অন্যান্য সংখ্যালঘু দলগুলির সাথে কংগ্রেসের আপােষ-মীমাংসা হওয়া অত্যাবশ্যক- শুধু তাই নয়, একেবারে অপরিহায্য। এমত অবস্থায় সাম্প্রদায়িক ও সংখ্যালঘু সমস্যা-সমাধানের আগে গণ-পরিষদ আহ্বানের দাবী হইতেছে ঘােড়ার সম্মুখে গাড়ী মুতিয়া দেওয়ার ন্যায় হাস্যকর কল্পনা মাত্র।

যদি ধরিয়া লওয়া যায় যে, বৃটিশ গবর্ণমেন্ট মুছলমান ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের সমবেত আপত্তি অগ্রাহ্য করিয়া কংগ্রেসী দাবীই মানিয়া লইবেন (যদিও এরূপ মনে করিবার কোনাে যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখা যায় নাই), তবু প্রশ্ন জাগে ও প্রস্তাবিত গণপরিষদের নির্বাচন-পদ্ধতি সকলে মানিয়া লাইতে পারিবে কি? “সংখ্যালঘিষ্ঠ বলিয়া স্বীকৃতি” (Accepted minorities) সম্প্রদায়সমূহ বলিতে বড়কর্তারা কাহাদিগকে বুঝাইতে চাহিয়াছেন? ষ্টেটসম্যানের সংবাদদাতার মতে, মুছলমান ও শিখ ছাড়া অন্য কাহাকেও কর্তারা সংখ্যালঘিষ্ঠ বলিয়া স্বীকৃত সম্প্রদায় হিসাবে মানিয়া লইবেন না। একথা সত্য হইলে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলির ইহা গ্রহণযােগ্য হইতে পারে না। খৃষ্টান, বৌদ্ধ, এ্যাংলাে-ইন্ডিয়ান- বিশেষ করিয়া, অনুন্নত হিন্দু সম্প্রদায়ের সাথে গত গােলটেবিল বৈঠকে মুছলমানদের যে যুক্তি হইয়াছিল, তাহা অগ্রাহ্য করিয়া কোনাে মীমাংসার কথা কল্পনা করাও মুছলমানদের পক্ষে অসম্ভব।

তাছাড়া সম্প্রদায়গুলির মধ্যে আপােষ-মীমাংসা সম্ভবপর না হইলে তাহা সালিসের দ্বারা মীমাংসার যে পাতি বড়কর্তারা দিয়াছেন, সে সম্বন্ধে বক্তব্য ঃ এই সালিস হইবেন কে, এবং তাহা নির্ধারণই বা করিবেন কাহারা? গণ-পরিষদ নির্ধারণ করিতে গেলে হিন্দু-ম্যাজরিটীর রায়ই বলবৎ হইবে। কিন্তু তাহা মাইনরিটীর কাছে আপত্তিকর বিবেচিত হওয়ারই ষােলআনা সম্ভাবনা। কোনাে আন্তর্জাতিক ব্যক্তি বা সকেও এর ভার দেওয়াতে সকলে একমত হইতে পারিবেন না। কারণ, ভারতের বিশেষ অবস্থা যাদের সম্যক জানা নাই, তাদের উপর এমন গুরুতর ব্যাপারের ভার দিতে স্বভাবতঃই অনেকে কুষ্ঠিত না হইয়া পারেন না। এমত অবস্থায় এই সালিসের প্রস্তাব অবাস্তব এবং অন্তঃসারশূন্য ফাকি মাত্র।

পরিশেষে প্রাপ্ত বয়স্কদের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে গণপরিষদের সমস্ত নির্বাচনের কথা আমাদের মতে ইহা একটা অসম্ভব প্রস্তাব। ৩৫ কোটীর একটা বিরাট মহাদেশে প্রায় প্রাপ্ত বয়স্ক ২৫ কোটী লােকের একযােগে এরূপ একটা নির্বাচন পরিচালনার কল্পনা শুধু আকাশচারী স্বাপ্নিকদের মনেই উদিত হইতে পারে।

বস্তুতঃ গণপরিষদের কল্পনায় বিরাট অবাস্তবের মােহ যতটা আছে, বাস্তব-বােধ ততটা নাই। এসব বড়ম্বরের পরিবর্তে কংগ্রেস যদি শুধু মােছলেম লীগের সাথে আপােষ করিয়া ফেলিতে পারেন, তবে আসল কাজ হইবে বেশী। বড়কর্তাদের প্রস্তাবে লীগের সাথে এই আপােসেরও একটা আভাস আছে- এই যা আশার কথা। যদি এই আপােষ সম্ভব না হয়, তবে অবাস্তবের পিছনে ঘুরিয়া বেড়ানােই কংগ্রেসের সার হইবে।

