You dont have javascript enabled! Please enable it!

”ওরা বললো- ‘বলো পাকিস্তান জিন্দাবাদ’। কিন্তু একটা আঙ্গুল তুলে উনি তাঁর শেষ বাণী উচ্চারণ করলেন ‘একদফা জিন্দাবাদ’। সাথে সাথে গুলি করলো পিশাচ জালিমরা, উনি পড়ে গেলেন। জীবনের অস্তাচলে দাঁড়িয়ে শেষবারের মতো আবার এক আঙ্গুল উঁচুতে তুলে ধরলেন…“

পাকসেনাদের হাতে লেঃ কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের বিয়োগান্ত পরিণতির বিবরণ

(লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন, তথাকথিত আগরতলা মামলার দুই নম্বর আসামী যার চোখে দেখেছি বাংলার ছবি, যার মুখে শুনেছি প্রথম একদফা বাংলার মুক্তির কথা, তিনি আজ কোথায়? ২৫শে মার্চের কালো রাত্রে কেড়ে নিয়ে গেল তাঁকে শূণ্য করে আমার এ ঘর।

আগরতলা মামলা থেকে ছাড়া পাওয়ার পর হতেই শুরু হয়েছিল তার অক্লান্ত পরিশ্রম। অবশ্য তার পরিশ্রম অনেক দিনের। ছেলেবেলা হতেই জীবনযুদ্ধে নেমেছেন তিনি। আই এস সি পাশ করেই তিনি ঘর ছেড়েছিলেন। সাগর পাড়ি দিয়েছিলেন তিনি। বিলেতে কেটে গেলো জীবনের ৯টি বৎসর। সেখান হতেই ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেন তিনি। তারপর ছিলেন পাকিস্তানী নৌ-বাহিনীতে।)

১লা মার্চ হতেই দেখলাম তাঁর মাঝে চঞ্চলতা, কর্মব্যস্ততা। ২রা মার্চ কয়েকজন সহকর্মীসহ তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে এক বৈঠকে যোগ দেন। বৈঠকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়। ওদিকে কেন জানি না আমার মন একটা অজানা আশংকায় কাঁপছিল বারবার। উনিও খবর পেয়েছিলেন দুর্দিন আসছে। তাই কিছুটা গোপনীয়তা অবলম্বন করতেই হলো। শুরু হলো লুকিয়ে কাজকারবার করার দিন। ১৫ই মার্চ তিনি ফিরলেন। ২৭শে মার্চ পল্টনে এক জনসভার আয়োজন করা হচ্ছিলো। ২৮শে মার্চ আর তাঁর জীবনে আসেনি।

২৫শে মার্চ এলো সেই ভয়ংকর কালরাত্রি। কে জানত আমার এ জীবনের হাসি গান সবকিছু মুছে নিয়ে যাবে সেই রাত। অকালে আমার ঘর ভেঙ্গে যাবে। ঘর ভাঙ্গবে এদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের। ২৫শে মার্চ সন্ধ্যা হতেই তিনি খুব ব্যস্ত। কিন্তু এত ব্যস্ততার মাঝেও মনে হচ্ছিলো, উনি যেন বড় ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। রাত প্রায় ১১টায় ফোন বেজে উঠলো। আমার দুলাভাই ফোন করে ওকে সরে যেতে বলছিলেন। এমন সময় দুটো ছেলে সবাইকে ধাক্কা দিয়ে হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে কাঁপতে লাগলো। তারা বললো মিলিটারী ওদের জীপের ওপর গুলিবর্ষন করেছে। ওদের একজনের গায়ে জ্বর ছিল। আমরা সেবা যত্ন করলাম। পরে জেনেছিলাম আমরা সেই অজানা ভাইদের মধ্যে একজন জালেমদের গুলিতে শহীদ হয়েছেন। সে রাত্রে আমরা উপর তলায় আমার এক বোনঝির ওখানে থাকি। নিস্তব্ধ রাত্রিকে সচকিত করে দিয়ে অবিশ্রান্ত ভাবে গোলাগুলি চলতে লাগলো।

উনি একটা প্যাসেজে দাঁড়িয়েছিলেন। সারাটা রাত এমনিভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন। কে জানতো সে রাত্রের সে দাঁড়ানোই হবে মৃত্যুকে বরণ করার প্রতিক্ষা। ভোর হয়ে এলো। নীল আকাশের শুকতারাটি বিদায় ব্যথিত চোখে বুঝি বা শেষবারের মতো মাটির পৃথিবীকে দেখে নিচ্ছিলো। এক সময় উনি এসে জানালায় মাথা দিয়ে ক্লান্ত অলসভাবে দাঁড়ালেন। আমি তাঁকে অনেকবার বলেছিলাম পিছনের পাঁচিল টপকে পালাতে। বললেন, কোথায় যাব। তাছাড়া যোগাযোগ রাখা সম্ভব হবে না।

