You dont have javascript enabled! Please enable it!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায় পাক বাহিনীর হত্যাভিযান

পঁচিশে মার্চ ও তার পরদিন
-মঞ্জুর হাসান

ঘুমিয়ে পড়েছিলাম শহীদ মিনারের সামনে ৩৪ নম্বরের এক তলার ফ্লাট বাড়ীতে। আমাদের এ বিল্ডিং এর পশ্চিম দিকের তিন তলায় পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যক্ষ জনাব মনিরুজ্জামান সে রাত্রে বিছানায় যেয়েও ঘুমোতে পারেননি, একথা তাঁর স্ত্রীর কাছে শোনা। দিন কতক আগে এখানে রাস্তায় গাছ ফেলে যে ব্যারিকেড দেয়া হয়েছিল সেনাবাহিনীর একদল প্রথমে তা কেটে সরিয়ে দিতে আসে।

সেই সব ডালপালা কাটার শব্দ হচ্ছিলো। এর কিছু পরই পাক সৈন্যের বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আক্রমণ শুরু হয়। ছাত্রাবাসগুলোর দিক থেকে সৈন্যদের গোলাগুলির আওয়াজে মনিরুজ্জামান সাহেব অস্থির হয়ে ওঠেন এবং বদনায় পানি নিয়ে পরপর তিনবার ওজু করেন। এমন সময় জগন্নাথ হলের কাছে গর্জে ওঠে বর্বর পাক সৈন্যদের গোলার আওয়াজ।

চারপাশে গোলাগুলির শব্দে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায় এবং পর মুহূর্তে বিশ্ববিদ্যালয় মেডিক্যাল সেন্টারের পাশেই মনে হলো তোপধ্বনির আওয়াজ। আমি যে ঘরে ঘুমাতাম, তার পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয় মেডিক্যাল সেন্টার, তার দক্ষিণে শহীদ মিনার। সেই আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে আলোকিত হয়ে উঠে মুহূর্তের জন্যে। আমি বিছানা থেকে মেঝেতে গড়িয়ে পড়ি।

আমার ছেলেটিকে আমি আর আমার স্ত্রী মেঝেতে শুইয়ে চেপে ধরি। ছোট ছেলে ভয়ে একবার শক্ত হয়ে যাচ্ছিলো আর শুয়ে থেকে শুধু কাঁদছিল। আমি মেঝেতে পড়ে থেকে কয়েক মুহূর্তে চিন্তা করতে চেষ্টা করছিলাম, কি হলো? চারদিকে অনবরত গোলাগুলির শব্দ আর রাস্তা দিয়ে ভারি গাড়ি চলার শব্দ পাচ্ছিলাম। ঠিক এমন সময় জগন্নাথ হলের পূর্ব দিকে আমাদের ৩৪ নং বাড়ির গেটে ভিতরে তিনটি মিলিটারী গাড়ি ঢোকে। তারপরই ভারি বুটের শব্দ এবং আমাদের দরজায় লাথি ও ধাক্কা শুরু হয়।– ‘দরজা খোল, দরজা খোল’।

ঠিক এর পরই সব ফ্লাটের দরজায় লাথি মারা আরম্ভ হয়ে গেছে এবং সব বাড়ির কলিং বেলগুলো ওরা বাজাচ্ছে। মা, বোনেরা এবং ছোট ভাইটি অন্য ঘর থেকে ছুটে আমার ঘরে এলো। মা বললেন, ‘বাবা ওদিক দিয়ে দেখলাম, মিলিটারিরা বাড়ি ঘিরে ফেলেছে।’ আর বিল্ডিং-এর টেলিফোনের লাইনগুলো কেটে দিল। আমার ঘরে সকলকে মেঝেতে শুয়ে যেতে বললাম। মাকে বললাম ‘ওরা যদি দরজা ভেঙ্গে আসে তাহলে আসুক, দরজা খুলব না আমরা।’

বাড়িতে আমার বয়সী এক আত্মীয় ছিলেন, উনি এই সময়ে বিল্ডিং এর ভিতরে বাঁচার আশা ত্যাগ করে বলতে লাগলেন, ‘আমি জঙ্গলে ঝোপের মধ্যে যেয়ে লুকাবো’ এবং ফ্ল্যাট ছেড়ে পিছন দিক দিয়ে বাইরে যেতে উদ্যত হলেন। আমি আর মা ওকে জাপটে ধরলাম। উনি বারান্দার নেট ছিঁড়ে ফেলতে উদ্যত হলেন। মা আর আমি ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম, ‘যদি আমরা মরে যাই সবাই একসাথে মরে যাব।’