২৫ নভেম্বর ১৯৩৯, ১ গ্রহণ ১৩৪৬, সম্পাদকীয়-১ম, পৃষ্ঠা-৪

“ভীষণ বিক্ষোভ”

মুক্তি দিবস পালনের নির্দেশ দিয়া মিঃ মােহাম্মদ আলী জিন্না কংগ্রেসের মােছলেমবিনাশী দুরভিসন্ধির মস্তকে যে কঠোর কুঠারাঘাত করিয়াছেন, কংগ্রেসী নেতারা তাহার ফলে অতিমাত্রায় বিচলিত হইয়া পড়িয়াছেন। কারণ, আঘাতটা ঠিক সময়ে ও ঠিক জায়গায় করা হইয়াছে। তাই, মুছলমান সমাজকে মুক্তি-দিবস পালনের কর্তব্য হইতে বিরত রাখার অপচেষ্টায় এখন তাহাদের সমস্ত শক্তি ও প্রতিভার সদ্ব্যবহার আরম্ভ হইয়াছে। কংগ্রেসের মুখপত্রগুলি মুছলমানকে বুঝাইতে চাহিতেছেন যে, মিঃ জিন্নার নির্দেশের বিরুদ্ধে মােছলেম-ভারতের দিকে দিকে প্রচণ্ড বিক্ষোভ উপস্থিত হইয়াছে, মুছলমান নেতারা মুক্তিদিবস পালনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানাইয়াছেন।

আমাদের এক হিন্দু সভাপহী কংগ্রেসী সহযােগী, ব্যাপারটাকে ঘােরাল করিয়া তােলার জন্য এইসব “মুসলীম নেতার নামের তালিকাও প্রকাশ করিয়া দিয়াছেন, যাহার জন্য সহযােগীর নিকট মুছলমান মাত্রই কৃতজ্ঞ। এই তালিকায় সাড়ে তিন ডজ্জন মােছলেম নেতার নাম সন্নিবেশিত হইয়াছে। তালিকাটী সেই পুরাতন ‘থােড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি ঘােড়’ ছাড়া আর কিছুই নয়। মওলানা আবুল কালাম আজাদ হইতে আরম্ভ করিয়া তারু মিয়া হারু মিয়া পর্যন্ত কংগ্রেসী বা কংগ্রেসের বশংবদ মুছলমানদের নাম কয়টি বহু যত্নে এই তালিকায় সঙ্কলন করিয়া দেওয়া হইয়াছে। কংগ্রেসী গবর্ণমেন্টের ভূতপূর্ব মুছলমান মন্ত্রী কয়টীও বাদ যান নাই। ইহার উপর অধিক বাংলার স্বনামখ্যাত উদ্দীন-কোম্পানী। কংগ্রেসী সাংবাদিকগণের মতে ইহারাই হইতেছেন মােছলেম-ভারতের নেতা এবং ইহাদের প্রতিবাদই হইতেছে মুছলমান জাতির সমবেত প্রচণ্ড ও ব্যাপক বিদ্রোহ। কিন্তু প্রচারণার আগ্রহাতিশয্যে সহযােগীরা ভুলিয়া গিয়াছেন যে, তাঁহাদের প্রদত্ত নামের তালিকাই মােছলেম ভারতকে মুক্তি দিবস পালনে অধিক মাত্রার আগ্রহশীল করিয়া তুলিবে। কারণ, মুক্তিদিবস পালন মুছলমান সমাজের পক্ষে বিশেষ আবশ্যক ও উপকারী না হইলে এই শ্রেণীর লােকরা কখনই তাহার প্রতিবাদের কষ্ট স্বীকার করিতেন না, ঐতিহাসিক সত্য হিসাবে মুছলমান সমাজ আজ এই তথ্যটী মর্মে মর্মে অনুভব করিতে বাধ্য হইয়াছে।