তিনি বুঝেছিলেন জালিমরা তাঁকে না পেলে অবুঝ অসহায় শিশুদের উপর অত্যাচার করতে পারে। তিনি পালালেন না। তাঁর ক্লান্ত ভাব দেখে তাঁকে শুতে বললাম। জবাবে উনি বললেন, অনেক কাজ, শোবার সময় নেই। বরঞ্চ বড্ড ক্ষিধে পেয়েছে কিছু খাবার ব্যবস্থা করো। টেবিলে খাবার লাগানোও হলো, কিন্তু খাওয়া তাঁর হলো না। মনে হলো বাসার চারিদিকে অনেকগুলো গাড়ী দাঁড়িয়ে গেলো।

বুটের দুপদাপ আওয়াজ শোনা গেলো। জানালার ফাঁক দিয়ে চকিতে দেখলাম একজন উপরের দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখাচ্ছে। ভয়ে হিম হয়ে বললাম, ‘তুমি পালাও’। উনি ভেতরের দিকে চলে গেলেন। জালিমরা হুড়মুড়িয়ে উপরে উঠে এসে দরজা ধাক্কা দিয়ে ভেঙ্গে ফেললো। পিশাচরা আমাদের সামনে এসে বললো, ‘কমান্ডার মোয়াজ্জেম কাঁহা, উসকো বিবি কাঁহা। আচ্ছা করকে উনকো বাঙ্গাল নাদেগা।’ দেখে মনে হচ্ছিলো সামনে পেলে যেন ছিঁড়ে খাবে।

আমার ভাগ্নী বুদ্ধি করে বললো ‘ওরা নীচে থাকেন’। কিন্তু ওরা কোন কথা শুনলো না। কজন আমার ভাগ্নী জামাইকে নীচে নিয়ে গেলো। জালিমরা তন্নতন্ন করে খুঁজে ফিরতে লাগলো সমস্ত ঘর। খুঁজতে নীচে চলে গেলো, আশ্বস্ত হবার আগেই ফিরে এলো আবার। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। আবারও চলে গেলো ফায়ার করতে করতে নীচের দিকে। কিছুক্ষণ পর ফায়ারিং থেমে গেলো। শোকরগোজারী করলাম আল্লার কাছে। না পেয়ে হয়তো ওরা চলে গেলো। বাইরে পর্দা সরিয়ে দেখতে গেলাম।

কিন্তু উঃ একি দেখলাম! খোদা, এর আগে যদি চোখ অন্ধও হয়ে যেতো! দু’পা দু’হাত ধরে ঝোলাতে ঝোলাতে গাড়িতে তুলছে ওকে। মাথাটা ঝুলে পড়েছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে ডান পাশটা। আছড়ে পড়লাম মাটিতে। চিৎকার করে উঠতে গেলাম। কিন্তু তার আগেই ভাগ্নী মুখ চেপে ধরলো।, ‘খালাম্মা চিৎকার করবেন না। ওরা আবার এসে যদি বাচ্চাদের মেরে ফেলে। আপনাকে যদি ধরে নিয়ে যায় টের পেয়ে’।

চমকে থমকে গেলাম। পোড়া চোখ জ্বলে ছাই হলো। বুকের ভেতরটা এক শূণ্য বেদনায় হাহাকার করে উঠলো। জ্বলে গেলাম, হায়! একটি মানুষবিহীন সর্বহারা হলাম আজ। পরে জানতে পারলাম, উনি বাথরুমের দরজার এক পাশে উপায়হীন হয়ে লুকিয়ে ছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয়বারে ওরা আবার ওর নাম ধরে জিজ্ঞাসা করে বললো, ‘তোমহারা নাম কিয়া?’ উনি নির্ভিক চিত্তে বললেন, কম্যান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন।

আবার ওরা বললো- ‘বলো পাকিস্তান জিন্দাবাদ’। কিন্তু একটা আঙ্গুল তুলে উনি তাঁর শেষ বাণী উচ্চারণ করলেন ‘একদফা জিন্দাবাদ’। সাথে সাথে গুলি করলো পিশাচ জালিমরা, উনি পড়ে গেলেন। জীবনের অস্তাচলে দাঁড়িয়ে শেষবারের মতো আবার এক আঙ্গুল উঁচুতে তুলে ধরলেন। পরপর গুলি হলো, দু’টো তাঁর মাথায় বিঁধলো। আর দু’টো ফসকে গেলো। মনে হলো বুকের রক্ত দিয়ে উনি ধুয়ে দিয়ে গেলেন পরাধীন বাংলার যত কলংক আর মলিনতা আর রক্তকণিকাগুলো।