এমন সময় দু’টো সৈন্য আমাদের জানালার পাশ দিয়ে দৌড়ে এসে ফ্ল্যাটের পেছনের দরজায় দাঁড়িয়ে গেল। দরজাটি ছিল বাগানে যাবার জন্য খুব কম মজবুত একটা প্লাইউড দিয়ে বানানো দরজা। আমরা বারান্দা থেকে মুহূর্তে ঘরে ঢুকলাম; কিন্তু আমার ঘরের দরজা লাগাবার সাহস হলো না যদি শব্দ হয়ে যায়। এর অল্প পরই সৈন্য দু’টো চলে গেল পাশের পশ্চিম দিকে একতলার ফ্ল্যাটের পেছনে, সম্ভবতঃ ওদিককার দরজা খুলে ফেলার আওয়াজ শুনে। আমি দরজা লাগিয়ে দিয়ে মেঝেতে শুয়ে পড়লাম।

মৃত্যু আসন্ন মনে হলো, আমরা সকলে আল্লাহকে স্মরণ করতে লাগলাম। ততক্ষণে আমাদের দরজায় লাথি মারা থেমে ছিলো কিন্তু আবার শুরু হলো ‘খোল খোল’ আর লাথি। ভারি বুটের দুড়দাম করে সিঁড়ি দিয়ে ওঠা নামার শব্দের মাঝে জোরে শুনতে পেলাম মনিরুজ্জামান সাহেবের গলার আওয়াজ- ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (স.)’ চার-পাঁচবার শুনতে পেলাম উনার কালেমা পড়ার শব্দ, তারপর হঠাৎ থেমে গেলেন যেন।

বাইরে চারিদিকে গোলাগুলির আওয়াজ-এর পরই আমাদের বাইরের দরজার উপর গুলি হলো, আর কয়েকটা বুকফাটা আর্তনাদ ভেসে এলো। ১২/১৪ রাউন্ড গুলির শব্দ শুনলাম। মনে হলো, মেরে ফেললো- মরে গেলো মানুষ। রাত তখন দেড়টা। তারপর আমাদের বিল্ডিং-এ সব কিছু নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। মিনিট দশেক পরে শুনলাম ডঃ জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরদার চিৎকার, ‘বাসন্তী-দোলা।’ তিনি স্ত্রী ও মেয়ের নাম ধরে ডেকে উঠেছিলেন। বিল্ডিং-এর সামনে তাঁকে গুলি করা হয়েছিল।

উনি ঘাসের উপর পড়েছিলেন। ডঃ জ্যোতির্ময় ২৫শে মার্চের পরও কয়েকদিন জীবিত ছিলেন এবং ২৭শে মার্চের সকালে তাঁকে মেডিক্যাল কলেজে নেয়া হয়। মনিরুজ্জামান সাহেবের ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙ্গে গিয়েছিলো মিলিটারির বুটের ধাক্কায়। মনিরুজ্জামান সাহেবের স্ত্রী এবং তাঁর বোন, জ্যোতির্ময় বাবুর গলার আওয়াজ শুনে পানি নিয়ে নিচে নামছিলেন। তাঁরা তিনতলা থেকে আর্মিদের চলে যেতে দেখেছেন এবং তখনো বুঝতে পারেননি যে নিচে তাঁদের বাড়ির লোকজনদের একতলার দরজার উপর হত্যা করা হয়েছে।

মনে করেছিলেন এরেষ্ট করে নিয়ে চলে গেলো। নিচে নামতেই দেখতে পেলেন এক ভয়াবহ দৃশ্য। মনিরুজ্জামান সাহেবের ষোল বছরের ছেলের তখন অন্তিম মুহূর্ত। সে কষ্টে বলেছিল ‘মা পানি দাও’। মুখে পানি দেবার পর সে এক মুখ পানি নিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। ছেলের পাশে পড়ে ছিলেন মনিরুজ্জামান সাহেব, তাঁর প্রায় ৩০ বছর বয়স্ক ছোট ভাই এবং ১৪ বছরের ভাগ্নেটি। এই চারজন শহীদের রক্তের ওপর দিয়ে হেঁটে যেয়ে মনিরুজ্জামান সাহেবের স্ত্রী জ্যোতির্ময় বাবুর মুখে পানি দেন।

পূর্ব দিকের দোতলায় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক সাহেব দেখতে পান আর্মি চলে গেছে এবং জ্যোতির্ময় বাবুর গলার আওয়াজ শোনা গেলো বিল্ডিং-এর সামনে ঘাসের ওপর থেকে। তখন রাজ্জাক সাহেবের বাসা থেকে একজন লোক নিচে নামতে যেয়ে দোতলার দরজায় এই ভয়াবহ দৃশ্য দেখে ঘরে ঢুকে পড়ে। এরপর রাজ্জাক সাহেব তাঁকে নিয়ে নিচে নেমে আসেন। এ সময় জ্যোতির্ময় বাবুর স্ত্রী, সারভেন্ট কোয়ার্টার থেকে তাঁর ড্রাইভারকেও ডেকে এনেছিলেন।