মুছলমান সমাজকে প্রতারিত করার এই অতি আগ্রহের ফলে আমাদের সত্যাগ্রহী বন্ধুরা অধঃপতনের কোন স্তরে গিয়া উপনীত হইয়াছেন, তাহার একটী মাত্র নমুনা পাঠকগণের খেদমতে উপস্থিত করিতেছি। যেসব মহামান্য মােছলেম নেতা মিঃ জিন্নার নির্দেশের প্রতিবাদ করিয়াছেন বলিয়া হিন্দু সংবাদপত্রগুলিতে প্রকাশ, তাহাদের মধ্যে আসামের নেতারাও আসাম প্রাদেশিক মােছলেম যুব-সমিতির প্রেসিডেন্ট বলিয়া মিঃ পি, এম, শাহাবুদ্দিনের নাম পুনঃ পুনঃ ঘােষিত হইয়া আসিতেছে। সিলেটের বিভিন্ন ও সম্রান্ত বন্ধুর পত্র হইতে জানিতে পারিলাম যে, এই নেতা ছাহেব একটী স্কুলের ছাত্র, ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য কিছুদিন হইতে চেষ্টা করিতেছেন। এই বালক ছাত্রীকে মােছলেম ভারতের মহামান্য নেতার আসনে বসাইয়া দিতেও সহযােগীদের বা তাহাদের স্থানীয় সংবাদদাতাদের বিবেকবুদ্ধিতে একটুও কুণ্ঠা অনুভূত হয় নাই। কিন্তু সকল সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিশেষরূপে জানিয়া রাখা উচিত যে, এই শ্রেণীর প্রতারণার দ্বারা মুছলমান সমাজকে বঞ্চিত করার দিন অনেক পূর্বেই অতিবাহিত হইয়া গিয়াছে।

২০ ডিসেম্বর ১৯৩৯, ৪ পৌষ ১৩৪৬, সম্পাদকীয়-২, পৃষ্ঠা-৪

অর্থনৈতিক

নূতন ঋণ-সমস্যা

পল্লীবঙ্গের ঋণ-সমস্যা বলিতে আমরা সাধারণতঃ পল্লীবাসী জনসাধারণের দুর্বহ ঋণভার ও তাহা পরিশােধ করার উপায় সংক্রান্ত সমস্যাগুলিকেই বুঝিয়া থাকি। এইরূপ বুঝিবার কতকগুলি বিশেষ কারণও আছে। কিন্তু নূতন ব্যবস্থার প্রবর্তন ও পুরাতন

অবস্থার পরিবর্তন ফলে আজ দেশবাসীর সম্মুখে যে নূতন পরিস্থিতি উপস্থাপিত হইয়াছে, তাহাতে ঋণ-সমস্যার দ্বিতীয় দিকটার প্রতি সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ মনােযােগ প্রদান করাও সমাজের চিন্তা নাহকগণের পক্ষে বিশেষ আবশ্যক হইয়া দাঁড়াইয়াছে।
সকলেই জানেন, ঋণ-সমস্যার দ্বিতীয় দিক এবং বর্তমান অবস্থার গুরুতর দিকহইতেহে ঋণ সগ্রহের সমস্যা। ঋণ-শালিসী আইন ও বর্তমানে ব্যবস্থা-পরিষদের বিচারাধীন মহাজনী কারবার আইন, জনসাধারণকে তাহাদের বর্তমান বিপদে বহু পরিমাণে সাহায্য করিতে পারিবে, ইহা নিঃসন্দেহে বলা যাইতে পারে। পল্লীবঙ্গের জনসাধারণের, বিশেষতঃ বাংলার কৃষক সমাজের বর্তমান ঋণভার কিরূপ দুৰ্বহ, উভয় সরকারী ও বে-সরকারীভাবে সে সম্বন্ধে এ যাবৎ তাহার অনেক আলােচনা হইয়া গিয়াছে। মােটর উপর সেই সব আলােচনার সমবেত সিদ্ধান্ত এই যে, পন্নী বঙ্গের জনসাধারণ আজ যে পরিমাণে ঋণগ্রস্ত হইয়া পড়িয়াছে, তাহাদের সমস্ত স্থাবর সম্পত্তি বিক্রয় করিয়া দিয়াও সে ঋণ পরিশােধ করা সম্ভব হইবে না। এই ঋণভারের নিষ্ঠুর নিপেষণে বাংলার প্রজাসাধারণের জীবন-রস দিন দিন কিরূপ শােচনীয়ভাবে শুকাইয়া আসিতেছে এবং সমাজের সকল স্তরের উপর তাহার অর্থনৈতিক প্রভাব ক্রমশই কি প্রকার মারাত্মক হইয়া দাঁড়াইতেছে, তাহার পুঙ্খানুপুঙ্খ আলােচনাও বহুবার হইয়া গিয়াছে। সকলে স্বীকার করিয়াছেন যে, দেশের দুস্থ দুর্গত জনসাধারণকে, তাহাদের দুর্বহ ঋণভারের বর্তমান নিষ্পেষণ হইতে উদ্ধার করার জন্য অনতিবিলবে কোন প্রকার সঙ্গত ব্যবস্থা অবলম্বিত হওয়া একান্ত উচিত। বাংলার শাসনকার্যে মুছলমান প্রতিনিধিগণের প্রভাব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গেই, ইহার প্রতিকার-প্রচেষ্টার সূচনাও স্বভাবতঃ আরম্ভ হয়। হক মন্ত্রিমণ্ডলের আন্তরিক চেষ্টায় এবং কোয়ালীশন দলের সদস্যগণের আগ্রহে ও সমর্থনে এই প্রচেষ্টা আজ সফলতার দিকে অনেক দূর অগ্রসর হইয়াছে। অদূর-ভবিষ্যতে এই সাফল্য পূর্ণ পরিণত হইয়া যাইবে, এ-আশা আজ নিঃসন্দেহে করা যায়।