কিন্তু মাঝে মাঝে ক্ষীণ আশা জন্মায়, তাঁকে তো মৃত দেখিনি। শুধু গুলি লাগা অবস্থায় তুলে নিয়ে যেতেই দেখেছি। তবে কি তিনি বেঁচে থাকতে পারেন না? নীচে দেখলাম রক্তের বন্যা মাটিতে, শুধু ভোরের আকাশ বাতাস হাহাকার করে উঠলো নেই-নেই-নেই। কোথা দিয়ে সারা বেলা কেটে গেলো, রাত এলো শূন্যতার হাহাকার নিয়ে, তারও শেষ হলো। সকাল হলো, কারফিউ ভাঙ্গলো কিছুক্ষণের জন্যে। কত মানুষ ছুটে এলো চেনা-অচেনা। চেয়ে দেখলাম কত মানুষ অশ্রুসজল নেত্রে রক্ত ছুঁয়ে শপথ নিলো।

বোবা কান্নায় অসহায় হয়ে ছোট তিনটি শিশু বুকে নিয়ে দুলাভাই ডাঃ কাজী আব্দুল খালেকের বাসায় ছুটে গেলাম। তারা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেননি যে আমার এত বড় সর্বনাশ হয়ে গেছে। আবার হাহাকার আর্তনাদ উঠলো। কিন্তু কান্নার সময় কোথায়, সান্তনার অবকাশ নেই। পালাতে হবে, যদি আবার জালিমেরা আসে। তাই পাড়ি দিলাম অদৃষ্টের হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে অনিশ্চয়তার পথে। জিঞ্জিরা গেলাম। নৌকা পার হবার সময় গোলাগুলি আরম্ভ হলো।

মানুষের মৃত্যুর ভয়াল আর্তনাদের মধ্য দিয়ে ওপারে গিয়ে পৌঁছলাম। ওখানে কেটে গেলো তিনটি দিন। তারপর ফিরে এলাম আবার ঢাকায়। আমার বড় ভাই ডাঃ আমজাদ খবর পেয়ে ছুটে এসে নিয়ে গেলেন আমাদের। জালিমরা তারও সবকিছু পুড়িয়ে জ্বালিয়ে নিঃস্ব করে দিয়েছে। তিনিও রাজবাড়ী ফরিদপুরের মুক্তিফৌজের কমান্ডার ছিলেন এবং কয়েকটা অপারেশন করেছেন। এই হলো তাঁর অপরাধ। তাঁকেও পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছিলো।

অথচ আমাদের ফেলে তিনি, আমার অনুরোধ সত্ত্বেও, ওপারে যেতে পারেননি শেষ পর্যন্ত। আমাদের জন্যই তাঁকে কিছুদিন আগে গ্রহণ করতে হলো একটা ছোট্ট চাকুরী, যাতে সরকার তাঁর পরিচয় না পায়। নানা দুর্যোগ আর ব্যথার মধ্য দিয়ে কেটে গেলো দীর্ঘ ৯টা মাস। পথ চেয়ে বসে থেকেছি মিছে আশা বুকে বেঁধে যদি আসেন তিনি। কিন্তু কই আজো তো এলেন না তিনি। বুকে আশা নিয়ে ছুটে এসেছি এই কর্ম-কোলাহলপূর্ণ নগরীতে যদি কেউ বলে আছেন তিনি।

দেশ স্বাধীন হলো। খুশির বন্যায় প্লাবিত হলো চারিদিক। শুকরিয়া করলাম খোদার দরগায়। তাঁর আদরের সাত বছরের শিশুকন্যা শিপু ফুঁপিয়ে শুধালো ‘মাগো সবাই আজ এতো খুশী, কিন্তু আমার খুশি লাগছে না কেন? আমার যে খালি বাপির কথা মনে হচ্ছে। কেন আজও তিনি এলেন না। কেন আমার বাপি নেই মা?’ শিশুর মনের এই আকুল করা প্রশ্নের জবাব কে দেবে?

-মিসেস কোহিনুর মোয়াজ্জেম হোসেন
Ref: Bangladesher Swadhinota Zuddho Dolilpotro, Vol 8, Chapter 8, pp. 356-358

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!