তাঁরা কয়েকজন ধরাধরি করে পশ্চিম দিকের একতলায় জ্যোতির্ময় বাবুকে তাঁর ফ্ল্যাটে নিয়ে যান। ঠিক এই সময় আবার বিল্ডিং এর গেটের কাছে আর্মি এসে পড়ে। এর আগেই রাজ্জাক সাহেব দোতলায় তাঁর ঘরে ঢুকে পড়েছিলেন এবং সকলেই দরজা বন্ধ করে ফেলেন। বাড়ির বাগানে বেরুবার পেছন দিকের দরজা দিয়ে সৈন্যরা জ্যোতির্ময় বাবুর ফ্ল্যাটে ঢোকে এবং তাঁকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যায়। এ কথা তাঁর কাছ থেকে শোনা। ২৭শে মার্চ জ্যোতির্ময় বাবুর স্ত্রীর সঙ্গে মেডিক্যালে দেখা হয় এবং তাঁকে সাথে করে ডঃ জ্যোতির্ময় বাবুর বেডের পাশে যেয়ে দাঁড়াই।

দেখেছিলাম তাঁর ঘাড়ের কাছে গুলি লেগে এদিক থেকে ওদিক দিয়ে বেরিয়ে গেছে এবং ডান হাত ও ডান পা অবশ হয়ে গেছে। জ্ঞান সম্পূর্ণ ছিল এবং খুব ভালোভাবে তখন আমার সাথে কথা বলছিলেন। মনের জোর তখনো অটুট ছিল। বলেছিলেন, রাইট সাইডটা পেরালাইজড কিন্তু বেশ বহাল তবিয়তেই আছি। উনি বলেছিলেন যে নাম জিজ্ঞাসা করার পরই তাঁকে গুলি করা হয়। এরপর আরম্ভ হলো আমাদের বিল্ডিং-এর উত্তর দিকে প্রায় বিশ গজ দূরে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের প্রভোস্টের বাড়ির দরজা ভাঙ্গার চেষ্টা।

‘খোল খোল, দরজা খোল’- আর দরজায় লাথি, ধাক্কা। কিছুক্ষণ চললো, তারপর থেমে গেলো। তারা বাকি রাত্রিটুকুর মধ্যে ওখানে পুরনো দিনের মজবুত দরজা খোলার আরো দু’বার চেষ্টা চালায়। চারদিকে অনবরত গুলির শব্দ। ভোর হলো। থেকে থেকে আশপাশে গুলির শব্দ হচ্ছে। সকাল ৯টার দিকে শহীদ মিনারের কাছে একটা ক্ষীণ মাইক দিয়ে এক অবাঙ্গালী বাংলাতে বললো, ‘আপনারা বাড়ির বাইরে বেরুবেন না, আপনাদের ঘেরাও করা হয়েছে।’ মেঝেতে শুয়ে নিজে নিজে মনে করলাম হয়ত কারফিউ-এর বাংলা তরজমা করতে যেয়ে ‘ঘেরাও’ বললো। মনকে প্রবোধ দিলাম, কারফিউ-এর কথাই হয়ত বলছে। এর ঘন্টাখানেক পর এত ঘন্টার পরিচিত গোলাগুলির আওয়াজের ব্যাতিক্রম ঘটিয়ে শহীদ মিনারের কাছে একটা জোর শব্দ হলো। মনে হলো হাত বোমা।

অল্পক্ষণের মধ্যে ঘরে বারুদের গন্ধ ভেসে আসলো, দরজার নীচে দরজার সামান্য ফাঁক দিয়ে পোড়া কাপড়ের মতো ছাই উড়ে এসে পড়তে লাগলো। এ হাত বোমার রহস্য উদ্ঘাটন হয়েছিল পালিয়ে যে গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলাম, সেই ধলেশ্বরী নদীর ওপারে এক লোকের কাছ থেকে। সে আমাকে গ্রামে দেখতে পেয়ে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে। কারণ সেও অনেকের মতো শুনেছিলো, প্রফেসর আব্দুল হাইয়ের ফ্যামিলির সকলেই ওই বিল্ডিং-এ ২৫শে মার্চের রাত্রে মারা গেছে। এই লোকটি হলো হাশেম। আমাদের ৩৪ নম্বর বিল্ডিং-এর পূর্বদিকের তিনতলার ফ্ল্যাটে জার্মান প্রফেসর ওয়ান্টার শোয়েপ্পির সে বাবুর্চি ছিল। তার জীবনের চরম মুহূর্ত সেই ২৫শে মার্চের রাতেই কেটে গেছে। তাঁকে দাঁড় করানো হয়েছিলো অধ্যাপক মনিরুজ্জামান, তার ছেলে, ভাই, ভাগ্নের সঙ্গে গুলি করে হত্যা করার জন্য। আর্মি অফিসার গুলি করার হুকুম দিতেই গুলির পূর্বক্ষণে সে চিৎকার দিয়ে পড়ে যায়… তার পরই কতক গুলো গুলি হয়ে গেছে- তার শরীরের ওপর লুটিয়ে পড়েছে অন্যেরা।