অবস্থার পরিবর্তন পূর্ব হইতে হইয়া চলিয়াছে, এবং আমরা যতটুকু বুঝি, তাহার প্রধান কারণ হইতেছে উৎপন্ন শষ্যের মূলহাস। ইহার ফলে বাংলার কৃষি আর শিল্পব্যবসায় নাই, তাহা হইয়া দাঁড়াইয়াছে কৃষকদিগের দিন-মজুরীর একটা সামান্য অবলম্বন মাত্র। ফলে কৃষি ক্ষেত্রের মূল্য তথা সেগুলির ঋণ গ্রহণের সামর্থ্য (Capacity) কমিয়া গিয়াছে। নূতন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ার ফলে, শাইলকী মহাজনী প্রথার চির-অভ্যস্ত শােষণনীতির মস্তকে বজ্রপাত হইতে চলিয়াছে। তাই পল্পীবঙ্গের মহাজন সমাজ ক্ষুন্ন হইয়াছেন, মহাজনী কারবার স্থগিত রাখার চেষ্টা করিতেছেন। এইসব আইনকে, তাহার সমর্থকবর্গকে ও বাংলার খাতক সমাজকে জব্দ করার একটা প্রচ্ছন্ন প্রবৃত্তিও ইহার মধ্যে আছে বলিয়াও অনেকে আশঙ্কা করেন। সে যাহা হউক, অবস্থা ও ব্যবস্থার এইসব পরিবর্তনের ফলে, পল্পী বঙ্গের জনসাধারণের ঋণ সগ্রহের সমস্যা অপেক্ষাকৃত গুরুতর হইয়া দাঁড়াইয়াছে।

সুখের বিষয়, বাংলার অর্থ-সচিব মান্যবর নলিনীরঞ্জন সরকার ঠিক সময়েই দেশের এই গুরুতর সমস্যার সমাধান চিন্তায় অবহিত হইয়াছেন। এই সমস্যার বিভিন্ন দিকের অর্থনৈতিক জটিলতা ও তাহার প্রতিবিধান সম্বন্ধে মিঃ সরকারের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা যথেষ্ট আছে। এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানকল্পে তিনি যে দীর্ঘকাল হইতে আন্তরিকতার সহিত চিন্তা ও আলােচনা করিয়া আসিতেছেন, কৃষক সমস্যার সহিত সংশ্লিষ্ট বন্ধুরা তাহা বিশেষভাবে অবগত আছেন। বিধাতার অনুগ্রহে, নিজের দীর্ঘকালের আকাক্ষাকে বাস্তবে পরিণত করার যথেষ্ট ক্ষমতাও আজ তাহার হস্তগত হইয়াছে। সুতরাং দেশের দুই জনগণ দৃঢ়তার সহিত আশা করিতে পারে যে, এই সমস্যার সমাধানকল্পে সরকার মহাশয় যথাসাধ্য চেষ্টার ত্রুটী করিবেন না। এই চেষ্টায় দেশবাসীর পূর্ণ সমর্থন ও আন্তরিক সাহচৰ্য্য তিনি নিশ্চয় লাভ করিতে পারিবেন, এ বিশ্বাস আমাদের আছে।

মান্যবর মিঃ সরকার সম্প্রতি এ সম্বন্ধে যে দীর্ঘ বিবৃতি প্রকাশ করিয়াছেন, তাহার বিস্তারিত বিচার আলােচনা শুধু বিশেষজ্ঞরাই করিতে পারেন। এই বিবৃতি বিশেষ মনােযােগ সহকারে পাঠ করিয়া অ-বিশেষজ্ঞ আমরা যতটুকু বুঝিতে পারিয়াহি, তাহাতে আমরা উৎসাহিত ও আনন্দিত হইয়াছি। বাংলার প্রত্যেক মহকুমার একটী করিয়া ভূমিবন্ধকী ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে, এবং তাহা হইতে কৃষকদিগকে দীর্ঘ মীয়াদে শহজ শর্তে ও অপেক্ষাকৃত কম সুদে ঋণ-দানের ব্যবস্থা করিতে হইবে- বর্তমান ঋণ পরিশােধের এবং ভাবী কৃষিকার্য্যের উন্নতির জন্য। এই সব ব্যাঙ্কের পরিদর্শন, নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার জন্য কলিকাতায় একটী কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে। ইহার উদ্যোগ আয়ােজনের দায়িত্ব বাংলা সরকার গ্রহণ করিবেন এবং প্রথম অবস্থায় ঐসব ব্যাঙ্কে অর্থ সঞ্চয়ের আয়ােজনও বাংলা সরকারকেই করিয়া দিতে হইবে। মােটের উপর মিঃ সরকারের বিবৃতির প্রধান প্রস্তাব হইতেছে ইহাই। অল্প সময়ের জন্য সাময়িক ঋণদানের ব্যবস্থা কো-অপারেটিভ সােসাইটীর উপর ন্যস্ত করিতে হইবে, এবং সেজন্য ঐ সােসাইটীগুলির বর্তমান দোষত্রুটীগুলির সংশােধন করিয়া লইতে হইবে, মিঃ সরকার সঙ্গে সঙ্গে এ প্রস্তাবও উপস্থিত করিয়াছেন।

মিঃ সরকারের মতে, সমগ্র পরিকল্পনার জন্য, দুই কোটি হইতে আড়াই কোটি টাকা মূলধনের দরকার হইবে। বাংলা গবর্ণমেন্ট ঋণ গ্রহণ করিয়া এই আড়াই কোটি টাকা সগ্রহ করিতে পারেন। এই ঋন গ্রহণ ও দানের ফলে গবর্ণমেন্টের যদি কোন ক্ষতি হয়, তাহা হইলে সে ক্ষতির পূরণ করা হইবে নূতন কোন কর ধার্য্য করিয়া, অথবা সরকারের সাধারণ তহবিল হইতে। আমাদের মতে, ক্ষতি পূরণের ভাবনার প্রথম হইতে ব্ৰিত হইয়া পড়ার কোন কারণ নাই। ক্ষতি যদি হয়, তাহার পূরণ নিশ্চয়ই করিতে হইবে। নূতন করধাৰ্য্য দ্বারা অথবা সাধারণ তহবিল হইতে সে ক্ষতির পূরণ করিতে হইবে, তাহার শেষ মীমাংসা সম্পূর্ণভাবে নির্ভ করিবে, সরকারী তহবিলের ও দেশবাসীর তখনকার অবস্থার উপর। নূতন করের আকার প্রকারের উপরেও এ মীমাংসা বহু পরিমাণে নির্ভর করিবে। কিন্তু ক্ষতিপূরণের যে ব্যবস্থাই সঙ্গত বিবেচিত হউক না কেন, তাহার অজুহাতে মূল প্রস্তাবের বিরুদ্ধে কোন প্রকার বাধাবিঘ্ন উপস্থিত করা সঙ্গত হইতে পারে না। মােটের উপর, তাঁহার পরিকল্পনার মূল নীতি ও আদর্শের সমর্থন আমরা সর্বান্তঃকরণে করিতেছি।

বাহ্যতঃ অবান্তর হইলেও, এই প্রসঙ্গে আর একটী সমস্যার উল্লেখ করাও আমরা আবশ্যক মনে করিতেছি। পাটের বাজারের ফটকাবাজী ও অন্যান্য অনাচারের প্রতিকার সম্বন্ধে কোন প্রকার কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করা, বাংলা সরকারের পক্ষে, নানা সঙ্গত কারণে, এযাবৎ সম্ভবপর হইয়া ওঠে নাই। কিন্তু এ সম্বন্ধে একটা কিছু সুব্যবস্থা অবলম্বন করা একেবারে অপরিহার্য হইয়া দাঁড়াইয়াছে। ঋণ দিয়া কৃষকের অভাব পূরণ অপেক্ষা, তাহার ধনাগমের পথগুলিকে দস্যু তস্করের উন্দ্রব হইতে রক্ষা করা অধিক আবশ্যক, একথা বােধহয় কেহই অস্বীকার করিবেন না। এই হিসাবে সংক্ষেপে আমাদের প্রস্তাব-আড়াই কোটির স্থলে গবর্ণমেন্ট, পাঁচ কোটি (বা তাহারও অধিক) টাকার ঋণগ্রহণ করুন, কৃষকগণকে কিছু কিছু মূল্য দিয়া তাহাদের সমস্ত পাট বাহির করিয়া রাখুন এবং জগতের চাহিদা অনুসারে সেই পাট প্রকৃত মূল্যে বিক্রয় করিয়া, খরচা বাদে অবশিষ্ট টাকা কৃষকগণকে ফিরাইয়া দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। ইহাতে কৃষকদের প্রাপ্য মূল্যের পরিমাণ নিশ্চয়ই বাড়িয়া যাইবে। এই ব্যবস্থার উপকার যখন বাংলার কৃষক প্রত্যক্ষভাব বুঝিতে পারিবে, তাহার পর নিজেদের উৎপন্ন পাটের উপর মণপ্রতি দুই এক পয়সা কর দিতেও তাহারা কুণ্ঠিত হইবে না।