গুলি শেষ করে বর্বর পশুরা মৃত দেহের উপর লাথি মেরেছিলো এবং হাশেমের কোমরে বুটের প্রচন্ড বাড়ি মারে। তারপর তারা সেখান থেকে সরে যেতেই হাশেম উঠে দাঁড়ায় এবং ছুটে তিনতলায় যেয়ে দরজা বন্ধ করে। তার সমস্ত জামায় রক্ত লেগে গেছে, সে বুঝতে পারছিলনা তার কোথায় গুলি লেগেছে। জামা খুলে হাশেম তার শরীরটা পরীক্ষা করে দেখে যে গুলি লাগেনি। আমি হাশেমকে জিজ্ঞাসা করায় বলেছিলো যে সে ঘুমকাতুরে এবং যখন দরজায় কলিংবেল বাজায়, মাত্র তখন তার ঘুম ভাঙ্গে এবং আমরা কেউ বেল বাজাচ্ছি মনে করে সে ঘুমের ঘোরে দরজা খোলে।

খুলতেই সেনাবাহিনীর লোক সাক্ষাৎ যমদূতের মতো মধ্যবয়সী হাশেমের জামার কলার চেপে ধরে বলে- ‘তোম প্রফেসর হো?’ হাশেম বলে উঠে, ‘জার্মান সাবকা নওকর হুঁ’। নিমেষে তাদের কয়েকজন ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়ে। যে তার কলার ধরেছিলো সে পকেটে হাত দিয়ে বলে, ‘জয় বাংলাকা ফোটো হ্যায়?’ তার পকেটে বেতনের কয়েকটা একশ’ টাকার নোট ছিল। জার্মান প্রফেসর হাশেমকে তার আগামী তিন মাসের বেতন দিয়ে ব্যাঙ্কক চলে গিয়েছিলো।

নোটগুলো হাতে নিয়ে ছুঁড়ে দেয় মেঝেতে। বলে ‘শালা তোম রূপিয়ে লেকে কেয়া করোগে, আভি তোমকো গুলি করেঙ্গে’। বলেই হিড়হিড় করে ওকে নিচে নামিয়ে আনে এবং দুজন ওকে ধরে রাখে। এর পরই সে দেখতে পায় মনিরুজ্জামান সাহেব এবং তাঁর বাসার অন্যান্যদের ধরে নিয়ে আসতে। শ্মশ্রূধারী মনিরুজ্জামান সাহেব উচ্চস্বরে কলমা পড়ছিলেন এমন সময় উনাকে চপেটাঘাত করে এক পাঞ্জাবী সৈন্য। এর পর মুহূর্তে গুলি করা হয়!

সেই হাশেম যখন মৃত্যুর হাত থেকে ছুটে এসে দম ফেলেছিলো তখন আবার শুনতে পায় বিল্ডিং-এ মিলিটারি আসার শব্দ। এর কিছু পরে কে যেন তাঁর ফ্ল্যাটের দরজায় কাতরাতে থাকে। ও মনে করেছিলো হয়ত এ বিল্ডিং-এর কেউ আহত অবস্থায় দরজার কাছে এসেছে। সিঁড়িতে আলো জ্বলছিলো। হাশেম কাঠের দরজার ছিদ্রপথে দেখে, এক সৈন্য অস্ত্র হাতে দরজার পাশে বসে অভিনয় করছে। হাশেম ছুটে বারান্দার প্রান্তে যায় এবং শেষ পর্যন্ত পাক সেনারা ওই ফ্ল্যাটের দরজা ভাঙ্গার চেষ্টা করেনি। এ হাশেমের কাছ থেকেই তখনি শোনা, শহীদ মিনারের অভাবিত দৃশ্যের কথা।

বেলা তখন দশটার মতো। হাশেম বলে চললো, আমি লুকিয়ে তিনতলা থেকে শহীদ মিনারের দিকে তাকিয়ে দেখছি চারজন পাঞ্জাবী সৈন্য শহীদ মিনারের ওপর দাঁড়িয়ে আমাদের বিল্ডিং-এর দিকে মুখ করে আছে। এমন সময় কি হয়ে গেলো সেখানে; বোমা ফেটে গেলো, হাতবোমা। ধোঁয়া, আর শহীদ মিনারের পেছন দিকে দু’টো লোক পালিয়ে গেলো। দেখা গেলো সে মুহূর্তে দু’জন সৈন্য শহীদ মিনার থেকে মেডিক্যাল কলেজের মোড়ের ট্রাফিক লাইটের দিকে দৌড়ে পালালো। কয়েক মিনিট পরেই এলো একটা গাড়ি। শহীদ মিনারের ওপর পড়েছিলো দু’টো মিলিটারির লাশ। সে গাড়িটি মরা সৈন্য দু’টোর অস্ত্রগুলো নিয়ে চলে গেলো। কয়েক মিনিট পর আর একটি গাড়ি এলো এবং লাশ দু’টোকে নিয়ে চলে গেলো। সেদিন ছিল ২৬শে মার্চ, শুক্রবার। শহীদ অধ্যাপক মনিরুজ্জামান সাহেবের স্ত্রীর কাছ থেকে শুনেছি।