২৫ জুন ১৯৩৯, ১০ আষাঢ় ১৩৪৬, সম্পাদকীয়-১২, পৃষ্ঠা

সামাজিক

বেকার-বান্ধব-বিল

নিম্ন-পরিষদ কর্তৃক সংশােধিত আকারে বঙ্গীয় গ্রাম্য বেকার-বান্ধব-বিল সেদিন কাউন্সিলে গৃহীত হইয়াছে। ইহার উদ্দেশ্য খুব সাধু এবং ইহার প্রস্তাব অনুসারে কাৰ্য্য করা হইলে পল্লীর ভিক্ষাবৃত্তি নিবারণ করা যাইতে পারে। তবে বর্তমান বিলে যেরূপ সমস্ত বিষয়ই স্বেচ্ছাধীন করিয়া রাখা হইয়াছে, তাহাতে এ-উদ্দেশ্য কতদূর সিদ্ধ হইবে, তাহাতে সন্দেহ আছে। বিলে বলা হইয়াছে

“প্রত্যেক ইউনিয়নে স্বেচ্ছায় প্রেরিত চাঁদার সাহায্যে গঠিত দরিদ্র ভাণ্ডার হইতে দরিদ্র ও বেকারদিগকে সাহায্য করা হইবে। প্রাদেশিক সরকার এবং স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনশীল প্রতিষ্ঠানগুলিও ইচ্ছা করিলে এই ভাণ্ডারে অর্থ সাহায্য করিতে পারিবেন। পাঁচজনের অনধিক অতিরিক্ত সদস্যসহ ইউনিয়ন বাের্ডের সদস্যগণই এই ভাণ্ডার পরিচালন করিবেন, প্রত্যেক কমিটিকেই স্ব স্ব এলাকাধীন অঞ্চলের দরিদ্র ও বেকারদের একটি তালিকা প্রস্তুত করিয়া রাখিতে হইবে এবং গ্রাম্য-চৌকিদারের রিপাের্ট অনুযায়ী কাজ করিতে হইবে। যেখানে সাহায্য দেওয়া সাব্যস্ত হইবে, সেখানে ১২ বত্সরের উর্দ্ধ বয়স্ক লােকদের জন্য প্রত্যহ দুই আনা এবং নিম্ন বয়স্কদের জন্য প্রত্যহ অর্ধ আনা হারে সাহায্য দেওয়া হইবে। এইসব লােককে ঋণও দেওয়া যাইতে পারে, তবে ঋণের পরিমাণ কখনাে পাঁচ টাকার বেশী হইবে না।”

প্রস্তাবিত তহবিল গঠিত হইবে, ইউনিয়নের অধিবাসীদের স্বেচ্ছা-প্রদত্ত চাঁদার দ্বারা। গবর্ণমেন্ট বা স্থানীয় স্বায়ত্ত শাসনমূলক প্রতিষ্ঠান তথা ইউনিয়ন-বাের্ড, লােকালবাের্ড, ডিস্ট্রিক্ট বাের্ড প্রভৃতিও ইচ্ছা করিলে এই ভাণ্ডারে সাহায্য দান করিতে পারিবেন সুতরাং এরূপ স্বেচ্ছাপ্রদত্ত চাঁদার দ্বারা প্রস্তাবিত তহবিলে আদৌ কোন অর্থ সংগৃহীত হইবে কিনা সন্দেহ। অতীতে দেশের বহু সহৃদয় ব্যক্তি এরূপ তহবীল গঠনের চেষ্টা করিয়াছেন। কিন্তু তাঁহাদের সে-চেষ্টা সফল হয় নাই। যদি কচিৎ কদাচিৎ কোথায়ও সফল হইয়া থাকে, তবে তাহাও স্থায়ী হয় নাই। সুতরাং ইউনিয়নবাসীর স্বেচ্ছা-প্রদত্ত চাঁদার দ্বারা এরূপ তহবিল গঠন করা সম্ভবপর বলিয়া মনে হয় না।

কিন্তু এরূপ একটী ভাণ্ডার প্রতিষ্ঠা পল্লীর পক্ষে একান্ত প্রয়ােজন, সে-সম্পর্কে কোন মতভেদ হইতে পারে না। বিদেশী শাসন ও সভ্যতার কল্যাণে পল্লীর শিল্প-বাণিজ্য ধ্বংস হইয়া গিয়াছে। বাংলার পল্লীতে পল্লীতে যে-সব তত ছিল, সেগুলি আর নাই। পল্লীর চিনি, লবণ প্রভৃতি শিল্পও বিদেশী ও স্বদেশী কল-কারখানার ধাক্কায় পড়িয়া ধ্বংস হইয়া গিয়াছে। এ-সকল শিল্প ধ্বংসের ফলে লক্ষ লক্ষ শিল্পী বেকার হইয়া পড়িয়াছে। বর্তমানে তাহাদের একমাত্র সম্বল কৃষি ও কৃষি-মজুরী বলিলেও অত্যুক্তি হয় না।
অধিকন্তু প্রায় ৮৪টী ক্ষুদ্র বৃহৎ টাউন, ৮৫টি জুট মিল, ৩২টী কাপড়ের কল, চিনি, রবার, দেশলাই ও নানাপ্রকার ঔষধের কারখানা প্রতিষ্ঠার ফলে বাংলার কৃষি-ভূমিও অনেক পরিমাণে হ্রাস পাইয়াছে। এই দুই কারণে পল্লীর দারিদ্র্য সমস্যা-চরমে উঠিয়াছে। বেকার ও ভিক্ষুকের সংখ্যা দিন দিন বাড়িয়া চলিয়াছে। প্রস্তাবিত বিল যদি কাৰ্যকরী হইত, তাহা হইলৈ ইহার দ্বারা তাহাদের যথেষ্ট সাহায্য করা সম্ভব হইত।

কিন্তু বিলটি যেভাবে রচিত হইয়াছে, তাহাতে পল্লীর এই দুরবস্থার কোন প্রতিকার সম্ভব কিনা, সন্দেহ। গবর্ণমেন্ট ও অন্যান্য স্বায়ত্তশাসনমূলক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সম্ভব না হইলেও অন্ততঃ ইউনিয়ন-বাের্ডের আয়ের এক অংশ প্রস্তাবিত ফন্ডে দেওয়া যদি বাধ্যতামূলক হইত, তাহা হইলে উহাকে ভিত্তি করিয়া ইউনিয়ন বাের্ডের সদস্য এবং অন্যান্য সকল ব্যক্তির চেষ্টায় আরও কিছু চাঁদা সংগৃহীত হওয়া সহজ হইত। সেসংগৃহীত অর্থ হইতে বেকারদিগকে যথাসম্ভব সাহায্য করা যাইত। . পল্পী-বঙ্গের অবস্থা যাহারা অনুসন্ধান করিয়াছেন, তাহারা অবশ্য স্বীকার করিবেন যে, সেখানে দুইটী মাত্র টাকা দিলেও বেকারের যথেষ্ট সাহায্য করা হয়। সেই দুই টাকার মূলধনকে সম্বল করিয়া হাটে বাজারে মােটা-কারবার করিতে পারে এবং তাহাতে তাহার অন্ন সংস্থানের ব্যবস্থা হয়। সামান্য মূলধনের দ্বারা অসহায় বিধবাদিগকে পশু বা পাখী পালনে বা অন্য কোন শিল্প-কাৰ্য্যে নিয়ােগ করা যাইতে পারে। কিন্তু বেকারবান্ধব-সমিতি গঠন, চাঁদা-সংগ্রহ ও সাহায্য দান সবই স্বেচ্ছাধীন হওয়াতে বিলের বিধান অনুসারে কোন কার্য সম্পাদিত হইবে কিনা, সন্দেহ।

তথাপি বিলের রচয়িতা খান বাহাদুর মােয়াজ্জেমুদ্দীন হােছেন এবং বাংলার কাউন্সিল ও এ্যাসেম্বলী এজন্য দেশবাসীর ধন্যবাদের পাত্র। বঙ্গ পল্লীর দারিদ্র্য ও বেকার-সমস্যার সমাধানের উপায় কি, এই বিলে সে সম্পর্কে চিন্তা করার সুযােগ ঘটিয়াছে। ইউনিয়ন বাের্ডের সদস্য এবং পল্পী-সেবকবৃন্দের মনোেযােগ এদিকে আকৃষ্ট হইলে প্রয়ােজন অনুসারে বিলের সংশােধন করিয়া লওয়া বিশেষ কষ্টকর হইবে না।