যে, ২৬শে মার্চ শুক্রবারে তাঁর ফ্ল্যাটে বার পাঁচেক পাক সেনারা ঢোকে এবং বলতে থাকে ‘আওর এক আদমি হ্যায়, ও কিধার হ্যায়?’ উনারা জানান যে বড় পুরুষ মানুষ আর কেউ জীবিত নেই। তখন তারা সমস্ত ঘর তন্নতন্ন করে খোঁজে এবং জিনিষপত্র তছনছ করে ফেলে। হয়ত এই অপর এক আদমি ছিল হাশেম। মনিরুজ্জামান সাহেবের স্ত্রী ও হাশেম এই বিল্ডিং-এর তিনতলা থেকে জগন্নাথ হলের মাঠে বুলডোজার দিয়ে গর্ত করে বহু মৃতদেহ সে গর্তে ফেলে দিতে দেখেছিলেন।

রাজ্জাক সাহেবের সঙ্গেও গ্রামে একদিন দেখা হয়, উনিও বুলডোজার দিয়ে গর্ত করে লাশ পুঁতে ফেলার কথা বলেন। মনিরুজ্জামান সাহেবের স্ত্রী ধরা গলায় বলেছিলেন, আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। বিকেল বেলা আর্মি গেঞ্জী পরা ১২/১৪ বছরের চারটে ছেলে নিয়ে এসে মনিরুজ্জামান সাহেবের লাশ টানিয়ে নিয়ে গেলো গর্তের ওখানে। তখন বোধ হয় আর লাশ মাঠে ছিলোনা। ছেলে চারটিকে গর্তের পাশে লাইন করে ওরা গুলি করেছিলো।“

ইশতিয়াক মাহমুদ টিপু

<৮,৭,৩৫৩-৫৫>
[গণহত্যার কিছু দলিল]
-দৈনিক বাংলা, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭২।

“নরঘাতকদের কিছু সংলাপঃ ওদের খতম কর।“

(লেখক ডঃ মোজাম্মেল হোসেন একজন বিজ্ঞানী। ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় বর্বর পাকিস্তানী সেনারা যে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল তখন পাক সেনাদের বিভিন্ন ইউনিটের মধ্যে কথোপকথন তিনি রেডিওতে শুনেন ও তার অংশবিশেষ টেপ রেকর্ডারে ধরে রাখেন। ঐ টেপের বিশেষ অংশ কপি করে বন্ধুর সাহায্যে কলকাতায় প্রেরণ করেন। মে, ১৯৭১ সালের মাঝামাঝি ‘আকাশবাণী’ কোলকাতা থেকে ‘সংবাদ বিচিত্রায়’ তা শোনানো হয়।

এছাড়াও কথোপকথনের সময় পাক সেনারা যে সব সাংকেতিক শব্দ করেছিল সেগুলিও যথাসাধ্য অনুবাদ করে অপর এক ব্যাক্তির মাধ্যমে প্রেরণ করেন। মে মাসে আকাশবাণী কোলকাতা থেকে ‘সংবাদ পরিক্রমায়’ তা শোনানো হয়। ২৩ ডিসেম্বর ‘বাংলাদেশ অভজার্ভারে’-এ এই বার্তা ছাপা হয়েছিল।)

“২৫শে মার্চ ১৯৭১ সালের কালরাত। সোয়া একটার দিকে গোলাগুলির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল। জেগে উঠার প্রথম মুহুর্ত থেকেই মন বলেছিল এ আর কিছু নয় পাকিস্তানী সেনারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। পুরো মার্চ ধরে অপেক্ষা করেছি, কি হয় হয়। আমরা কি স্বায়ত্ত্বশাসন পাবো, না দেশে নামবে রক্তপাত? বিদেশীরা যখন ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছিল তখন মন বলছিলো, ওরাতো ওদের দেশে ফিরছে বিপদের সংকেত পেয়ে।