১০ মে ১৯, ২৬ বৈশাখ ১৪৬, সম্পাদকীয়-৩, পৃষ্ঠা-৪

বিবিধ প্রসঙ্গ

স্যার জাওলা-প্ৰসাদ শ্রীবাস্তব লক্ষ্ণৌর এক সভার বিরূদ্ধে নির্দয়ভাবে গান্ধী-চেলাদের দ্বারা প্রহৃত হইয়াছিলেন, সে-খবর ইতিপূৰ্বেই পাঠকগণ জানিতে পারিয়াছেন। প্রকাশঃ সম্প্রতি স্যার জাওলা গান্ধী-চেলাদের এই কীর্তিকাহিনী জানাইবার জন্য নয়াদিল্লীতে বয়ং গান্ধীজী সমীপে গিয়া হাজির হইয়াছেন। আমরা বুঝিতে পারি না, গান্ধীজীকে এইভাবে অপ্রস্তুত করার স্যার জাওলার বিশেষ কি লাভ হইবে। তিনি কি মনে করেন যে, গান্ধীজী তার চেলাদের এই অহিংস বীরত্বের খবর এখনাে পান নাই? সমস্ত জগৎ যে-সংবাদ জানিতে পারিল, সে খবর গান্ধীজী পান নাই, তার এরূপ অনুমানের কারণ কি? সংবাদ জানিয়াও যখন গান্ধীজী একটী টু’ শব্দ করেন নাই, তখন দিল্লী দৌড়াইয়া কি ফল হইবে? জিজ্ঞাসা করি, বােম্বাই গবর্ণমেন্ট যখন ধর্মঘটী শ্রমিকদের উপর বেপরােয়া গুলীবর্ষণে অনুমিত দিয়াছিলেন, তখনও কি তিনি তাঁর বােম্বেয়ে চেলাদের এই অহিংস’ কাজ সম্পর্কে একটা কথাও খরচ করিয়াছিলেন? কাজেই এই অহিংসার অবতারের কাছে বেহুদা দৌড়াইয়া লাভ আছে? ইনি হিটলারকে অহিংস হওয়ার উপদেশ দিতে কার্পণ্য না করিলেও নিজ অনুচরদের সে উপদেশ দিতে নারাজ।

আলীগড়ে এক অভিনন্দন সভার বক্তৃতা করিতে গিয়া মিঃ জিন্নাহ, সামান্ত রাজ্য সম্বন্ধে মােছলেম লীগের অনুসৃত নীতির আভাষ দিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেনঃ “আমরা স্টেটগুলির মুছলমান প্রজাদিগকে সমবদ্ধ হইতে উপদেশ দেই এবং রাজকীয় অত্যাচারের প্রতিরােধে দণ্ডায়মান হইতে বলে। মােছলেম লীগ তাদের সম্রামে সর্ব প্রকারে সাহায্য করিবে। ভৌগলিক সাম্য এছলামের সন্তানদিগকে কখনাে বিভক্ত করিতে পারে না।” ষ্টেটের ব্যাপারে মােছলেম লীগের এই সক্রিয় পন্থা গ্রহণের যে আভাস মিঃ জিন্নাহর উপরােক্ত উক্তিতে ফুটিয়া উঠিয়াছে, তাহা শুধু সময়ােচিত নয়, অত্যন্ত সঙ্গতও হইয়াছে। স্টেটগুলিকে লইয়া কংগ্রেস যেভাবে ছিনিমিনি খেলা খেলিতে শুরু করিয়াছিল, মােছলেম লীগের এই হস্তক্ষেপে তাহা অনেকটা সংযত হইবে বলিয়াই আমরা মনে করি। অতঃপর ষ্টেট সম্পর্কে কংগ্রেস-পরিকল্পিত দুষ্ট অভিপ্রায় সিদ্ধির পথে কিছুটা বাধা সৃষ্টি না হইয়া পারেনা। ফলে ষ্টেটগুলির মুছলমান প্রজাদিগকে আর ভাসাইয়া দেওয়া চলিবে না।

৯ এপ্রিল ১৯৩১, ২৬ চৈত্র ১৩৪৫, সম্পাদৰয়-৩, পৃষ্ঠা

 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!