কিন্তু বিপদ এলে আমরা এদেশেই থাকবো, আমাদের নিজের দেশ। কি হবে সেই বিপদ, কি হবে তার রুপ-তা কল্পনা করতে পারিনি। কি সেই ভয়ংকর রাতে ঘুম ভাংতেই বুঝলাম, বিপদ এসে গেছে। শুরু হলো আমাদের ভাগ্যে অমাবশ্যা। মনে প্রশ্ন জেগেছিল কবে সেই অন্ধকার কাটিয়ে আসবে আলো, আসবে স্বাধীনতা? হঠাৎ ভেঙ্গে যাওয়া ঘুমের ভাব কেটে গেল। উপলব্ধি করার চেষ্টা করলাম কি হচ্ছে? মনে তখন সবার আগে একটা প্রশ্ন, বঙ্গবন্ধু নিরাপদে আছেন তো? কিন্তু কিভাবে সে খবর? হঠাৎ মনে এলো, পাক সেনাদের বিভিন্ন ইউনিটগুলো নিশ্চয় একে অপরের সাথে রেডিও মারফত যোগাযোগ রাখবে।.

রেডিও তুলে নিয়ে ডায়াল ঘুরাতে আরম্ভ করলাম। ৯০ মিটারে পেয়ে গেলাম যা খুঁজেছিলাম। হানাদার বাহিনীর দল গুলোর একে অপরের সাথে কথাবার্তা। জোরে শোনার উপায় নেই, তাই এয়ারফোন লাগিয়ে নিলাম কানে। ভেসে আসতে লাগলো বর্বর পশুদের গলা। ইতিমধ্যে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছে। পাক সেনাদের আগমনের গোড়াতেই কেউ সাইরেন বাজিয়ে বিপদ সংকেত জানাবার চেষ্টা করেছিল। আমাদের বাসা থেকে মাইলখানেক দূরে রাজারবাগ।

সেকি প্রচন্ড গুলি, তালা লেগে যায়। মাঝে মাঝে পাক সেনারা আকাশে ফানুশ ছোড়ে। দিনের মত আলো হয়ে যায় চারদিকে। তারপর আবার বৃষ্টির মত গুলি। মাঝে মাঝে ভেসে আসে ভারী গোলার শব্দ। একটু পরে গুলির তীব্রতা কমে এল। বুঝলাম আমাদের বীর পুলিশ জন্মভূমির জন্য চরম আত্মোৎসর্গ করে শহীদ হয়েছেন। আরো একটু পরে দেখা গেল আগুনের লেলিহান শিখা- রাজারবাগ পুলিশ লাইন পুড়ছে। সে রাত্রের কথা জীবনে ভুলবো না। কখনো ছুটে যাই জানালায় আগুন দেখার জন্য। আবার ছুটে আসি রেডিও শুনার জন্য।

ইতিমধ্যে রেডিওতে শুনেছি পাক কমাণ্ডারের গলা। জানাচ্ছে, “দ্যা বিগ ফিস হ্যাজ বিন কট।“ কার কথা বলেছে তা বুঝতে এক মুহূর্তও দেরী হয় নি। কিন্তু মন কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায় নি যে বঙ্গবন্ধু বন্দী হয়েছেন। রেডিও শুনে চলেছি আর ঢেকে রাখা অস্তমিত আলোতে প্রধান তথ্যগুলো টুকে রাখছি। হঠাৎ কানে এলো কন্ট্রোলের গলা “দেয়ার ইজ নো কোয়েশ্চেন অব টেকিং প্রিজনার। দে আর শুটিং এট ইউ। সো ওয়াইপ দেম অফ। কাউকে বন্দী করার প্রশ্ন উঠেনা, ওরা তোমাদের গুলি করেছে। সুতরাং ওদের খতম কর। কথাগুলোয় মনে প্রচন্ড আঘাত লাগলো। তাহলে এই করছে পাক বর্বররা?

এর প্রমাণ রাখতেই হবে। সঙ্গে সঙ্গে উঠে গিয়ে টেপরেকর্ডার এনে সোজাসুজি তার দিয়ে রেডিওর সাথে লাগিয়ে দিলাম। এয়ারফোনের মাধ্যমে শুনতে লাগলাম। বাবা, মা, বাড়ীর সবাই তখন চারপাশে জড়ো হয়েছেন। মাঝে মাঝে জানালায় গিয়ে বাইরের দিকে খোঁজ নেয়া হয়-কেউ ও দিকে আসছে কি না। এরপর দুইদিন ধরে প্রায় সারাটা সময়ই বাড়ীর কেউ না কেউ এয়ারফোন কানে ধরে বসে রয়েছে কি শোনা যায়। সব কিছু টেপ করা সম্ভব হয় নি। টেপ আছে ২৫শে মার্চ রাত আর ২৬শে মার্চ সকালের পাক সেনাদের নিজেদের মধ্যে কথাবার্তার অংশ।

অন্য তথ্য টেপে নেই, তবু যা আছে তা আজ এতদিন পরে শুনলেও মনে যে অনুভূতি জাগে, তা বর্ণনা করার ক্ষমতা আমার নেই। বর্বরদের সে কি উল্লাস! বাংলাদেশের পতাকা ও কালো পতাকা নামাতে হবে। রাস্তায় ব্যারিকেড সরাতে হবে। এ কথা লাউড স্পীকারের মাধ্যমে প্রচার হুকুম দিল পাক কমাণ্ডার নেটিভ টাং এজ ওয়েল এজ ইংলিশ এণ্ড উর্দুতে। নেটিভ হচ্ছি আমরা অর্থাৎ বাঙ্গালীরা।

আদেশ না মানলে কি করতে হবে তারও বিশদ হুকুম শুনলাম। আশেপাশের লোক ধরে এনে তাদের মধ্যের কয়েকজনকে পুরস্কৃত করতে হবে (কমাণ্ডারের ভাষায়)। সে পুরস্কার হবে মৃত্যুদন্ড। অন্যদের ফিরে যেতে দেয়া হবে যাতে ব্যাপারটা সবাই ভালো করে বুঝতে পারে। তাই সেই রাতে ঐ মূহুর্তেই নামিয়ে ছিলাম স্বাধীন বাংলার পতাকা ও কালো পতাকা। নামাতে বলেছিলাম প্রতিবেশীদের। সে পতাকা ফেলে দেয় নি, নষ্ট করিনি। লুকিয়ে রেখেছিলাম ঘরে।

পাক কমান্ডার আরো হুকুম দিল কিভাবে বাড়ী গুলি তল্লাশি করতে হবে। বাড়ীর সবাইকে বাইরে এনে দাঁড় করিয়ে ভেতরে খুঁজে দেখতে হবে ভালো করে। স্থানীয় সহযোগীদের দ্বারা সনাক্ত করতে হবে সেই সব ব্যক্তিদের যাদের আটক করার প্রয়োজন ইত্যাদি।

ধীরস্থির গলায় হুকুম দিচ্ছিল কমান্ডার-এতটুকু উত্তেজনা ছিলনা কণ্ঠস্বরে। পরে জেনেছিলাম ঐ গলা বিগ্রেডিয়ার আরবীর খানের। ঐ গলায় বিভিন্ন টার্গেট দখলের খবর দিচ্ছিলেন, সবাইকে জানাচ্ছিলেন যে দৈনিক পিপল পত্রিকার অফিস উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কি সাংঘাতিক ক্রোধ ছিল পিপল- এর উপর, ট্যাংক বিধ্বংসী কামান ব্যবহার করেছে পিপল অফিসের উপর পাক সেনারা। এটি ছিল ২৬ নম্বর ইউনিট। পরে জেনেছি এর ইমাম ছিল কর্ণেল তাজ। যার হেডকোর্টার প্রেসিডেন্ট হাউস।

এই ২৬ নম্বর ইউনিট হত্যা করেছে লেঃ কমান্ডার মোয়াজ্জেম কে। বলেছে,তাকে ধরতে যাওয়া হয়েছিল, বাধা দেওয়ায় নিহত হয়েছে। ঠাণ্ডা মাথায় তাকে হত্যা করে জীপের পেছনে দড়িতে বেঁধে রাস্তায় টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তার মৃতদেহ। এই ২৬ নম্বর ইউনিট আক্রমণ করেছে রাজারকার পুলিস লাইন। সবচেয়ে উল্লাস ছিল এই ২৬ নং ইউনিটেরই। তার বীরত্বের পুরষ্কার হিসেবে কর্ণেল তাজকে করা হয়েছিল- ডি, এস, এ, এম, এল-ডেপুটি সাব এডমিনিষ্ট্রেটর মার্শাল ল। মাঝে মাঝেই শোনা যাচ্ছিল। কন্ট্রোল বলছে ‘দ্যাট ইজ রিয়েলি গুড। দ্যাট ইজ একসেলেন্ট। বা হি ইজ ইউজিং এভরিথিং হি হ্যাজ গট’।

সেই এভ্রিথিং এ ছিল ট্যাংক, রিকয়েললেস রাইফেল, রকেট ল্যান্সার ইত্যাদি। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ঘিরে ছিল পশ্চিম দিক থেকে রেল লাইন জুড়ে ৪১ নং ইউনিট। দক্ষিণ দিক থেকে ৮৮ নং ইউনিট ও উত্তর দিক থেকে ২৬ নং ইউনিট। বাধা এসেছিল জগন্নাথ হল, ইকবাল হল ও লিয়াকত হল থেকে। সবচেয়ে বেশি বাধা এসেছিল জগন্নাথ হল থেকে। ২৬শে মার্চ সকালের দিকে কন্ট্রোল ও ৮৮ নং ইউনিটের মধ্যে যে কথপোকথন হল তা মোটামুটি এই রুপঃ

কন্ট্রোলঃ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আনুমানিক কতজন হতাহত হয়েছে?আমাকে মোটামুটি সংখ্যাটা বললেই হবে। উত্তর এলো তিনশয়ের মত।

কন্ট্রোলঃ চমৎকার। তিনশই মারা গেছে না কেউ আহত বা বন্দী হয়েছে?

উত্তরঃ আমি একটাই পছন্দ করি। তিনশ মারা গেছে।

কন্ট্রোলঃ ৮৮। আমিও তোমার একমত। ঐ কাজটিই সহজ। কিছু জানতে চাইবে না। আবার বলছি চমৎকার।

ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই উপরের কথা গুলোর। ওরা যে কোন ‘বন্দী’ নেয় নি, সবাইকে হত্যা করেছে, সে কথা এর চেয়ে স্পষ্টভাবে জানাতে পারতো না। শুনতে পেয়েছিলাম শহিদ মিনারের কথাঃ ঐ রাতেই ডিনামাই দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। মিনারের নিচের ঘরে ওদের কথায় ৪ জন ছাত্র লুকিয়েছিল, ৩ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এক জন পালিয়ে গেছে। ২৭শে মার্চ সকালে দেখতে গিয়েছিলাম শহীদ মিনার। মাঝখানের মিনারটির সামান্য ক্ষতি হয়েছে।

শুনলাম যারা মিনারের নিচের ঘরে আশ্রয় নিয়েছিল তারা ছাত্র ছিল না। কিন্তু ছিল তো আমাদের দেশেরই মানুষ। দেখলাম ভাঙ্গা কাঁচ, দেয়ালে রক্ত। শনিবার রাতে প্রচন্ড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে অবশেষে শহীদ মিনার ধ্বংশ করেছিল পাক বর্বরেরা। ২৫শে মার্চের সেই কালরাত্রি যখন শেষ হয়ে আসছিল, হুকুম এলো কন্ট্রোলের যেখানে যত মৃতদেহ আছে সব সরিয়ে ফেলতে। সরিয়ে ফেলতে হবে দিন শুরু হওয়ার আগে। লোকচক্ষুর অন্তরালে। মৃতদেহ সরাতে ব্যবহার করা হয়েছিল বাঙ্গালিদের। যে হতভাগ্যদের ব্যবহার করা হয়েছিল এই কাজে, কাজ শেষে তাদেরও হত্যা করেছিল নরপশুরা। মৃতদেহের হিসেব রেখেছিল ২৬ নম্বর ইউনিট।

কন্ট্রোল জিজ্ঞেস করেছিল ২৬ নং ইউনিটকে, রাজারবাগে পুলিশের মৃতদেহের সংখ্যা। উত্তর এসেছিল গোণা শেষ হয় নি। কিন্তু সংখ্যায় অনেক। ক্যাম্পাসের মৃতদেহ কিন্তু ঐ সময় সরানো হয় নি। ২৬শে মার্চ সারাদিন রেখে দেয়া হয়েছে। রেডিওতে শুনেছি, কমাণ্ডার গিয়ে দেখবেন ছাত্রনেতা কেউ আছেন কিনা। সেটা দেখার পরই সরানো হবে। তাই হয়েছিল।

২৭শে মার্চ সকালে দেখছিলাম, ইকবাল হলের পেছনের পুকুর পাড়ে সারি দিয়ে রাখা দশটি মৃতদেহ। যাতে বাঙ্গালীরা ভয় পায়, নতি স্বীকার করে। দেখেছিলা জগন্নাথ হলের সামনের মাঠে বুলডোজার দিয়ে তৈরী গর্ত করে দেয়া গণকবর। মাসখানেক পরে যখন দু’একজন বিদেশী সাংবাদিককে য়াসার অনুমতি দিয়েছিল পাক সরকার, তখন একদিন রাতে সেই গলিত দেহের অবশিষ্টও তুলে নিয়ে যায় পাক সেনারা।

জিঞ্জিরায় যে হত্যাকাণ্ড চালায় পাক সেনারা কদিন পরে তার পূর্বাভাসও পেয়েছিলাম ঐ রাতে। কন্ট্রোল বলেছিল ৮৮ নং ইউনিটকে যে ওখানে অস্ত্র জমা করা হয়েছে, তাই ঐ জায়গায় সেনাদের যেতে হবে আস্তে আস্তে। রাত ফুরিয়ে এলো দিনের আলো জেগে উঠলো। সারারাত ধরে যা দেখেছি, যা শুনেছি কোন কিছুই যেন বিশ্বাস করতে মন চাইছিল না।

মন চাইছিল না যে স্বীকার করতে যে এত বড় বিপদ নেমে এসেছ। মনে হয়েছিল, কবে এই অমাবশ্যা কাটবে, কবে আবার সন্মানের সাথে মানুষের মত বাঁচার সুযোগ পাবো? সে দিন একদিন আসবেই, কিন্তু ২৫শে মার্চের সেই রাতে একথাও মনে জেগেছিল, যখন সেদিন আসবে আমিও যেন থাকি তখন।“

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!